একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীর বহু স্থানে জাদুবিদ্যার চর্চা হতো। মানুষ সেই সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে জাদুর আশ্রয় নিতো। সেই প্রাচীন কালে বহু সভ্যতা আর সংস্কৃতিতে জাদু, কুসংস্কার, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে ছিল পরিষ্কার ব্যবধান। সেই সময় জাদুকরদেরকে দেখা হতো জ্ঞানের প্রতীক, গোপন তথ্যের রক্ষক এবং নানা শিল্পকলা, গণিত, বিজ্ঞান বিশেষ করে রসায়নের গুরু হিসেবে। তখনকার দিনে জাদুকরদেরকে ভাবা হতো অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে। তাদেরকে আলাদা সম্মান ও ভয়ের চোখে দেখতো মানুষ। সেই প্রাচীন কালে গ্রিসে জাদুবিদ্যার ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
নানা ধরনের জাদু ও মন্ত্রের ব্যবহার মিশরীয় সভ্যতায় প্রায় কয়েক হাজার বছর ধরে চলে এসেছে। আর এই মিশরীয় জাদুবিদ্যার পথ অনুসরণ করেই গ্রিসে জাদুবিদ্যার প্রচলন ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও তৃতীয় শতাব্দীর পুরানো প্যাপিরাসে এই গ্রিক জাদুবিদ্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিসের এসব জাদু চর্চার মধ্যে জাদুমন্ত্র, মাদুলি, মন্ত্রপূত কবচ, শাপ বা বাণ মারা প্রভৃতি জাদু প্রাচীন গ্রিসের মানুষ সচরাচর ব্যবহার করতো। চলুন আজকে জেনে নিই প্রাচীন গ্রিসের মানুষের মধ্যে প্রচলিত এসব অদ্ভুত জাদু সম্পর্কে।
মাদুলি ও মন্ত্রপূত কবচ
প্রাচীন গ্রিসের জাদুবিদ্যার সবচেয়ে প্রচলিত ব্যবহার ছিল মাদুলি ও মন্ত্রপূত কবচ হিসাবে। তাদের বিশ্বাস মতে, এসব কবচ মানুষকে বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতো এবং সৌভাগ্য বয়ে আনতো। এগুলো সাধারণত গলায় বা কব্জিতে পরা হতো অথবা নির্দিষ্ট ইচ্ছা পূরণের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে যেমন ঘরে রাখা হতো। গ্রিক রক্ষাকবচগুলো মূলত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটিকে বলা হতো ‘তালিসমান’ এবং অন্যটি ছিল ‘ফাইল্যাক্টার’। তালিসমান সৌভাগ্য বয়ে আনতো, আর ফাইল্যাক্টার বিপদ থেকে রক্ষা করতো।
তালিসমান তৈরিতে হাড়, কাঠ, পাথর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম দামী রত্ন পাথর ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও প্যাপিরাসের ছোট টুকরা কিংবা ধাতব পাতেও মন্ত্র লেখা হতো। তারপর এগুলো ছোট্ট থলে কিংবা পাত্রে রাখা হতো। কোনো কোনো থলের মধ্যে আবার নানা রকম ঔষধি গাছও দিয়ে দেওয়া হতো। এবার সব শেষে কবচ প্রস্তুতকারী কোনো একটি দেব-দেবীকে স্মরণ করে মন্ত্রপাঠ করতো। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেলো মন্ত্রপূত কবচ।
কালো জাদু ও শাপ
