ইতিহাসের পাতা ওল্টালে শক্তিশালী অল্প যে কতগুলো সেনাবাহিনীর কথা উঠে আসবে, রোমান সেনাবাহিনী তার মাঝে একটি। তাদের দক্ষতাই ইতালীয় পেনিনসুলার ছোট একটি শহরকে কালক্রমে পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় পুরোটুকুরই চালকের আসনে বসিয়েছিলো। আজকের লেখার মাধ্যমে আমরা সেই রোমান সেনাদেরই জানা-অজানা বেশ কিছু বিষয় নিয়ে জানবো।
১.
রোমের শুরুর দিককার ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, দেশটির অর্থনীতি ছিলো মূলত কৃষিনির্ভর। ফলে যুদ্ধে জড়ানোর থেকে কৃষিকাজের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তাই ফসলের বীজ বপন ও সেই ফসল ঘরে তোলার মধ্যবর্তী সময়, অর্থাৎ গ্রীষ্মকালেই মূলত রোমানরা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করতো।
লিভির মতে (হিস্টোরি অফ রোম, ৫.৬), যদি গ্রীষ্মের শেষে এসেও যুদ্ধ শেষ হবার কোনো সম্ভাবনা দেখা না যেত, তাহলে সেনারা পুরো শীত জুড়ে অপেক্ষা করেই কাটিয়ে দিতো। অবসরের সেই সময়টা তারা তুষারঘেরা পাহাড়ে ঘুরে এবং বনজঙ্গলে শিকার করে কাটাতো।
৩৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এট্রুস্কান শহর ভেই অবরোধের সময়ই রোমান সেনারা প্রথমবারের মতো শীতকালেও তাদের যুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল বলে জানা যায়।
২.
সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় মাঝে মাঝেই ঘটতো। আর এটা যাতে না ঘটে সেজন্য নানা ধরনের কড়া নিয়মকানুন প্রচলিত ছিলো রোমান সেনাবাহিনীতে। মৃত্যুদণ্ড ছিলো এসবের মাঝে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি। বলা বাহুল্য, এটা বিদ্রোহের প্রবণতাকেও অনেকাংশে কমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো।
সেনাবাহিনীর যে ইউনিটে বিদ্রোহ সংঘটিত হতো, তার প্রতি ১০ম ব্যক্তিকে মৃত্যু নিশ্চিত হবার আগপর্যন্ত পাথর ছোড়া হতো কিংবা প্রহার করা হতো। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, শাস্তির শিকার কে হবে তা নির্ধারণের ভার পড়তো সহকর্মীদের উপরই। যদি কোনো ইউনিটে গোপনে গোপনে বিদ্রোহের শলাপরামর্শ চলতোও, তবে এই মৃত্যুদণ্ডই তাদেরকে সেই চিন্তাভাবনা করার আগে আরেকটিবার ভাবতে বাধ্য করতো। অনেক সময় মানসিক চাপ সইতে না পেরে সহকর্মীরাই একে অপরকে ধরিয়ে দিত!
তবে এই মৃত্যুদণ্ডে অনেক সময় নিরীহ লোকেরও প্রাণ যেত, আর এই কথাটা রোমানরাও বেশ ভালো করেই জানতো। তবে তারা মনে করতো, এমনটা হলেও এটাই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। ট্যাসিটাস লিখেছিলেন,
“বেশ বড় মাত্রায় নজির স্থাপন করতে গেলে কিছু না কিছু অবিচার হতেই পারে, যেখানে জনগণের মঙ্গলের জন্য একজন ব্যক্তিকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।”
৩.
