প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধ শেষে নেদারল্যান্ডসের যে সমূহ ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে নিতে তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। একইসাথে নিজেদের মূল শক্তি, নৌবাহিনীর উন্নতিসাধনের প্রয়োজনীয়তাও এস্টেট জেনারেল পরিষদ অনুধাবন করেন। এদিকে ওয়েস্টমিন্সটার চুক্তি সাময়িকভাবে অরেঞ্জিস্টদের দমিয়ে দিয়ে গ্র্যান্ড পেনশনার ডি উইটের রিপাবলিকান বন্ধুদের হাত শক্তিশালী করলেও রাজতন্ত্রপন্থিরা এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না।
নতুন ভূমিকায় ডি রুইটার
যুদ্ধ শেষে ৪৭ বছর বয়স্ক ডি রুইটার ভ্লিসিঞ্জেনে ফিরে গেলেন। তার ইচ্ছা এবার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাবেন। কিন্তু ট্রম্পের মৃত্যুর পর তখন ডাচ নৌবাহিনীতে যোগ্য নেতার আকাল। ফলে নিশ্চিন্তে অবসর কাটানো ডি রুইটারের দোরগোড়াতে এসেই ধর্না দিতে হলো। কর্মকর্তারা হল্যান্ডের নৌবাহিনীর অধিদপ্তরের অধীনে তাকে ভাইস-অ্যাডমিরাল পদ দিতে চাইলেন।
কিন্তু ডি রুইটার অপারগতা প্রকাশ করেন। তার ভয় ছিল- এতে করে অ্যাডমিরাল ডি উইটের মতো ব্যক্তিত্ব, যারা অভিজ্ঞতায় তার থেকে বেশি পরিপক্ক, তাদের সাথে মনোমালিন্য সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু কর্মকর্তারা বারবার অনুরোধ করতে থাকলে বাধ্য হয়ে তিনি গ্র্যান্ড পেনশনারের সাথে সাক্ষাৎ করতে হেগ শহরে এলেন। এখানে ডি উইট ব্যক্তিগতভাবে তাকে দেশের জন্য আরেকবার কাজ করতে অনুরোধ করলে তিনি রাজি হন। কাজের সুবিধার্থে পরিবার নিয়ে তিনি আমস্টারডামে বাসা বাঁধলেন।
দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৬৫৪ সালের ১৭ জুন ডি রুইটার বানিজ্য জাহাজের এক বহরের পাহারায় রওনা হন। তার হুইস টে জুইটেন (Huis te Zwieten) জাহাজের সাথে আরো পাঁচটি রণতরী এই যাত্রায় সঙ্গী হয়।তাদের গন্তব্য ছিল ভূমধ্যসাগর। সেখান থেকে একই বছরের নভেম্বরে তিনি আমস্টারডাম ফিরে আসেন।
১৬৫৫ সালের বসন্তে ডি রুইটারকে আমস্টারডামের একজন বার্গেস (burgess) পদ দেয়া হয়। বার্গেস’রা বরো (এমন একটি এলাকা যেখান থেকে এস্টেট জেনারেল পরিষদে প্রতিনিধি প্রেরিত হতো) এলাকার নির্বাচিত বা মনোনীত কর্মকর্তা ছিলেন।
রাজনৈতিক টানাপোড়ন
ডি রুইটারের জন্ম জিল্যান্ডে। তার জন্মভূমি ভ্লিসিঞ্জেনের অধিকর্তা ছিলেন প্রিন্স অফ অরেঞ্জ। জিল্যান্ডের অধিকাংশ এলাকাতেই তার প্রভাব বিপুল। ফলে হল্যান্ডের পরেই দ্বিতীয় শক্তিশালী প্রদেশ জিল্যান্ডে অরেঞ্জিস্টরা ছিল শক্তিশালী। এস্টেট জেনারেল পরিষদে জিল্যান্ডের সমস্ত প্রতিনিধিরাই ছিলেন অরেঞ্জিস্ট। গ্রনিজেন, ফ্রাইজল্যান্ড আর হল্যান্ডেও তাদের ক্ষমতা প্রসারিত হতে থাকে।
