শুরুর আগে
দুর্ধর্ষ রোমান সাম্রাজ্যের কথা ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। ইতিহাসের ব্যাপারে আগ্রহী নন এমন প্রায় সবাই-ই চলচ্চিত্রে, গল্পে কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে ঠিকই শুনেছেন রোমানদের কথা। অথচ রোমানদের চেয়েও দুর্ধর্ষ আরেকটি জাতির কথা অনেকটাই আড়ালে পড়ে গেছে। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং থেকে শুরু করে বাবর-আকবরের কথা ইতিহাসে যতটা উঠে এসেছে, কেন যেন সেভাবে উঠে আসেনি একইরকম পরাক্রমশালী আরেকজন দিগ্বিজয়ীর বিজয় গাথা।
আটিলা দ্য হান। নিজেকে যিনি পরিচয় দিতেন‘স্কার্য অফ গড’ নামে। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ঈশ্বরের চাবুক! হান সাম্রাজ্য আটিলার মৃত্যুর পর একরকম ধ্বসেই পড়ে। ফলশ্রুতিতে, রোমানরা আবারো ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে। ইতিহাস বরাবরই ক্ষমতাসীনরাই লিখে এসেছে। ভিয়েতনামের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের হেরে যাওয়ার পর এই নিয়ে যেমন খুব বেশি উচ্চবাচ্য হয়নি, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠিটি পুরো ব্যাপারটিকে একরকম আড়ালে নিয়ে গেছে একই ব্যাপার ঘটেছে হানদের ক্ষেত্রেও।
রোমানদের ইতিহাসে হানদেরকে অভিহীত করা হয়েছে ‘বর্বর’ জাতি হিসেবে। সেইসঙ্গে আটিলাকে বলা হয়েছে, বর্বর সেনানী। সবই ঠিক আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইতিহাসের পাতায় পাতায় রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া রোমানরা নিজেদেরকে দাবী করেছে ‘মহান’ জাতি হিসেবে। তবে এ লেখার উপজীব্য রোমানরা নয়, আটিলা দ্য হান এবং হান সাম্রাজ্য। তাই এ প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। আটিলার গল্পে ফেরা যাক।
এই গল্পের প্রতিটি পরতে পরতে আমরা টের পাবো, আটিলা দ্য হান মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খানের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না। যুদ্ধ কৌশল, চাতুর্য, নির্মমতা সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন বিধ্বংসী। ঠিক চেঙ্গিস খানের মতোই, প্রচন্ড নির্মমভাবে একের পর এক সমস্ত কিছু জয় করে চলা এই মানুষটির মৃত্যুকে ঘিরে আছে নিদারুণ অসহায়ত্ব এবং রহস্য।
আটিলা দ্য হানের মৃত্যু যে আসলে কীভাবে হয়েছে কিংবা কোথায় রয়েছে তার কবর, কেউ জানে না!