দেশকে রক্ষার্থে, দেশের গৌরব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছাপোষণ করেন অনেক দেশপ্রেমিক নাগরিকই। প্রাচীন রোমেও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। তবে তখন শুধু ইচ্ছা থাকলেই হতো না, সেই সাথে থাকা লাগতো অর্থের জোরও। অর্থ না থাকলে শুধু ইচ্ছাশক্তির জোরে রোমান সেনাবাহিনীতে শুরুর দিকে সুযোগ পাওয়া যেত না, এমনকি সেটা যোগ্য হলেও না।
সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যারা আসতো, তাদের মাঝে সবচেয়ে স্বচ্ছল পরিবারের তরুণদের জায়গা হতো অশ্বারোহী বাহিনীতে। যাদের এত বেশি না হলেও মোটামুটি ধনসম্পদ থাকতো, তারা যোগ দিতো পদাতিক বাহিনীতে। আর যাদের ধনসম্পদ বলতে কিছুই থাকতো না, তাদের কোনো স্থানই মিলতো না সেনাবাহিনীতে।
দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের পর (খ্রিস্টপূর্ব ২১৮-২০১ অব্দ) বোঝা গেলো, সম্পত্তির উপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনীতে কাউকে অন্তর্ভুক্তির এই যে নীতি, তা আর এতটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। কারণ, সাম্রাজ্যের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের যুদ্ধের মাত্রা এবং সময়কাল বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। সেই সাথে নতুন করে বিজিত এলাকাসমূহেও সেনাসদস্যদের নিয়োগ দেয়া দরকার হয়ে পড়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এসে এই নিয়ম আরো শিথিল করা হয়। সবশেষে ১০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এসে সম্পদহীন যে কাউকেও রাষ্ট্রের খরচে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছিলো।
৪.
যখন রোমানরা কোনো শহর বা ভবন অবরোধ করতো, তখন তারা সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ দলকে সেখানে পাঠাতো, যারা সেই স্থাপনাটিকে এমনভাবে ঘিরে রাখতো যেন কেউই পালাতে না পারে। এর কাছাকাছি উঁচুভূমিতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হতো। তবে সেটা এমন দূরত্বে বানানো হতো, যাতে প্রতিপক্ষের নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র যাতে তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এবার সেনাবাহিনীর আরেকটি দলকে পাঠানো হতো, যারা চেষ্টা করতো প্রতিরক্ষামূলক দেয়াল অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করতে। এ সময় তাদের নিরাপত্তা দিতে তীরন্দাজরা তীর ছুড়তো, ক্যাটাপুল্ট থেকে ছোড়া হতো পাথর।
এমন অবরোধ চালিয়ে নেবার সময় রোমান সেনাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিলো সুড়ঙ্গ খনন করা। অবরোধটি সফল হবে কি না তা অনেকাংশেই নির্ভর করতো সেনারা শহরের বা ভবনের দেয়ালের নিচে দিয়ে সুড়ঙ্গ খনন করে ভেতরে প্রবেশ করে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারলো কি না তার উপর।
শুরুর দিকে এই কৌশলটি বেশ ভালোভাবে কাজ করলেও আস্তে আস্তে রোমের শত্রুরা তাদের এই কৌশল সম্পর্কে জেনে যায়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে মিথ্রিডেটস অফ পন্টাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রোমান সেনারা একই কৌশলে থেমিস্কাইরা শহরের প্রাচীরের তলদেশ দিয়ে শহরটিতে ঢুকতে চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু শহরবাসীরা আগে থেকেই সতর্ক ছিলো। তাই তো সেসব সুড়ঙ্গের অস্তিত্ব টের পাওয়া মাত্রই তারা সেখান দিয়ে বেশ কিছু বন্যপ্রাণী ছেড়ে দিয়েছিলো, যার মাঝে ভালুক, এমনকি মৌমাছি পর্যন্ত ছিলো!
রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে যুদ্ধের প্রথম নজির পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে। সিরিয়ার দুরা ইউরোপাস সুড়ঙ্গে ঘটেছিলো এই ঘটনা। ভূগর্ভে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল রোমান ও সাসানীয় পার্সিয়ান সেনারা। পারস্যের সেনারা তখন রোমানদের একটি গ্যারিসন ঘিরে রেখেছিল, চেষ্টা চালাচ্ছিলো এর ভেতরে প্রবেশের।
সুড়ঙ্গ থেকে প্রাপ্ত কঙ্কাল পরীক্ষানিরীক্ষা করে বোঝা গিয়েছে, পারস্যের সেনাদের ব্যবহার করা সালফার ক্রিস্টাল ও বিটুমিন থেকে প্রস্তুতকৃত একধরনের শ্বাসরোধী গ্যাসের প্রভাবে মারা গিয়েছিল রোমান সেনারা।
৫.
