৬ অক্টোবর, ১৯৫১। পীত সাগরের তীরবর্তী উত্তর কোরীয় উপকূল। মার্কিন বিমানবাহিনীর তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট বিল এন. গ্যারেট তার বিধ্বস্ত ‘এফ৮৬ স্যাবর’ যুদ্ধবিমান থেকে কোনোক্রমে বের হয়ে এসেছেন। বিধ্বস্ত বিমানটিকে ক্র্যাশল্যান্ড করানোর সময় তিনি চেষ্টা করেছিলেন যাতে বিমানটি উপকূল থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে পড়ে। কিন্তু এটি এসে পড়েছে উপকূল বরাবর, সেখানে কাদায় আটকে গেছে। এখান থেকে বিমানটিকে উদ্ধার করে নিজেদের অঞ্চলে নেওয়া সম্ভব নয়। গ্যারেট প্রার্থনা করছিলেন, যাতে উদ্ধারকারী বিমান দ্রুত এসে তাকে উদ্ধার করে। তিনি ভালো করেই জানতেন, বিধ্বস্ত বিমানটি যাতে সোভিয়েতদের হাতে না পড়ে, সেজন্য শীঘ্রই মার্কিন বোমারু বিমান এসে এই অঞ্চলে বোমা ফেলবে, এবং প্রয়োজনে বিধ্বস্ত বিমানটির সঙ্গে গ্যারেটকেও নিশ্চিহ্ন করে দিতে তারা দ্বিধা করবে না!
গ্যারেটের সৌভাগ্য, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর একটি ‘এসএ১৬ আলবাট্রস’ সীপ্লেন বিমান আকাশে দেখা দিল। ভূপাতিত মার্কিন বৈমানিকদের উদ্ধার করার জন্য এই বিমানগুলো ব্যবহৃত হতো। বিমানটি অবতরণ করার সাথে সাথে গ্যারেট সেটিতে চড়ে বসলেন, কিন্তু একই সময়ে নিকটবর্তী কোনো অবস্থান থেকে উত্তর কোরীয় সৈন্যরা উপকূল লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ শুরু করল। এমতাবস্থায় গ্যারেট বা অন্য কারো বিধ্বস্ত বিমানটি নিয়ে চিন্তা করার কোনো সময় ছিল না। দ্রুত উদ্ধারকারী বিমানটি আকাশে উড্ডয়ন করে উত্তর কোরীয়দের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আর বিধ্বস্ত বিমানটি অধিকারের জন্য মার্কিন আর সোভিয়েতদের মধ্যে শুরু হলো এক তীব্র প্রতিযোগিতা।
এসময় চলছিল কোরীয় যুদ্ধ। পূর্ব এশিয়ার এক প্রান্তে কোরীয় উপদ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট চীনা ও উত্তর কোরীয় সৈন্যরা। এটি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের প্রথম রণক্ষেত্র, যেখানে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্তালিন ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদে’র সঙ্গে সরাসরি শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রথম (এবং কার্যত শেষ) বারের মতো মার্কিন ও সোভিয়েত বৈমানিকরা বৃহৎ মাত্রায় পরস্পরের বিরুদ্ধে এক তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল, কোরিয়ার আকাশে।
১৯১০ সালে জাপান কোরীয় উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং এটিকে একটি উপনিবেশে পরিণত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৪৫ সালের আগস্টে ইতোপূর্বে পৌঁছানো সমঝোতা অনুযায়ী সোভিয়েত ও মার্কিন সৈন্যরা জাপানিদের কাছ থেকে কোরীয় উপদ্বীপ দখল করে নেয়। ৩৮ অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়া দুইভাগে বিভক্ত হয় ৩৮ অক্ষরেখার উত্তরে সোভিয়েতনিয়ন্ত্রিত অংশ এবং ৩৮ অক্ষরেখার দক্ষিণে মার্কিননিয়ন্ত্রিত অংশ। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ঠিক হয়েছিল, যুদ্ধের পর জাতিসংঘের অধীনে কোরিয়াকে একটি একক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই পরাশক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এই প্রস্তাবনা ব্যর্থ হয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ার দক্ষিণাংশে ‘কোরিয়া প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কোরীয় রাজনীতিবিদ সিংমান রীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করে। প্রত্যুত্তরে ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন কোরিয়ার উত্তরাংশে ‘কোরিয়া জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কোরীয় মেজর কিম ইল সুংকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত করে।
