কোরআন সংকলনের পর দীর্ঘদিন ধরে কোনো ভাষায় এর কোনো অনুবাদ ছিল না। মূল আরবিতেই এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে হতো। কিন্তু অনেকেই আরবি ভাষা জানে না। নামাজের মতো ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি আদায়ে কোরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করতে হয়। সেজন্য প্রায় প্রত্যেক মুসলমানই কোরআনের শিক্ষা নিয়ে থাকে। আরেকটি দিক থেকে মুসলমানদের জন্য কোরআন পাঠের ফজিলত অত্যাধিক। কুরআন পাঠে মুসলিমদের জন্য রয়েছে সওয়াবের প্রতিশ্রুতি।[1],[2] সেজন্য আগে অনেকে শুধুমাত্র আরবি অক্ষরজ্ঞান নিয়ে কোরআন পাঠ করতো। কিন্তু তাদের বেশিরভাগের আরবি-জ্ঞান শুধুমাত্র অক্ষরের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতো, অর্থ বুঝে কোরআনের মর্মার্থ অনুধাবন করা সম্ভব হতো না তাদের পক্ষে। সেজন্য যারা আরবিভাষী নয়, তাদের জন্য কোরআনের অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
কিন্তু কোরআনের অনুবাদে একটু কথা থেকে যায়। যেকোনো লেখকের বইয়ের অনুবাদ যেকোনো ব্যক্তি যেকোনোভাবে করতে পারে। সেই অনুবাদ খারাপ হতে পারে, আবার ভালোও হতে পারে। এক্ষেত্রে খারাপ হলে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয় না। খারাপ হলে নাহয় কিছু বক্তব্যের এদিক সেদিক হলো, তা খুব বেশি ক্ষতিকর নয়। কিন্তু কোরআনের বেলায় এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারবে না। কারণ মুসলিমদের বিশ্বাস অনুসারে, কোরআন আল্লাহর গ্রন্থ। এখানে যা যা বলা আছে, তার সবই আল্লাহর বক্তব্য। কেউ যদি এটি অনুবাদ করে, তাহলেও বক্তব্যগুলো আল্লাহরই থেকে যায়। এখন কারো অনুবাদে যদি সামান্যতম ত্রুটিও থেকে যায় এবং কোনো পাঠক সেই ত্রুটিপূর্ণ কোরআন পাঠ করে, তাহলে সে আল্লাহর বক্তব্যের ভুল অর্থ পাঠ করবে। যে কথা আল্লাহ বলেননি তা পরোক্ষভাবে বলানো হচ্ছে, যে বক্তব্য আল্লাহ দিয়েছেন তা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এরকম কাজ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ।
কেউ অনুবাদ করে কোনোকিছু লিখলে তা মূলত আল্লাহর কথাকেই লেখা হয়।[3] তাই এখানে কোনো ভুল হয়ে গেলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাই কেউ এর অনুবাদে হাত দেয়নি দীর্ঘদিন। বিশেষ করে মুসলমানরা এটি অনুবাদ করার সাহসই দেখাতো না। তবে অমুসলিমদের মাঝে এই ভয়টা মুসলিমদের তুলনায় কম থাকে। তাই দেখা যায়, কোরআনের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ কিংবা বাংলা অনুবাদ অমুসলিমরাই করেছে।
বাংলাতে দীর্ঘ ছয় বছর খেটে কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন।[4] তিনি ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী। তবে আরবি ও ফার্সি ভাষার উপর তার বেশ দখল ছিল। ১৮৮১ সালে বাংলায় কোরআন অনুবাদের কাজ প্রথম শুরু করেন তিনি। কয়েক বছরের অবিরাম পরিশ্রমে অনুবাদ কাজ সম্পন্ন হয়। তখন বাংলার প্রকাশনা ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক। ঢাকায় তখনও প্রকাশনা শিল্প বিকাশ লাভ করেনি। অল্প অল্প করে তিনি অনুবাদ করতেন এবং খণ্ড খণ্ড আকারে তা প্রকাশ করতেন। তার লেখা আত্মজৈবনিক বই আত্ম-জীবন-এ তিনি জানাচ্ছেন-
