অ্যাম্বার রুম স্থাপন
ক্যাথেরিন সেন্ট পিটার্সবার্গের শীতকালীন প্রাসাদে অ্যাম্বার রুম স্থাপন করেন। আরাস্ট্রেল্লি আবিষ্কার করলেন যে মাপে জারিনা অ্যাম্বার রুম স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন প্যানেলের সংখ্যা তার জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি সমস্যা সমাধানের অভিনব এক উপায় বের করলেন। আঠারটি আয়তাকার কাঠের কলামে কাচ বসিয়ে তিনি ঘরকে প্রাসাদের মাপমতো বানালেন। এসব কলামে খোদাই করা ছিল নানারকম নকশা, আর কাঠগুলো রঙ করা ছিল অ্যাম্বারের রঙে। মাইকেল নামে ফরাসি এক নির্মাতা এই কলামগুলো বানিয়ে দেন। শ্লুটার প্ল্যান কিছুটা পরিবর্তন করে তিনি কাঠের প্যানেলগুলোর মধ্যকার ফ্রেমে আয়নার বদলে নানা চিত্রকর্মকে স্থান দেন। ১৮৪৩ সালে এই কাজ সমাপ্ত হলো। কিন্তু শ্লুটার পরিকল্পনা অনুযায়ী চারটি ফ্রেমের বদলে রুমে তিনটি ফ্রেম ছিল, যা এলিজাবেথকে পীড়া দিচ্ছিল।
প্রুশিয়ার ক্ষমতায় তখন দ্বিতীয় ফ্রেডারিক। তিনি রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকে এলিজাবেথের আক্ষেপ জানতে পারলেন। তার আদেশে কনিগ্সবার্গে তৈরি করা হলো নতুন একটি অ্যাম্বারের ফ্রেম। জারিনাকে চমকে দিতে তাকে কিছু না জানিয়েই ১৭৪৬ সালে এই ফ্রেম তার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো। অবশেষে অ্যাম্বার রুম তার পূর্ণরূপ পেল। এলিজাবেথ নয় বছর ধরে একে শীতকালীন প্রাসাদের অভ্যর্থনা কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন।
অ্যাম্বার রুমের স্থানান্তর
১৭৫২ সালে জারিনা চাইলেন অ্যাম্বার রুম ক্যাথেরিন প্রাসাদে সরিয়ে নিতে। এবারও এই দায়িত্ব বর্তাল আরাস্ট্রেল্লির কাঁধে। ততদিনে তিনি ক্যাথেরিন প্রাসাদের নানবিধ সংস্করণ করেছেন। দেখা গেল, সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রাসাদের মাপে এখানে অ্যাম্বার রুম বসানো যাচ্ছে না, কারণ এর জায়গা বড়। তিনি আগের কলামের সাথে আরো পাঁচটি নতুন কলাম যোগ করলেন। রুমের সব চিত্রকর্ম সরিয়ে সেখানে তিনি বসালেন নকশা আর মূল্যবান জেস্পার পাথর সম্বলিত মোজাইক। অ্যাম্বারের প্যানেলের উপরে রুমের ছাদের দিকে নতুন করে কাঠ বসিয়ে অ্যাম্বারের রঙে রাঙ্গানো ক্যানভাস দিয়ে তা ঢেকে দেয়া হলো। ১৭৭০ সালে সমস্ত কাজ শেষ হয়।
এই রুম রাজবংশের সদস্যরা ব্যবহার করতেন নানা কাজে। কেউ মেডিটেশনের জন্য, কেউ সরকারি কাজে, আবার কেউ ট্রফি রুম হিসেবে। এরপর আরো কয়েকবার অ্যাম্বার রুমের সংস্কার করা হয়। একপর্যায়ে এর আয়তন ছিল ১৮০ বর্গ ফুট। ছয় টন অ্যাম্বার আর অন্যান্য মূল্যবান পাথর দিয়ে অলঙ্কৃত করা ছিল এর পুরো কাঠামো। বর্তমান সময়ে শুধু রুমের সব উপাদানের দাম ধরা হয় ১৪২-৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর ঐতিহাসিক মূল্য হিসেবে আরো বেশি। বলশেভিক বিপ্লবের পর কমিউনিস্ট শাসন জারি হলে প্রাসাদ পরিত্যক্ত হয়। অ্যাম্বার রুম থেকে যায় সেখানেই। জোসেফ স্ট্যালিন পুরো প্রাসাদ জাদুঘরে রুপান্তরিত করলে সাধারণের জন্য অ্যাম্বার রুম উম্মোচিত হলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
