সিরিয়াল কিলার!, একের পর এক খুন করা যার নেশা। এরকম খুনীর আবির্ভাব যখন কোনো এলাকায় ঘটে, তখন তা পরিণত হয় এক আতঙ্কের নগরীতে। আজ আমরা এমনই এক সিরিয়াল কিলারের গল্প শুনতে যাচ্ছি। তা-ও আবার আমাদের উপমহাদেশেরই এক সিরিয়াল কিলারের গল্প। নাম তার ‘দ্য স্টোনম্যান’, ১৯৮৫-১৯৮৯ সাল পর্যন্ত যে ভারতের মুম্বাই আর কলকাতায় তৈরি করেছিল এক ত্রাসের রাজত্ব।
বোম্বের হত্যাকাণ্ডসমূহ
একজন সিরিয়াল কিলার, যে ভিক্ষুক এবং গরীব কাপড় বিক্রেতাদের খুন করে চলেছে, এমন সন্দেহের প্রথম শুরু হয় ভারতের মুম্বাইতে। দুঃখের বিষয়, প্রথম ৬টি খুন একইভাবে হলেও ৬ নম্বর খুনের আগপর্যন্ত মুম্বাই পুলিশ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি এটি একটি সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনা হতে পারে। ৬ নম্বর খুনের পর পুলিশ খুনগুলোর মাঝে একধরনের প্যাটার্ন বা মিল খুঁজে পায়, যা তাদের সিরিয়াল কিলিং সম্বন্ধে ভাবতে বাধ্য করে।
খুনগুলো শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। মুম্বাই বা বোম্বেতে টানা ২ বছর ১২ জনকে খুন করে এই খুনী। তারপর ১৯৮৭ সালে সে ক্ষান্ত হয়। মুম্বাইয়ের সিয়ন এবং কিং’স সার্কেল এলাকায় এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল।
মুম্বাইয়ের এই হত্যাকারী খুব দ্রুতই স্থানীয় জনগণের মাঝে ‘পাত্থারমার’ নামে পরিচিত হয়ে যায়। পাত্থারমারের খুনের ধরন ছিল খুবই সাধারণ। প্রথমেই সে একজন সাধারণ মানুষকে খুঁজে বের করত যে রাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুমায়। রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষটি যদি একটু নিরিবিলি জায়গায় একা ঘুমিয়ে থাকে, তবেই সে খুনীর টার্গেটে পরিণত হতো। একটি ভারী পাথর দিয়ে তখন খুনী রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষটির মাথা একদম থেঁতলে দিত। যে পাথরগুলো দিয়ে খুনী হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাত, সেগুলোর প্রত্যেকটির ওজন প্রায় ৩০ কেজির মতো ছিল।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাদের হত্যা করা হতো, তাদের পরিচয় কখনোই জানা যেত না। এর কারণ তারা একা ঘুমাত। এছাড়াও তারা তাদের পরিবার থেকেও দূরে থাকত। সম্ভবত তারা সবাই ভাসমান মানুষ ছিল। আর মুখগুলোও এমনভাবে থেঁতলে যেত যে, চেনার উপায় থাকত না। এ কারণেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো প্রথমদিকে পুলিশ একদমই গুরুত্ব সহকারে নেয়নি।
এরই মাঝে পুলিশের হাতে চলে আসে এক সুবর্ণ সুযোগ। এই সিরিয়াল কিলার এক হোটেলের ওয়েটারকে রাতের আঁধারে পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যার চেষ্টা করে। এই ওয়েটারের নিজের কোনো বাড়ি ছিল না, তাই সে রাস্তায় ঘুমাত। খুনী তাকে খুন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লে সে কোনোভাবে তাকে ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পরে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সিওনের রাস্তার মৃদু আলোয় বেঁচে আসা এই ওয়েটারটি খুনীকে একদমই দেখতে পায়নি। তাই তার কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্যই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১২টি খুনের পর হঠাৎ করেই মুম্বাইয়ের এই হত্যাকাণ্ডগুলো একদম থেমে যায়।
