গত এক দশকে পূর্ব এশিয়ায় বেশ কিছু পালাবদল এসেছে। একদিকে অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে চীনের, অপরদিকে সামরিক উত্থান ঘটেছে উত্তর কোরিয়ার। চীনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সামরিক উত্থান ঘটেছে বললেও ভুল হবে না। এই দুটি দেশের প্রধান শত্রু একটিই- আমেরিকা। ফলে একটি সাধারণ শত্রু থাকায় দুটি দেশের মধ্যে বেশ জোরালো কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত উত্তর কোরিয়ার আমদানি ও রপ্তানি বহুলাংশে নির্ভর করে চীনের উপর। জাপানের ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে উপরের দুটি দেশেরই বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধকে কাজে লাগিয়েই বর্তমান চীনের প্রধান শত্রু আমেরিকা দুটো দেশের সাথেই সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া, দুটোরই মিল আছে বেশ কিছু দিক থেকে। দুটোই অর্থনৈতিকভাবে এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম। বিশ্বের নাম করা বেশ কিছু প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানের শেকড়ও এই দুটি দেশে। তারপরও বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে, যেগুলো দুটি দেশের জোড়ালো বন্ধন তৈরিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৮ সালে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বোচ্চ আদালত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জোরপূর্বক শ্রমপ্রদানে বাধ্য করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় দুটি জাপানি কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। একটি হচ্ছে নিপ্পন স্টিল এন্ড সুমিটোমো মেটাল কর্পোরেশন, আরেকটি মিতসুবিশি হেভি মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ। কিন্তু জাপানি সরকার দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
জাপান সরকারের দাবি ছিল যে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার যে ক্ষতিপূরণ দাবি করছে, তা ১৯৬৫ সালেই দেয়া হয়ে গিয়েছে। ১৯৬৫ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, যে চুক্তির অধীনে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের স্বাভাবিকীরণ হয়েছিল। এর পাশাপাশি জাপান সরকার ৫০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ারও অঙ্গীকার করে। এটি ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন জাতীয় বাজেটের দেড় গুণ। দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলে থাকে, ১৯৬৫ সালের সেই চুক্তিতে দেশটির রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আমেরিকার চাপে একপ্রকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছিলেন।
জাপান কেন ১৯৬৫ ঐতিহাসিক বিরোধগুলো মিটিয়ে ফেলার তার দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল? কেন প্রায়ই বিভিন্ন দিক থেকে মিল থাকার পরও দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে নামে? এসবের উত্তর জানতে হলে আমাদেরকে দুই দেশের বিরোধপূর্ণ ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে। মূলত তিনটি ঐতিহাসিক বিষয় জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কে কয়েক দশক থেকেই প্রভাব ফেলে আসছে। একটি হচ্ছে কোরীয় উপদ্বীপকে জাপানি সাম্রাজ্যের উপনিবেশে রূপান্তরিত করা, ঔপনিবেশিক সময়ে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরীয়দের নারীদেরকে যৌন দাসত্বে বাধ্য করা, এবং শেষটি হচ্ছে কোরীয় শ্রমিকদেরকে জোরপূর্বক শ্রমপ্রদানে বাধ্য করা।
ইতিহাসে অনেক আগে থেকেই কোরীয় উপদ্বীপের সাথে জাপানের বিরোধ ছিল। জাপান বারবার চেষ্টা করেছে দ্বীপরাষ্ট্রটির উপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার। উনিশ শতকের শেষ দিকে জাপানের সামরিক সক্ষমতা বেড়ে যায় বহুগুণ। তারা তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনে, পূর্ব এশিয়ায় নিজেদেরকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির করা প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় তাদের। তখন কোরিয়া ছিল চীনের চিন রাজবংশের অধীনে শাসিত একটি অঞ্চল। চিন সাম্রাজ্যের সাথে উচ্চাভিলাষী জাপানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হলে চিন সাম্রাজ্য পরাজিত হয় এবং সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী কোরিয়াকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হলেও আদতে জাপানিরা দ্বীপটিতে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