রিপাবলিকানরা যেখানে ছিল প্রধানত অভিজাতশ্রেণী, সেখানে অরেঞ্জিস্টরা কিন্তু সাধারণ জনতার ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ফলে তারা সাধারণ নাগরিকদের দলে ভেড়াতে থাকে। একইসাথে ডি উইটের প্রতিটি পদক্ষেপের নিন্দা জানানোর কৌশল অবলম্বন করা হয়। অরেঞ্জিস্টরা অভিযোগ করতে থাকে- প্রিন্স অফ অরেঞ্জকে ডি উইট এতটাই ঘৃণা করেন যে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তিনি এমনকি পুরো দেশ বিকিয়ে দিতে দুবার ভাববেন না।
ওদিকে ফ্রান্স থেকে শ্যেনদৃষ্টি দিচ্ছেন চতুর্দশ লুই। তার ইচ্ছে ফ্রান্সের সীমানা নেদারল্যান্ডস অবধি বিস্তৃত হোক। কাজেই নেদারল্যান্ডসের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে তিনি দুই রাজনৈতিক পক্ষকেই গোপনে ইন্ধন দিতে থাকেন। তবে উপরে উপরে ডাচদের সাথে ফ্রান্স সুসম্পর্ক বজায় রাখে।
সাগরযাত্রা
৫০টি ডাচ বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে ১৬৫৫ সালে ডি রুইটারের নেতৃত্বে ১০টি রণতরী রওনা হলো। ভূমধ্যসাগরে দিয়ে যেতে হবে তাদের, সেখানে তখন বার্বারি আর অন্যান্য জলদস্যুদের আনাগোনা। এর সাথে যোগ হয়েছে ফরাসি প্রাইভেটিয়ার। প্রাইভেটিয়াররা মোটাদাগে রাষ্ট্রস্বীকৃত জলদস্যুর মতো কাজ করত। যুদ্ধকালে রাজা বা রানী তাদের জাহাজ দিয়ে শত্রুদের যেকোনো জাহাজে হামলা করার অনুমতি প্রদান করতেন।
লুটপাট করে যে মালামাল পাওয়া যেত তার একাংশ এরা রাজকীয় কোষাগারে জমা দিত। এই পদ্ধতিতে রাজকীয় নৌবহরকে ব্যবহার না করেই শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা যেত। আবার বিনা পয়সায় প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার পাশাপাশি মুফতে কিছু অর্থলাভও হতো।
যাত্রাপথে দেখা মিলল অ্যাডমিরাল ব্লেকের। তিনি তখন সাগরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন। একসময় প্রতিপক্ষ হলেও দুই অ্যাডমিরাল একে অপরের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ওয়েস্টমিন্সটার চুক্তি অনুযায়ী ডাচরা প্রথমে তাদের পতাকা অর্ধনমিত করে, এরপর রয়্যাল নেভি তাদের স্যালুটে অনুরূপ সাড়া দেয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে ডি রুইটার ব্লেকের জন্য কিছু পানীয় প্রেরণ করেন, আর ব্লেক তাকে পাঠালেন ব্রিটিশ জ্যাম।
ব্লেকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিব্রাল্টারে প্রবেশ করল ডাচ বহর। ইউরোপ, বিশেষ করে দক্ষিণ ইউরোপে বাণিজ্যের পথ সুগম কোর্টে এই অঞ্চল নিরাপদ রাখা দরকার ছিল ডাচদের। শুধু ডাচ নয়, অন্যান্য ইউরোপিয়ান পরাশক্তির কাছেও এখানকার নৌপথ ছিল অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