উভয় সরকারই সমগ্র কোরীয় উপদ্বীপের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব দাবি করে, এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে এসময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বৃহৎ পরিবর্তন আসে। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় (যার মধ্য দিয়ে মার্কিন পারমাণবিক একাধিপত্যের অবসান ঘটে), এবং চীনা গৃহযুদ্ধে সোভিয়েতসমর্থিত কমিউনিস্টদের বিজয়ের পর মাও জেদংয়ের নেতৃত্বে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এমতাবস্থায় উত্তর কোরীয় নেতা কিম ইল সুং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোরিয়াকে তার শাসনাধীনে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মৌন সমর্থনে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়, এবং কোরীয় যুদ্ধের সূচনা ঘটে। সংখ্যাগত ও প্রযুক্তিগতভাবে পশ্চাৎপদ দক্ষিণ কোরীয় সৈন্যরা শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়, এবং উত্তর কোরীয় সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার সিংহভাগ দখল করে নেয়।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিজমের বিস্তার রোধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, এবং দক্ষিণ কোরিয়া ‘উত্তর কোরীয়/কমিউনিস্ট আগ্রাসন’ থেকে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘের শরণাপন্ন হয়। এসময় চীনের পরিবর্তে তাইওয়ানকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আসনে অধিষ্ঠিত রাখা হয়েছিল, এবং এর প্রতিবাদে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন বর্জন করছিল। অর্থাৎ এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন কেউই নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থিত ছিল না। সেই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে জাতিসংঘ দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘রক্ষা’র জন্য প্রেরিত বাহিনীতে সৈন্য প্রেরণ করে, যদিও এই ‘জাতিসংঘ বাহিনী’র ৯০% সৈন্যই ছিল মার্কিন। মার্কিননেতৃত্বাধীন বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উত্তর কোরীয়দের পিছু হটতে বাধ্য করে, এবং এরপর জাতিসংঘের ম্যান্ডেট অতিক্রম করে উত্তর কোরিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়। ১৯৫০ সালের অক্টোবরের মধ্যে মার্কিননেতৃত্বাধীন বাহিনী উত্তর কোরিয়ার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ অধিকার করে নেয়।
উত্তর কোরিয়ার পতনের সম্ভাবনাকে চীন নিজের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং ১৯৫০ সালের অক্টোবরে চীনা সৈন্যরা উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করে মার্কিননেতৃত্বাধীন বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মার্কিননেতৃত্বাধীন বাহিনীকে তারা উত্তর কোরিয়া থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে। কিন্তু চীনাদের বিমানবাহিনী ছিল অত্যন্ত দুর্বল, ফলে মার্কিনিরা কোরিয়ার আকাশে পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে এবং বিমান হামলা চালিয়ে চীনা ও উত্তর কোরীয়দের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি করে। এমতাবস্থায় চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিল না, কারণ মার্কিনসোভিয়েত যুদ্ধ শীঘ্রই পারমাণবিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারত। কিন্তু চীনা ও উত্তর কোরীয়দের দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো কোরিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করতে সম্মত হয়।