প্রাচীন কালে গ্রিসের কেউই জাদুমন্ত্রের আক্রমণ হতে নিজেকে নিরাপদ মনে করতো না। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই কালো জাদুর ভয়ে থাকতো। এই কালো জাদু সাধারণত খুব গোপনে করা হতো এবং এই মন্ত্রপূত বস্তুকে মৃত দেহের সাথে মাটির নিচে পুতে ফেলা হতো যাতে তা প্রেতলোকে এই জাদুর আবেদন নিয়ে যেতে পারে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, গ্রিসের বেশিরভাগ ‘কাটারেস’ বা মন্ত্রপূত শাপ প্রাচীন গ্রিসের কেরামেইকস কবরস্থানে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষুদ্র মূর্তির মধ্যেও এই কাটারেস পাওয়া গিয়েছে। এগুলো প্রায়ই অল্পবয়সী ও যৌবনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের কবরে পুঁতে রাখা হতো। জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ জুট্টা স্ট্রোসজেকের মতে, তৎকালীন মানুষের বিশ্বাস ছিল যাদের অকালমৃত্যু ঘটে তারা প্রেতলোকের দেবতাদের কাছে দ্রুত জাদুমন্ত্রের আবেদন পৌঁছে দিতে পারে। আর দেবতারা যত দ্রুত এই জাদুর প্রার্থনা মঞ্জুর করবেন তত দ্রুত জাদু কাজ করবে। ডক্টর স্ট্রোসজেক আরো জানান, এই কাতারেস বা জাদুমন্ত্রগুলো কুয়ায়ও নিক্ষেপ করা হতো। কারণ কুয়াকে মনে করা হতো পাতালপুরীর প্রেতলোকের প্রবেশদ্বার।
কাতারেস শুধু গ্রিসেই নয়, বরং ভূমধ্যসাগর জুড়েও খুঁজে পাওয়া যায়। তবে গ্রিসের কাতারেসের বিশেষত্ব হলো সেগুলো থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের সভ্যতা সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। আর সেটি হলো ২,৫০০ বছর আগের পেরিক্লিসের যুগ, যখন এথেন্সে দেবী অ্যাথিনির মন্দির পার্থেনন তৈরি হয়েছিল। ডক্টর ড্রেক কলিন্সের মতে, “পঞ্চম শতাব্দীর প্রচলিত জাদুগুলো ছিল মানুষের ক্ষতি করার জন্য। এগুলো কাউকে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ও তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কর্মদক্ষতা এমনকি তাদের বোধশক্তিকেও লোপ পাইয়ে দিতো।”
নেক্রোম্যান্সি, মৃতের আত্মা ডেকে আনা
নেক্রোম্যান্সি বা মৃতের আত্মা ডেকে এনে জাদু করা প্রাচীন গ্রিসে নিষিদ্ধ ছিল। তবে বহু স্থানে গোপনে এটি করা হতো বলে জানা যায়। সাধারণত প্রাচীন একটি মন্দিরে এটি করা হতো। মন্দিরটি ছিল মৃতপুরীর দেবতা হেডিস ও তার সঙ্গিনী দেবী পার্সিফোনকে উৎসর্গিত। প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীদের বিশ্বাস ছিল, কেউ মারা গেলে তার দেহ মাটিতে পচে মিশে যায় এবং তার আত্মা দেহ থেকে মুক্তি পায়।
মুক্তি প্রাপ্ত আত্মা মাটির নিচে পৃথিবীর ফাটল দিয়ে মৃতের দুনিয়া বা প্রেতলোকে পৌঁছায়। তারা বিশ্বাস করতো মৃতের আত্মাদের এমন কিছু ক্ষমতা রয়েছে যা জীবিত মানুষের নেই। যেমন ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার ক্ষমতা। আর এজন্য এসব মন্দিরকে এমন স্থানে নির্মাণ করা হতো যে স্থানটি মাটির নিচের প্রেতপুরীতে প্রবেশের দ্বার হিসেবে ধরা হতো। এই স্থানে মন্দির নির্মাণ করা হলে মৃতের সাথে যোগাযোগ ও তাদের কাছ থেকে ভবিষৎবাণী শোনা সহজ হতো বলেই মনে করতেন তারা।
প্রেমের জাদু