জিব্রাল্টার দিয়ে চলাচল করা জাহাজগুলো প্রায়ই উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে, যেমন- সালে, রাবাত, আলজিয়ার্স, তিউনিস, ত্রিপোলি ইত্যাদিতে ঘাঁটি করে থাকা বার্বারদের হাতে আক্রান্ত হতো। ফরাসি প্রাইভেটিয়ারদের মতো তারা ছিল অটোমান প্রাইভেটিয়ার। তাদের অটোমান বা বার্বার কর্সেয়ারও (Barbary corsairs or Ottoman corsairs) বলা হতো। ফলে উত্তর আফ্রিকার উপকূলকে ইউরোপিয়ানরা বলত বার্বারি উপকূল। এই জলদস্যুদের হাত থেকে ডাচ বাণিজ্য বহর নিরাপদ রাখতে অভিযান পরিচালনা করছিলেন ডি রুইটার।
আলজিয়ার্স তখন অটোমান সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য। ১৭২৬ সালে চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি হবার আগে প্রায় ৮৮ বছর ধরে নেদারল্যান্ডসের প্রজাতন্ত্রের সাথে তাদের থেমে থেমে চলছিল সংঘাত। তাদের অ্যাডমিরালের অধীনস্থ বহর সেই সময় ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। সেই সূত্রে তাদের বহরের কয়েকটি জাহাজ দখল করে তাড়িয়ে দিলেন ডি রুইটার। এরপর তিনি উপস্থিত হন বর্তমান মরক্কোর উত্তরপশ্চিমের বন্দরনগরী সালেতে।
সালেতে নগরপ্রধানের সাথে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মোতাবেক সালে’র বন্দর ব্যবহার করে বার্বার কর্সেয়ারদের যাতে ডাচ জাহাজের আক্রমণ করতে না পারে সেই বিষয়ে আলাপ আরম্ভ হলো। আশেপাশের সাগরে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য সাময়িকভাবে দমন করে এরপর ১৬৫৬ সালের মে-তে ডি রুইটার দেশে ফিরে এলেন।
মে মাসের শেষদিকে ডি রুইটার বাল্টিক সাগরের দিকে পাল তুললেন। এবার তার সঙ্গী ভন ট্রম্পের ছেলে, তার নামও ট্রম্প। পোল্যান্ড আর সুইডেনের মধ্যে নর্দার্ন ওয়ারের কারণে বাল্টিকে ডাচ জাহাজের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেটা নিশ্চিত করাই তাদের উপর নির্দেশ ছিল। ২৫টি রণতরীর এই বহর প্রথমে ডি রুইটারের অধীনে ছিল, পরে লেফটেন্যান্ট-অ্যাডমিরাল অপড্যাম ওয়াসেনার সেই দায়িত্ব বুঝে নেন।
বাল্টিকের পরিস্থিতি মোটামুটি ঠাণ্ডা হয়ে এলে ডাচ বহর সরিয়ে আনা হয়। ডি রুইটার চলে যান স্পেনের কাদিজে। ভূমধ্যসাগরে তখন ফরাসি প্রাইভেটিয়াররা নানাভাবে ডাচ বনিকদের উত্যক্ত করছে, যদিও নেদারল্যান্ডস আর ফ্রান্সের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। চতুর্দশ লুই গোপনে গোপনে প্রাইভেটিয়ারদের ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছিলেন, উদ্দেশ্য ডাচ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করা যা তার নেদারল্যান্ডস দখলের মহাপরকল্পনার অংশ। কাজেই ডি রুইটার কাদিজকে কেন্দ্র করে আশেপাশে টহল জারি করেন।
