“তুর্কিরা ছাড়া আর্মেনীয়দের আর কোনো শত্রু নেই, এবং আর্মেনীয়দের প্রতিশোধ ন্যায় ও ঐশ্বরিক।” – আর্মেনীয় লেখক ও বিপ্লবী শাহান নাতালি এভাবেই তুর্কিদের প্রতি তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন।
আর্মেনীয়রা পশ্চিম এশিয়ার আর্মেনীয় উচ্চভূমিতে বসবাসকারী একটি স্বতন্ত্র জাতি, যারা স্বতন্ত্র বর্ণমালাবিশিষ্ট আর্মেনীয় ভাষায় কথা বলে। আর্মেনীয়রা অত্যন্ত প্রাচীন একটি জাতি। চতুর্থ শতাব্দীতে আর্মেনিয়া বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে, এবং ‘আর্মেনিয়ান অ্যাপোস্টোলিক চার্চ’ বিশ্বের প্রথম জাতীয় খ্রিস্টধর্মীয় মতবাদ। পরবর্তীতে অবশ্য আর্মেনীয়রা তাদের সাম্রাজ্য ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা উভয়ই হারিয়ে ফেলে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ঐতিহাসিক আর্মেনীয় ভূমি দুইটি অংশে বিভক্ত ছিল – পূর্ব আর্মেনিয়া এবং পশ্চিম আর্মেনিয়া। পূর্ব আর্মেনিয়া ছিল খ্রিস্টান–অধ্যুষিত রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত, আর পশ্চিম আর্মেনিয়া ছিল মুসলিমপ্রধান ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। এর বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে জাতিগত আর্মেনীয়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল (এবং এখনো রয়েছে)।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের (এবং ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের) জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটে, এবং আর্মেনীয়রাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আর্মেনীয়রা ওসমানীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিষ্পেষণের জন্য তাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল, অন্যদিকে ওসমানীয় সরকার ‘বিধর্মী’ আর্মেনীয়দের প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহী হিসেবে বিবেচনা করত। ১৮৯০–এর দশকে ওসমানীয় সরকারের মৌন সমর্থনে সাম্রাজ্যের আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো হয় এবং এর ফলে কয়েক লক্ষ ‘ওসমানীয় আর্মেনীয়’ নিহত হয়।
১৯০৮ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থান/বিপ্লবের মাধ্যমে ‘কমিটি অফ ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রোগ্রেস’ (যারা ‘তরুণ তুর্কি’ নামে পরিচিত ছিল) ওসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনক্ষমতা হস্তগত করে এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের জাতিগত সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক ‘তুর্কীকরণ’ (Turkification) করতে শুরু করে।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে তুরস্ক কেন্দ্রীয় শক্তির (জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি) পক্ষাবলম্বন করে, এবং মিত্রশক্তির (রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্স) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ওসমানীয় যুদ্ধমন্ত্রী (এবং কার্যত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রকৃত শাসক) এনভের পাশা রাশিয়ার ট্রান্সককেশিয়া অঞ্চলে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করেন এবং এই উদ্দেশ্যে ঐ অঞ্চলে একটি বড় সৈন্যদল প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রধানত ওসমানীয় সমরনায়কদের অকর্মণ্যতা এবং সৈন্যদের রসদপত্র সরবরাহের অব্যবস্থার জন্য সারিকামিশের যুদ্ধে ওসমানীয় সৈন্যরা রুশদের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
