১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখ। আর দশটা দিনের মতোই নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত ছিলেন স্পেনের বাস্ক প্রদেশের ছোট অথচ সাজানো গোছানো শহর গোয়ের্নিকার বাসিন্দারা। দিন শেষে সকলে যখন নিজ নিজ নীড়ে ফিরবার আয়োজন করছেন, তখনই আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো যুদ্ধ বিমানের গর্জনে। শুরু হলো মুহুর্মুহু বোমা নিক্ষেপ। নিমিষেই তছনছ হয়ে গেল গোয়ের্নিকা শহর। ফ্যাসিবাদী ফ্রাঙ্কোর রোষানলে পড়ে ক্ষণিকের ব্যবধানে মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গেল শহরের শত শত নিরীহ মানুষের।
গোয়ের্নিকার এই নির্মম অবস্থা দেখে প্রাণ কেঁদে উঠলো স্পেনেরই এক প্রখ্যাত চিত্রকরের। কথায় বলে, শব্দ যেখানে নীরব হয়ে যায়, শিল্প সেখানে কথা বলে। শিল্পী পাবলো পিকাসোর তুলির আঁচড়ে ঠিক তেমনি বিধ্বস্ত এ শহরের স্তূপের মাঝে জন্ম নিল এক অমর ছবি, গোয়ের্নিকা।
শিল্পানুরাগী অথচ পিকাসোর গোয়ের্নিকার নাম শোনেনি, এমন মানুষের জুড়ি মেলা ভার। মাদ্রিদের কুইন সোফিয়া মিউজিয়ামে অবস্থিত ১৩৭.৪ বাই ৩০৫.৫ ইঞ্চি আকারের এই চিত্রকর্মটি শুধু একটি ছবিই নয়, এটি স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার তথা ফ্যাসিবাদী ফ্রাংকোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক মৌন প্রতিবাদের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যুগে যুগে গোয়ের্নিকাকে দেখে মানুষের মনে উচ্চারিত হয়েছে শুধু একটিই বাক্য “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই”।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শুরুতে পিকাসো নিজেও জানতেন না তার আঁকা গোয়ের্নিকার সর্বশেষ রূপ আসলে কেমন হবে। স্পেনের নাগরিক হওয়ার সুবাদে গৃহযুদ্ধের বিরোধীপক্ষ স্প্যানিশ রিপাবলিক ১৯৩৭ সালে পিকাসোকে দায়িত্ব দেয় স্পেনের পক্ষে একটি ম্যুরাল তৈরি করতে, যা হবে ফ্রান্সে আয়োজিত প্যারিস ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশনে স্পেন প্যাভিলিয়নের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
তাদের লক্ষ্য ছিল দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন উন্নয়ন ম্যুরাল জনসম্মুখে তুলে ধরে স্পেনের অর্থনৈতিক মন্দা ও সামাজিক অস্থিরতা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া। কিন্তু বহু চেষ্টার পরও পিকাসো ম্যুরালটি তৈরি করবার মতো যথেষ্ট উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। একদিকে বাদ সাধছিল তার ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন ও হতাশা, কর্মক্ষেত্রে কোনোভাবেই মন বসাতে পারছিলেন না তিনি। অপরদিকে ছিল স্পেনের তখনকার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক দৈন্যদশা। স্পেনের তৎকালীন একনায়ক ফ্রাংকো দিনের পর দিন দেশ ও জনগণের উন্নতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও দেশের জনগণের মৃত্যুর হার বেড়েই চলছিল।
গোয়ের্নিকার সৃষ্টি
পিকাসো যখন ম্যুরাল তৈরি করবেন কি করবেন না, এ নিয়ে নিজের মনের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত, এমন সময় স্প্যানিশ রিপাবলিক ও পিকাসোর বন্ধুমহল তাকে অনুরোধ করলেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে নয়, তিনি যেন ফ্যাসিবাদী ফ্রাঙ্কো ও স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের আসল রূপ তুলে ধরে একটি ম্যুরাল আঁকেন। একে তো এমনিতেই নানাবিধ কারণে পিকাসোর মন মেজাজ ভালো নেই। তার উপর রাজনৈতিক একটি ম্যুরাল তৈরি করে নিজেকে বিতর্কের পাত্রে পরিণত করবার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না।