১
হান নামক এক সাম্রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন আটিলা দ্য হান, যার ইংরেজি অর্থ হলো লিটল ফাদার । তবে ঐতিহাসকদের ধারণা, এটি তার জন্মগত নাম নয়। পরবর্তীতে শ্রদ্ধা থেকে হানরা তাকে এই নাম দিয়েছিল। হানরা মূলত এশিয়ায় বসবাস করতো। দ্বিতীয় শতকের দিকে তারা ইউরোপে প্রবেশ করে। এ সময় গথ নামের এক জাতির সঙ্গে লড়তে হয়েছিল তাদের। যুদ্ধে জিতে গথদেরকে তাড়িয়ে দেয় হানরা। ফলশ্রুতিতে, গথরা গিয়ে রোমে আশ্রয় নেয়। মোটামুটি ৩৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে দানিয়ুব (কেউ কেউ একে বলেন দানুব) নদীর উত্তরাঞ্চলে হানরা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। এর কিছুকাল পরে, ৫ম শতকের দিকে জন্ম নেন আটিলা।
আটিলার জন্ম হয়েছিল হানদের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরিবারগুলোর একটিতে। উল্লেখ্য, বাবরের সঙ্গে তার ছোটবেলার দারুণ মিল লক্ষ্য করা যায়। সেসময় হান সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন মান্ডজুক এবং রুগা নামের দুই ভাই। হানদের মধ্যে আটিলার আগ পর্যন্ত এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করা যায়। একসঙ্গে দুজন শাসক থাকতো তাদের। মান্ডজুক ছিলেন আটিলা এবং ব্লেডার বাবা। আর রুগা ছিলেন তাদের চাচা। আটিলার মায়ের পরিচয় ইতিহাসের গহীনে হারিয়ে গেছে।
আটিলা এবং তার ভাই ব্লেডা তীর-তলোয়ার চালানো, আত্মরক্ষা, ল্যাসো চালানো, ঘোড়ায় চড়া ইত্যাদি যুদ্ধকৌশল শিখতে শিখতেই বড় হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে কূটনৈতিক বিভিন্ন কৌশলও শেখানো হয় তাদের। তার উপর ছোটবেলাতেই মাঝে মাঝে দরবারে বসতেন তারা। ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন, গথিক এবং লাতিন ভাষা জানতেন এই ভ্রাতৃদ্বয়। এই পর্যায়ে এসে একটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো। হানরা সেসময় কী ভাষায় কথা বলতেন, তা জানা যায়নি। মোদ্দা কথা, পরবর্তীতে শাসক হিসেবে তারা যেন সুষ্ঠুভাবে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে পারেন, সেভাবেই গড়ে তোলা হয় তাদের।
রুগার মৃত্যুর পর আটিলা-ব্লেডা একসঙ্গে ক্ষমতায় বসেন। সময় ৪৩৪ খ্রিস্টাব্দ। রুগা তার মৃত্যুর আগে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছিলেন। আসলে, হানদের বিরুদ্ধাচরণকারী অনেক গোত্র হান সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়ে পূর্ব রোমে বসবাস করতে শুরু করে। ক্ষমতার হিসেবে এতে হানরা হেয় প্রতিপন্ন হয়। সেইসঙ্গে এই গোত্রের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কর; সবই চলে যায় পূর্ব রোমানদের হাতে। এতে শুধু হানরাই নয়, পশ্চিম রোমও ক্ষেপে উঠছিল দিন দিন।
কিন্তু ক্ষমতায় এসে আটিলা প্রথমে নিজেদের সীমানার দিকে মনোযোগ দিলেন। যেহেতু অনেক গোত্র হান সাম্রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তাই কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে হানদের ক্ষমতা অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাছাড়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলের গোত্রদের অবস্থাও তখন অনেকটাই এলোমেলো। আটিলা প্রথমে এদেরকে এক করলেন। তারপর নিজেদের নড়বড়ে ভাবটুকু কাটিয়ে ওঠার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, অ্যাটিয়াসকে পশ্চিম রোমান বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সাহায্য দেওয়া। সব সুতো বাঁধা হলে আটিলা দ্য হান ভাই ব্লেডাকে নিয়ে প্রথম বড় আকারের সামরিক যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। লক্ষ্য ফ্রান্সের বারগান্ডিয়ানরা।
২
পশ্চিম রোমান সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে যৌথভাবে বারগান্ডিয়ানদেরকে আক্রমণ করলো হান বাহিনী। আক্ষরিক অর্থেই কচুকাটা করলো তারা প্রতিপক্ষকে। প্রাচীন ইতিহাসবিদ সেন্ট প্রোসপার অফ অ্যাকুইটিয়ান ছিলেন অগাস্টিন অফ হিপোর শিষ্য। তিনি ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে লিখেছেন,
৪৩৭ খ্রিস্টাব্দের সেই যুদ্ধে বারগান্ডিয়ানদেরকে ‘সমূলে’ উপড়ে ফেলেছিল হান আর পশ্চিম রোমানদের যৌথবাহিনী।
এর পরপরই তারা আবারো যৌথভাবে গথদেরকে আক্রমণ করেন। তবে এবারে সিটি অফ টোলাউসাতে তারা হেরে যায়। ফলে হানরা তাদের বাহিনী নিয়ে দানিয়ুবের ওপারে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। ক্ষয়ক্ষতি সারানোর জন্য তাদের তখন যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। কিন্তু এর মধ্যেই হান সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তির ব্যাপারে সবার ধারণা হয়ে গেছে। কাজেই, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য হানদের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তিতে আসে। প্রিয় পাঠক, একটু থেমে আন্দাজ করার চেষ্টা করুন তো, পূর্ব রোমানদের এজন্য কী মূল্য দিতে হয়েছিল?
