বিচারের কাঠগড়ায় নাৎসি যুদ্ধবাজরা

১৯৪৫ সালের এপ্রিল। সোভিয়েতদের লাল পতাকা বার্লিনে ওড়া তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বার্লিন ছেড়ে পালানোর জন্য হিটলারকে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সামরিক অফিসার সবাই অনুরোধ করলো। তিনি রেড আর্মির হাতে ধরাও দিলেন না আবার বার্লিন থেকে পালিয়েও গেলেন না। ৩০ এপ্রিল লাখ লাখ মানুষকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হিটলার আত্মহত্যা করেন। এর ৮ দিন পর বার্লিনের পতন হয়।

বার্লিনে সোভিয়েত পতাকা; Image Source: earthporm.com

যুদ্ধ বাঁধলে যুদ্ধাপরাধ কম-বেশি হয়েই থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ করেছিল নাৎসি জার্মানি। মিত্রবাহিনীরা যে একদম নিষ্পাপ ছিল সেটাও কিন্তু নয়। জাপানে পারমাণবিক হামলা করে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা মানবসভ্যতায় অনন্তকাল মানবিকতার পরাজয় বলেই বিবেচিত হবে। প্রচুর নাৎসি নেতা ইউরোপজুড়ে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি লিপ্ত ছিলেন। লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের কি সাজা হওয়া উচিত নয়? 

অবশ্যই তাদের সাজা হতে হবে। কিন্তু সেই সাজা কে দেবে? কোন আলাদতে তাদের বিচার হবে? তখনো আন্তর্জাতিক আদালতের কোনো নজির সৃষ্টি হয়নি। অক্ষশক্তির যুদ্ধাপরাধীদের কীভাবে বিচার করা যেতে পারে এটা নিয়ে মিত্রশক্তির মধ্যে স্পষ্ট বিভেদ দেখা দেয়। মিত্রবাহিনী প্রথমে জার্মান আদালতকে প্রায় ৯০০ জন নাৎসি নেতার বিচারের নির্দেশ দেয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিবাদের জন্য বিচার হয় মাত্র ১২ জনের। এর মধ্যে ৬ জনকে আবার দাঙ্গাবাজরা জেল থেকে বের করে নিয়ে যায়।

তেহরানে মিত্রশক্তির নেতাদের এক নৈশভোজে স্তালিন অনেকটা কৌতুক করেই প্রস্তাব করেন প্রথম সারির ৫ হাজার নাৎসিকে গুলি করা যেতে পারে। আমেরিকার তখনকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। তিনিও প্রস্তাবে মৌখিক সায় দেন। এতে অবশ্য ব্রিটেন ক্ষিপ্ত হয়। তবে রুজভেল্টের নাৎসিদের নিয়ে আগ্রহ একটু কম ছিল। তার চোখের বিষ জাপানিরা, যারা হঠাৎ করেই পার্ল হারবার আক্রমণ করে বসে।

রুজভেল্ট মারা যাওয়ার পর হ্যারি ট্রুম্যান ক্ষমতায় আসেন। এবার সবার মনে বিচার কাজ শুরু হবার আশা বাঁধতে শুরু করে। জুনের শেষ দিকে সোভিয়েত, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। উদ্দেশ্য, একটা ট্রাইবুনালের ভিত্তি তৈরি করা।

এবার সমস্যা দেখা দিল বিচারব্যবস্থা নিয়ে। ৪ দেশের মধ্যে ২ রকম আইনব্যবস্থা ছিল। একধরনের বিচারব্যবস্থায় বিচারক নিজেও সক্রিয় তদন্তকর্তার ভুমিকা পালন করবেন। আরেকটিতে হবে প্রথাগত বিচার, দুই পক্ষের আইনজীবীরা প্রমাণ উপস্থাপন করবেন। সব বিবেচনা করে রায় দেবে আদালত। শেষমেশ দুই আইনব্যবস্থার সমন্বয়ে বিচারকাজ চালানোর সিদ্ধান্ত হলো।

কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে হত্যার আগে বন্দীদের হাত থেকে আংটি খুলে রাখা হতো। আংটির পরিমাণই বলে দিচ্ছে কেমন হত্যাযজ্ঞ চলেছিল তখন; Image Source: Nebe