১৬৫৭ সালের শেষদিকে ডি রুইটার আবার সালেতে ফেরত গেলেন। আগের বছর নগরপ্রধানের সাথে আলোচনার সমাপ্তি টানা হলো আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে, যাতে সালের এলাকা ব্যবহার ডাচ বহরের উপর আক্রমণ চালাবে এমন জাহাজের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ডি রুইটার বেরিয়ে এসে দেখা পেলেন একদল ফরাসি প্রাইভেটিয়ারের। তাদের ধাওয়া দিয়ে একটি জাহাজ ছিনিয়ে নিলেন তিনি, বাকিরা দ্রুত ইটালির স্পেজিয়া বন্দরে ঢুকে আত্মরক্ষা করল।
ডি রুইটার তাদের অবরোধ করে রাখলেন। ফরাসি রাজপ্রতিনিধি আর নেদারল্যান্ডস সরকার প্রাইভেটিয়ারদের ব্যাপারে আলোচনা করে মোটামুটিভাবে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর পর তিনি অবরোধ তুলে নিয়ে কাদিজে ফিরে যান।
পর্তুগাল
ভূমধ্যসাগর আর তার পার্শ্ববর্তী সাগরে ডাচ জাহাজের ক্রমাগত উপস্থিতির মূল কারণ ছিল জিব্রাল্টার প্রণালী নিরাপদ রাখা, কারণ এখান দিয়েই ডাচ বাণিজ্য জাহাজের সিংহভাগ চলাচল করত। কাজেই জিব্রাল্টার বিপদজনক হয়ে ওঠা মানে নেদারল্যান্ডসের অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়া। সেই কারণে ডি রুইটারকে প্রায়ই সেদিকে পাঠানো হতো।
এরকম এক অভিযানে থাকার সময় তাকে দিক পাল্টে পর্তুগালে যেতে বলা হলো। ১৬৫৭ সালে অপড্যামের অধীনে তিনি পর্তুগালের ট্যাগাস নদীর মুখ অবরোধ করে বন্দরে থাকা সমস্ত জাহাজ আটকে দেন। ব্রাজিলের উপনিবেশ নিয়ে পর্তুগাল আর নেদারল্যান্ডসের রেষারেষির জেরে এই ঘটনা ঘটে, যা পরে যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়।
ট্যাগাসের অবরোধে চিনিবাহী দশটি পর্তুগিজ জাহাজ ডাচরা ছিনিয়ে নেয়। ডি রুইটারের উপর দায়িত্ব পড়ল এগুলো দেশে নিয়ে যাবার। ঝড়ঝঞ্ঝা পাড়ি দিয়ে ১৬৫৭ সালের ৬ ডিসেম্বর টেক্সেলে এসে পৌঁছলেন ডি রুইটার।
১৬৫৮ সালের শুরুতেই ২২টি জাহাজ নিয়ে আবার পর্তুগালের উপকূলের দিকে রওনা হন ডি রুইটার। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে পৌঁছতে পৌঁছতে জুন মাস চলে এলো। পর্তুগিজরা তার সাথে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি নিল না। ফলে ফাঁকা মাঠে একাই গোল দিতে লাগলেন তিনি। অবরোধ আর একের পর এক পর্তুগিজ বাণিজ্য জাহাজ হাত করে তাদের অর্থনীতি মোটামুটি অচল করে দেন।
ডেনমার্কের সহায়তায়
তৎকালীন পরাশক্তি সুইডেন বাল্টিক অঞ্চলজুড়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিল। ১৬৫৬ সালে ইংল্যান্ডের সাথে চুক্তি সম্পাদন করে তারা বাল্টিকের ব্যাপারে ইংল্যান্ডের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে। এরপর ডেনমার্কের সাথে তাদের সংঘাত বেধে গেলে ড্যানিশ রাজা মিত্র হিসেবে ১৬৫৮ সালে নেদারল্যান্ডসের সাহায্য চেয়ে বসেন।