এনভের এই পরাজয়ের জন্য সরাসরি ওসমানীয় আর্মেনীয়দের দায়ী করেন এবং ওসমানীয় সরকার আর্মেনীয়দের নির্মূল করার পরিকল্পনা করে। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে ওসমানীয় সরকার ৮ থেকে ১৫ লক্ষ জাতিগত আর্মেনীয়কে খুন করে, এবং এই ঘটনাটি ইতিহাসে ‘আর্মেনীয় গণহত্যা’ নামে পরিচিত। ১৯১৮ সালে রুশ গৃহযুদ্ধের সময় ট্রান্সককেশিয়ার জাতিগত আজারবাইজানিরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজারবাইজানিরা ‘বৃহত্তর তুর্কি’ জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একটি শিয়াপ্রধান জাতি, যারা রাশিয়া ও ইরানের শাসনাধীন ছিল। অবশ্য আর্মেনীয়দের দৃষ্টিতে, তুর্কি ও আজারবাইজানিরা একই জাতি, এবং আজারবাইজানিরা আসলে ‘শিয়া তুর্কি’। ১৯১৮ সালে ওসমানীয় সৈন্য ও আজারবাইজানি স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইসলামি সৈন্যবাহিনী’ এনভেরের ভাই নূরী পাশার নেতৃত্বে বাকু দখল করে এবং সেখানে গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০ আর্মেনীয়কে খুন করে।
অর্থাৎ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল আর্মেনীয়দের জন্য একটি জাতীয় মহাবিপর্যয়ের সময়। লক্ষ লক্ষ বেসামরিক আর্মেনীয় এসময় তুর্কিদের (এবং ক্ষেত্রবিশেষে আজারবাইজানিদের) হাতে প্রাণ হারায়। কিন্তু সেসময় এমন কোনো আন্তর্জাতিক আইন ছিল না, যার মাধ্যমে গণহত্যার জন্য কোনো রাষ্ট্রকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যার জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও কার্যত কোনো রাষ্ট্রকে গণহত্যার জন্য শাস্তি প্রদান করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। অবশ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯১৯–১৯২০ সালে বিজয়ী মিত্রপক্ষের চাপে ওসমানীয় সরকার আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের সামরিক আদালতে বিচার করতে বাধ্য হয়, কিন্তু তারা এই বিচারের রায় কার্যকর করেনি এবং পরবর্তী কামাল আতাতুর্কের উগ্র জাতীয়তাবাদী তুর্কি সরকার এই প্রসঙ্গটিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে।
অবশ্য তদানীন্তন পরিস্থিতিতে আর্মেনীয়রা কোনো ন্যায়বিচারের প্রত্যাশাও করেনি। ১৯১৮ সালের মে মাসে প্রাক্তন ‘রুশ আর্মেনিয়া’র ভূমিতে একটি স্বাধীন আর্মেনীয় রাষ্ট্র স্থাপিত হয়। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে ‘আর্মেনীয় বিপ্লবী ফেডারেশনে’র ৯ম সাধারণ কংগ্রসে অনুষ্ঠিত হয়। ‘আর্মেনীয় বিপ্লবী ফেডারেশন’ (সংক্ষেপে ‘দাশনাক’ নামে পরিচিত) ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার অনুসারী একটি দল। এই কংগ্রেসে দাশনাকের একদল সদস্য আর্মেনীয় গণহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার প্রস্তাব করেন। তারা আর্মেনীয় গণহত্যার সঙ্গে জড়িত তুর্কি ও আজারবাইজানি সরকারি কর্মকর্তাদের খুন করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। দলটির একাংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও তারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
দাশনাকের দুই শীর্ষ নেতা শাহান নাতালি এবং কারেকিন পাস্তেরমাদজিয়ান (ছদ্মনাম ‘আর্মেন কারো’) ছিলেন এই পরিকল্পনার মূল প্রবক্তা। তারা ২০০ জন তুর্কি ও আজারবাইজানি কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করেন, যাদেরকে তারা আর্মেনীয় গণহত্যার মূল কারিগর হিসেবে বিবেচনা করতেন। এই তালিকাটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘কালো তালিকা’ (Black List)। আর এই পরিকল্পনাটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘অপারেশন নেমেসিস’ (Operation Nemesis)। উল্লেখ্য, ‘নেমেসিস’ ছিলেন প্রাচীন গ্রিকদের ঐশ্বরিক প্রতিশোধের দেবী। এই পরিকল্পনার প্রবক্তারা আন্তরিকভাবেই নিজেদের প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষাকে ন্যায্য বলে বিবেচনা করতেন।
১৯২০ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে দাশনাক সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে ‘কালো তালিকা’র অন্তর্ভুক্ত বেশকিছু তুর্কি ও আজারবাইজানি ব্যক্তিত্বকে খুন করতে সক্ষম হয়। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তাদের পরিচিতি নিচে সংক্ষেপে দেয়া হলো।
ফাতালি খান খোয়স্কি
ফাতালি খান ইসগান্দার ওগলু খোয়স্কি ছিলেন একজন আজারবাইজানি রাষ্ট্রনায়ক। ১৮৭৫ সালে রুশ সাম্রাজ্যের শাকি শহরে একটি অভিজাত আজারবাইজানি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী খোয়স্কি ছিলেন একজন আইনজীবী এবং রুশ আইনসভা ‘রাষ্ট্রীয় দুমা’র একজন সদস্য। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর রুশ ট্রান্সককেশিয়া অঞ্চলে ‘ট্রান্সককেশিয়ান গণতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং খোয়স্কি রাষ্ট্রটির আইনসভা ‘ট্রান্সককেশিয়ান সেজম’–এর সদস্য ও বিচারমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯১৮ সালের মে মাসে ট্রান্সককেশিয়ান ফেডারেশন থেকে আজারবাইজান স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং খোয়স্কি আজারবাইজানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি আজারবাইজানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯২০ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত রুশ লাল ফৌজের সহায়তায় আজারবাইজানি বলশেভিকরা রাষ্ট্রটির শাসনক্ষমতা দখল করে এবং খোয়স্কি সপরিবারে পার্শ্ববর্তী জর্জিয়ায় চলে যান। এসময় তিনি জর্জিয়ার রাজধানী তিফলিসে (বর্তমান তিবলিসি) অবস্থান করছিলেন।
১৯১৮ সালে ওসমানীয়–আজারবাইজানি ‘ইসলামি সৈন্যবাহিনী’ বাকুতে গণহত্যা চালিয়ে হাজার হাজার আর্মেনীয়কে খুন করেছিল এবং আর্মেনীয়দের দৃষ্টিতে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খোয়স্কি এই গণহত্যার জন্য দায়ী ছিলেন। এজন্য খোয়স্কি ‘অপারেশন নেমেসিসে’র অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন৷ ১৯২০ সালের ১৯ জুন খোয়স্কি এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘মুসাভাৎ’ দলের নেতা খান মাহমাদভ তিবলিসির এরিভানস্কি স্কয়্যার দিয়ে যাচ্ছিলেন। এসময় প্রাক্তন আর্মেনীয় সৈনিক আরাম ইয়েরগারিয়ান ও তার সহযোগী মিসাক কিরাকোসিয়ান ১০০–১৫০ মিটার দূর থেকে তাদের ওপর গুলি চালায়। মাহমাদভ আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু খোয়স্কি ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
তালাত পাশা
মেহমেদ তালাত পাশা ছিলেন একজন ওসমানীয় রাষ্ট্রনায়ক। ১৮৭৪ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কার্দঝালি শহরে একটি পোমাক (বুলগেরীয় মুসলিম) ও জিপসি মিশ্র পরিবারে জন্মগ্রহণকারী তালাত ছিলেন ১৯০৮ সালের তরুণ তুর্কি বিপ্লবের একজন অন্যতম নেতা। তিনি ১৯১৩ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী এবং ১৯১৭ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যে তিনজন পাশা মিলে কার্যত ওসমানীয় সাম্রাজ্য শাসন করতেন, তালাত ছিলেন তাদেরই একজন।
তালাত পাশাকে আর্মেনীয় গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ ১৯১৫ সালে ওসমানীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনিই পশ্চিম আর্মেনিয়া থেকে আর্মেনীয়দের নির্বাসিত করার নির্দেশ দেন, যে নির্বাসন পরবর্তীতে গণহত্যার রূপ ধারণ করে। এজন্য তিনি ছিলেন ‘অপারেশন নেমেসিসে’র মূল লক্ষ্যবস্তু এবং শাহান নাতালির মতে, আর্মেনীয়দের ‘এক নম্বর শত্রু’।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর তালাত পাশা ওসমানীয় সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে যান এবং জার্মানির রাজধানী বার্লিনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তালাতের বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী মনোভাবের জন্য ব্রিটিশ ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা তাকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত এবং তার সন্ধান করছিল। ১৯২১ সালের মার্চে দাশনাক সদস্যরা তালাতের সন্ধান লাভ করে। ১৫ মার্চ তালাত বার্লিনের শার্লটেনবার্গে তার বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন। এসময় দাশনাক সদস্য সোঘোমন তেহলিরিয়ান তালাতের ওপর গুলি চালায় এবং তালাত ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তেহলিরিয়ানের পুরো পরিবার আর্মেনীয় গণহত্যায় নিহত হয়েছিল।
তেহলিরিয়ানকে দাশনাকের নেতারা নির্দেশ দিয়েছিলেন, তালাতকে খুন করার পর সে যেন পালানোর চেষ্টা না করে। তেহলিরিয়ান সেই মোতাবেক পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু তেহলিরিয়ানের বিচার কার্যত আর্মেনীয় গণহত্যার বিচারে পরিণত হয়। আদালত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, পুরো পরিবারকে হারানোর ফলে তেহলিরিয়ান মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, এবং এজন্য তাকে কোনো শাস্তি না দিয়ে মুক্তি প্রদান করা হয়।