ঐতিহাসিক কেলির মতে,
পূর্ব রোমানরা আটিলা এবং ব্লেডাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রতি বছর ৭০০ পাউন্ড করে স্বর্ণ কর (Tax) দিত!
তবে, এসব দিয়েও হানদেরকে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। কেলি লিখেছেন, ৪৪১ খ্রিস্টাব্দের দিকে পূর্ব রোম তাদের সেনাবাহিনীকে সিসিলি এবং উত্তর আফ্রিকা আক্রমণ করতে পাঠায়। সেখানে ভ্যান্ডাল নামের এক জাতি থাকত। তারাই ছিল এ আক্রমণের মূল লক্ষ্য। এবং এই সুযোগটাই নিয়েছিল চতুর হানরা। দানিয়ুবের তীর ধরে পূর্ব রোমে পরপর বেশ কিছু আক্রমণ চালায় তারা। হানদের প্রথম লক্ষ্য ছিল কন্সট্যানটিয়া শহর। ঘটনার বর্ণনা উঠে এসেছে কেলির লেখনীতে,
বাজারের দিন ছিল সেদিন। মানুষজন নিজেদের কেনাকাটায় ব্যস্ত। এরকম সময় কোনো ধরনের পূর্ব সংকেত ছাড়াই আক্রমণ করে হানরা। নিঁখুত এবং পরিকল্পিত এক আক্রমণে পুরো শহর দখল করে নেয় তারা।
যেহেতু বেশিরভাগ সৈন্যই ভিনদেশে, রোমান সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস উপায়ন্তর না দেখে আবারো সন্ধির প্রস্তাব দেন। তাতে গা করেনি হানরা। একরকম বিনা বাধায় যতটুকু সম্ভব লুট করে নিতে থাকে তারা। এদিকে রোমান সম্রাট নিজের সেনাবাহিনীর কাছে দূত পাঠিয়ে তাদের দ্রুত ফিরতে বলেছেন। কিন্তু তারা আসার আগেই বিপুল ধন-সম্পদ লুট করে দানিয়ুবের ওপারে, নিজস্ব এলাকায় ফিরে আসে হানবাহিনী।
৩
আটিলা দ্য হান ঠিক কোন ধর্মে বা বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে তিনি দৈব বাণীতে বিশ্বাস করতেন। নিজেকে তিনি শুধু স্কার্য অফ গড বলে পরিচয়ই দিতেন না, আসলেই বিশ্বাসও করতেন। এর পেছনে একটা অদ্ভুত গল্প আছে। আটিলার এক শেফার্ড কুকুর হঠাৎ করেই দারুণ যত্ন নিয়ে তৈরি একটি তলোয়ার আবিষ্কার করে। এই তলোয়ার কে তৈরি করেছে বা কীভাবে এখানে এলো- তা জানা যায়নি। তিনি এটাকে দৈব চিহ্ন বলে ধরে নেন। তলোয়ারটা সবসময় নিজের সঙ্গে রাখতেন আটিলা। সেই থেকে তার ধারণা হয়, যুদ্ধ করা এবং সব কিছুর উপর নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা তার অধিকার।
সম্ভবত এই ভাবনা থেকেই ৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে আটিলা তার ভাই ব্লেডাকে খুন করেন। তবে এই খুন তিনি কীভাবে করেছেন বা তখন আসলেই কী হয়েছিল- ঐতিহাসিকরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে আটিলা হয়ে ওঠেন হান সাম্রাজ্যের একক ক্ষমতাধিকারী। সর্বেসর্বা। পূর্ব রোমের সঙ্গে তার হিসাব নিকাষর তখনো বাকি আছে। পূর্ব রোমান সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস সেই ঝটিকা আক্রমণ এবং লুটতরাজের পরে স্বর্ণ কর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