১৯৫০ সালের নভেম্বরে সোভিয়েত বিমানবাহিনীর ‘৬৪তম ফাইটার এভিয়েশন কোর’কে উত্তর কোরিয়ায় প্রেরণ করা হয়। এছাড়া, উত্তর কোরীয় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য সোভিয়েত ক্রুদের মোতায়েন করা হয়। ক্রমে উত্তর কোরিয়ায় সোভিয়েত সৈন্যসংখ্যা ২৬,০০০এ উন্নীত হয়। কোরীয় যুদ্ধ চলাকালে প্রায় ৭২,০০০ সোভিয়েত সৈন্য বিভিন্ন মেয়াদে উত্তর কোরিয়ায় চলমান যুদ্ধে অংশ নেয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ এড়ানোর লক্ষ্যে মস্কো কোরীয় যুদ্ধে সোভিয়েত অংশগ্রহণের তথ্য সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখে। সোভিয়েত যুদ্ধবিমানগুলোতে চীনা বা উত্তর কোরীয় বিমানবাহিনীর প্রতীক সংযুক্ত করা হয়, সোভিয়েত বৈমানিকদের চীনা বা উত্তর কোরীয় উর্দি পরিধান করানো হয় এবং বিমান চালানোর সময় রেডিওতে রুশ ভাষা ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয় (এর পরিবর্তে ম্যান্ডারিন বা কোরীয় ভাষা ব্যবহারের জন্য সোভিয়েত বৈমানিকদের নির্দেশ দেয়া হয়)।
সোভিয়েতনির্মিত ‘মিকোয়ানগুরেভিচ মিগ১৫’ জেট বিমান কোরিয়ার আকাশে মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়। চীনাউত্তর কোরীয় সীমান্তে অবস্থিত ইয়ালু নদীর উপত্যকা পরিণত হয় সোভিয়েত বৈমানিকদের মূল চারণক্ষেত্রে। এই অঞ্চলটি ‘মিগ গলি’ (MiG Alley) নামে পরিচিতি লাভ করে, এবং এই মিগ গলিতে প্রবেশ করে বহু মার্কিন যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়। প্রথম দিকে মার্কিনিরা জানত না যে, এই বিমানগুলো সোভিয়েত বৈমানিকরা চালাচ্ছে। পরবর্তীতে তারা ব্যাপারটা আঁচ করতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের করার কিছুই ছিল না, কারণ কোনো সোভিয়েত বৈমানিককে জীবন্ত অবস্থায় বন্দি করতে না পারলে এই যুদ্ধে সোভিয়েতদের সরাসরি জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ দেখানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
মিগ১৫ জেট বিমানের মোকাবেলা করার জন্য মার্কিননেতৃত্বাধীন বাহিনী কোরিয়ায় তাদের নিজস্ব জেট বিমান ব্যবহার করতে শুরু করে, যেটির নাম ছিল ‘নর্থ আমেরিকান এফ৮৬ স্যাবর’। স্যাবর এবং মিগ১৫ ছিল পরস্পরের প্রায় সমকক্ষ, এবং কোরিয়ার আকাশে তারা একে অপরের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। স্যাবরের গতি ছিল ঘণ্টায় ৬৮৫ মাইল। এটি ছিল মিগ১৫ এর চেয়ে অ্যারোডাইনামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি স্থিতিশীল, এটি মিগের চেয়ে দ্রুতগতিতে ঘুরতে বা ডাইভ দিতে পারত, এটিতে এএন/এপিজি৩০ রাডার গানসাইট সংযুক্ত ছিল, এবং মিগের তুলনায় এটির কামান ছিল লক্ষ্যভেদের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকরী। অন্যদিকে, মিগ১৫ এর গতি ছিল ঘণ্টায় ৬৭০ মাইল। উড্ডয়ন ও গতিবৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে এটি স্যাবরের চেয়ে বেশি ভালো ছিল, এটি স্যাবরের চেয়ে বেশি উচ্চতায় উঠে যুদ্ধ করতে পারত, এটিকে ঘুরানো ছিল তুলনামূলকভাবে সহজ, এবং এটির কামান ছিল স্যাবরের কামানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
উভয় পক্ষই প্রতিপক্ষের অন্তত একটি হলেও বিমান হস্তগত করতে চাচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল, একটি মিগ১৫ জঙ্গিবিমানকে কাছে থেকে পরীক্ষানিরীক্ষা করা এবং এটির শক্তি ও দুর্বলতা যাচাই করা, যাতে এর বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে যুদ্ধ করা যায়। এই উদ্দেশ্য তারা একটি মিগ১৫ বিমান হস্তগত করতে আগ্রহী ছিল। একই উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি এফ৮৬ স্যাবর বিমান হস্তগত করতে ইচ্ছুক ছিল। ফলে উভয় পক্ষই প্রতিপক্ষের ভূপাতিত বিমানগুলো হস্তগত করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে।