এক্ষেত্রে কোরিয়ার তৎকালীন নেতৃত্ব রুশ সাম্রাজ্যের সহযোগিতা প্রার্থনা করলে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। এখানেও জাপান জয় লাভ করলে কোরিয়ার উপর জাপানী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। ১৯১০ সালে জাপান চূড়ান্তভাবে কোরিয়াকে নিজেদের মানচিত্রের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। সার্বভৌমত্ব হারানোর প্রতিবাদে কোরীয়দের অনেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তুললেও সেগুলো কঠোরভাবে দমন করা হয়।
কোরিয়াকে নিজেদের মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেও কোরীয় উপদ্বীপকে মোটেও জাপানের মূল ভূখন্ডের মতো দেখা হচ্ছিল না। বরং ইউরোপীয়রা যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপনিবেশবাদকে দেখতো, জাপানরাও কোরিয়াকে ঠিক একইভাবে দেখা শুরু হয়েছিল। জাপানে তখন শিল্পবিপ্লবের ফলে প্রচুর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, যেগুলোতে দরকার হচ্ছিল প্রচুর জনবল। জাপানিরা দেখতে পায়, কোরীয়রা যেহেতু তাদের ‘অধস্তন’, অতএব তাদেরকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এরপর জাপানিরা কোরীয়দের শ্রমিক বানিয়ে জোরপূর্বক শ্রমপ্রদানে বাধ্য করে। শিল্পবিপ্লবের ফলে কয়লার চাহিদা অত্যধিক থাকায় অসংখ্য খনি খনন করা হয়। এসব খনিতে কাজ করা ছিল অত্যন্ত কষ্টদায়ক এবং বিপদজনক। জাপানিরা এক্ষেত্রেও কোরীয়দের দিকে নজর দেয়। হাজার হাজার কোরীয়কে খনিশ্রমিক হিসেবে খনিগুলোতে নিয়োজিত হতে বাধ্য করে। এই শ্রমিকদের ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না, পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় দেয়া হতো না এবং অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। অসংখ্য কোরীয় খনিশ্রমিক চিকিৎসা অভাবে, না খেয়ে মৃত্যুবরণ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে উচ্চাভিলাষী জাপানি সেনাবাহিনী অক্ষশক্তির জাপান ও ইতালির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। জাপানিদের চোখে তখন বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্ন। এই যুদ্ধের সময় জাপানিদেরকে লড়তে হয়েছিল বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে। এ কারণে অসংখ্য জাপানি সৈন্যকে মাতৃভূমি ছেড়ে বিভিন্ন দেশে গমন করতে হয়েছিল। এই সৈন্যদের জীবন যেন যুদ্ধের ময়দানে নিরানন্দ হয়ে না ওঠে, এজন্য জাপানের সেনাবাহিনী অসংখ্য কোরীয় নারীকে যৌনদাসত্ব গ্রহণে বাধ্য করে। এই নারীদের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত সামরিক বাহিনী পরিচালিত পতিতালয়ে যৌন দাসী হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অসংখ্য জাপানি সৈন্যের পাশাপাশি যৌন দাসত্ব বরণে বাধ্য হওয়া কোরীয় নারীও মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া যুদ্ধের সময় অসংখ্য কারখানায় কোরীয় নাগরিকদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছিল। এই কারখানা শ্রমিকদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন পরিশ্রমিক দেয়া হতো না, খাবার দেয়া হতো না ঠিকমতো, অসুস্থ হলে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা ছিল না। অর্থাৎ কোরীয়দের ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক অধিকার ঠিকমতো দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সাম্রাজ্যবাদী জাপান।
১৯৪৫ সালে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়। এর ফলে কোরীয় উপদ্বীপ স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু ঔপনিবেশিক ও যুদ্ধ চলাকালে জাপানিরা যেভাবে কোরীয় নাগরিকদের প্রতি আচরণ করেছিল, সেটি এত সহজে ভুলে যাওয়া উপায় ছিল না। তাই স্বাধীনতার বিশ বছর পরেও দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। ১৯৬৫ সালে আমেরিকার মধ্যস্থতায় দুটি দেশের মধ্য চুক্তি সম্পন্ন হলে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এর পাশাপাশি জাপান বড় অংকের ক্ষতিপূরণও প্রদান করে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার নেতৃত্ব বরাবরই এই ক্ষতিপূরণকে যথাযথ মনে করেনি। ফলে বেশ কয়েকবার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিবাদে জড়িয়েছে দুটো দেশ।
২০১৯ সালে জাপান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি শিল্পের জন্য অতি প্রয়োজনীয় রাসায়নিক কাঁচামাল রপ্তানি কমিয়ে দেয়, যেটি দেশটির প্রযুক্তি শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়া দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত একটি ‘ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং’ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দেয়। সম্প্রতি দুটো দেশই মুখে জোরালো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানালেও বারবার তাদের মাঝে সেই ‘তিক্ত অতীত’ হানা দিয়েছে।