আটিলা আবারো সৈন্যবাহিনী নিয়ে হামলা করলেন। এবারে আর তিনি এক শহর নিয়ে থামবেন না, একেবারে রাজধানীতে গিয়ে ঘাঁটি গেড়ে তারপর থামার কথা ভাববেন। মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ যাকে বলে, ঠিক এরকম সময় রোমের রাজধানী কন্সট্যানটিনোপোলে ভূমিকম্প হলো। এই ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় রোমানদের। এমনকি তাদের রাজধানীর শহর-দেয়ালের নানা জায়গা ভেঙ্গে পড়ে। ফলে পূর্ব রোমানরা আটিলাকে ঠেকানোর জন্য মরিয়া হয়ে যা যা করা সম্ভব, সব করার প্রস্তুতি নেয়। পূর্ণ শক্তিতে দেয়াল মেরামতের কাজ শুরু হয়। কিন্তু আটিলা এর মধ্যে চলে এলে তাকে থামানোর উপায় কী?
কেলি লিখেছেন,
রোমানরা তাদের রাজধানী বাঁচানোর জন্য একের পর এক শহর, সেনাবাহিনীর পর সেনাবাহিনী আটিলার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে থাকে।
তখন পর্যন্ত মানুষ ভাবত, রোমানরা অপরাজেয়। আটিলা দ্য হান এই কথাকে সর্বাঙ্গে ভুল প্রমাণিত করলেন। কচুকাটা হতে লাগল সৈন্যদল। একের পর এক শহর মুখ থুবড়ে পড়তে লাগল। ষষ্ঠ শতকের ইতিহাসবিদ মার্সেলিনাস লিখেছেন,
শহর, দূর্গ; রাজধানীর আশেপাশের সব কিছুকে ধুলোয় মিশিয়ে সামনে এগোতেই থাকলেন আটিলা দ্য হান।
প্রায় ৭০টির মতো রোমান শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো। এই পর্যায়ে এসে সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস বাধ্য হলেন আটিলার সঙ্গে আরেক দফা শান্তিচুক্তি করতে। কিন্তু আগের সেই মূল্যে আটিলা রাজী হলেন না। ফলশ্রুতিতে বাৎসরিক ২,১০০ পাউন্ড স্বর্ণ কর দেয়ার চুক্তিতে আটিলাকে রাজী করানো হয়। ঐতিহাসিকদের মতে,
যুদ্ধ করার চেয়ে, এই কর দেয়ায় বরং পূর্ব রোমানদের খরচ কম হয়েছিল। আর এটুকু তাদের সামর্থ্যের তুলনায় ছিল নিতান্ত অল্প।
এর মধ্য দিয়ে আটিলা দ্য হান এবং পূর্ব রোমানদের যুদ্ধ আপাতত মুলতুবি হয়। পশ্চিমের দেশগুলো আটিলার মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তবে এমনি এমনি নয়। এর পেছনেও আছে অদ্ভুত এক গল্প।
৪
গল্পের ভেতরেও গল্প থাকে। আটিলা দ্য হানের সারা জীবনের সমস্ত কিছু বিস্তারিত বলতে গেলে তাই এ লেখা শেষ হবে না। ঘটনার ঘনঘটায় বিশাল প্রভাব ফেলেছে, এরকম ব্যাপারগুলো নিয়েই তাই বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে। এছাড়া, বাকি ঘটনাগুলো একটু সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক।
পূর্ব রোমানদের সাথে এই যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আটিলার কথা চারপাশের সবখানে ছড়িয়ে গেছে। ঘোড়ায় চড়ে আটিলা আসছেন, এই চিত্র গেঁথে গেছে মানুষের মস্তিষ্কে। খ্রিস্টানদের মধ্যে ‘স্কার্য অফ গড’ নামটা ততদিনে ব্যাপক প্রচলিত হয়ে উঠেছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে, স্বয়ং স্রষ্টা না থামালে এই সাক্ষাৎ ধ্বংসের দূতকে থামানো মানুষের পক্ষে সম্ভব না।