মার্কিনিরা এক বা একাধিক মিগ১৫ বিমান হস্তগত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালে ‘অপারেশন মুলাহ’ (Operation Moolah) নামক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ভূপাতিত মিগ১৫ বিমান হস্তগত করা তাদের জন্য সহজ ছিল না। সোভিয়েত বিমানগুলো কখনো ৩৮ অক্ষরেখা অতিক্রম করত না, ফলে কোনো সোভিয়েত বিমান বিধ্বস্ত হলেও সেটি উত্তর কোরীয় ভূমিতে পড়ত, যেখান থেকে বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা ছিল মার্কিনিদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। এজন্য তারা বিকল্প পন্থা অবলম্বন করে। তারা উত্তর কোরিয়া ও চীনে (এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে) প্রচুর সংখ্যক প্রচারপত্র বিলি করে। কোরীয়, ম্যান্ডারিন ও রুশ ভাষায় লেখা এই প্রচারপত্রগুলোতে বলা হয়েছিল যে, কোনো বৈমানিক যদি তার মিগ১৫ বিমান নিয়ে মার্কিনিদের পক্ষে যোগদান করে, তাহলে তাকে ১ লক্ষ মার্কিন ডলার পুরস্কার দেয়া হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। সহজ ভাষায়, মার্কিনিরা নিজেদের দক্ষতার মাধ্যমে উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়ে প্রতিপক্ষের বৈমানিকদের নিজ দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য উৎসাহিত করতে থাকে।
সোভিয়েতরাও অনুরূপভাবে এক বা একাধিক ভূপাতিত এফ৮৬ স্যাবর বিমান হস্তগত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু তাদের জন্যও কাজটা সহজ ছিল না, কারণ কোনো স্যাবর ভূপাতিত হলে সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন বোমারু বিমান আক্রমণ চালিয়ে ভূপাতিত বিমানটিকে ভস্মে পরিণত করে ফেলত। অবশ্য সোভিয়েতরা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে, এবং ১৯৫১ সালের ৬ অক্টোবর তাদের সেই প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখে।
এদিন ১৬টি মার্কিন এফ৮৬ স্যাবর মিগ গলিতে ১০টি সোভিয়েত মিগ১৫ বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সোভিয়েত বিমানগুলোর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল ইয়েভগেনি পেপেলিয়ায়েভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পেপেলিয়ায়েভ ছিলেন কোরীয় যুদ্ধের সবচেয়ে সফল বৈমানিকদের একজন। এই যুদ্ধে তিনি মার্কিননেতৃত্বাধীন বাহিনীর ১৯টি (মতান্তরে ২৩টি) যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন। পেপেলিয়ায়েভের বিমানযুদ্ধের একটি স্ট্যান্ডার্ড টেকনিক ছিল। প্রতিপক্ষের যুদ্ধবিমানের মুখোমুখি হলে তিনি তার বিমানকে প্রথমে একদিকে এবং তারপর অন্যদিকে ঘুরাতেন। এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের বৈমানিককে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে তিনি তার বিমানটিকে ঘুরিয়ে প্রতিপক্ষের বিমানের পেছনে নিয়ে আসতেন। এরপর পেছন থেকে আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষের বিমানটিকে ভূপাতিত করতেন।
সেদিন মার্কিন বৈমানিক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট বিল এন. গ্যারেট পেপেলিয়ায়েভের কৌশলে ধরাশায়ী হন। পেপেলিয়ায়েভের মিগ থেকে নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে গ্যারেটের স্যাবরের ইঞ্জিন ও ইজেকশন সিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাধ্য হয়ে গ্যারেট রণে ভঙ্গ দেন এবং বিমানটিকে নিকটবর্তী পীত সাগরের কাছে ক্র্যাশল্যান্ড করান। গ্যারেট জানতেন যে, সোভিয়েতরা তার বিমান হস্তগত করার চেষ্টা করবে। এজন্য তিনি উপকূল থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রের মধ্যে তার বিমান ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিমানটির ওপর তার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সেটি উপকূলের কাছেই কাদায় আটকে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি মার্কিন উদ্ধারকারী বিমান এসে গ্যারেটকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়, কিন্তু বিমানটি সেখানেই থেকে যায়।