বাল্টিক সাগর চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখা নেদারল্যান্ডসের অন্যতম নীতি, সুতরাং ড্যানিশদের সাহায্যে ২,০০০ সৈনিক নিয়ে ওয়াসেনার সেদিকে যাত্রা করলেন। সুইডিশরা ততদিনে বাল্টিকের উপকূলে কামান বসিয়ে ফেলেছে। ডাচদের দেখেই তারা গোলা ছুড়তে শুরু করল। এর ভেতরেই ১৬৫৮ সালের ৮ নভেম্বর ওয়াসেনার বাল্টিক উপকূলে চলে আসেন। ডাচ সেনারা তীরে নেমে তুমুল লড়াইয়ের পরে সুইডিশদের হটিয়ে দেয়।
বিজয়ের খবর পেয়ে এস্টেট জেনারেলরা নতুন পরিকল্পনা সাজালেন। তারা অনুমান করেছিলেন এই যুদ্ধে নৌবাহিনীর থেকে সেনাবাহিনী বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কাজেই ওয়াসেনারকে ডেকে পাঠিয়ে তারা ডি রুইটারকে তার জায়গায় প্রেরণ করেন। কর্নেল কিল্গ্রিউয়ের ৪,০০০ সৈন্যকে চারটি রণতরীর পাহারায় তিনি বাল্টিকে নিয়ে যেতে প্রস্তুত হন।
এর মধ্যেই অলিভার ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর তার ছেলে রিচার্ড পিতার স্থলাভিষিক্ত হলেন। তিনি মিত্র সুইডিশদের জন্য বাল্টিকে রয়্যাল নেভির একটি বহর প্রেরণ করলে ডি রুইটারের অভিযান পিছিয়ে যায়। এই অবসরে ৬,০০০ সেনা নিয়ে সুইডেনের রাজা দশম চার্লস (Charles X Gustav) ডেনমার্কের ফুনেন দ্বিপ দখল করে নেন।
শেষ পর্যন্ত ১৬৫৮ সালের ২০ মে টেক্সেল থেকে ৪৫টি জাহাজ নিয়ে কোপেনহেগেনর উদ্দেশ্যে বের হলেন ডি রুইটার, তার উপর স্পষ্ট নির্দেশ রয়্যাল নেভি সরাসরি তাদের উপর আক্রমণ না করলে তাদের সাথে কোনো গন্ডগোলে জড়ানো যাবে না। জুলাই মাসের ১৮ তারিখ কোপেনহেগেন পৌঁছে ডাচরা। সিদ্ধান্ত হল তাদের সাহায্যে ফুনেন পুনর্দখলের।
সেই অনুযায়ী ১০০ জাহাজে অশ্বারোহী আর ইনফ্যান্ট্রি মিলিয়ে প্রায় দশ হাজার সৈনিক নিয়ে ৮ নভেম্বর ফুনেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর নেইবোর্গের সাগরপাড়ে দেখা দিলেন ডি রুইটার। কিন্তু শহরে ছিল সুইডিশদের শক্ত ঘাঁটি। তাদের কঠিন প্রতিরোধে তীরে সেনা নামানো অসম্ভব প্রতীয়মান হয়।
পরদিন ডি রুইটার ড্যানিশ জেনারেলদের কাছে তার প্রস্তাব পেশ করলেন। তার কথা ছিল শত্রুদের ধোঁকা দেবার জন্য রাতে সৈকতে নামার ছল করা হোক। তাদের নজর সেদিকে সরিয়ে রেখে তারা চলে যাবেন ফুনেনের পূর্ব উপকূলে, নেইবোর্গের থেকে ১০-১২ মাইল দূরের কার্টমুন্ড (Kiertemunde) শহরে। সেখানে সেনাদল নামিয়ে নেইবোর্গে হামলা করা হবে। তার পরামর্শমতো রাতে সুইডিশদের দেখিয়ে পানিতে নামানো হলো নৌকা, এরপর ভোরের দিকে হঠাৎ করেই জাহাজ রওনা দিল কার্টমুন্ড বরাবর।
দুপুরের দিকে কার্টমুন্ডের অদূরে নোঙ্গর করে সাগরতীরে থাকা শত্রু ঘাঁটি কামান দেগে ব্যস্ত করে তোলা হলো। এরপর ২টার দিকে মার্শাল শ্যাকের (Schack) নেতৃত্বে ড্যানিশ সৈন্যরা নৌকায় তীরের দিকে যাত্রা করে, ডি রুইটারও ডাচদের নিয়ে তাদের সঙ্গী হলেন। তীরে টিকে থাকা সুইডিশ সেনাদের কামানের মুখে অবিচল ডি রুইটার সেনাদের উৎসাহ দিয়ে তীরে অবতরণ করলেন। কঠিন লড়াইয়ের পর কার্টমুন্ড কব্জা করা হলো।