“শেরপুরের চারুযন্ত্রে প্রথম খণ্ড মুদ্রিত হয়, পরবর্তীতে কলকাতা থেকে প্রতি মাসে খণ্ড খণ্ড মুদ্রিত হতে থাকে। প্রায় দুই বছরে সম্পূর্ণ কোরআন অনূদিত ও মুদ্রিত হয়। পরবর্তীতে সবগুলো খণ্ড একত্রে বাঁধাই করে সম্পূর্ণ এক খণ্ড কোরআন পাওয়া যায়। প্রথমবারে এক হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। এগুলো বিক্রি হয়ে গেলে কলকাতার দেবযন্ত্রে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এ সংস্করণও শেষের পথে। বর্তমানে (১৯০৬ সাল) এর সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণ বের করার কাজ চলছে।”[5]
(অনুধাবনের সুবিধার্থে গিরিশচন্দ্র সেনের বক্তব্যকে চলিত ভাষায় সহজবোধ্য আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। ফুটনোটে মূল বক্তব্য প্রদান করা হলো।)
অমুসলিম হয়েও তিনি যে কোরআন অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন তার পেছনে বেশ কিছু প্রভাবক কাজ করেছিল। প্রথমত তার পরিবার। তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সেখানে ফারসি ভাষা চর্চার জন্য এলাকায় সুনাম ছিল। ইসলাম চর্চার জন্য ফারসি ভাষা অনেক সমৃদ্ধ। ছোটবেলাতেই তিনি ফারসি ভাষা শিখতে শুরু করেন। কিশোর বয়সে ইংরেজি শিক্ষায় মন টেকেনি, তাই ফারসিতেই পড়াশোনা শুরু করেন। কৈশোর পেরিয়ে তরুণ বয়সে যখন পা দেন, তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ময়মনসিংহে, সেখানে একজন মওলানার অধীনে ফারসি ভাষার গভীর জ্ঞানার্জন শুরু করেন।[6]
হিন্দু হলেও সব ধর্মের প্রতিই আগ্রহ ছিল তার। সে সূত্রে চাকরির পাশাপাশি ইসলাম সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করতে থাকেন দীর্ঘদিন। তার বয়স যখন ৪২ তখন তিনি আরবি ভাষা শিক্ষা এবং ইসলাম সম্বন্ধে আরো গভীর জ্ঞান লাভের জন্য লাখনৌ যান। সেখান থেকে আরবি ভাষা শিখে আসেন কলকাতায়। সেখানেও একজন মৌলবির কাছে ইসলাম সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়, এখানে এসেও চালিয়ে যান ইসলাম সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন।
কোরআন সম্বন্ধে বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন অনুবাদ ও তাফসীর পড়ে কোরআনের উপর বেশ দখল অর্জন করলেন গিরিশচন্দ্র। একপর্যায়ে তিনি অনুভব করেন, কোরআনের মর্মবাণী সকলের জানা উচিৎ। সেজন্য বাংলা ভাষায় কোরআনের একটি অনুবাদ থাকা প্রয়োজন। এরপর সাহস করে শুরু করলেন বাংলায় কোরআনের অনুবাদ। তার অনূদিত কোরআনের ভূমিকাতে তিনি এ সম্বন্ধে লিখেছেন। অনুধাবনের সুবিধার্থে তার বক্তব্যকে প্রমিত ও সহজ বাংলায় উপস্থাপন করা হলো। ফুটনোটে মূল বক্তব্য উল্লেখ করা আছে।[7]
“পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সকল ভাষায় ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অনূদিত হয়েছে এবং প্রায় সকল জাতির মধ্যে তার প্রচার হয়েছে, ফলে এটি সাধারণ জনগণের জন্য খুব সুলভ হয়েছে। সেজন্যই দেবাত্মা ঈসার দেবচরিত্র ও তার স্বর্গীয় জীবনপ্রদ উপদেশগুলো পাঠ করতে পারে সকলে। ফলে নানা দেশের নানা জাতির অগণ্য লোক জীবন ও আলোর দিশা পেয়েছে। কিন্তু বিধানমণ্ডলীভুক্ত ভূমণ্ডলের একটি প্রধান ও পরাক্রান্ত জাতি হলো মুসলমান। তাদের