“আমরা আমেরিকানরা মনে করি, ভিয়েতনাম যুদ্ধ আমাদের চরিত্রের অপূর্ণতাকে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে, আমাদের সামরিক ও রাজনৈতিক যোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে তুলে দিয়েছে। আমরা সবসময়ই নিজেদেরকে সেরা ভাবতে পছন্দ করি, পুঁজিবাদী ডানপন্থী হিসেবে কমিউনিজমকে রুখে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাই। কিন্তু যে পন্থায় ভিয়েতনামে আমরা কমিউনিজমকে রুখতে চেয়েছিলাম, তা ছিল পুরোপুরি ত্রুটিপূর্ণ এবং দিনশেষে এটি ভয়ংকর ট্র্যাজেডি বয়ে এনেছে।”
কথাগুলো বলেছিলেন অধ্যাপক আর্থার ওয়ালড্রন, যিনি ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজে পড়াতেন। উপরের কথাগুলো শুধু তার ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে পাঠ করলে ভুল হবে, এটা আসলে সব মার্কিন নাগরিকের মনোভাবকে ধারণ করে।
আমেরিকান তরুণরা এখনও ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা স্মরণ করতে চায় না। ভিয়েত কংরা যে ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছিল আমেরিকানদের, তা এখনও দুঃস্বপ্নের মতো পীড়া দেয় তাদের। কিন্তু ইতিহাস থেকে যেহেতু পুরোপুরি মুছে ফেলা সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন প্রসঙ্গে সেই অপমানজনক তিক্ত পরাজয়ের কথা বার বার সামনে চলে আসে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের কাছে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের কাছে– মোট দুবার আমেরিকার কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী নেতারা। ঔপনিবেশিক শক্তিশালী দেশগুলোর বিপক্ষে ভিয়েতনামের সামরিক সক্ষমতা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল, যার কারণেই আমেরিকার কাছে হাত পাততে হয়েছিল। কিন্তু দুবারই আমেরিকার কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাননি তারা, একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছে প্রতিবার। উপরন্তু, ভিয়েতনামে ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ফ্রান্সের পেছনে লক্ষ লক্ষ ডলার ঢেলেছে মার্কিনীরা, যা পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনামের সাধারণ জনগণের মার্কিন-বিরোধিতার আগুনে ঘি ঢালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় সব ঔপনিবেশিক শাসক দেশের পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন শুরু হয়। শত শত বছর ধরে নিজেদের সার্বভৌমত্ব বর্গা দিয়ে থাকা উপনিবেশের সাধারণ মানুষজন রাস্তায় নামে, তীব্র প্রতিবাদ সংগ্রামে অংশ নেয়। বিশ্বযুদ্ধের ব্যয় বহন করা ও শত্রুপক্ষের হামলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হওয়া অর্থনীতি নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলোর সামর্থ্য ছিল না উপনিবেশের বিদ্রোহ ঠেকানোর। উদাহরণ হিসেবে ভিয়েতনামে ফ্রান্সের কথা কিংবা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের কথা বলা যায়। জাপান বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় বরণ করে, ফলে ভিয়েতনামকে হারাতে হয় তাদের। এদিকে ফ্রান্স ভিয়েতনামের উপর পুরনো দাবি নিয়ে হাজির হয়। ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী নেতারা সেটি মানতে রাজি ছিলেন না। ফলাফল হিসেবে যুদ্ধ শুরু হয়, এবং আট বছর যুদ্ধের পর ফ্রান্সকে ভিয়েতনাম ছেড়ে যেতে হয়।
ফ্রান্স ভিয়েতনাম ছেড়ে যাওয়ার পর জেনেভা অ্যাকর্ড অনুসারে ভিয়েতনাম দু’ভাগে ভাগ করা হলো। উত্তর ভিয়েতনামের শাসনক্ষমতার দায়িত্ব নিলেন ভিয়েত মিন বিপ্লবীরা, যারা ফ্রান্সকে বিতাড়িত করেছিল সম্মুখযুদ্ধে। আর দক্ষিণ ভিয়েতনামের দায়িত্ব দেয়া হলো আমেরিকাপন্থী পুতুল সম্রাট বাও দাইকে। উত্তর ভিয়েতনামে প্রতিষ্ঠা করা হলো সমাজতন্ত্র, আর দক্ষিণ ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো সাজানো হলো পশ্চিমা পুঁজিবাদের আদলে। একই দেশ, অথচ দুটো ভাগ, দুটো ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ, দুটো ভিন্ন নেতৃত্ব।
উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতারা চেয়েছিলেন একটি ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠা করতে, যেখানে পুঁজিবাদী শ্রেণীবৈষম্য থাকবে না, শোষণ থাকবে না। কিন্তু জেনেভা অ্যাকর্ডের কারণে ভিয়েতনামে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার ঘটনা তাদের স্বপ্নে আঘাত হানলেও একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারেনি। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বের কারণে উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধের সেসময়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম পুঁজিবাদী হওয়ায় আমেরিকার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা লাভ করে। অপরদিকে ভিয়েত মিনের নেতৃত্বে থাকা উত্তর ভিয়েতনামের পেছনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল চীন ও সোভিয়েত রাশিয়া।
আমেরিকা সরাসরি দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধ শুরু করে ১৯৬৫ সালে। কিন্তু এর আগেই তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে সামরিক সহায়তা করেছে অনেকভাবে। যখন আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেয়, তার আগেই প্রায় ১৬ হাজার মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা অবস্থান করছিল ভিয়েতনামে। অসংখ্য সিআইএ অফিসারকে পাঠানো হয় ভিয়েত কংদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। ডোমিনো তত্ত্ব অনুসারে, যেহেতু একটি দেশ কমিউনিস্ট শাসনে চলে গেলে পুরো অঞ্চলটিতেই কমিউনিস্ট শাসন গোড়াপত্তন হওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাই আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে হলেও দক্ষিণ ভিয়েতনাম টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। একটি পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশের পরাজয় পক্ষান্তরে আমেরিকারই পরাজয় বলে প্রতীয়মান হতো তখন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সিআইএ-র গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা। ষাটের দশকের শুরুতেই উত্তর ভিয়েতনামে সিআইএ-র অনেক অফিসারকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভিয়েত কংদের পার্টির ভেতরের খবর বের করে আনার। কিন্তু অধিকাংশ গোয়েন্দা অফিসারই উত্তর ভিয়েতনামে সুবিধা করতে পারেনি। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। আমেরিকার অনুগত দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নগু দিন দিয়েমকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গদিছাড়া করা হয় এবং পরে হত্যা করা হয়। সিআইএ প্রেসিডেন্ট দিয়েমকে নানাভাবে সহযোগিতা করার পরও তার সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানোর বিষয়টি সিআইএ-র ব্যর্থতাকেই নির্দেশ করে।
আমেরিকার সামরিক কর্মকর্তারা অনেকে শুধু সম্মানজনক পদক পাওয়ার লোভে ভিয়েতনামে এসেছিলেন– এরকম অভিযোগও পাওয়া যায়। এ অভিযোগের সত্যতাকে আরেকটু জোরালো করে কর্মকর্তাদের মিথ্যা রিপোর্ট পাঠানোর ঘটনা। উচ্চপদস্থ থেকে নিম্নপদস্থ, অসংখ্য কর্মকর্তা যুদ্ধের সময় ভিয়েত কংদের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছেন পেন্টাগনে পাঠানো রিপোর্টে। পরবর্তী সময়ে যখন অনেক অফিসারের মিথ্যাবাদিতা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন সেই অফিসাররাই আবার বাকিদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
১৯৬৫ সালে, অর্থাৎ যুদ্ধে মার্কিনীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সময় থেকেই মার্কিন যুদ্ধকৌশলের মূলনীতি ছিল ‘অ্যাট্রিশন’। এই পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো, সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে এমনভাবে ধসিয়ে দেয়া, যাতে তারা আবার কোনো প্রতিআক্রমণ পরিচালনা করতে না পারে। আমেরিকার এই কৌশল পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়।