এক সপ্তাহ কার্টমুন্ডে রসদপত্র আর যুদ্ধ সরঞ্জামের জোগাড়যন্ত্রের পর নেইবোর্গের দিকে মার্চ করল যৌথ সেনাদল। তুষারের মধ্যে শহরের বাইরে এক পাহাড়ের ঢালে ২৩ নভেম্বর তারা ৭,০০০ সেনার সুইডিশ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। ড্যানিশদের কমান্ড করছিলেন শ্যাক আর প্রিন্স অফ সুল্টসব্যাখ। ডি রুইটার আর ডাচ সেনারা মধ্যভাগে দাঁড়াল, দুই পাশে ছিল ড্যানিশ ইনফ্যান্ট্রি আর অশ্বারোহী।
লড়াই আরম্ভ হলে ড্যানিশরা প্রথমে আক্রমণ করে। সুইডিশ সৈন্যরা তাদের প্রতিহত করে পেছনে ঠেলে দিলে ড্যানিশ ব্যুহে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। এই পরিস্থিতিতে ডাচ সৈনিকেরা অগ্রসর হয় এবং পলায়নরত ড্যানিশদের ধাওয়া করতে থাকা সুইডিশদের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে পালাতে থাকা ড্যানিশদের একাংশও পুনরায় সংগঠিত হয়ে ডাচদের সাথে যোগ দিয়ে শত্রুদের কচুকাটা করে ফেলে। তবে নেইবোর্গে থেকে যাওয়া সুইডিশ গ্যারিসন প্রতিরোধ চালিয়ে যায়।
এই বিজয়ের পর ২৫ নভেম্বর ডেনমার্কের উপকূলে কয়েক স্থানে অবরোধ জারি করে ডি রুইটার নুশোভেট (Knutshovet) দুর্গে হামলা করেন।নুশোভেট ছিল নেইবোর্গের নিকটবর্তী স্লিপশ্যাভেন (Slipshaven) বন্দরের প্রবেশদ্বার। কাজেই দুর্গ অধিকার করে এখানেই নোঙ্গর করেন ডি রুইটার। স্লিপশ্যাভেন থেকে এরপর নেইবোর্গের উপর চালানো হলো ভয়াবহ গোলাবর্ষণ। অনন্যোপায় সুইডিশরা বাধ্য হলো আত্মসমর্পণে। এরপর ডি রুইটার রসদপত্রের যোগান নিতে বাল্টিকের তীরে লুবেকে চলে যান।
নেইবোর্গের পর ফুনেনে পুনরায় ড্যানিশ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে দশম চার্লস শান্তির চিন্তা করলেন। ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডও সব পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ করার চাপ দিতে থাকে। ১৬৫৯ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাথমিক একটি চুক্তির খসড়া আলোচনার জন্য অনুমোদিত হলো।
ফুনেনে ডি রুইটারের অবদানের জন্য ডেনমার্কের রাজা তাকে প্রচুর পুরস্কারে ভূষিত করেন। ডি রুইটার ও তার পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মান বরাদ্দ হয়। এস্টেট জেনারেলরাও ডি রুইটারকে প্রশংসাপত্র প্রেরণ করলেন। লুবেক থেকে ফিরে ডি রুইটার তখন অবস্থান করছিলেন কোপেনহেগেনে। তীব্র শীতের কারণে ১৬৬০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি একরকম বন্দী হয়ে ছিলেন এখানে।