জুন ২২, ১৯৪১। তিন মিলিয়ন জার্মান সেনা তীব্র আক্রমণ চালালো তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর। সূচনা হলো অপারেশন বার্বারোসার।
হিটলারের নির্দেশে সেনারা দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল লেনিনগ্রাদের (পূর্ববর্তী সেন্ট পিটার্সবার্গ) দিকে। স্ট্যালিনের আদেশে আশেপাশের সমস্ত জাদুঘর খালি করে ফেলা হতে লাগল। সমস্ত বাক্স ভর্তি হয়ে গেল জারিনার প্রদর্শিত কাপড়ের ভেতর অনেক কিছু প্যাকেট করা হলো।
ওদিকে অ্যাম্বার রুমের মিউজিয়ামের কিউরেটর কুচুমভ পড়ে গেলেন সমস্যায়। সব প্যানেল খুলে নিয়ে রুমটি আলাদা করে নিয়ে যাওয়া তার পরিকল্পনা, কিন্তু প্যানেল খুলতে গিয়ে দেখা গেল এর ভেতরকার মোম অনেক স্থানেই দুর্বল হয়ে গেছে। বেশি নাড়াচাড়া করলে ক্ষতি হতে পারে- এই ভয়ে পুরোনো পরিকল্পনা বাতিল করে কুচুমভ পুরো ঘর সস্তা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। মনে আশা, নাৎসিরা হয়তো খেয়াল করবে না।
এর আটদিনের মাথায় জার্মানরা পুশকিনে ঢুকে পড়ে। তারা তো আর বোকা নয়, ঠিকই অ্যাম্বার রুম খুঁজে বের করল। কুচুমভ যে কাজ এতদিনেও করতে পারেননি, মাত্র ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যেই জার্মানরা তা করে ফেলল। ঊনত্রিশটি বাক্সবন্দি হয়ে অ্যাম্বার রুম ট্রেনে চেপে চলে গেল কনিগসবার্গ দুর্গের মিউজিয়ামে, কিউরেটর রোহডের হাতে। যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলে ১৯৪৩ সালের শেষদিকে অ্যাম্বার রুম সেখান থেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়। পরের বছর আগস্টে মিত্রবাহিনীর বোমা হামলায় শহর ও দুর্গ ভস্মীভূত হয়ে যায়। অ্যাম্বার রুমের রহস্যও শুরু হয় এর পর থেকে।
কোথায় গেল অ্যাম্বার রুম
তিনটি ধারণার কথা বলা হয়।
১) রোহডের ডায়রির এন্ট্রি থেকে জানা যায় ১২ জানুয়ারি, ১৯৪৫ সালে তিনি অ্যাম্বার রুম আলাদা করার নির্দেশ দেন। চব্বিশটি বাক্সে সব গুছিয়ে সেগুলো রাখা হলো দুর্গের দক্ষিণ অংশের নাইটস হল নামে একটি কক্ষে। অনেকে মনে করেন, রোহডের উদ্দেশ্য ছিল স্যাক্সোনির ওয়েশেলবার্গের দুর্গে তা লুকিয়ে ফেলা। রাস্তাঘাট মিত্রবাহিনীর দখলে থাকায় তিনি সাগরপথে বাক্সগুলো পাঠানোর জন্য যাত্রীবাহী জাহাজ ভিলহেম-গুসোলফে (Wilhelm Gustloff ) তুলে দেন। কিন্তু রাশিয়ান সাবমেরিন ভিলহেম-গুসোলফেকে ডুবিয়ে দেয়। ২০০৩ সালে চালানো উদ্ধারকাজে ডুবুরিরা সেখানে কিছুই খুঁজে পাননি। তবে চিহ্ন দেখে তারা এটাও বলেছেন যে, তাদের আগেই অনেক ডুবুরি সেই স্থানে খোঁজ করেছেন।
২) আরেকদল মনে করেন, রাশিয়ানরা অ্যাম্বার রুম খুঁজে পেয়েছিল। তারাই সেটা লুকিয়ে রেখেছে। অন্য দলের দাবী, অ্যাম্বার রুম এখনও কনিগসবার্গের কোথাও লুকোনো আছে, আর না হলে কাছাকাছি কোনো খনির ভেতরে আছে, কারণ নাৎসি বাহিনী লুণ্ঠিত অনেক মালামালই খনিতে লুকানোর চেষ্টা করেছিল।