১৯৮৯, কলকাতা: উত্তপ্ত গরমে ভয়ঙ্কর স্টোনম্যান
কলকাতা, ১৯৮৯; তখন গ্রীষ্মকাল চলছিল। জুন মাসের কেবল শুরু। পাথর হাতের ভয়ঙ্কর খুনীটি আবার ফিরে এল। ১৯৮৯ সালের জুন মাসে কলকাতায় প্রথম খুনটি করার পর পরের ৬ মাসে আরো ১২ জনকে একের পর এক খুন করল সে। সারা কলকাতা ভয়ে, আতঙ্কে কেঁপে উঠল।
কলকাতার এক বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা প্রথমবারের মতো এই খুনীর এক চমকপ্রদ নাম দিলো- ‘দ্য স্টোনম্যান’। এরপর থেকে এই খুনী সেই নামেই পরিচিত হয়ে গেল।
যদিও এটা কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, কলকাতার খুনী আর মুম্বাইয়ের খুনী একই কিনা। কারণ, কোনো খুনী সম্বন্ধেই পুলিশের কাছে তেমন কোনো তথ্য ছিল না। তবে দুই জায়গার ঘটনাগুলোর মাঝেই বেশ কিছু মিল ছিল। বিশেষ করে খুনের অস্ত্র দুই ক্ষেত্রেই ছিল পাথর। যাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা সবাই ছিল অত্যন্ত গরীব এবং দিনে এনে দিনে খাওয়া লোক। তারা রাস্তায় ঘুমাত। কারো পরিচয়ই কখনও পাওয়া যায়নি। খুনের সময়গুলোও মুম্বাই আর কলকাতার ক্ষেত্রে একইরকম ছিল। তাই যদি একই খুনী না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও কলকাতার খুনী অবশ্যই আগের মুম্বাইয়ের স্টোনম্যানের কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তাই মুম্বাই পুলিশের কাছে থাকা যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য কলকাতার পুলিশ সংগ্রহ করতে শুরু করে।
খুনী এখানেও অত্যন্ত ভারী পাথর মাথায় মেরে তার শিকারদের হত্যা করত। মাথায় আঘাতের ধরন দেখে পুলিশের ধারণা হয়, পাথরগুলো দিয়ে বেশ উঁচু থেকে তাদের মাথায় আঘাত করা হতো। এছাড়াও পাথরগুলোর ওজন ছিল প্রায় ৩০-৩৫ কেজি করে। তাই কলকাতার পুলিশ ধারণা করেছিল, লোকটি লম্বা এবং বেশ শক্তিশালী গঠনের। কারণ, এত বড় পাথর নিয়ে ঘোরা এবং আঘাত করে মেরে ফেলা কোনো দুর্বল লোকের কাজ নয়।
একের পর এক হত্যাকান্ড হতে থাকলে কলকাতার পুলিশ আক্রান্ত এলাকাগুলোতে রাতের বেলা টহল ব্যাপক পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। অনেক সন্দেহভাজনকে এ সময় আটক করা হয়। কিন্তু কারো বিরুদ্ধেই তেমন কোনো শক্ত প্রমাণ না থাকায় তাদের সবাইকেই পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ১৯৮৯ সালে পুলিশী ধর-পাকড় শুরু হওয়ার পর হঠাৎ করেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো থেমে যায়। তাহলে কি স্টোনম্যান পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় পেয়েছিল? ভয় পেয়ে সে তার হত্যাকাণ্ড থামিয়ে দেয়? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো অজানাই রয়ে যাবে।
কলকাতা এবং মুম্বাই পুলিশ এখনো নিশ্চিত নয়, তাদের এলাকার ঘটনাগুলো একই খুনী ঘটিয়েছিল কিনা। এমনকি তারা এটাও নিশ্চিত নয় যে, কলকাতার খুনগুলোই একই খুনী করেছিল কিনা বা এটা কোনো একদল খুনীর সম্মিলিত কাজ কিনা। এছাড়াও এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, এর মাঝে কোনো কোনো খুন ‘স্টোনম্যানের’ খুনের ধরন দেখে প্রভাবিত হয়ে অন্য কেউ নকল করে (যাদের কপিক্যাট কিলার বলে) করেছিল কিনা। এমনকি পুলিশ এখনও এটাও জানে না যে, এটি কোনো পুরুষ নাকি নারীর কাজ। তবে রাতের বেলা হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে থাকায় পুলিশের ধারণা এগুলো সম্ভবত কোনো পুরুষই ঘটিয়েছে। কারণ, উপমহাদেশে এত রাতে নারীদের অবাধ চলাচল সাধারণত দেখা যায় না। আবার এমনটাও হতে পারে যে, খুনী নিজেও একজন উদ্বাস্তু এবং রাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