সবিনয়ে নিজের অপারগতা প্রকাশ করবার চিন্তা ভাবনা করছেন তিনি, এমতাবস্থায় ১৯৩৭ সালের ২৯শে এপ্রিল তাঁর চোখ পড়লো L’Humanite নামের এক পত্রিকার পাতায়। পত্রিকা পড়ে গোয়ের্নিকা শহরের নির্মম পরিণতির খবর জানতে পারলেন তিনি। জানলেন নিজ দেশের মানুষের রক্তপাতের খবর। জার্মান কমান্ডার উলফ্রাম রিখতোফ্রেম-এর তত্ত্বাবধানে দুই ঘণ্টা ধরে চলা সেই বিমান অভিযানে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় গোটা শহর। ফ্রাংকো এই আক্রমণটি মূলত করেছিলেন হিটলারের সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে। হিটলারও এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন এই ভেবে যে এতে ফ্রাঙ্কোর আনুগত্যও পাওয়া যাবে, আবার তার বাহিনীর নব-আবিষ্কৃত যুদ্ধকৌশলও পরিক্ষামূলক ব্যবহার করা হবে। এভাবে গোয়ের্নিকায় হামলার মাধ্যমেই জন্ম নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ “ব্লীৎক্রিজ মেথড”।
হামলার ভয়াবহতা দেখে আত্মা কেঁপে উঠে পিকাসোর। এমন হীন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ না করাও যে পাপ। আর একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় অস্ত্র রঙ তুলি ছাড়া আর কি ই বা হতে পারে? ১৯৩৭ সালের মে মাসে পিকাসো তার ছবির স্কেচ শুরু করলেন।
নিজের সকল রাগ, ক্ষোভ, অভিমান উগড়ে দিলেন ছবির পটে। রং হিসেবে ব্যবহার করলেন কালো ও ধূসর। এ রং যেন কষ্টকে প্রতিনিধিত্ব করে। ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে লাগল কষ্টের মাঝে থাকা নারী, শিশু, ঘোড়া, ষাঁড়ের ছবি। এ যেন যন্ত্রণার বজ্রকঠিন প্রকাশ।
শুরুতে জনপ্রিয় ছিল না এই চিত্রকর্ম “এটা কি ছবি নাকি জগাখিচুড়ি?”, ম্যুরালটি দেখে এমনই মন্তব্য করেছিলেন এক জার্মান সাংবাদিক। যথেষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষ না থাকায় ফ্রান্স সরকার তো এককথায় বাতিলই করে দিলেন ছবিটিকে। রাশিয়াও ছবিটির কোনো প্রশংসা করলো না। প্যারিস ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশনে অনেকটা অপাংক্তেয় হয়েই পড়ে রইলো এটি।
ফ্রান্সে ব্যর্থ প্রদর্শনীর পর ইউরোপের কিছু দেশে ভ্রমণ করে গোয়ের্নিকা। এরপর গোয়ের্নিকাকে পাঠানো হয় আমেরিকায়, স্প্যানিশ উদ্বাস্তুদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সানফ্রান্সিসকো মিউজিয়াম অব আর্ট ১৯৩৯ সালের ২৭শে আগস্ট থেকে ১৯শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিনামূল্যে ছবিটি প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে এটি চলে আসে নিউ ইয়র্কে অবস্থিত মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে। পিকাসোর অনুরোধে স্পেনে ফেরত যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছবিটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় এই মিউজিয়ামটি।
১৯৩৯ থেকে ১৯৫২ সাল, এই সময়ের মধ্যে গোয়ের্নিকার তাৎপর্য ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে শিল্পবোদ্ধারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে এটি। গোয়ের্নিকাকে একনজর দেখতে ঢল নামে মানুষের। ১৯৬৮ সালে খোদ ফ্রাঙ্কো চিত্রকর্মটিকে স্পেনে ফেরত নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু এতে বাদ সাধলেন পিকাসো। বললেন,
যতদিন পর্যন্ত স্পেনের সাধারণ মানুষ ফ্রাঙ্কোর নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবে না, ততদিন পর্যন্ত এ ছবি স্পেনে যাবে না।
১৯৭৫ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর গোয়ের্নিকা স্পেনে আসবার পথ সুগম হয়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, বিজয়ের বেশে দেশে আসা গোয়ের্নিকাকে এর স্রষ্টা নিজেই দেখে যেতে পারলেন না। ১৯৭৩ সালেই তিনি পাড়ি জমিয়েছেন অজানার উদ্দেশ্যে। তার পূর্ব ইচ্ছা অনুযায়ী ছবিটির স্থায়ী অবস্থান হয় মাদ্রিদের প্রাডো মিউজিয়ামে। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার জন্য এটিকে স্থানান্তর করা হয় পাশে অবস্থিত কুইন সোফিয়া জাদুঘরে। সেই থেকে আজ অবধি এই জাদুঘরে অবস্থান করছে পাবলো পিকাসোর অমর সৃষ্টি গোয়ের্নিকা।
কী আছে এতে?
