ছাত্রজীবনে পরীক্ষা নামক দানব তাড়া করে বেড়ায় দিনরাত্রি। পরীক্ষার চিন্তায় নাওয়া খাওয়া শিকেয় উঠে বসে। ক্লাস পরীক্ষা, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষা, হঠাৎ পরীক্ষা, ষাণ্মাসিক পরীক্ষা, টিউটোরিয়াল পরীক্ষা, প্রস্তুতি পরীক্ষা, অর্ধ বাৎসরিক পরীক্ষা, বাৎসরিক পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা– পরীক্ষার যেন অভাব নেই! এতসব পরীক্ষার যাঁতাকলে রীতিমত নাভিশ্বাস উঠে যায় ছাত্রদের। পরীক্ষার সাতদিন আগে থেকেই এক অজানা আতঙ্ক ভর করে বসে মনের মধ্যে। কেমন যেন অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি বিরাজ করতে থাকে। খাওয়ার অরুচি, মাথাব্যথা, বমি বমি লাগা এমনকি অনেকের জ্বরও চলে আসে! এই যে আমাদের জীবনটা এত বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে, কখনো কি আপনাদের জানতে ইচ্ছে করে নি পরীক্ষা নামক এই পুলসিরাতের প্রবর্তক কে? কে এই পরীক্ষা পদ্ধতিকে শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবনের মাঝে একটি সাঁকোর ন্যায় বানিয়ে দিয়েছেন? চলুন আজ জানা যাক তার সম্পর্কেই!
১৯১৩ সালের ২০ নভেম্বর জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন হেনরি ফিশেল। তিনিই সর্বপ্রথম পরীক্ষা পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। আমেরিকার ব্লুমিংটন শহরে অবস্থিত ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে তিনি প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি জিউইশ স্টাডিজ প্রোগ্রাম চালু করেন। পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের পেছনে তার ধারণাটা ছিল অনেকটা এরকম– চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে যেকোনো ঘটনা বা ব্যক্তিকে সঠিকভাবে যাচাই বাছাই করা উচিত। আর এই যাচাই বাছাইয়ের জন্য প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতির”।
সময়ের সাথে সাথে পরীক্ষার ধরন পাল্টেছে, পরিমাপক সূচক পাল্টেছে। যদি বাংলাদেশের স্কুলের পরীক্ষা পদ্ধতির কথাই বলা হয়- আজ থেকে ২০ বছর আগে বইয়ের পড়া আত্মস্থ করে ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার হলে যেত এবং সেগুলো পরীক্ষার খাতায় লিখে আসত। কিন্তু বর্তমানের পরীক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণই আলাদা। বর্তমানে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে আগের মত গৎবাঁধা পড়া মুখস্থ করে গিয়ে পরীক্ষার হলে লেখার কোনো সুযোগ নেই।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে– পরীক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্বে তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়নটা কেমন ছিল। সেই সময়গুলোতে পরীক্ষার দুশ্চিন্তা নিয়ে কেউ পড়ালেখা করত না। বছর শেষে তারা যা শিখেছে তাই নিয়ে তাদেরকে কাজ করতে বলা হতো। নতুন কিছু আবিষ্কার করা বা নতুন ধারণা প্রবর্তনের জন্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা হত। শিক্ষার্থীরাও নতুন কিছু তৈরির লক্ষ্যে বেশ উৎসাহের সাথেই পড়াশোনা করত সারা বছর। কে কতটা নতুন কিছু উপহার দিতে পারছে তা নিয়ে সকলের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো এবং সবচেয়ে অসাধারণ কাজটিকে পুরস্কৃত করা হতো। সেসব দিনের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা মনে হলে ক্ষণিকের জন্য মনটা ভালো হয়ে যায় কি?