এবার মিত্রশক্তি বিচারকাজের জন্য আদর্শ স্থান খুঁজতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই বার্লিনের নাম প্রথমে আসে। কিন্তু বার্লিনে এমন কোনো ভবনই পাওয়া যায় না যেটা অক্ষত আছে এবং বিচারকাজ চালানোর জন্য উপযুক্ত। জার্মানিকে তখন চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে মিত্রশক্তির চার দেশ। সোভিয়েতের আওতায় থাকা নুরেমবার্গের কারাগার আর তার পাশের একটি ভবন পছন্দ হয় সবার।

নুরেমবার্গের এই ভবনে হয়েছিল বিচারকাজ। ২০০৯ সালে তোলা ছবি; Image Source: Pinterest

চার রাষ্ট্র লন্ডনে বিচারব্যবস্থার দলিলে সাক্ষর করে। ট্রাইবুনালের নীতিমালা, অভিযোগের ধরন এসব উল্লেখ করা ছিল দলিলে। ৪ ধরনের অভিযোগের জন্য কোনো অপরাধীকে অভিযুক্ত করা যেত।

১. চক্রান্ত: এমন কিছু কাজকে অপরাধের মধ্যে আনে যাদেরকে এতদিন সরাসরি অপরাধ বলা হতো না। একজন পেশাদার খুনিকে বন্দুক ভাড়া দেওয়াটা চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের আওতায় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। একজন সৈনিক আদেশ পালনের দোহাই দিয়ে অপরাধীর তকমা থেকে যেন বাঁচতে না পারে সেজন্য এ ধরনের অভিযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়।

২. আক্রমণাত্মক যুদ্ধ: বিনা উস্কানিতে এবং চুক্তি ভঙ্গ করে আগ্রাসন।

৩. যুদ্ধাপরাধ: যুদ্ধের প্রচলিত প্রথার বরখেলাপ। যেমন আত্মসমর্পণ করলে শত্রুকে হত্যা করা যাবে না অথবা বেসামরিকদের হত্যা করা যাবে না। একইসাথে বেসামরিকদের সম্পদের ক্ষতিসাধন করা যাবে না।

৪. মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ: যুদ্ধের আগে, পরে এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লোকজনকে বিনা কারণে হত্যা, ধর্ষণ, দাস হিসেবে ব্যাবহার করা, স্থানচ্যুত করা এবং ধর্ম বা জাতিভেদে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করা।

চার ধরনের অপরাধের তদন্তের কাজ চার দেশ ভাগ করে নেয় এবং অনুসন্ধান শুরু করে কাদের কাদের অভিযুক্ত করা যায়। নাৎসি প্রশাসন কীভাবে কাজ করতো এটা নিয়েই অনেক ধোঁয়াশা ছিল। তার উপর হিটলার, গোয়েবলস, হিমলারের মতো প্রথম সারির অনেক নেতা তখন মৃত।

প্রথমদিকে হিটলারের নামও ছিল অভিযুক্তের তালিকায়। কারণ হিটলারের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। অক্টোবরে প্রথম ২৪ জন অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করা হয়। দেখা গেল তালিকায় পক্ষ পরিবর্তন করা লোক এমনকি ১৯৪১ সাল থেকে বিছানায় পড়ে থাকা ব্যক্তির নামও আছে। শেষ পর্যন্ত আবার যাচাই বাছাই করে ২৪ জনের (২ জন পলাতক) বিচার শুরু হয়। এরা ছাড়াও ৭ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং বিচার হয়েছিল। বিচারকাজ যেখানে হয়েছিল, নুরেমবার্গের সেই ভবনের নাম দেওয়া হয় ‘প্যালেস অব জাস্টিস’।

আদালতে অভিযুক্ত যুদ্ধবাজরা; Image Source: Timetoast

চার দেশ থেকেই বিচারক এবং প্রসিকিউর নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি ছিলেন ব্রিটেনের গাফারি লরেন্স। জার্মান কোনো বিচারপতি ছিল না সেখানে। সেজন্য কিছুটা বিতর্কিত হতে হয়েছিল এই আদালতকে। মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করা হয় কিন্তু আদালত সেটা গ্রহণ করেনি। যেমন জার্মানির ড্রেসডেন শহরে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর এয়ার মার্শাল হ্যারিস ব্যাপকভাবে বোমা বর্ষণের নির্দেশ দেন যার ফলে প্রায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। উল্লেখ্য ড্রেসডেন শহরটি সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক কারণে ব্রিটেনের অক্সফোর্ডের মতোই  বিখ্যাত। 

