ভার্চুয়াল জগতের ফেসবুক আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মতোই ফেসবুকে দিনের অনেকটা সময় ব্যয় না করলে যেন চলে না। ফেসবুকের উদ্ভব হয়েছিল একটি সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে, কাছে এবং দূরের বন্ধু বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে যোগাযোগ রক্ষার জন্য।
কালক্রমে ফেসবুক ব্যবহারের ধরণের আমূল পরিবর্তন এসেছে। আজকাল ফেসবুকে আসল পরিচয়ের মানুষের সংখ্যার থেকে মেকি মানুষের সংখ্যাটা অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ফেসবুক ব্যবহারকারীর মোট শতাংশের মধ্যে মুখোশধারী মুখের সংখ্যা প্রায় ৮.৭ শতাংশ। যদি আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বিশ্লেষণ করি, তাহলে এই মুখোশধারী গোষ্ঠীকে ৩ ভাগে বিভক্ত করা যায়।
১) একজন ব্যক্তির দুটি ফেসবুক একাউন্ট এবং দু’ধরণের পরিচয়, যা মোট মুখোশের ৪.৮ শতাংশ।
২) মিসক্ল্যাসিফাইড একাউন্ট- যারা ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্য একটি একাউন্ট তৈরি করছেন। মোট ভুয়া একাউন্টের মধ্যে এদের সংখ্যা ২.৪ শতাংশ।
৩) অনাকাঙ্ক্ষিত একাউন্ট- যারা ফেসবুকের প্রদত্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে একাউন্ট তৈরি করছেন এবং ব্যবহার করছেন। এদের সংখ্যা ১.৫ শতাংশ।
একজন পুরুষের পরিচয়ে ফেসবুকে বিরাজমান ব্যক্তিকে অনেক সময় বাস্তবে নারী হিসেবে পরিচয় পাওয়া যায় এবং একইভাবে এর বিপরীতটাও হয়ে থাকে। জেনে না জেনে মানুষ এই মুখোশধারী মুখগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। অপরিচিত মানুষগুলোর মিষ্টি কথায় তাকে বাস্তব জগতের একজন পরিচিত মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করে। হাই, হ্যালো দিয়ে শুরু হওয়া কথাবার্তার গভীরতা বাড়তে থাকে দিন দিন ।
একসময় অচেনা, অদেখা মানুষের সাথে ব্যক্তিগত বিষয়গুলোও আলোচনায় উঠে আসে সাবলীলভাবে। বাস্তবিক সম্পর্কের চেয়েও এই ভার্চুয়াল জগতের সম্পর্কটা গুরুত্ব এবং সময় উভয়ই বেশি পেতে শুরু করে। ঘনিষ্ঠতার এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত তথ্য এবং ছবির আদান-প্রদান শুরু হয়। বিপদের শুরুটা বোধহয় এখান থেকেই। মেয়েরা এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী বেশি হয়ে থাকে।
একসময় অপর পাশের অচেনা মানুষটির কথাবার্তার ধরণ পাল্টাতে থাকে, রূপ পরিবর্তিত হয়। ব্যক্তিগত ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার অধ্যায়ের সূচনা হয়। লোকলজ্জার ভয়ে ভুক্তভোগী টাকা ও অন্যান্য দ্রব্যাদী দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। ফলশ্রুতিতে এক উভয় সংকট পরিস্থিতি ও শংকার মাঝে দিন কাটতে থাকে।
আমরা যদি সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখি এবং তাদেরকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করি বা তাদের সাথে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে হয়ত উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা কিছুটা হলেও সচেতন হবে। এছাড়াও সামাজিক এবং ধর্মীয় শিক্ষার আলো তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া একান্ত প্রয়োজন।
নিপা (ছদ্মনাম) একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। হিমেলের (ছদ্মনাম) সাথে নিপার ফেসবুকে পরিচয় হয় গত ৪ মাস আগে। অচেনা হিমেলের কাছ থেকে একটি বন্ধুত্বের আহ্বান পায় নিপা ফেসবুকের মাধ্যমে। প্রোফাইল চেক করে নিপার ভালোই লাগে, গ্রহণ করে বন্ধুত্বের আহ্বান। ৪ মাসের কথোপকথনের এক পর্যায়ে হিমেল নিপার ইনবক্সে নিপার পাঠানো একটি ছবি প্রেরণ করে।
নিপা তখনো খুব একটা অবাক হয় না, কারণ এ ছবি তো নিপা নিজেই তাকে দিয়েছে। এরপর যখন হিমেল নিপার কাছে ৫০ হাজার টাকা চেয়ে বসে এবং ছবিটা সকলের সাথে শেয়ার করার কথা জানায়, তখন নিপা ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকে, বুঝতে পারে তার ভুল। অদেখা, অচেনা এক মানুষকে আপন ভাবা এবং তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে নিজের কপালে চপেটাঘাত করতে থাকে। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে ।
হিমেল এই ৪ মাসের আলাপে জেনে গিয়েছিল যে, নিপা এক ধনীর দুলালী। আর সঙ্গ দোষে কৈশোরে বখে গিয়েছিলো হিমেল। অবৈধ নানা পথে অর্থোপার্জন করেই চলতো সে। নির্বুদ্ধিতার কারণে নিপা আজ হিমেলের অর্থ উপার্জনের আরেকটি উৎস।
আজকাল ফেসবুকে আমরা প্রায়শই দেখে থাকি বিভিন্ন আর্থিক সাহায্যের আবেদন সংবলিত পোস্ট। মানবিক কারণে অনেক সামর্থ্যবান ব্যক্তিই এগিয়ে আসেন, বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী বিষয় নিয়েও কিছু মানুষ ধোঁকাবাজি করছে আজকাল ফেসবুকে।
মিথ্যে কিছু তথ্য আর ছবি দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য একটি গল্প বানিয়ে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন জানানো হচ্ছে, হাতিয়ে নিচ্ছে বিশাল অঙ্কের অর্থ। কখনো কখনো কেউ সাহায্যের আবেদনের সত্যতা যাচাই করছেন, যার ফলে আমাদের সামনে প্রকাশ পেয়েছে মানুষের এমন প্রতারণার গল্প। মিথ্যে আর প্রতারণামূলক এসব প্রচারণার ফলে অনেক প্রকৃত সাহায্যপ্রার্থী হচ্ছেন অবহেলিত এবং সন্দেহের তালিকাভুক্ত। সামান্য কিছু সাহায্য পেলে হয়ত তাদের অনেকটা উপকার হতো, কিন্তু আফসোস। ধিক জানাই এমন বিবেকহীন, বিকৃত মন মানসিকতার মানব সমাজকে। বিবেককে অন্ধকার কুটিরে বন্দী করে রেখে আর কতদিন?