চেঙ্গিস থেকে বাবর সবার ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটা চোখে পড়ে। প্রতিপক্ষের ভয়ে আপনার যদি যদি থরথরি কম্পমান অবস্থা হয়, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই মনে মনে হেরে যান; তাহলে বাধা দেয়ার প্রশ্নই থাকে না। একই জিনিস আটিলার ব্যাপারেও হলো। এশিয়ার অনেকটা অঞ্চল, ইউরোপে ফ্রান্স থেকে শুরু করে বেলজিয়াম, গ্রিস পর্যন্ত- এই বিশাল অঞ্চলটুকু একরকম বিনা বাধায়ই আটিলার দখলে চলে এলো।
ঐতিহাসিক জর্ডানসের বর্ণনায় আটিলার ব্যাপারে আরেকটি ব্যাপার উঠে এসেছে। নির্মম বর্বরদের মধ্যে থেকেও আটিলা কিছুটা আলাদা ছিলেন। যুদ্ধপ্রিয় হলেও রাজদরবারে তার কথা শুনে তাকে যথেষ্ট ধীর স্বভাবের মানুষ বলে মনে হতো। ছিলেন বকলম, অথচ মনে হতো, যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, দৈব নিয়ে নিজের বিশ্বাস প্রজা এবং নিজ সেনাবাহিনীর মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন- অন্যরকম এক শ্রদ্ধা পোষণ করতো তারা তার ব্যাপারে।
এই যখন অবস্থা, তখনই এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতি তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের বোন রাজকন্যা অনোরিয়া আটিলার সাহায্য চেয়ে পত্র লিখলেন। সম্রাট চাইছিলেন বোনকে এমন একজনের সঙ্গে বিয়ে দিতে, যাতে সে রোমান সাম্রাজ্যের কোনো অংশ দাবী না করতে পারে। অনোরিয়া আটিলাকে লিখলেন, তিনি এই বিয়েতে রাজী নন এবং এ ব্যাপারে আটিলার হস্তক্ষেপ আশা করছেন। বিনিময়ে আটিলাকে প্রচুর স্বর্ণ দিতে রাজী আছেন তিনি। পত্রের সঙ্গে একটি আংটিও ছিল।
আটিলা ভাবলেন, অনোরিয়া তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ফিরতি পত্রে তিনি লিখলেন, যৌতুক হিসেবে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অর্ধেক তার চাই। তবে অনোরিয়া এই সবকিছু আটিলার সঙ্গে যুগ্মভাবে শাসন করতে পারবেন। আটিলার পত্র পেয়ে অনোরিয়া জানালেন, তিনি আটিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেননি, এবং তাকে তিনি বিয়ে করতে রাজীও নন। একই সঙ্গে ভ্যালেন্টিনিয়ানও বার্তা পাঠালেন আটিলার কাছে। জানালেন, এমন কোনো প্রস্তাব বা কিছুই তাকে পাঠানো হয়নি।
এই ফিরতি বার্তা কি অনোরিয়া নিজেই পাঠিয়েছিলেন? সেটা জানার এখন আর কোনো উপায় নেই। আটিলা কি আসলেই ভুল বুঝেছিলেন? জানার উপায় নেই তা-ও। তবে একরকম হুড়োহুড়ি করেই অনোরিয়ার বিয়ে হয়ে যায় পূর্ব নির্ধারিত পাত্রের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় কথা, সেসময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, উপহার বা নমুনা হিসেবে আটিলাকে স্বর্ণের খন্ড পাঠাতে পারতেন অনোরিয়া। তা না করে তিনি আংটি পাঠিয়েছিলেন। ইচ্ছা করেই কি ভুল বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি আটিলাকে? পাঠক, এ প্রশ্নের ভার নাহয় আপনার কাছেই তোলা থাকুক!