ক্ষতবিক্ষত ড্রেসডেন শহর; Image Source: britannica.com

নুরেমবার্গের বিচারে ১২ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১ জন পলাতক ছিলেন। বাকি ১১ জনকে একই দিনে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কী অপরাধে আট বর্গফুট ফাঁসির মঞ্চ এই ১২ জনের জীবনের শেষ মঞ্চ হলো তা দেখে নেওয়া যাক। 

হারমান গোয়েরিং

তার আইকিউ স্কোর ছিল ১৩৮, যা যথেষ্ট ভালো মেধার পরিচয় দেয়। মস্তিস্কের পুরোটাই ঢেলে দিয়েছিলেন অমানবিক কাজে। ১৯৩৪ সালে গেস্টাপো বাহিনী ৮৫ জন রাজনীতিবিদকে হত্যা করে। আর এর নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। পরের বছর তিনি জার্মান বিমান বাহিনীর প্রধান হন। ১৯৩৯ সালে তাকে হিটলার নিজের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা দেয়।

ইহুদীদের বিতারিত করা, হত্যা করা এবং তাদের সম্পদ দখল করে নেওয়া ছিল তার পরিকল্পনা। নাৎসিদের ৪ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার পরিচালক ছিলেন তিনি। জার্মান বিমান আগ্রাসনের সব পরিকল্পনাও ছিল তার। ১৯৪০ সালে হিটলার তাকে  ‘রাইখমার্শাল’ পদে উন্নীত করেন (জার্মান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্টের দাপ্তরিক নাম রাইখমার্শাল)।

আত্মসমর্পণের পরেও হল্যান্ডের রটারড্যাম শহর ধ্বংস, পোলিশ বুদ্ধিজীবী হত্যা, যুদ্ধবন্ধীদের হত্যা এবং ফ্রান্সের জাদুঘর লুট করার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। বিচারে তার ফাঁসি হয়।

গোয়েরিং এর মৃতদেহ; Image Source: ushmm.org

১৬ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহরে ফাঁসি কার্যকর হবে এটা দণ্ডপ্রাপ্ত বেশিরভাগ আসামী জেনে যায়। রাত ১টা ৪৫। কারাগারের কক্ষের একটি স্থানে গোয়েরিং গার্ডের চোখের আড়াল হন। টয়লেটের কয়েক ফুটের দেয়াল। সেখানে বসলেই গার্ডের নজর থেকে বাঁচা সম্ভব। কাঁচের একটি ক্যাপস্যুল বের করলেন তিনি। মুখে নিয়ে কামড় দেওয়া মাত্রই একটি তরলে তার মুখ ভরে যায়। সায়নাইড! তীব্র খিঁচুনির শব্দ গার্ড পেয়েছিল। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। আত্মহত্যা করে গোয়েরিং। বাকিরা যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে তাই সবাইকে হাতকড়া পরানো হয়।

জোয়াকিম ভন রিবেনট্রপ

ব্যবসায়ী হিসেবে দুনিয়া ঘুরে বেড়াতেন এবং নাৎসি বাহিনীর নেতাদের চেয়ে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল ভালো। ১৯৩২ সালে প্রথম হিটলারের নজরে আসেন তিনি। ১৯৩৩ সালে তার বাড়িতেই এক গোপন বৈঠক হয় যেখানে হিটলারকে জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি পরে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ইতালিকে অক্ষশক্তিতে আনা ছিল তার কূটনৈতিক সাফল্য। অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়া আক্রমণের পরিকল্পনায় ছিলেন তিনি। ইহুদী হত্যার পেছনেও তার সমর্থন ছিল। বিচারে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং বলেন তিনি হিটলারের আদেশ পালন করে গেছেন মাত্র।

প্রথম ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল গোয়েরিংয়ের। কিন্তু তার আত্মহত্যার কারণে রেবেনট্রপকে প্রথম ঝুলতে হয় ৩৩ ফুট দড়িতে। 