বর্তমানে আনন্দ নিয়ে অনেকেই পড়াশোনা করে না, নতুন কিছু শেখার জন্য কেউ বইয়ের পাতা উল্টায় না, অনেক তথ্য ঘেঁটে কেউ অ্যাসাইনমেন্ট করে না। পরীক্ষার আগের রাতে কোনোরকম বইয়ের পাতায় লেখাগুলো পড়ে গিয়ে পরের দিন পরীক্ষার খাতায় বমি করে দেয়। বমি করে দেয়ার পর যেমন আমাদের পেটে কোনো খাদ্য অবশিষ্ট থাকে না, ঠিক তেমনি পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আসার দুদিন পর সেসব পড়া বা তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনো ছাত্রছাত্রীর মুখ দিয়ে রা বের হবে না। ছেলেপুলেরা শুধুমাত্র পরীক্ষা পাশের জন্য বিদ্যে হজম করে, জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়। বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি ছাত্রদের চিন্তাশক্তিকে তালাবদ্ধ করে দিয়েছে, শুধুমাত্র চোখের সামনে থাকা কালো হরফে লেখা কিছু তথ্যকে আত্মস্থ করতে শিখিয়েছে।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে জানা যায়, প্রাচীন চীনে সর্বপ্রথম একধরনের প্রমিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ, সময়টা তখন সুই সাম্রাজ্যের। তথাকথিত সুনির্দিষ্ট কিছু সরকারি পদে যোগ্য লোককে নিয়োগ প্রদানের জন্য একধরনের রাজকীয় পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন ছিল। এর প্রায় ১,৩০০ বছর পরে অর্থাৎ ১৯০৫ সালে কিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে চীনে চলতে থাকা এই পরীক্ষা পদ্ধতি স্থগিত করা হয়। ইংল্যান্ডের শাসক সমাজের কাছে আবার এই পরীক্ষা পদ্ধতি বেশ মনঃপুত হয় এবং ১৮০৬ সালে তারা তাদের রাজ্যের বেসামরিক পদে লোকবল নিয়োগের জন্য অনেকটা একইরকম পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে। পরে ধীরে ধীরে এই পরীক্ষার প্রচলন তাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও অনুপ্রবেশ করে। আর এভাবেই একসময় পুরো বিশ্বে পরীক্ষা পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে।
এবার পরীক্ষাভীতি নিয়ে কিছু কথা বলি। কখনো কি নিজের বা আপনার সন্তানের ছেলেবেলার কথা ভেবে দেখেছেন? ধরেই নিন না, আপনার সন্তান জীবনে প্রথম কোনো পরীক্ষা দিচ্ছে, হতে পারে ভর্তি পরীক্ষা বা অন্য যেকোনো পরীক্ষা। পরবর্তীতে পরীক্ষাপত্র হাতে পেয়ে দেখলেন সে ৩০টি বানান ভুল করেছে। পরীক্ষা দিয়ে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত তার মনে কোনো পরীক্ষাভীতির অনুভূতি নেই। যেই মাত্র আপনি পরীক্ষাপত্র দেখার পর তাকে বকুনি দিয়ে বসলেন বা কানটাই হয়ত মলে দিলেন, পরীক্ষা নামক ভীতিটির জন্ম এখান থেকেই।
পরবর্তীতে সে যতবার পরীক্ষা দিতে যাবে, তার মনে এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা অ্যালার্মের মত বেজে উঠবে। অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা সারা বছর প্রচুর পড়াশোনা করলেও পরীক্ষা ঘনিয়ে আসলে তাদের কাছে মনে হয় তারা সবকিছু ভুলে যাচ্ছে, কিছুই পড়া হয়নি তাদের। এটি সম্পূর্ণরূপে একটি মানসিক ব্যাপার, যার বাস্তবিক কোনো ভিত্তি নেই। আবার অনেকে সারা বছর বইয়ের উপর জমে থাকা ধুলার পুরু আস্তরণ পরিস্কার করার জন্যও পড়ার টেবিলের ধারেও যায় না, পড়াশোনা তো অনেক দূরের কথা। এসব ছাত্র পরীক্ষার আগের রাতে বই-পুস্তক খুলে বসলে সবকিছুই একটা গোলকধাঁধা বলে মনে হয় এবং মনে কিঞ্চিৎ ভীতির উদ্রেক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষকরা খুব সহজ সরল কিছু বিষয়বস্তুকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে অনেক জটিলভাবে উপস্থাপন করে থাকেন, যা ছাত্রদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠে। সব মিলিয়ে ছাত্রদের মনে পরীক্ষায় অসফল হওয়ার একটা দুশ্চিন্তা সবসময় থেকেই যায়।
ক্লাস চলাকালীন শিক্ষক যা পড়ান, তা যদি নোট করে নেয়া হয় তাহলে তা পরবর্তীতে অনেকটা উপকারে আসে। পরীক্ষার আগে সেই নোটবইটা খুলে বসলেও ক্লাসের সেই লেকচারগুলো মনে পড়ে যায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজকাল স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই অভ্যাসটা একদমই নেই এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তো বই-খাতা ছাড়াই ক্লাসে উপস্থিত হয়।
পরীক্ষা নিয়ে আমরা অনেকেই বলে থাকি- “পরীক্ষা কি কোনো মানুষের যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে? অনেকের প্রকৃতপক্ষে খুব প্রগাঢ় চিন্তা বা কল্পনাশক্তি না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা আত্মস্থ করে একাডেমিক পরীক্ষাগুলোতে শীর্ষস্থান অধিকার করছে”।
একবার ভাবুন তো যদি পরীক্ষা পদ্ধতি না থাকতো তাহলে ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী আর সর্বাপেক্ষা দুর্বল ছাত্রটির মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব হতো? সারা বছর কষ্ট করে নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা ছাত্রটিকে মূল্যায়ন করা সম্ভত হতো? যে ছাত্রটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাশ করেছে, বুঝতে হবে সে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। সে সারা বছর যা শিখেছে তা সঠিকভাবে শিখেছে এবং তা অন্যের কাছে অর্থাৎ শিক্ষকের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সিলেবাসটা এত বিশাল যে শুধুমাত্র মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে পরীক্ষায় পাশ করা যায়, কিন্তু ভালো ফলাফল অর্জন করা যায় না। তুমুল প্রতিযোগিতার এই যুগে ভালো ফলাফল অর্জন করতে হলে নিজের জ্ঞান বুদ্ধিকে প্রতিনিয়ত শাণিত করা প্রয়োজন। একজন ভালো ফলাফল অর্জনকারীকে শিক্ষাজীবন বা চাকরিজীবন, যেকোনো ক্ষেত্রেই গুরুত্বের সাথে দেখা হয়, যা পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যতিরেকে কখনো সম্ভব হত না।