মূল ধর্মগ্রন্থ আরবি ভাষায় লিখিত বলে এবং সে ভাষায় সকলের দখল না থাকাতে কোরআনের মর্মবাণী স্বয়ং মুসলমানদের মাঝেই দুর্ভেদ্য দুর্গের আড়ালে লুকিয়ে আছে। (মুসলমান ছাড়া) অন্য জাতির নিকট মুসলমানেরা কোরআন বিক্রয় পর্যন্ত করেন না। সেসকল লোক তা পড়বে দূরের কথা স্পর্শও করতে পারে না। পাশাপাশি অন্য জাতির মধ্যে আরবি ভাষা চর্চাও বিরল। কোনোভাবে কেউ কোরআন সংগ্রহ করতে পারলেও ভাষাজ্ঞানের অভাবে তার মর্মবাণীর কিছুই অনুধাবন করতে পারে না। ফলে এটি কতিপয় মুসলমান মৌলবীর একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে রয়েছে।
উর্দু ভাষায় মৌলবী শাহ রফিউদ্দীন এবং পারস্য ভাষায় শাহ আলী আল্লাহ ফতেহোর রহমান কোরআনের অনুবাদ করেছেন। তবে তা মূল কোরআনের সাথে একত্রে সংঘবদ্ধ আছে, স্বতন্ত্র পুস্তক আকারে সেসব পাওয়া যায় না। সেসব অনুবাদ দুষ্প্রাপ্য নয়, তবে স্বপ্রাপ্য হলেও উর্দু ও পারস্য ভাষায় অনভিজ্ঞ বাঙ্গালীর বেলায় তা অন্ধ ব্যক্তির সামনে দর্পনের মতো নিষ্ফল। ইংরেজি ভাষায় কোরআনের অনুবাদ প্রচার হয়েছে সত্য; কিন্তু এদেশে তা সচরাচর প্রাপ্য নয়। আর যারা ইংরেজি জানেন না, তাদের বেলায় সে অনুবাদ পাওয়া না পাওয়া একই কথা।
আমি আরবি ভাষা শিক্ষায় নিয়োজিত হলে অনেক বন্ধু বাংলা ভাষায় মূল কোরআন শরিফ অনুবাদ করে প্রচার করতে অনুরোধ করেন। এক্ষেত্রে কোনো কোনো মুসলমান বন্ধুও অনুরোধ করেন। কোরআন অধ্যয়ন ও তা অনুবাদ করাই আরবি ভাষা শিক্ষায় আমার নিয়োজিত হবার প্রধান উদ্দেশ্য। বন্ধুদের আগ্রহে ও নিজ কর্তব্যের অনুরোধে ঈশ্বরের কৃপায় আমি এখন বাংলা ভাষায় কোরআন অনুবাদ করে প্রকটন করেছি।”[8]
প্রচলিত বিতর্ক
বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ নিয়ে বিতর্ক প্রচলিত আছে। অনেকেই মানতে চায় না যে, কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন। তবে এসব দাবী অমূলক নয়। কারণ গিরিশচন্দ্র সেনের আগে আগে দুজন ব্যক্তি কোরআন অনুবাদের চেষ্টা করেছিলেন। তার অনুবাদের কয়েক বছর আগে ১৮৭৯ সালে আরেকজন অমুসলিম কোরআন অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি কোরআনের প্রথম পারা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। কলকাতার আয়ুর্বেদ প্রেস থেকে প্রথম পারার অনুবাদ ছাপাও হয়েছিল। ১৬ পৃষ্ঠা বা এক ফর্মার ঐ ছোট পুস্তিকা ৫০০ কপি ছাপা হয়েছিল তখন।
তারও অনেক আগে মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া নামে একজন মুসলিম বাংলায় কোরআন অনুবাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। গিরিশচন্দ্র সেন কোরআনের অনুবাদ কাজ শুরু করেছিলেন ১৮৮১ সালে, আর মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া শুরু করেছিলেন তার প্রায় ৭৩ বছর আগে ১৮০৮ সালে। তবে তার অনুবাদও অল্পতে সীমাবদ্ধ থাকে। তিনি শুধু কোরআনের শেষ অংশ আমপারার অনুবাদ করেছিলেন।