গোয়ের্নিকার মূল প্রতিপাদ্য যুদ্ধ ও যুদ্ধের নির্মম পরিণতি। ছবির বাঁ পাশে আছে একটি শিশুর লাশ ধরে হাত বাড়িয়ে থাকা এক নারীর ছবি। তার ঠিক উপরে আছে রক্তচক্ষুর একটি ষাঁড়। ছবির মাঝখানটা জুড়ে আছে যন্ত্রণাকাতর এক ঘোড়ার প্রতিকৃতি। ঘোড়ার শরীরের উপর আবছাভাবে আছে একটি মানুষের মাথার খুলি।
ছবির উপরের অংশে আছে বিশালাকার একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব যা সূর্যের প্রতীকী উপস্থাপন হিসেবে ধারণা করা হয়। ছবিটির নিচের দিকে খেয়াল করলে একটি কাটা হাত দেখা যায়, যেটি এখনো একটি ভাঙ্গা তলোয়ার ধরে রেখেছে। ডানদিকে আছে দুটি নারীমুর্তি। এর মধ্যে একটি নারীমুর্তি তার শূন্য দৃষ্টি ফেলছে সামনের চলমান বিভীষিকার দিকে। অপর নারীমুর্তিটিকে দেখে মনে হবে হিংস্র কোনো পশুর করাল গ্রাসে তলিয়ে যাচ্ছে।
গোয়ের্নিকার অর্থ
গোয়ের্নিকার অর্থ ও পিকাসো ছবিটির মাধ্যমে কী বুঝাতে চেয়েছেন, এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। মতবিভেদটা মূলত ছবির ঘোড়া ও ষাঁড়টিকে নিয়ে। অনেকের মতে ঘোড়া ও ষাঁড় স্পেনের তৎকালীন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় এ দুটো প্রাণীকে পিকাসো তার ছবিতে ব্যবহার করেন। আবার অনেকের ধারণা ঘোড়াটিকে সাধারন মানুষ ও বুনো ষাঁড়টিকে ফ্রাঙ্কোর প্রতীকী রূপে এঁকেছেন পিকাসো। তবে ছবিটি সম্পর্কে সকলেরই ঐক্যমত্য আছে, এরকম কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গবেষক বেভারলী রে-এর লেখায়। তাঁর মতে-
- গোয়ের্নিকায় ব্যবহৃত আকৃতিগুলি প্রতিবাদের।
- ছবিটি দুঃখ ও যন্ত্রণার, তাই পিকাসো কালো ও ধূসর রঙ ব্যবহার করেছেন।
- বৈদ্যুতিক বাল্বটির মাধ্যমে পিকাসো সূর্যকে চিত্রায়িত করেছেন।
- ছবির ভাঙ্গা তলোয়ারটির মাধ্যমে শাসকের কাছে শোষিতদের পরাজয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
গোয়ের্নিকাকে নিয়ে শিল্পবোদ্ধাদের উৎসাহের শেষ নেই। তবে পিকাসো নিজে কী বলেছেন ছবিটির ব্যাপারে? সৃষ্টিকে নিয়ে স্রষ্টার উদ্ধৃতি দিয়েই সমাপ্তি টানবো আজকের লেখার। ছবির চরিত্রগুলো কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে পিকাসো বলেন
ঘোড়া হলো একটি ঘোড়া, ষাঁড় হল একটি ষাঁড়। আপনি আমার ছবিতে কোনো অর্থ খুঁজে পেলে সেটিই সত্য, কিন্তু সেটি আমার আরোপিত নয়। আমি ছবির জন্য ছবিটি এঁকেছি। এঁকেছি যে যা, তাকে তা-ই ভেবে।
কে কী ব্যখ্যা দিলো তাতে কি আসে যায়? পিকাসো নিজে যখন বলছেন “আপনি আমার ছবিতে কোনো অর্থ খুঁজে পেলে সেটিই সত্য…”। গোয়ের্নিকাকে আপনি নাহয় আপনার মতো করেই দেখুন?