এবার আসা যাক ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসার বিশ্বস্ততাকে প্রশ্নবোধক এবং বিস্ময়সূচক চিহ্নের সম্মুখীন করা কিছু বিশেষ মানুষের অপকীর্তি নিয়ে। ঘরে বসে খুব সহজে অর্থ উপার্জন করার লক্ষ্যে ফেসবুকে অনলাইনে ব্যবসা একটি খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম, যেখানে বিশ্বাস আর প্রতিজ্ঞা হচ্ছে ব্যবসার মূল পুঁজি। সরাসরি একটি পণ্যকে না দেখে শুধুমাত্র বিক্রেতার মুখের কথার উপর বিশ্বাস করে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে বিক্রেতার প্রতিজ্ঞাবদ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে একজন ক্রেতা একটি পণ্য ক্রয় করে থাকেন। সঠিক সময়ে পণ্যটি ক্রেতার কাছে সরবরাহ করার মাধ্যমে বিক্রেতা তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করে থাকেন।
কতিপয় অসাধু মানুষের কিছু উদ্ভট খেয়াল থেকে শুরু হয় অনলাইন ব্যাবসায় প্রতারণা। কখনো নিম্নমানের পণ্য, কখনো প্রদর্শিত পণ্যের সাথে হাতে পাওয়া পণ্যের মিল না থাকা, আবার কখনোবা অগ্রিম টাকা হাতিয়ে নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করা খুব সাধারণ একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
রেহানা (ছদ্মনাম) পেশায় একজন কর্মজীবি। ঘরে বাইরে কাজ করার দরুণ কেনাকাটা করার জন্য খুব একটা সময় হয়ে উঠে না। তাই তিনি বেছে নেন ফেসবুকের অনলাইন শপিংকে। একটি ফেসবুক পেজ থেকে কিছু পোশাক পছন্দ করেন তিনি এবং বিক্রেতার কথা অনুযায়ী বিকাশে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করেন। কথা ছিল তিন দিন পরেই তার কাছে পোশাকগুলি পৌঁছে দেয়া হবে। এদিকে তিন দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও যখন রেহানা পোশাকগুলি পেলেন না, তখন তিনি সেই বিক্রেতাকে ফেসবুকের ইনবক্সে বিষয়টা জানালেন।
কিন্তু প্রায় একদিন পার হয়ে গেল, কোনো উত্তর পেলেন না। আবার তিনি তার সাথে যোগাযোগ করতে গেলে দেখেন যে, তাকে ব্লক করে দেয়া হয়েছে। অবাক হলেন রেহানা। এবার তিনি বিক্রেতার ফোন নাম্বারে কল দিলেন, উত্তর আসল, “দুঃখিত, এই মুহূর্তে মোবাইল নম্বরটিতে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ!” বুঝতে বাকি রইল না রেহানার যে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
আমাদের সমাজে পরিচিত অপরিচিত সকল মুখই কোনো না কোনো মুখোশের আড়ালে ঢাকা। আর ফেসবুক হচ্ছে এমন একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেখানে পরিচিত-অপরিচিত সকল মানুষের রয়েছে অবাধ বিচরণ। প্রত্যেকটা মানুষ তার ফেসবুকের জগতটাকে সাজায় নিজের ইচ্ছে ও পছন্দ অনুযায়ী। এত মানুষের মাঝে আসল মানুষকে খুঁজে পাওয়াটা কঠিন। তাই কোনো ব্যাপারে অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন না করে নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে। আমাদের সচেতনতাই পারে আমাদের এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার হাত থেকে বাঁচাতে। নিজে সচেতন হই এবং অন্যকে সচেতন হতে সাহায্য করি।
তথ্যসূত্র
১) somewhereinblog.net/blog/bilatipola/29649529
২) wired.com/2014/07/virtual-unreality-the-online-sockpuppets-that-trick-us-all/#slide-1
৩) washingtonpost.com/news/the-intersect/wp/2016/11/18/this-is-how-the-internets-fake-news-writers-make-money/?utm_term=.3cbe5ded1b4a