সম্পূর্ণরূপে কোরআনের বঙ্গানুবাদ গিরিশচন্দ্রই করেন। শুধু সম্পূর্ণ অনুবাদই নয়, তার অনুবাদে স্থানে স্থানে প্রয়োজন অনুসারে বেশ কিছু টীকাও সংযোজিত হয়েছিল। এসব টীকা দেবার জন্য তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় প্রকাশিত বেশ কিছু তাফসীর গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছিলেন। এত বড় কাজ অবশ্যই পরিশ্রমসাধ্য ও দীর্ঘ সাধনার ফল। নিঃসন্দেহে এটি একটি ঐতিহাসিক কাজ এবং এটি বাংলা ভাষায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবে দুঃখের বিষয়, অনেকেই কোরআনের প্রথম অনুবাদক হিসেবে তাকে কৃতিত্ব দিতে ইতস্ততঃ করেন। সম্ভবত এর প্রধান কারণ তিনি অমুসলিম বলে। যেমন প্রতিষ্ঠিত একটি সংবাদপত্রে বাংলায় প্রথম কোরআন সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে–
“কে বা কারা আমাদের সমাজে এ কথাটি চালু করে দিয়েছে যে ব্রাহ্মধর্মের নব বিধানমণ্ডলীর নিষ্ঠাবান ধর্মপ্রচারক গিরিশ চন্দ্র সেন সর্বপ্রথম কোরআনের বাংলা অনুবাদ করেছেন। আসলে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে যাঁদের সর্বময় আধিপত্য বিরাজমান, তাঁরাই যে কথাটা ছড়িয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। দুঃখ লাগে, যখন দেখি আমাদের এ অঞ্চলের দু-একজন কোরআনের মুদ্রাকর ও প্রকাশকও তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ঐতিহাসিকভাবে অসমর্থিত এমন একটি কথা অবাধে প্রচার করে চলেন। অথচ কোরআন ও কোরআনের শিক্ষার প্রতিটি ছাত্রই জানেন যে তাঁর অনুবাদের পাতায় কোরআনের শিক্ষা সৌন্দর্য বাক-ধারার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রচারনীতিতে কোরআনের প্রতি ক্ষমাহীন বিদ্বেষ ছড়ানো রয়েছে।”[9]
এমন বক্তব্য আসলে কাম্য নয়, তিনি হিন্দু হয়ে থাকেন আর যা-ই হয়ে থাকেন, যদি তিনি সঠিকভাবে কোরআনের অনুবাদ করতে পারেন তাহলে তা গ্রহণযোগ্য। দুটি বাক্যের মাঝে পার্থক্য অনুধাবন করতে হবে। “সর্বপ্রথম কোরআন অনুবাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন” আর “সর্বপ্রথম কোরআন অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন” এই দুটি বাক্যের মাঝে অনেক ভিন্নতা আছে। কোনো ব্যক্তি সে মুসলিমই হোক আর অমুসলিমই হোক, যদি সম্পূর্ণরূপে কাজ সম্পন্ন করতে পারে তাহলে গ্রহণ না করা কিংবা স্বীকৃতি না দেয়াটা অনৈতিক। আর তাছাড়া তিনি শুধুই কোরআনের অনুবাদক ছিলেন না, তিনি বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থ, নবী-রাসূল ও সাহাবাদের জীবনী নিয়েও লিখেছেন।[10] ইসলাম বিষয়ে পুরোদস্তর জ্ঞানী বলা যায় তাকে।
তবে তার অনুবাদ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। অনেকে মনে করেন তৎকালে বাজারে প্রচলিত তার অনুবাদ ছিল বিভিন্ন দোষে দুষ্ট।[11] তাকে নিয়ে বর্তমানে কিছু মুসলিমদের মাঝে যদিও কিছু অগ্রহণযোগ্যতা আছে, কিন্তু অনেক মুসলিমই আছে এবং ছিলেন যারা তার কর্মকে স্বাগত জানিয়েছে এবং তাকে এ কাজে প্রশংসা ও উৎসাহ দিয়েছে।
এখন বাংলা ভাষায় কোরআনের অনেক অনুবাদ আছে। তৎকালে তার করা অনুবাদ ছিল বাংলা ভাষায় সাড়া ফেলে দেবার মতো কাজ। তার এই কাজের প্রতি সাধুবাদ জানিয়ে তৎকালের কলকাতা মাদ্রাসার আরবি শিক্ষক আহমদউল্লা এবং আরও কিছু আলেম-উলামা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিঠি লিখেন। সে চিঠির বক্তব্য অনেকটা এরকম-
“আমরা বিশ্বাসে ও জাতিতে মোসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতাদৃশ চেষ্টা ও কষ্টসহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আমাদিগের অত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি।”[12]