প্রাচীনকালে গ্রিসে জাদুর অন্যতম প্রচলিত ব্যবহার ছিল প্রেম ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে। ডক্টর ক্রিস্টোফার ফারাওনের মতে, প্রাচীন গ্রিসে প্রেমের জাদু ও মন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। প্রেমের এই জাদুর ছিল দুটি ভিন্ন ধরণ। একটি ব্যবহৃত হতো কারো মধ্যে ‘এরোস’ বা যৌন আবেগ সৃষ্টি করতে এবং অন্যটি ব্যবহৃত হতো ‘ফিলা’ বা আকর্ষক ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে। ডক্টর ফারাওন এটির বিস্তারিত ইতিহাস নিয়ে ‘প্রাচীন গ্রিসের প্রেমের জাদু’ নামে ২০০১ সালে একটি বইও লেখেন।
সাইকেডেলিকস
প্রাচীন গ্রিসের জাদুবিদ্যার ইতিহাসে সাইকেডেলিকস বা বিভ্রান্তি সৃষ্টকারী মাদক দ্রব্যের ব্যবহার তেমন দেখা না গেলেও বহু গবেষক এর উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, বিভিন্ন জাদুর আচার পালন করার সময় জাদুকররা এ ধরনের মাদকদ্রব্য গ্রহণ করতেন। বিশেষ একধরনের মাশরুম এই মাদক দ্রব্য হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এই মাশরুম খাওয়ার পর জাদুকর একধরনের ঘোরের মধ্যে চলে যেতেন। ফলে দ্রুত তিনি দেবতাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন।
ওরাকল
প্রাচীন গ্রিসের জাদুবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ছিলেন ডেলফির মন্দিরের যাজক ও যাজিকারা। এরা ওরাকল নামে পরিচিত। ধারণা করা হতো, ওরাকলদের সরাসরি দেবতাদের কাছ থেকে আসা বার্তা ও আদেশ বোঝার ও তা থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা রয়েছে।
ডেলফিতে অবস্থিত দেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরের প্রধান যাজিকার নাম ছিল পিথিয়া। এই যাজিকার বয়স ছিল পঞ্চাশের বেশি। তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা বসবাস করতেন এবং সবসময় কুমারীর সাজসজ্জায় থাকতেন। ডেলফির এই মন্দিরের একজন প্রাক্তন যাজক প্লুটার্কের বর্ণনামতে, পিথিয়া প্রথমে মন্দিরের সবচেয়ে ভিতরের কক্ষ আডিটনে প্রবেশ করতেন। এরপর তিনি একটি তেপায়া আসনে বসতেন। এই কক্ষের মেঝের একটি ফুটো দিয়ে মাটির নিচের ফাটল থেকে বেরিয়ে আসতো হালকা গ্যাসযুক্ত ধোঁয়া।
পিথিয়া এই ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করতেন। বর্তমানের ভূতত্ত্ববিদরাও এই ঘটনাটি নিশ্চিত করেছেন। সেই ধোঁয়া গ্রহণের ফলে ঘোরের মধ্যে চলে যেতেন পিথিয়া এবং সেইসময় তিনি দুর্বোধ্য ভাষায় বিড়বিড় করে কথা বলতেন। এই কথা মন্দিরের অন্যান্য যাজকেরা বুঝতেন ও তা সাধারণ মানুষের ভাষায় অনুবাদ করে তাদেরকে জানাতেন। এভাবে সাধারণ মানুষ ওরাকলের মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যৎ জেনে নিতো।
জাদুবিদ্যার এসব অদ্ভুত আচার ও চর্চায় প্রাচীন গ্রিস একসময় পরিপূর্ণ ছিল। এসব নিয়ে বহু গবেষক বহু গবেষণা করেছেন। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনী থেকেও এই জাদুবিদ্যার অনেক তথ্য পেয়েছেন তারা। তবে এখনো প্রাচীন গ্রিসের জাদুবিদ্যার বহু রহস্যময় বিষয় সম্পর্কে গবেষকরা বিস্তারিত জানতে পারেননি। এসব রহস্যময় তথ্য উন্মোচিত হলে হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা ভবিষ্যতে জানতে পারবো।
ফিচার ইমেজ – pinterest.com