৩) তৃতীয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত হলো- মিত্র বাহিনী কনিগসবার্গে বোমা ফেললে দুর্গের সাথে সাথে অ্যাম্বার রুমও ধ্বংস হয়ে গেছে। এপ্রিলের ৯-১১ তারিখের ভেতর কনিগসবার্গ আত্মসমর্পণ করলে রাশিয়া থেকে ব্রুসভ নামে এক কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। তিনি দুর্গে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে জুনের ৫ তারিখে নাইটস হলে ঢুকতে সমর্থ হলেন। অন্যান্য অনেক গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারলেও অ্যাম্বার রুম তিনি পাননি। পরে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রিপোর্ট করলেন যে অ্যাম্বার রুম বোমা হামলাতেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
১৯৯৭ সালে জার্মান গোয়েন্দারা কালোবাজারে বিক্রি হবার সময় অ্যাম্বার রুমের একটি খণ্ডিতাংশ খুঁজে পান। এর সূত্র ধরে তারা জানতে পারেন যে, বিক্রয়কারীর বাবা রাশিয়া থেকে অ্যাম্বার রুম নিয়ে আসার ট্রেনে পাহারাদার সেনাদের একজন ছিলেন। সেখান থেকেই এই অংশ তিনি কোনোভাবে হাতিয়ে নেন।
অ্যাম্বার রুমের অভিশাপ বলেও একটি কথা প্রচলিত আছে। কারণ এর সাথে জড়িত বেশ কিছু লোকই অপঘাতে মারা গেছে। রোহড আর তার স্ত্রী মারা যান রোগে ভুগে। জেনারেল গুসেভ নামে এক রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্মকর্তা অ্যাম্বার রুম নিয়ে এক সাংবাদিকের সাথে কথা বলার পরই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা পড়েন।এছাড়া ১৯৮৭ সালে বাভারিয়ার বনে জর্জ স্টেইনের নাড়িভুঁড়ি বের হওয়া লাশ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন প্রাক্তন জার্মান সেনা এবং অনেকদিন থেকেই তিনি অ্যাম্বার রুম হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন।
নতুন অ্যাম্বার রুম
১৯৭৯ সাল থেকে রাশিয়া অ্যাম্বার রুমের একটি রেপ্লিকা তৈরি করা আরম্ভ করে। পঁচিশ বছর সময় আর এগার মিলিয়ন ডলার অর্থ খরচ করার পর সেন্ট পিটার্সবার্গের ত্রিশতবার্ষিকীতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নতুন অ্যাম্বার রুমের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে আরো ছিলেন তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার, ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিল্ভিও বারলুস্কোনি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার আর জাপানি প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি।
নতুন এই অ্যাম্বার রুমে আছে বারটি বার ফুটি প্যানেল, তিন ফুট উচ্চতার দশটি প্যানেল, চব্বিশটি অ্যাম্বারের বোর্ড যা তৈরি হয়েছে এক লাখেরও বেশি ছোট ছোট অ্যাম্বারের ব্লক দিয়ে। পুরো দেয়ালের আয়তন প্রায় ১৫০ মিটার, যার মধ্যে বিশ রকম বর্ণচ্ছটার অ্যাম্বার শোভা পাচ্ছে। অ্যাম্বার প্যানেলগুলোর মাঝে মাঝে সাজানো হয়েছে আয়না দিয়ে। আর মেঝেতে বানানো হয়েছে পনের ধরনের কাঠ দিয়ে। বর্তমানে শহরের ঠিক বাইরে সারস্কোয়ে সেলো স্টেট মিউজিয়ামে (Tsarskoye Selo State Museum/পূর্বের ক্যাথেরিন প্রাসাদ) সবার দেখার জন্য রাখা আছে এই অ্যাম্বার রুম।