মুম্বাইয়ের যে এলাকায় ঘটনাগুলো শুরু হয়েছিল, সেই সিওন এলাকাতে অনেক কালো জাদু বা তন্ত্র-মন্ত্র সাধনাকারীদের দেখা যায়। এটা তাদের একরকম ঘাঁটিই বলা চলে। তাই অনেকেই ধারণা করে থাকে, এই হত্যাকাণ্ডগুলো কেউ কোনো এক তান্ত্রিকের কথামতো এক বিশেষ কর্মের অংশ হিসেবে করেছিল। সে সময় মুম্বাই আর কলকাতায় এই স্টোনম্যান এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানকার অনেকেই বিশ্বাস করত, এই হত্যাকাণ্ডগুলো কোনো অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা ঘটিয়ে এসে ঘটিয়ে যেত।
রহস্যজনক এই সিরিয়াল কিলার ‘স্টোনম্যান’ এখনও পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। যদিও তার নামে তদন্ত ফাইল কলকাতায় এখনও খোলা রয়েছে।
সিনেমায় স্টোনম্যান
এত বড় এক রহস্যজনক সিরিয়াল কিলিংয়ের গল্প নিজেদের এলাকায়, আর বলিউড-টলিউডে সেটা নিয়ে সিনেমা হবে না, তা কি হয়? হয়েছেও কয়েকটি।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বলিউডে তৈরি হয়েছে ‘দ্য স্টোনম্যান মার্ডার্স’ নামের এক চলচ্চিত্র। ২০০৯ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়। এই সিনেমার কাহিনী রচনা ও পরিচালনা করেছেন বিখ্যাত পরিচালক মনীষ গুপ্ত। সিনেমাটি মুক্তির সময় একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, সিনেমাটিতে এমন সত্য তুলে ধরা হয়েছে যা মুম্বাই পুলিশ জেনেও গোপন রেখেছিলেন। যদিও সিনেমার পরিচালক আর মুম্বাই পুলিশ উভয়েই সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। ডিরেক্টরের মত অনুসারে, সিনেমাটি মূলত একটি সত্য ঘটনার উপড়ে দাঁড়ানো ফিকশান। এই সিনেমাতে দেখানো হয়, স্টোনম্যান ছিল বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম এক পুরুষ। সে এই অক্ষমতা দূর করতে এক তান্ত্রিক বাবার পরামর্শে এই খুনগুলো করে বেড়াচ্ছিল।
২০১১ সালে কলকাতায় ‘২২শে শ্রাবণ’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়, যার পরিচালক ছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। এই সিনেমার প্লটও কলকাতার এই রহস্যজনক সিরিয়াল কিলিং নিয়েই গড়ে উঠেছে। যদিও সিনেমার শেষে দেখা যায়, স্টোনম্যান তার সব দোষ শিকার করে নেয় এবং নিজের নিষ্ঠুরতার কথা শিকার করে নিয়ে আত্নহত্যা করে, যা প্রকৃত সত্য থেকে অনেক দূরে।
স্টোনম্যানের গল্প ভারতীয় অপরাধ জগতের এক অমীমাংসিত রহস্য হয়েই রয়েছে এবং সম্ভবত রহস্য হয়েই থাকবে। রাতের আঁধারে নিরপরাধ মানুষদের কোনো কারণ ছাড়াই পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর এবং আতঙ্কের বিষয় আর কী হতে পারে? সেই আতঙ্ক এখন হয়তো আর মুম্বাই বা কলকাতার মানুষদের তাড়া করে বেড়ায় না, কিন্তু ২৬টি খুনের রক্তাক্ত ইতিহাস নিয়ে স্টোনম্যান মুম্বাই আর কলকাতার ইতিহাসে এক আতঙ্ক হয়েই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।