এই কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শত্রুপক্ষকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হবে, যাতে তারা নতুন করে প্রস্তুতি নেয়ার সময় না পায়। ভিয়েতনামে মার্কিন আক্রমণে যে পরিমাণ ভিয়েত কং মারা যাচ্ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্ক যুবককে প্রতি বছর উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছিল। আর অনবরত বোমা হামলার মাধ্যমে অবকাঠামোগত ক্ষতি করা হয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিল ভিয়েত কংরা। এমনও হয়েছে, ধসে যাওয়া একটি ব্রিজকে এক রাতের মধ্যেই আবার ব্যবহার উপযোগী করে ফেলা হয়েছে।
আমেরিকার বিপরীতে উত্তর ভিয়েতনাম যে সামরিক যুদ্ধকৌশল গ্রহণ করেছিল, তা হচ্ছে ‘এনার্ভেশন’। এই কৌশলে নিজেদের যতটা সম্ভব টিকিয়ে রেখে যুদ্ধের সময়ের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে শত্রুপক্ষের যুদ্ধ করার ধৈর্য শেষ করে দিতে হয়, শত্রুকে সরাসরি আক্রমণ না করে গেরিলা কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। উত্তর ভিয়েতনামের জন্য এই কৌশল খুবই কার্যকরী হয়েছিল।
যুদ্ধের সময়সীমা বেড়ে যাওয়ায় ও কার্যকরী কোনো ফলাফল আসার সম্ভাবনা দেখা না পাওয়ায় আমেরিকার জনগণ ও গণমাধ্যম ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেয়। দিনে দিনে মৃত আমেরিকান সৈন্যদের কফিন যতই মার্কিন বিমানবন্দরে ভিড়তে থাকে, ততই সরকারের সমালোচনা বাড়তে থাকে। মার্কিন প্রশাসন শেষ পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
‘অপারেশন রোলিং থান্ডার’ নামে বোমাবর্ষণের যে মিশন পরিচালনা করেছিল মার্কিনীরা, তা ছিল ভিয়েতনামের জনমতের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমেরিকানরা বেসামরিক জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করার ফলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের যেসব সাধারণ মানুষ মার্কিনীদের পক্ষে ছিল, তারাও পক্ষত্যাগ করে। আর উত্তর ভিয়েতনাম অবকাঠামোগতভাবে তেমন উন্নত না থাকায়, শুধু বোমাবর্ষণ করে শত্রুপক্ষের ক্ষতি করা যায়নি।
ভিয়েত কংদের জন্য যুদ্ধটি ছিল স্বদেশ বাঁচানোর লড়াই। তাই ব্যাপক হারে মার্কিন বাহিনীর হাতে মারা যাওয়ার পরেও তারা রণেভঙ্গ দেয়নি, লড়াই জারি রেখেছিল সব সময়। মার্কিন সৈন্যদের এখানে দেশপ্রেমের কোনো বিষয় ছিল না। তাদের নীতি-নৈতিকতার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল একসময়। সিআইএ রিপোর্ট করে, ভিয়েত কংদের কাছ থেকে জব্দ করা মোট সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় ৩১ শতাংশ ছিল মার্কিনিদের তৈরি।
উত্তর ভিয়েতনামের আরেকটি বড় নির্ধারক কৌশল হলো প্রথাবিরোধী গেরিলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া। অতর্কিত আক্রমণ করে নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যাওয়া– এ কৌশলে আমেরিকানরা নাস্তানাবুদ হতে শুরু করে, প্রচুর সৈন্য মারা পড়তে শুরু করে ভিয়েত কংদের হাতে। কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে আমেরিকানরা যে সরাসরি আক্রমণে কৌশল প্রয়োগ করেছিল, তা অব্যাহত রেখেছিল ভিয়েতনামে এসেও। কিন্তু ভিয়েতনাম ছিল সবদিক থেকেই কোরিয়ার চেয়ে আলাদা। গেরিলা আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় মার্কিন বাহিনী ভিয়েতনামে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে।
ভিয়েতনামের সংগ্রাম তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতাকামী সব দেশের জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছে। পরাক্রমশালী আমেরিকান সেনাবাহিনীকে যেভাবে ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা প্রতিহত করেছে, পাল্টা আক্রমণ করে একসময় দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে, তা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সকল দেশের অনুপ্রেরণা হিসেবে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে।