আদিম তাসমানিয়ান: বিচিত্র সংস্কৃতির আড়ালে বিবর্ণ ইতিহাস

তাসমানিয়া; সাগরের উদ্দাম ঢেউ আর উপকূলে আছড়ে পড়া ছলাৎ ছলাৎ জলতরঙ্গে স্নিগ্ধ সকালের সূর্যোদয়ের সঙ্গী হিসেবে জেগে ওঠা এক অপরূপ নৈসর্গিক দ্বীপ-রাজ্য। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রতট থেকে কিছুটা অদূরে নীল জলরাশিকে ঘিরে নয়নাভিরাম এই দ্বীপের অবস্থান। ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বুলডোজারে নিষ্পেষিত এ দ্বীপের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে এক অতিপ্রাচীন কৃষ্ণাঙ্গ জাতিগোষ্ঠীর করুণ ইতিহাস; সমুদ্রের নোনাজলে ভেসে চলা হাজারও অজানা আতঙ্ক-উৎকণ্ঠার গল্প! চলুন, আজ জেনে আসা যাক সেসব গল্পই।

পটভূমি

২৫-৪০ হাজার বছরের মধ্যবর্তী কোনো একসময়, কাঠের নৌকা করে ভানুয়াতু, টুভ্যালু ও অন্য কোনো নিকটবর্তী নির্জন দ্বীপ থেকে ছোট্ট এই দ্বীপে একে-দুইয়ে পাড়ি জমাতে শুরু করে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ছোট ছোট দল। জীবিকার অন্বেষণে এখানে এসে তারা গড়ে তোলে নিজস্ব আবাসস্থল; তৈরি হয় গোত্র-সম্প্রদায়।

মানচিত্রে তাসমানিয়ার অবস্থান; Image Source: omniatlas.com

মুষ্টিবদ্ধ ভাগ্যকে সঙ্গী করে নতুন ভূমিতে ভেসে আসা এসব মানুষের গায়ের বর্ণ কালো, যাদের শ্বেতাঙ্গ বিশ্ব চেনে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। অতিকায় চোয়াল, বড় বড় দাঁত, কদাকার ঠোঁট, বৃহৎ মস্তক, অস্বাভাবিক মুখাবয়ব কিংবা খর্বাকৃতির দৈহিক গড়নের কারণে তারা দেখতে ছিল অন্যদের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। ইতিহাসবিদদের মতে, এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বদক্ষিণে বসতি গড়ে তোলা জাতি হিসেবে তারাই প্রথম!

বিশ্বাস ও রীতিনীতি

আদিম এ যাযাবর জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো ধর্ম ছিল না। তবে, প্রচলিত ছিল কতক গোত্রবদ্ধ বিশ্বাস ও রীতিনীতি। যেমন- গোত্রের কোনো সদস্য মারা গেলে তার শেষকৃত্য সম্পাদনের পূর্বে গুহার মুখে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। অপেক্ষা করা হতো বিকেলের সূর্য সন্ধ্যার আকাশে হেলে পড়ার। কেননা, তাদের ধারণা, মৃত্যুর পর মৃতদের দুনিয়ায় পুনরায় জন্ম নেবে এ মানুষগুলো। আর এ সময়টা পার করতে প্রয়োজন আলো নয় বরং অন্ধকারের। মিশরীয় ফেরাউনদের মতো তারাও মৃত ব্যক্তির কবরে দিয়ে দিত প্রয়োজনীয় রসদ, খাদ্যসামগ্রী ও আত্মরক্ষার সরঞ্জাম।

আগুনের পাশে নাচগা-ন ও রাত্রি যাপন; Image Source: Getty Images

পোশাক-পরিচ্ছদ ও গাত্রাবরণের চর্চা না থাকায় নগ্ন গায়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো এ মানুষগুলো। তবে, বিশেষ কোনো উৎসব ও অসুখ-বিসুখে একখণ্ড চামড়া অথবা গাছের ছাল গলায় জড়িয়ে নিত তারা। অনিষ্টকারী প্রেতাত্মার ভয়ে লতাপাতায় মোড়ানো বিছানায় ঘুমাতো সংঘবদ্ধভাবে। পাশে জ্বালিয়ে নিত একখণ্ড লেলিহান আগুন। কখনো ঘুমানোর পূর্বে কিংবা ঘুম থেকে জেগে ওঠে এসব আগুনে পুড়িয়ে খেতো শিকারের মাংস। গোত্রের সাথে সংঘর্ষে তারা শত্রুকে বোকা বানানোর জন্য অবলম্বন করত ব্যতিক্রমী কায়দা; আয়ত্ত করত অভিনব কৌশল। যাযাবর এ মানুষগুলো খাবার হিসেবে গ্রহণ করতো বন্য ফলমূল, বীজ ও পাখ-পাখালির ডিম। ক্যাঙ্গারুর মাংস তাদের নিকট ছিল পরম উপাদেয় ভোজন। আর তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হতো আগুনে ঝলসানো হাড়সমেত এই খাবার।

শিল্প-সংস্কৃতি

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বর্বর এ জনপদের মানুষগুলোর ভেতর ছিল শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা। ছিল নান্দনিক চিত্রকল্পের চমৎকার উপস্থাপন। গুহার গায়ে পোড়া মাটির প্রলেপ ও কয়লার আঁচড়ের আঁকিবুঁকিতে সৃষ্টি করতো কতশত জীবজন্তু, মানুষ ও প্রকৃতির নান্দনিক চিত্রকর্ম, সে হিসেব আজ মেলানো ভার।

গুহার গায়ে আঁকা হরেকরকম চিত্রকর্ম; Image Source: Getty Images

শিকারকৃত পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি করত বিনোদনের বাদ্যযন্ত্র। অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হতো পশুপাখির হাড় ও মাথায় পরিধান করত সুশোভিত ফুল ও পাখির পালক। উৎসবের দিনে তারা আয়োজন করতো দুঃসাহসিক প্রতিযোগিতার। অতঃপর, পালাক্রমে সংঘবদ্ধ নাচ-গান। এই মানুষেরা পারদর্শী ছিল তীর-ধনুক চালনা ও নিখুঁতভাবে বর্শা নিক্ষেপে। যাদুবিদ্যার তন্ত্রমন্ত্রেও তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। সেসব যাদুবিদ্যায় ব্যবহৃত হতো মৃত মানুষের হাড়, বিচিত্র সব গাছগাছড়া ও দুর্লভ শিকড়।

দ্বীপের সন্ধান

১৬৪২ সালের ডিসেম্বর মাস, উত্তাল সাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলছে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের গভর্নর জেনারেল এন্থনি ভ্যান ডাইম্যানের অনুসন্ধানী জাহাজ। এই জাহাজে অবস্থান করছিলেন বিখ্যাত ডাচ নাবিক আবেল তাসমান। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণের সমুদ্র উপকূল ঘেঁষে অতিক্রমের সময় তাসমানের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় অপরূপ এই দ্বীপের পানে।

ডাচ নাবিক আবেল তাসমান; Image Source: Wikimedia Commons

ফলমূল ও সুপেয় পানি সংগ্রহ কিংবা অন্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে দ্বীপটির দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে প্রথমবারের মতো নোঙর করে তারা। দ্বীপটির মোহনীয় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এর নামকরণ করা হয় গভর্নর জেনারেলের নামে- ‘ভ্যান ডাইম্যান্স ল্যান্ড’। তবে, দ্বীপের আবিষ্কারকের সম্মানার্থে পরবর্তীকালে এটি বিবর্তিত হয়ে আবেল তাসমানের নামে তাসমানিয়া হিসেবেই বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।

উপনিবেশ স্থাপন

তার ঠিক ১৩০ বছর পর, ১৭৭২ সালে প্রথম ভিনদেশী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ঘাঁটি গাড়ে ফ্রান্স। অতঃপর, ১৭৮৮ সালে ফরাসিদের অগোচরে নিউ সাউথ ওয়েলসে উপনিবেশ কায়েম করে মোড়ল রাষ্ট্র ব্রিটেনও। তবে, কিছুদিন যেতে না যেতেই বৈরী প্রকৃতির খেয়ালীপনায় বাধে বিপত্তি। ব্রিটেনের চেয়ে এখানকার প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া বেজায় অসম্ভব। তার উপর দেখা দেয় খাবার ও পর্যাপ্ত সুপেয় পানিরও অভাব। আর তাই, উপরমহল থেকে সিদ্ধান্ত হয় দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়ার। নবীন রূপে শুরু হয় অনুসন্ধান অভিযান কাজ।