অন্যান্য সেনাবাহিনীর মতো রোমান সেনারাও হেলমেট ব্যবহার করতো, তবে তাদের ব্যবহৃত হেলমেট মাথাকে সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও করতো। পলিবিয়াসের লেখনী থেকে জানা যায়, রোমান সেনাদের হেলমেটের উপরিভাগের সাজসজ্জা এমন হতো যে তাতে তাদেরকে প্রকৃত আকারের থেকে বেশ লম্বা দেখাতো। প্রতিপক্ষের সেনাদের মানসিকতার উপর এই দীর্ঘাকৃতি বেশ প্রভাব ফেলতো, তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করতো।
৬.
রোমান রিপাবলিকের সময়কালে কোনো যুদ্ধ ঘোষণার এখতিয়ার ছিলো কেবলমাত্র সিনেটের। কিন্তু কালে কালে রোমান সাম্রাজ্যের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে রোমান জেনারেলদের ক্ষমতাও। তাই পরবর্তীতে সিনেটের অনুমতির কোনো তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন সরাসরি জেনারেলরাই।
এমনই এক যুদ্ধ ছিলো মিথ্রিডেটস অফ পন্টাসের বিরুদ্ধে, খ্রিস্টপূর্ব ৮৯ অব্দে যা রাষ্ট্রদূত ও জেনারেল ম্যানিয়াস অ্যাকুইলিয়াস ঘোষণা করেছিলেন সিনেটের কোনোরকম অনুমতি ব্যতিরেকেই। এটা হয়তো আইনবিরুদ্ধ ছিলো, কিন্তু সিনেটের এখানে আসলে তেমন কিছু করারও ছিলো না। কেন? কারণ কেবলই ক্ষমতা। কিছু কিছু জেনারেলের ক্ষমতা ছিলো কল্পনাতীত। রোম যখন সাম্রাজ্যে পরিণত হলো, তখন যুদ্ধে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতেন একজন সম্রাট।
৭.
রোমান সেনারা সাধারণত যে খর্বাকৃতির তলোয়ার ব্যবহার করতো, সেটার নাম ছিলো গ্ল্যাডিয়াস হিস্পানিয়েনসিস (স্প্যানিশ তলোয়ার)। আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় প্রস্তুতকৃত এই তলোয়ারের কার্যকারীতা ছিলো প্রবাদতুল্য।
মেসিডোনিয়ান যুদ্ধে (খ্রিস্টপূর্ব ২০০-১৯৬ অব্দ) রোমান সেনারা লড়ছিলো পঞ্চম ফিলিপের বিরুদ্ধে। সেখানে গ্ল্যাডিয়াসের খেল দেখে তাজ্জব বনে যায় মেসিডোনিয়ান সেনারা। তখন পর্যন্ত তারা কেবলমাত্র বর্শা আর তীর দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত দেখেই অভ্যস্ত ছিলো। কিন্তু যখন তারা রোমান সেনাদের হাতে সহযোদ্ধাদের দ্বিখণ্ডিত হতে, তাদের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে, মাথা আলাদা হয়ে যেতে কিংবা নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসতে দেখছিলো, তখনই তারা বুঝতে পারে যে, কী ভয়ানক অস্ত্র আর সেনাদলেরই না মুখোমুখি হয়েছে তারা!
৮.
রোমান সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট ছিলো প্রেটোরিয়ান গার্ড। সম্রাটের প্রাসাদ নিরাপদ রাখার পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব ছিলো সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর ভূমিকা পালন করাও। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে এই প্রেটোরিয়ান গার্ডরাই মাঝে মাঝে সম্রাট নিয়োগ দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা শুরু করে দিয়েছিল।
কিন্তু সময় যতই গড়াতে লাগলো, এই প্রেটোরিয়ান গার্ডের ক্ষমতা ততই বাড়তে লাগলো। একটা সময় অবস্থার এমন হলো যে, সম্রাটের নিয়োগ, অপসারণ, এমনকি খুনের মতো কাজে জড়িয়ে গেলো এই বাহিনীর নাম। একজন সম্রাটকে খুন করলে নতুন যিনি আসতেন, তিনি এই গার্ডদের আর্থিক পুরস্কার দিতেন, যা ‘ডোনেটিভ’ নামে পরিচিত ছিলো।
এভাবেই একসময় রোমান সম্রাটের রক্ষাকারী বাহিনীটি দূর্নীতিতে জড়িয়ে সম্রাটের জন্যই সবচেয়ে হুমকিস্বরুপ বাহিনী হয়ে দেখা দিলো।