তার অনুবাদের চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা লিখেন মওলানা আকরম খাঁ। তিনি ‘মোহাম্মদী’ ও ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ইসলামের উপর বেশ পাণ্ডিত্য ছিল তার। ভূমিকায় তিনি ভাই গিরিশচন্দ্র সেনকে প্রশংসা করে লিখেন-
“তিন কোটি মোছলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা তাহাতে কোরানের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ দেশের কোন মনিষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তখন আরবি-ফারসি ভাষার সুপণ্ডিত মোছলমানের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তাঁহাদের মধ্যকার কাহারও যে বাংলা সাহিত্যের উপরও যে যথেষ্ট অধিকার ছিল তাঁহাদের রচিত বা অনুদিত বিভিন্ন পুস্তক হইতে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু (কোরআন অনুবাদের জন্য) এই মনোযোগ দেওয়ার মতো সুযোগ তাঁহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই। এই গুরুদায়িত্ব বহন করিবার জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়া, সর্বপ্রথমে প্রস্তুত হইলেন বাংলার একজন হিন্দু সন্তান, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন…।”[13]
কেউই নিখুঁত নয়, কারো কাজের মাঝে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, বিতর্ক থাকতে পারে। তাই বলে কারো নিঃস্বার্থ কর্মকে একেবারেই অস্বীকার করে ফেলা যায় না। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনও নিঃস্বার্থ মননে অন্তরের ভালোবাসা থেকে কোরআন অনুবাদ করেছিলেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার অনুবাদকর্মের মূল্য অনেক। তার প্রতি এবং তার ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত সাহিত্যকর্মের প্রতি রইলো অশেষ শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র ও নোট
[1] আল কোরআন, সূরা আ’রাফ, আয়াত ২০৪। (যখন কোরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোনো এবং চুপ থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়।)
[2] সহীহ আল-তিরমিজি, হাদিস নাম্বার ২৯১০, আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রা:) হতে বর্ণিত- যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের একটি অক্ষর পড়বে, সে একটি নেকী পাবে। আর একটি নেকী দশটি নেকীর সমপরিমাণ।
[3] তফসীরে নূরুল কোরআন, ১ম খণ্ড (পৃষ্ঠা পাঁচ), মওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, আল বালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০০৯
[4] বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ, আখতার হুসেন, দৈনিক প্রথম আলো (অন্য আলো), ১৬ মার্চ ২০১২
[5] আত্ম-জীবন, গিরিশচন্দ্র সেন-
“শেরপুরস্থ চারুযন্ত্রে প্রথম খণ্ড মুদ্রিত হয়, পরে কলকাতায় আসিয়া খণ্ডশঃ আকারে প্রতিমাসে বিধানযন্ত্রে মুদ্রিত করা যায়। প্রায় দুই বছরে কোরআন সম্পূর্ণ অনুবাদিত ও মুদ্রিত হয়। পরিশেষে সমুদয় এক খণ্ডে বাঁধিয়া লওয়া যায়। প্রথমবারে সহস্র পুস্তক মুদ্রিত হইয়াছিল, তাহা নিঃশেষিত হইলে পরে ১৮৯৮ সালে কলকাতা দেবযন্ত্রে তাহার দ্বিতীয় সংস্করণ হয়। দ্বিতীয়বারের সহস্র পুস্তকও নিঃশেষিত প্রায়। এখন সংশোধিত আকারে তাহার তৃতীয় সংস্করণের উদ্যোগ হইতেছে।”