এর পরের ঘটনা প্রবাহ খুবই অদ্ভুত। এমন কিছু ঘটনা পরপর ঘটেছে যে, ব্যাপারগুলো চিন্তার উদ্রেক করে। প্রশ্ন তোলে মনে, কিন্তু উত্তর মেলে না। সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবল গতিতে আটিলা এগিয়ে গেলেন পশ্চিম রোমের দিকে। অঞ্চল হিসেবে বলা যায় ইতালির দিকে। পথিমধ্যে সবকিছু দখল করে নেন তিনি। তারপর হঠাৎ করেই পো নদীর তীর থামলেন আটিলা। অথচ এই অঞ্চলে তখন প্লেগের প্রকোপ চলছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো, প্লেগ ছড়িয়ে পড়ল হান সেনাবাহিনীতে। রোগীদের সেবা দেয়া আর এতদিনের টানা যুদ্ধে দেখা দিল খাদ্য সংকট।
ওদিকে রোমান সম্রাট জেনারেল অ্যাটিয়াসকে গিয়ে ধরলেন। হানদের সঙ্গে সখ্যতা ছিল তার। কৈশোরে অনেকটা সময় হান সমাজেই কাটিয়েছেন। রোমান বাহিনীতে বড় পদও বাগিয়েছেন তাদেরই সাহায্যে। আটিলাকে আটকাতে হলে অ্যাটিয়াসের বিকল্প নেই। অ্যাটিয়াসও রাজী হলেন। এদিকে ফ্রান্স এবং ইতালির আশেপাশের সমস্ত বর্বর এবং যাযাবর গোত্রের লোকজনও রোমানদের সঙ্গে যোগ দিল।
কাতালোনিয়ার মাঠে মুখোমুখি হলো দুই বাহিনী। ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোর একটা সংঘটিত হলো এখানে। লাশের পর লাশ পড়লো, ধুলোর মেঘে ঢাকা পড়ে গেলো আকাশ। অন্ধকার নেমে এলো যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রায় দেড় লক্ষের মতো মানুষ মারা যাওয়ার পর আটিলা দ্য হান কিছুটা পিছিয়ে এলেন। প্রচন্ড রাগে-ক্ষোভে চিৎকার করছিলেন এই নির্মম নৃপতি। না, তার বাহিনী এখনো ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়নি। যুদ্ধে তার পরাজয় হয়েছে- এ কথা কেউ বলতে পারবে না।
কিন্তু রোমানরা নিজেদেরকে সে যুদ্ধে বিজয়ী হিসেবেই ধরে নিল। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থমাস বার্নস লিখেছেন,
এটা এমন এক যুদ্ধ, যার আসলে কোনো শেষ নেই!
ঘটনার কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। হলে সেটা অবশ্যই অদ্ভুত কিছু হতো না। আটিলা পিছিয়ে এসেছেন দেখে রোমানরাও ফিরে গেল শহর প্রাচীরের ভেতরে। কিন্তু শক্তি সঞ্চয় করে আবারো এগোলেন আটিলা। তার স্পষ্ট দাবী। রাজকন্যা এবং রাজ্যের অর্ধাংশ; দুটোই তার চাই। শুধু তা-ই নয়, তিনি বললেন, অনোরিয়া আসলেই তাকে বিয়ে করতে চান। ভাইয়ের জন্য পারছেন না।
অনোরিয়ার কাছ থেকে এবারে কিন্তু কোনো নেতিবাচক বার্তা আসেনি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আটিলার সঙ্গে দেখা করতে ভ্যালেন্টিনিয়ান পাঠিয়েছিলেন পোপ প্রথম লিওকে। রোমের কিছুটা দূরে পোপের সঙ্গে আটিলার দেখা হলো। কিছুক্ষণ কথা বলার পর, কোনোরকম উচ্চবাচ্য না করে নিজ বাহিনী নিয়ে সোজা ফিরতি পথ ধরলেন আটিলা দ্য হান।
কী কথা হয়েছিল তাদের মধ্যে? কেউ জানে না। এমনকি রোমানরাও কখনো এ নিয়ে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। কোনো কর বা কিচ্ছু দেয়নি কেউ কাউকে। নিয়তি স্বয়ং কি তাহলে কোনোভাবে হাতে তুলে নিয়েছিল আটিলার ভবিতব্য? কেউ জানে না!