বেহবুদ খান জাভানশির
বেহবুদ খান জাভানশির আজাদ খান ওগলু ছিলেন একজন আজারবাইজানি রাষ্ট্রনায়ক। ১৮৭৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের আজাদ কারাকোয়ুনলু গ্রামে একটি অভিজাত আজারবাইজানি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী জাভানশির ছিলেন একজন তেল প্রকৌশলী ও রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯১৮ সালে আজারবাইজানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরবর্তীতে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আজারবাইজানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি প্রথমে জার্মানির বার্লিনে এবং পরবর্তীতে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কনস্টান্টিনোপলে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আর্মেনীয়দের মতে, ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাকুতে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার সঙ্গে জাভানশির জড়িত ছিলেন। ১৯২১ সালের ২১ জুলাই সন্ধ্যায় জাভানশির কনস্টান্টিনোপলের একটি থিয়েটার থেকে সপরিবারে পেরা প্যালেস হোটেলে ফিরছিলেন। এসময় দাশনাক সদস্য এবং প্রাক্তন রুশ ও আর্মেনীয় সৈনিক মিসাক তোরলাকিয়ান জাভানশিরকে চিনে ফেলে। সে এবং তার দুই সহযোগী এরভান্দ ফুন্দুকিয়ান ও আরুতিউন আরুতুইনিয়ান জাভানশিরকে অনুসরণ করে। একপর্যায়ে তোরলাকিয়ান জাভানশিরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। জাভানশিরের বুকে দুইটি এবং মাথায় একটি গুলি বিদ্ধ হয়, এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।
হালিম পাশা
সাইদ হালিম পাশা ছিলেন একজন ওসমানীয় রাষ্ট্রনায়ক। ১৮৬৫ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মিসরের কায়রোতে জন্মগ্রহণকারী হালিম পাশা ছিলেন আলবেনীয় জাতিভুক্ত আধুনিক মিসরের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলীর নাতি। ১৯১৩ সালে হালিম পাশা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯১৫ সালে তিনি আর্মেনীয়দের নির্বাসিত করার নির্দেশে স্বাক্ষর করেন। তাকে আর্মেনীয় গণহত্যার অন্যতম রূপকল্পকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয়দের পরাজয়ের পর হালিম পাশা ওসমানীয় সাম্রাজ্য থেকে পলায়ন করেন এবং প্রথমে ইতালির সিসিলিতে ও পরে ইতালির রাজধানী রোমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু ‘অপারেশন নেমেসিস’ অনুযায়ী দাশনাক সদস্যরা হালিম পাশাকে খুঁজে বের করে। ১৯২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হালিম পাশা একটি ট্যাক্সিতে করে বাসায় ফিরছিলেন। এসময় দাশনাক সদস্য আরশাভির শিরাকিয়ান ও আরাম ইয়েরগানিয়ান (ফাতালি খান খোয়স্কির খুনি) তার ওপর গুলি চালায়। হালিম পাশা ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
বাহায়েদ্দিন শাকির এবং জেমাল আজমি
বাহায়েদ্দিন শাকির ছিলেন একজন ওসমানীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ। ১৮৬৫ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কনস্টান্টিনোপলে জন্মগ্রহণকারী শাকির ছিলেন ‘কমিটি অফ ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রোগ্রেস’–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি ওসমানীয় বিশেষ (গোয়েন্দা) সংস্থা ‘তেশকিলাত–ই–মাহসুসা’র প্রধান ছিলেন। এই সংস্থাটি আর্মেনীয় গণহত্যা পরিচালনার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