শীত কেটে গেলে ডি রুইটার ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৬৬০ সালে সুইডেনের ল্যান্ডস্ক্রোনা (Landscrona) বন্দরের দিকে কয়েকটি জাহাজ পাঠিয়ে দেন। তার কাছে খবর আছে সেখানে ৩৬টি যুদ্ধজাহাজ জড়ো করা হয়েছে। চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি যেহেতু স্বাক্ষরিত হয়নি, তাই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এ কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। কে জানে সুইডিশ রাজার মাথায় কী আছে! তবে মাত্র তিনদিন পরেই দশম চার্লসের মৃত্যু হলে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা হ্রাস পায়।
তা সত্ত্বেও ডি রুইটার ল্যান্ডস্ক্রোনা অবরোধ করে রাখেন। ৩ মার্চ থেকে তিনি নিজে অবরোধে যোগ দেন। ২৭ মে আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেই (Treaty of Copenhagen) কেবল তিনি অবরোধ উঠিয়ে নেন। এরপর কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে দেন জিল্যান্ডে আটকে পড়া সুইডিশ সেনাদের নিজ দেশে পৌঁছে দিতে। এর জন্য সুইডেনের তরফ থেকে ধন্যবাদ পেলেন ডি রুইটার।
ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় চার্লস
১৬৫৮ সালে অলিভার ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর তার মতো শক্তিশালী নেতা ইংলিশ কমনওয়েলথ পায়নি। রিচার্ড ক্রমওয়েল বাবার লর্ড প্রটেক্টর উপাধি ধারণ করলেও ক্ষমতা ধরে রাখার মতো শক্ত লোক ছিলেন না। ফলে ক্রমওয়েলের বিলোপ করা রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কোনো বাধা থাকল না।
প্রাথমিকভাবে রাজতন্ত্রপন্থীরা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলে তাদের দমন করা হয়। কিন্তু হাওয়া বদলে যাচ্ছে দেখে ক্রমওয়েলের কয়েকজন অনুসারী দল পরিবর্তন করেন। তাদের একজন, জেনারেল জর্জ মঙ্ক, ফার্স্ট ডিউক অফ অ্যাল্বারমার্লে স্কটল্যান্ড থেকে সসৈন্যে ১৬৬০ সালে লন্ডনের দিকে যাত্রা করেন। তিনি রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হলেন।
দ্বিতীয় চার্লস নির্বাসন কাটাচ্ছিলেন নেদারল্যান্ডসের ব্রেডা শহরে। তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো দেশে ফিরে জন্মগত অধিকার, ব্রিটিশ সিংহাসন বুঝে নেবার। ব্রেডা থেকে চার্লস প্রথমে এলেন আমস্টারডাম। এস্টেট জেনারেলদের অনুষ্ঠানে ইনিয়ে বিনিয়ে জানালেন নেদারল্যান্ডসের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা, ভাইপো তৃতীয় উইলিয়ামের প্রতি ভালোবাসার কথা। প্রতিশ্রুতি দিলেন সিংহাসনে বসে নেদারল্যান্ডস আর ইংল্যান্ডের সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা করবেন তিনি।
৯ মে, ১৬৬০।
লন্ডনে বিপুল জনসমাগমের মাঝে দেশের মাটিতে পা রাখলেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস। ১৬৬১ সালের ২৩ এপ্রিল তার অভিষেক অনুষ্ঠান হলো। পরবর্তী চার বছরের মধ্যেই তিনি নেদারল্যান্ডসের সাথে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন বটে, তবে তা সুসম্পর্কের নয়, নতুন যুদ্ধের।