৫
অনোরিয়াকে কি মনে রেখেছিলেন আটিলা? নাকি, পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল? এই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর পর তিনি আর সেভাবে কোনো যুদ্ধ করেননি। প্রায় বছরখানেক পর আরেকটা বিয়ে করেন আটিলা। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো। তিনি প্রথম কখন বিয়ে করেছিলেন, ইতিহাসে সেটা সেভাবে উঠে আসেনি। তবে আটিলা বহুগামী ছিলেন। তার শেষ স্ত্রী ছিল ইলডিকো। বিয়ের রাতের ব্যাপক খানাপিনার পরের দিন সকালে তাকে স্ত্রীর পাশে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিক প্রিসকাসকে বলা হয় সে সময়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ। তার ভাষ্যমতে, নাক-গলার সংযোগস্থলের কোনো রক্ত বাহিকা শিরা বিস্ফোরিত হওয়ার ফলেই মৃত্যু হয়েছিল আটিলার। তবে এ নিয়ে অনেকগুলো ভিন্নমতও আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আরেকটি মত হিসেবে, ইলডিকোর হাতে খুন হয়ে গিয়েছিলেন আটিলা দ্য হান।
পুরো সেনাবাহিনী তার মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছিল। সৈন্যরা মুখে রক্ত মেখে তার তাবু ঘিরে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে শোক প্রকাশ করেছিল। প্রিসকাসের ভাষ্য উল্লেখ করে ইতিহাসবিদ কেলি লিখেছেন,
মাথা কামিয়ে ফেলেছিল সব সৈন্য। তারপর নিজেদের সমস্ত মুখ আঁচড়ে বিক্ষত করেছিল। অশ্রু দিয়ে নয়, রক্ত দিয়ে নিজেদের সম্রাটকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিল তারা।
আটিলার কবর কোথায় হয়েছে, কেউ জানে না। কিংবদন্তী বলে, কোনো এক নদীর গতিপথকে বাঁধ দিয়ে বাঁকিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর নদীর বুকে কবর দেয়া হয় তাকে। পরে বাঁধ খুলে দেয়া হয়, শুরু হয় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ। এ কাজে নিয়োজিত প্রত্যেককে খুন করা হয়েছিল, যাতে এই জায়গাটির কথা কেউ কখনো জানতে না পারে।
২০১৪ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে আবিষ্কৃত এক কবরকে আটিলার কবর বলে দাবী করেছিলেন কয়েকজন গবেষক। তবে, সেই দলের বাইরের কেউই তাদের সঙ্গে একমত হননি। আটিলার সঙ্গে হয়তো তার সম্পদের বিশাল একটি অংশও কবর দেয়া হয়েছে। সেসময় এই রীতি ছিল। তবে, সত্য-মিথ্যা নিশ্চিত করে বলার তো কোনো উপায় নেই!
হান সাম্রাজ্য আটিলার ছেলেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। কে বেশি পাবে, এই নিয়ে যুদ্ধ করে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে তারা। মাত্র ১৬ বছর বা এরকম সময়ের মধ্যেই ধ্বসে পড়ে বিশাল এই সাম্রাজ্য। এদিকে, রোমানরা এমনিতেই যথেষ্ট ক্ষমতাধর ছিল। হান সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ক্ষমতার সবটুকুই তাদের হাতে চলে যায়। এভাবেই, ইতিহাসের পাতায় টিকে গেলেও, অনেকটাই আড়ালে পড়ে যায় হানরা। সেইসঙ্গে আড়ালে চলে যান স্কার্য অফ গড খ্যাত নির্মম নৃপতি আটিলা দ্য হান।