অন্যদিকে, জেমাল আজমি ছিলেন একজন ওসমানীয় সরকারি কর্মকর্তা। ১৮৭৪ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আরাপগিরে জন্মগ্রহণকারী আজমি ছিলেন আর্মেনীয়–অধ্যুষিত ত্রেবিজন্দ প্রদেশের প্রাদেশিক শাসনকর্তা। আর্মেনীয় গণহত্যা চলাকালে ত্রেবিজন্দের অধিবাসী আর্মেনীয়দের নির্মূল করার ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আর্মেনীয় নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর দায়েও অভিযুক্ত ছিলেন। আর্মেনীয়রা তাকে ‘ত্রেবিজন্দের কসাই’ নামে আখ্যা দিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শাকির ও আজমি ওসমানীয় সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে যান এবং জার্মানির বার্লিনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু তারা দাশনাকের ‘হিটলিস্টে’ ছিলেন এবং তারা তাদেরকে খুঁজে বের করে। ১৯২২ সালের ১৭ এপ্রিল শাকির ও আজমি নিজ নিজ পরিবারসহ বার্লিনের উহল্যান্ড স্ট্রিটে হাটছিলেন। এসময় দাশনাক মিলিট্যান্ট আরশাভির শিরাকিয়ান ও আরাম ইয়েরগানিয়ান তাদেরকে আক্রমণ করে। শিরাকিয়ানের গুলিতে আজমি তৎক্ষণাৎ নিহত হন, কিন্তু শাকির আহত অবস্থায় পালিয়ে যান। ইয়েরগানিয়ান তার পিছু ধাওয়া করে এবং তার মাথায় গুলি করে হত্যা করে।
জামাল পাশা
আহমেদ জামাল পাশা ছিলেন একজন ওসমানীয় রাষ্ট্রনায়ক ও সামরিক কর্মকর্তা। ১৮৭২ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মিদিল্লিতে জন্মগ্রহণকারী জামাল ওসমানীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং এসময় ‘কমিটি অফ ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রোগ্রেসে’ যোগদান করেন। তিনি ১৯১২–১৯১৩ সালের বলকান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯১৪ সালে ওসমানীয় নৌবাহিনী সংক্রান্ত মন্ত্রী নিযুক্ত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এসময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং আরব বিদ্রোহীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার জন্য ‘রক্তপিপাসু’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যে তিনজন পাশা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাদের মধ্যে জামাল পাশা ছিলেন একজন। আর্মেনীয় গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি ওসমানীয় সাম্রাজ্য থেকে পলায়ন করেন এবং বিভিন্ন দেশ হয়ে ১৯২০ সালে আফগানিস্তানে পৌঁছেন।
তাকে আফগান সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এসময় সোভিয়েত রাশিয়া ও আফগানিস্তান পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ১৯২২ সালের জুলাইয়ে আফগান সেনাবাহিনীর সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে জামাল পাশা সোভিয়েত–নিয়ন্ত্রিত জর্জিয়ার তিবলিসিতে আসেন। এসময় দাশনাক সদস্যরা তার খোঁজ পেয়ে যায়। ১৯২২ সালের ২১ জুলাই দাশনাক সদস্য স্তেপান ঝাঘিগিয়ান, আর্তাশেস গেভর্গিয়ান ও পেত্রো–তের পোগোশিয়ান তিবলিসির রাস্তায় জামাল পাশার ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে জামাল ও তার সহকারী নিহত হন।
জামাল পাশার খুন ছিল অপারেশন নেমেসিসের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অপারেশন নেমেসিসের মধ্য দিয়ে আর্মেনীয়রা আর্মেনীয় গণহত্যার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়। অবশ্য আর্মেনীয় গণহত্যার সঙ্গে জড়িত আরেক শীর্ষ ওসমানীয় রাষ্ট্রনায়ক এনভের পাশাকে দাশনাক খুঁজে পায়নি। কিন্তু জামাল পাশার খুনের দুই সপ্তাহের মধ্যেই ১৯২২ সালের ৪ আগস্ট বর্তমান তাজিকিস্তানে সোভিয়েত লাল ফৌজের একটি অভিযানে এনভের পাশা নিহত হন। কাকতালীয়ভাবে, সোভিয়েত লাল ফৌজের যে ইউনিটটি এনভের পাশাকে খুন করেছিল, সেটির কমান্ডারও ছিলেন একজন জাতিগত আর্মেনীয় বলশেভিক ইয়াকোভ মেলকুমভ।
অপারেশন নেমেসিস ইতিহাসের অসংখ্য বিতর্কিত ঘটনার মধ্যে একটি। তুর্কি ও আজারবাইজানিদের দৃষ্টিতে, ‘অপারেশন নেমেসিস’ ছিল ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘আদর্শবাদী’ তুর্কি ও আজারবাইজানি রাষ্ট্রনায়কদের খুন করার জন্য আর্মেনীয় ‘সন্ত্রাসবাদী’দের পরিচালিত একটি অভিযান। অন্যদিকে, আর্মেনীয়দের দৃষ্টিতে, ‘অপারেশন নেমেসিস’ ছিল লক্ষ লক্ষ আর্মেনীয় নারী–পুরুষের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আর্মেনীয় ‘দেশপ্রেমিক’দের প্রতিশোধ। বর্তমানে তুরস্ক ও আজারবাইজানে ‘অপারেশন নেমেসিসে’র ভুক্তভোগীদের জাতীয় বীর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, আর্মেনিয়ায় ‘অপারেশন নেমেসিসে’ অংশগ্রহণকারী দাশনাক সদস্যদের জাতীয় বীর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।