তাসমানিয়ার সমুদ্র উপকূলে নোঙর করা ব্রিটিশ জাহাজ; Image Source: P.G. AI

অভিযান পরিচালনার বেশ কিছুকাল পর, ১৭৯৮ সালের গোড়ার দিকে মনোরম তাসমানিয়া দৃষ্টি কাড়ে তাদের। প্রথম দিকে তারা অস্ট্রেলিয়ার অতি ক্ষুদ্র অংশ শাসন করলেও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এর পরিসর। বিপরীতে কমতে থাকে ফরাসিদের আধিপত্য। ১৮০৩ সালে তাসমানিয়ার নিয়ন্ত্রণও হস্তগত করে তারা। পোর্ট ফিলিপ বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলো সরিয়ে আনা হয় তাসমানিয়ার সুরক্ষিত সমুদ্র উপকূলে। এখানকার কোমল আবহাওয়া, মনোরম পরিবেশ ও উর্বর ভূমিতে ঘটে বীভৎস ব্রিটিশ শাসনের পৈশাচিক সূচনাপর্ব।

ব্ল্যাক ওয়ার

১৮০৪ সালে শান্তিপ্রিয় তাসমানিয়ানদের সতেজ ভূমিতে শুরু হয় ব্রিটিশদের অযাচিত আধিপত্য। তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ব্ল্যাক ওয়ার নামক এক অসম যুদ্ধ। কেড়ে নেওয়া হয় শস্য, ফলমূল ও শিকারের বৃহৎ উৎসসমূহ। বনে-বাদাড়ে ও জনমানবহীন নির্জন গুহায় বেঁধে নিয়ে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। অতঃপর হত্যা করা হয় তাদের। ব্রিটিশদের আধুনিক সমরাস্ত্রের মুখে তীর, ধনুক আর বর্শা চালনায় সক্ষম গোবেচারা তাসমানিয়ানরা হয়ে পড়ে নির্বাক, নির্লিপ্ত ও অসহায়। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে চলে এই যুদ্ধ ও গণহত্যা।

ব্রিটিশ-তাসমান ব্ল্যাক ওয়ার; Image Source: Getty Images

অতঃপর, বীভৎস এ গণহত্যার পর ১৮৩১-৩৫ সালে বেঁচে থাকা প্রায় ২০০ তাসমানিয়ানকে শাস্তি হিসেবে স্থানান্তরিত করা হয় নিকটবর্তী ফ্লিন্ডার্স দ্বীপে। এরই মাধ্যমে কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় আদিম তাসমানিয়ানদের বৈচিত্র্যময় সমাজ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ধূলিসাৎ হয়ে যায় এক রহস্যে ঘেরা জীবনধারা। নির্বাসিত সেই দ্বীপে রোগে-শোকে, অনাহারে একে একে তারা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। ১৮৭৬ সালে সর্বশেষ তাসমান নারী ট্রুগানিনির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে বিলুপ্তি ঘটে এই আদিম অসমসাহসী আদিবাসীদের।

প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে বরফ যুগের অবসানের পর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে দ্বীপটি, এবং প্রায় ৮ হাজার বছর পূর্বে সম্পূর্ণরূপে আলাদা হয়ে যায়। আর তাই, আবেল তাসমানের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত দ্বীপটির বাসিন্দারা পুরো পৃথিবীর নিকট থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল- যা বর্তমান আধুনিক বিশ্বের কাছে এক রোমাঞ্চকর ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত।

Language: Bangla
Topic: Primitive Tasmanian: The story of a fading history behind a diverse culture
Feature Image: Getty Images
References: All the necessary links are hyperlinked inside, and one more has been mentioned below:
1. Tasmanian aboriginal people, Encyclopedia Britannica.

Related Articles

Exit mobile version