সমুদ্রের ঢেউয়ের কারণে বিমানটি কিছুক্ষণের জন্য পানির নিচে ঢাকা পড়ে যায়। ফলে মার্কিন বোমারু বিমান উপকূলে এলেও বিমানটিকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। এসময় আকাশে সোভিয়েত মিগবহর টহল দিচ্ছিল, এবং মার্কিনিরা প্রচণ্ড যুদ্ধের পরও তাদেরকে সরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। উল্টো তারা আরেকটি স্যাবর হারায়, যেটি উত্তর কোরীয় ভূমির বাইরে পতিত হয়, এবং এরপর মার্কিনিরা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এদিকে সোভিয়েতরা আগের ভূপাতিত বিমানটিকে হস্তগত করার জন্য দ্রুত সোভিয়েত টেকনিশিয়ান এবং চীনা ও উত্তর কোরীয় শ্রমিকদের একটি দলকে ঐ অঞ্চলে প্রেরণ করে। উত্তর কোরিয়ায় নিযুক্ত সোভিয়েত বিমান কোরের কমান্ডার ইভান কোঝেদুব তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা যেন স্যাবরটির সর্বশেষ স্ক্রু পর্যন্ত খুলে নিয়ে আসে। একটি ট্রাকবহরে করে টেকনিশিয়ান ও শ্রমিকরা সেখানে পৌঁছায় এবং ক্ষিপ্রগতিতে ভূপাতিত স্যাবর বিমানটির ব্যবচ্ছেদ শুরু করে।
পীতসাগরে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো উপকূলে সোভিয়েতদের গতিবিধি দেখে ধারণা করে যে, সোভিয়েতরা ভূপাতিত স্যাবরটি খুঁজে পেয়েছে। মার্কিন হাই কমান্ড এই তথ্য জানার পর উপকূলে অবস্থিত সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যুদ্ধজাহাজগুলোকে নির্দেশ দেয়। মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো উপকূলের ওপর ব্যাপক হারে গোলাবর্ষণ শুরু করে, কিন্তু তাতে সোভিয়েতদের কার্যক্রম থেমে থাকেনি। গোলাগুলির পরোয়া না করে তারা স্যাবরটির ব্যবচ্ছেদ করে এবং বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে ট্রাকে তুলে দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ে। মার্কিনিরা এটা লক্ষ্য করে ট্রাকগুলোর ওপর বোমাবর্ষণের জন্য একটি বোমারু বিমানবহর প্রেরণ করে, কিন্তু মার্কিন বিমানগুলো সময়মত পৌঁছানোর আগেই একটি ছাড়া বাকি সবগুলো ট্রাক একটি টানেলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সর্বশেষ ট্রাকটিকে লক্ষ্য করে মার্কিন বিমানগুলো বোমা নিক্ষেপ করে, কিন্তু ট্রাকটি নিরাপদে টানেলের ভিতরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়।
এটি ছিল সোভিয়েতদের জন্য বড় একটি সাফল্য। কার্যত মার্কিনিদের নাকের ডগা থেকে তারা প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে একটি এফ৮৬ স্যাবর যুদ্ধবিমান হস্তগত করতে সক্ষম হয়। বিমানটিকে আংশিক পরীক্ষানিরীক্ষার পর তারা মস্কোয় প্রেরণ করে। স্বভাবতই অভিযানটিতে অংশগ্রহণকারী সোভিয়েতরা তাদের কৃতিত্বের জন্য পুরস্কার ও প্রশংসা লাভের আশা করছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা হতাশ হয়। একজন সোভিয়েত বৈমানিকের ভাষ্যমতে, “আমরা মার্কিনিদের নাকের ডগা থেকে একটা বিমান চুরি করলাম, আর মস্কো থেকে আমাদের বলা হলো, ‘তোমরা বিমানটা পরিষ্কার করোনি কেন? এটা এত নোংরা!'”
এভাবে সোভিয়েতরা প্রথমবারের মতো মার্কিননির্মিত এফ৮৬ স্যাবর বিমান হাতে পায়। কিন্তু এটিই তাদের শেষ ‘প্রাইজ’ ছিল না। ২৪ অক্টোবর আরেকটি এফ৮৬ স্যাবর তাদের হস্তগত হয়। মার্কিন কর্মকর্তাদের প্রদত্ত তথ্যমতে, ৬ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত যতগুলো মার্কিন এফ৮৬ স্যাবর ভূপাতিত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে প্রায় ৭৫% সোভিয়েতদের হস্তগত হয়। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অমীমাংসিতভাবে কোরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। মার্কিনিরা মিগ১৫ বিমান হস্তগত করার জন্য যে ‘অপারেশন মুলাহ’ আয়োজন করেছিল, সেটি কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে সফল হয়নি। মার্কিনিদের বিপুল প্রচারণা সত্ত্বেও কোরীয় যুদ্ধ চলাকালে কোনো সোভিয়েত, চীনা বা উত্তর কোরীয় বৈমানিক তার মিগ১৫ বিমান নিয়ে মার্কিনিদের পক্ষে যোগদান করেনি। অবশ্য যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় দুই মাস পর উত্তর কোরীয় বৈমানিক লেফটেন্যান্ট নো কুম সোক একটি মিগ১৫ বিমানসহ দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে যান, এবং অবশেষে যুদ্ধের পর মার্কিনিরা একটি মিগ১৫ হস্তগত করতে সক্ষম হয়।