১৯৯৫ সালের ১১ ডিসেম্বর আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে ঘটে যায় এক বিয়োগান্তক ঘটনা। সেখানকার লরেন্স নামক স্থানে অবস্থিত বেশ কিছু কাপড় উৎপাদনকারী কারখানায় আগুন ধরে যায়, পুড়ে ছাই হয়ে যায় কারখানার বেশ কিছু ভবন। বিশ শতকের ইতিহাসে ম্যাসাচুসেটসের সবচেয়ে ভয়ংকর অগ্নিকান্ডের ঘটনা ছিল এটি। এই ঘটনায় ৩৩ জন কারখানা শ্রমিক আহত হন।
আমেরিকায় কাপড় উৎপাদনকারী শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই কারাখানা। অগ্নিকাণ্ডের পূর্বে এখানে কাজ করতো প্রায় তিন হাজার শ্রমিক, যাদের মাঝে এক হাজারজন এই ঘটনার পর কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ম্যাল্ডেন মিল কোম্পানিটি তাদের প্যাটেন্ট করা কাপড় ‘ফ্লিস পোলারটেক’ উৎপাদন করতো, বাজারে ছিল এই কাপড়ের বিশাল চাহিদা। এই অগ্নিকান্ডের পর কোম্পানির মালিক অ্যারন ফিউরস্টেইন যা করেছিলেন, তা ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন- একজন মালিক হিসেবে তিনি ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটিকে দেখবেন।
অগ্নিকান্ডের দুই সপ্তাহ পরই ছিল খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ‘বড়দিন’। এরকম সময়ে কর্মীরা কাজ হারিয়ে তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করতে পারবেন না– এটা ফিউরস্টেইন হতে দিতে চাননি। তিনি ঠিক করলেন- কোম্পানির তহবিলে সঞ্চিত অর্থ ও তার ব্যক্তিগত সম্পদের যৌথ উদ্যোগে তিনি একইসাথে পুড়ে যাওয়া কারখানা নতুনভাবে নির্মাণ করতে ব্যয় করবেন, এবং কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা প্রদান করবেন যাতে তারা এই দুঃসময়ে পরিবারকে সাথে নিয়ে ঠিকমতো চলতে পারে। বলা বাহুল্য, তিনি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে নৈতিকতা ও মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে হলেও কারখানার কর্মচারীদের বিপদ থেকে রক্ষার বিষয়টি দেখেছিলেন।
অগ্নিকান্ডটি ছিল ম্যান্ডেন মিলস কোম্পানির ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটের সময়। এই অগ্নিকান্ডের ফলে বাজারে কোম্পানির যে অবস্থান ছিল, সেটি ভেঙে পড়ে এবং সুনাম নষ্ট হয়। অসংখ্য যন্ত্র পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফলে নতুনভাবে শুরু করতে হলে নতুন যন্ত্র স্থাপন করতে হতো। এছাড়া বাজারে তাদের পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তাদের শূন্যস্থান পূরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। এরকম একটা দুর্বিষহ সময় পার করে অতীতের সুসময় ফিরিয়ে আনতে দরকার ছিল বড় অংকের বিনিয়োগ।
বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির এহেন দুঃসময়ে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে কিনা, এটাও ছিল বড় প্রশ্ন। একটি কোম্পানিতে ‘স্টেকহোল্ডার’ বা অংশীদার থাকে অনেক ধরনের মানুষ। প্রতিষ্ঠানকে ঋণদাতা, বিনিয়োগকারী, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ক্রেতা, পরিচালনা পর্ষদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক ও কারখানার মালিক– এরা সবাই একটি প্রতিষ্ঠানের স্টেকহোল্ডার। ফিউরস্টেইন ছিলেন ম্যাল্ডেন মিলসের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। কোম্পানিকে সবধরনের স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ রক্ষা চলতে হয়। সুতরাং ফিউরস্টেইনের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল অনেকগুলো।
তার তখন মূল কাজ ছিল কোম্পানির কারখানা আবার সচল করা, কাজ হারানো শ্রমিকদের আবার কাজে ফেরানো। ছাইয়ের স্তূপ সরিয়ে তিন মাসের মধ্যেই তিনি কারখানা সচল করে ফেলেন। এবার কারখানা কলেবরে আরও বৃদ্ধি পায়। সেই কোম্পানির শ্রমিকরা সেসময় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেতেন। ফলে তাদের মধ্যে এমনিই এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছিল। তার উপর যখন অগ্নিকাণ্ডের পর কোম্পানির মালিক তাদেরকে ছাটাই না করে কর্মহীন অবস্থায়ই পূর্ণ পারিশ্রমিক প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারাও এর প্রতিদান দেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠেন। এর ফলাফল দেখা দেয় অতি দ্রুত। প্রতিষ্ঠানের কারখানা থেকে অগ্নিকাণ্ডের আগে সপ্তাহে ১ লাখ ৩০ হাজার গজ কাপড় উৎপাদন হতো। অগ্নিকান্ডের পর দেখা গিয়েছিল কাপড়ের উৎপাদন বেড়ে সপ্তাহে ২ লাখ গজে পৌঁছেছে। অর্থাৎ পূর্বের চেয়ে চল্লিশ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে ‘ম্যাল্ডেন মিলস কেইস’। এখানে একটি প্রতিষ্ঠান আপদকালীন সময়ে নিজেদের দিক তো দেখেছিলই, পাশাপাশি তাদের কারখানার শ্রমিকদের দিকও গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করেছিল। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়- তারা মাঝে মাঝেই নীতিনৈতিকতাকে পাশ কাটিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থে সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এতে অসংখ্য মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। কিন্তু সমষ্টিগত স্বার্থের দিক বিবেচনা করলে মুনাফা একটু কম হলেও দিনশেষে নৈতিকতার মানদন্ডেও উতরে যাওয়া যায়, ব্যবসাও ঠিক থাকে। ম্যাল্ডেন মিলস কেইস ব্যবসায়িক পরিসরে নৈতিকতা প্রদর্শনের এক ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে স্থান পেয়েছে।