ফিল্ড মার্শাল উইলহেম  কেইটেল

তিনিই প্রথম সামরিক কর্মকর্তা যার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে নতুন আন্তর্জাতিক আইনে। তার ফাঁসি এই বার্তাই দেয় ‘রাজনীতিবিদরা যুদ্ধ বাঁধাতে বলেছে, পেশাদার সৈনিক হুমুক পালন করেছে’ এই যুক্তি যেন ভবিষ্যতে না খাটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকের সব অপারেশনের প্রাথমিক পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন। ফ্রান্স দখলের পর হিটলার তাকে ফিল্ড মার্শালে উন্নীত করেন। জার্মান জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন যে কাউকে গ্রেফতারের জন্য তিনি একটি আইন প্রণয়ন করেন। নামমাত্র কোর্ট মার্শালে তাদের ফাঁসি দেওয়া হতো। নিজের ফাঁসির মঞ্চে তিনি নাৎসি কায়দায় স্যালুট দেন এবং নিহত জার্মান সেনাদের জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফাঁসিতে ঝুলে পড়েন। 

আর্নেস্ট কালটেন ব্রুনার

ড. ব্রুনার ছিলেন রাইখের কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা কার্যালয়ের প্রধান। হিটলারের গোপন বাহিনী ‘এসএস’ এর যেসব কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছিল তাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন। কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদীদের পোড়ানো, শ্রমিক হিসেবে বন্ধীদের ব্যাবহার করা এবং দুর্বলদের হত্যা করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ৩ এবং ৪ নম্বর অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।

কর্তব্য পালনের দোহাই দিয়ে নিজেকে নির্দোষ বলার চেষ্টা করেন ফাঁসির মঞ্চে।

আলফ্রেড রোজেনবার্গ

পূর্ব ইউরোপে দখল করা অঞ্চলের মন্ত্রী হিসেবে তাকে নিযুক্ত করা হয়। দখল করা এলাকায় আগের সকল আইন বাতিল করে জোর-জবরদস্তিমূলক নতুন আইনের প্রণেতা ছিলেন তিনি। ৪০ হাজার আটক যুবককে শ্রমিক হিসেবে খাঁটাতে বাধ্য করেছিলেন। ইহুদীদের সম্পদ দখল করাও তার নির্দেশে হয়েছিল।

ফাঁসির দড়িতে সবচেয়ে কম সময় নিয়ে মারা যান তিনি, মাত্র ৯০ সেকেন্ডে। 

হ্যানস ফ্রাঙ্ক

হিটলারের ব্যক্তিগত আইনজীবী থেকে ধীরে ধীরে ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন তিনি। পোল্যান্ড দখলের পর হিটলার তাকে পোল্যান্ডের প্রধান বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করে। পোল্যান্ড থেকে ইহুদী বিতারণ, ৪টি কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি, বন্দীদের দাস হিসেবে ব্যাবহার করার অভিযোগ প্রমাণিত হয় তার বিরুদ্ধে। 

ফাঁসির পূর্বে নিজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বিশেষ কিছু বলেননি।

উইলহেম ফ্রিক

১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। গোয়েরিংয়ের সাথে কাজ করতেন। নুরেমবার্গ আইন নামের একটি আইন প্রবর্তন করেছিলেন। এই আইনের ফলে অনেক বন্দীকে কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো সহজ হয়। অপরাধের সত্যতা পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে। উইলহেমের সর্বশেষ কথা ছিল জার্মানি দীর্ঘজীবী হোক।

জুলিয়াস স্ট্রেইশার

তিনি ছিলেন একজন লেখক, সম্পাদক এবং প্রকাশক। ক্ষমতায় থাকাকালীন ঝলমলে পোশাকের জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন। উগ্রবাদী ইহুদীবিদ্বেষী বক্তব্য প্রচার করে তিনি হত্যার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতেন। এই কাজ ছিল অনেকটা ব্রেইন ওয়াশের মতো। এতে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছিলেন। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

ফাঁসির সময় মঞ্চের সিঁড়ির গোঁড়ায় মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলেন, “হেইল হিটলার”।
অনুষ্ঠানিকতার খাতিরে সবার নাম জিজ্ঞেস করা হয়। “আপনার নাম?” আমার নাম খুব ভালো করেই জানেন আপনারা, স্ট্রেইশারের উত্তর। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেসের পর তিনি তার নাম বলেন।

আর্থার সেইস-ইনকোয়ার্ট

তিনি মূলত একজন অস্ট্রিয়ান নাৎসি রাজনীতিবিদ। মাত্র ২ দিনের জন্য অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর হন। পরে জার্মান গভর্নর হিসেবে অস্ট্রিয়া শাসন শুরু করেন। তিনি অস্ট্রিয়া দখলের ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন। পোল্যান্ড দখল করার পর তিনি পোল্যান্ডের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। তার নির্দেশে অনেক পোলিশ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। ১ লক্ষ ২০ হাজার ডাচ ইহুদীকে তার তত্ত্বাবধানে কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়। এছাড়া নেদারল্যান্ডে তার নির্দেশে জিম্মিদের সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হতো। বল প্রয়োগ করে বন্দীদের শ্রমিক হিসেবে খাটানোর অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

নুরেমবার্গের বিচারে তার ফাঁসি হয়। ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে গির্জায় নেওয়া হয়েছিল।

আলফ্রেড জডল

তিনি একজন সাধারণ অফিসার থেকে জার্মান আর্মড ফোর্সের হাই কমান্ডের অপারেশনাল প্রধান হয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধের পরিস্থিতি হিটলারকে সরাসরি রিপোর্ট করতেন এবং যুদ্ধের গতি প্রকৃতি কেমন হবে তার পরিকল্পনা করতেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় সব অপারেশনের পরিকল্পনায় কম-বেশি তার অংশগ্রহণ আছে। ১৯৪১ সালে তিনি ‘কমিশার অর্ডার’-এ সাক্ষর করেন। মূলত সেনাবাহিনীতে যারা রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার শিক্ষা দেন তাদের কমিশার বলা হতো। তিনি কমিশারদের গুলি করে হত্যার আদেশ দেন।

যুদ্ধের পর ব্রিটিশ বাহিনী তাকে আটক করে। ফাঁসির আগে তার শেষ কথা ছিল “জার্মানিকে শুভেচ্ছা”। তবে তার ফাঁসি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। ১৯৫৩ সালে পশ্চিম জার্মানির একটি আদালত তাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা দেয়। যদিও পরে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তারা তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়।

ফ্রিজ সসকেল

ভুখণ্ড দখল করে জার্মানরা দখল করা অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে হত্যা করতো। বাকিদের শ্রমিক হিসেবে নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাটানো হতো। সসকেলের মর্যাদা ছিল মন্ত্রীর সমপর্যায়ের। জোর করে ৫ মিলিয়ন নিরীহ মানুষকে তার নির্দেশ অনুযায়ী দাসে পরিণত করা হয়। তার লক্ষ ছিল বিনা খরচে সবচেয়ে বেশি শ্রম আদায় করা। শ্রম দিতে অক্ষম হলে হত্যার প্রস্তাবও তিনি করেছিলেন।

আদালত তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানার নির্দেশ দেয়। মৃত্যুর আগে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং বিচারকে প্রহসন হিসেবে উল্লেখ করেন।

মার্টিন বোরম্যান

১৯৪২ সাল থেকে আইনগত বিষয়ে হিটলারের ইস্যু করা নির্দেশনার সবকিছুই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৪৩ সালে তিনি একটি আইনে সই করেন যাতে বলা হয় ইহুদীরা আদালত থেকে কোনো সুবিধা পাবে না। রাশিয়ায় হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনায় তিনি জড়িত ছিলেন। ভুপাতিত বিমানের পাইলটের হত্যার নির্দেশ দেন তিনি।

যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি বার্লিন থেকে পালিয়ে যান। তার অনুপস্থিতিতেই তার বিচার হয়েছিল। সবার ধারণা ছিল বোরম্যান হয়তো আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু ১৯৭২ সালে বার্লিনের এক রেল স্টেশনে পাওয়া একটি মৃতদেহের অবশিষ্টাংশকে তার দেহ বলে শনাক্ত করা হয়।

ফাঁসির পরে সবার মৃতদেহের ছবি তোলা হয়। পরে মৃতদেহ পোড়ানোর যন্ত্র দিয়ে ভস্মীভূত করে ফেলা হয় এবং ছাই নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আর ইতি ঘটে নাৎসি জার্মানির ঘৃণিত ক্ষমতাধরদের অধ্যায়ের।  

তথ্যসূত্র:

  1. http://www.history.com/topics/world-war-ii/nuremberg-trials
  2. http://www.jewishvirtuallibrary.org/in-depth-overview-of-judgements-in-nuremburg-trials
  3. http://www.bbc.co.uk/history/worldwars/wwtwo/nuremberg_article_01.shtml
  4. Nuremberg: Evil on Trial

ফিচার ছবি- Timetoast

Related Articles

Exit mobile version