[6] বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ, আখতার হুসেন, দৈনিক প্রথম আলো (অন্য আলো), ১৬ মার্চ ২০১২
[7] “পৃথিবীর যাবতীয় সভ্য ভাষায় বাইবেল পুস্তক অনুবাদিত হইয়া সর্বত্র সকল জাতির মধ্যে প্রচার হওয়ায় সাধারণের পক্ষে তাহা যাহার পর নাই সুলভ হইয়াছে। তজ্জন্যই দেবাত্মা ঈসার দেবচরিত্র ও তাহার স্বগীয় জীবন-প্রদ উপদেশ সকল বাইবেলে সহজে পাঠ করিতে পারিয়া নানা দেশের নানা জাতীয় অগণ্য লোক আলোক ও জীবন লাভ করিয়াছে। কিন্তু বিধানমণ্ডলীভুক্ত ভূমগুলের একটি প্রধান ও পরাক্রাস্ত জাতি মোসলমান, তাহাদের মূল বিধান-পুস্তক কোরআন শরীফ শুদ্ধ তাঁহাদের মধ্যেই দুরূহ আরব্য ভাষারূপ দুর্ভেদ্য দুর্গের ভিতরে বদ্ধ রহিয়াছে। অন্য জাতির নিকট মোসলমানেরা কোরআন ধিক্রয় পর্যস্ত করেন না, অপর লোকে তাহ পড়িবে দূরে থাকুক স্পর্শ করিতেও পায় না। অন্য জাতির মধ্যে আরব্য ভাষার চর্চাও বিরল। কেহ কোরআন হস্তগত করিতে পারিলেও ভাষাজ্ঞানের অভাবে তাহার মর্ম কিছুই অবধারণ করিতে সমর্থ হয় না। সুতরাং ইহা কতিপয় মোসলমান মৌলবীর একচেটিয়া সম্পত্তি হইয়া রহিয়াছে। মৌলবী শাহ্ রফিয়োদ্দীন উর্দু ভাষায় এবং শাহ্ আলী আল্লাহ্ ফতেহোৱ রহমান নামে পারস্য ভাষায় কোরআনের অনুবাদ করিয়া প্রচার করিয়াছেন; কিন্তু তাহা মূল পুস্তকের সঙ্গে একত্র সংবদ্ধ আছে, স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে পাওয়া যায় না। সেই অনুবাদিত পুস্তকদ্বয় স্বপ্রাপ্য হইলেও উর্দু ও পারস্য ভাষানভিজ্ঞ বাঙ্গালীর পক্ষে তাহা অন্ধজনের পক্ষে দর্পণের ন্যায় নিষফল। ইংরাজী ভাষায় কোরআনের অনুবাদ প্রচার হইয়াছে সত্য; কিন্তু এদেশে তাহা সচরাচর প্রাপ্য নহে । অপিচ যাহার ইংরাজী জানেন না তাঁহাদের পক্ষে উহ! প্রাপ্ত হওয়া না হওয়া তুল্য। আমি আরব্য ভাষা শিক্ষায় প্রবৃত্ত্ব হইলে অনেক বন্ধু বঙ্গভাষায় মূল কোরআন অনুবাদ করিয়া প্রচার করিতে আমাকে অনুরোধ করেন, এ বিষয়ে আমি কোন কোন মোসলমান বন্ধু কতৃকও বিশেষরূপে অনুরুদ্ধ হই। কোরআন অধ্যয়ন ও তাহ অনুবাদ করাই আরব্য-ভাষা শিক্ষায় প্রবৃত্ত হওয়ার আমার প্রধান উদ্দেশ্য। বন্ধুদিগের আগ্রহে ও স্বীয় কর্তব্যানুরোধে ঈশ্বর কৃপায় আমি এক্ষণ কোরআন বঙ্গভাষায় অনুবাদ করিয়া প্রকটন করিয়াছি।”
[8] কোরআন শরীফ, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, হরফ প্রকাশনী, কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা, ২০১১
[9] কোরআন শরিফ অনুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ, কালের কণ্ঠ
[10] বাংলাপিডিয়া, সেন, গিরিশচন্দ্র
[11] আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান, আলী হাসান তৈয়ব, সম্পাদনা : ড. আব্দুল কাদের, https://d1.islamhouse.com/data/bn/ih_books/single/bn_alqurunul_kareemer_orthanubader_prekkhapot_o_proyojonio_gean.doc
[12] বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ, আখতার হুসেন, দৈনিক প্রথম আলো (অন্য আলো), ১৬ মার্চ ২০১২
[13] http://www.narsingdipratidin.com/?p=93
ফিচার ছবি- Strategi Dan Bisnis