গান নিয়ে যত অবাক কথন

“গান তুমি হও গরম কালের সন্ধ্যে বেলার হাওয়া
অনেক পুড়ে যাওয়ার পরে খানিক বেঁচে যাওয়া
গান তুমি হও বিশ্রী গরম ভুলিয়ে দেয়া বৃষ্টি
সজীবতার ভরসা দেয়া সফল অনা সৃষ্টি

   গান তুমি হও বেঁচে থাকার রসদ সবার কাছে
বাঁচার লড়াই, বাঁচাও আমায় তোমার তালে তালে।।”

সুমনের এই বিখ্যাত গান দেখেই হয়তো ভাবতে পারেন, গান নিয়ে কোনো লেখা লিখছি। আজকের বিষয়টি জানলে আপনার মনে হতে পারে, এ তো বড়ই অদ্ভুত। গান মানুষের শারীরিক এবং মানসিক ভাষার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা যেকোনো অনুভূতিতে হৃদয়ের গোপন স্থানে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হতে থাকে সুরের ব্যঞ্জনা। কম-বেশি গান শুনতে পছন্দ করেন, গানের প্রেমে আপ্লুত হননি- এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া খুবই দুরুহ। কারণ সাধারণ মানুষ যুগ যুগ ধরে সুরের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। বিভিন্ন মানুষ তাদের রুচি অনুযায়ী পছসন্দই গানটি শুনে থাকেন, তা ক্লাসিক্যাল থেকে শুরু করে দেশের গান অথবা ব্যান্ড সঙ্গীত থেকে পপ মিউজিক।

মানব জীবনে সার্বক্ষণিক সঙ্গী মিউজিক। ইমেজ সূত্র: http://www.uform.org/

কিন্তু এই গান সম্বন্ধে এমন কিছু তথ্য আপনাদের আজ জানাবো, যা শুনে অনেকেই হয়তো তাজ্জব হতে পারেন। চলুন তা হলে জানা যাক গান নিয়ে নানা অদ্ভুত আর বিস্ময়কর  তথ্যগুলো।

আপনার জীবনের স্নায়ুচাপ ও অবসাদ কাটাতে দরকার গান 

মানসিক চাপ বর্তমানে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। কাজের চাপ, ব্যস্ততা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, আর্থিক চিন্তা বিভিন্ন কারণে আসা চাপের মোকাবেলা করতে ক্রমশই জনপ্রিয় হচ্ছে বিভিন্ন থেরাপি। ম্যাসাজ, রিল্যাক্সেশনের মতোই চাপ কমাতে জনপ্রিয় মিউজিক থেরাপি। আর সেই মিউজিক থেরাপি কতটা কার্যকর তা প্রমাণ করতে গবেষণা চালায় ব্রিটেনের মাইন্ডল্যাব ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংস্থা। মনোবৈজ্ঞানিক ডেভিড লুইজ হজসন সাসেক্সের ২৬ জনের একটি দলের উপর গবেষণাটি চালান। তাদের দেয়া তথ্যমতে, সঙ্গীত শ্রবণ চাপ কমানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

স্নায়ুচাপ ও অবসাদ কাটাতে দরকার গান । ইমেজ সূত্র: interesting-facts-about-music

হাজার কাজের কারণে মনে বাড়তি চাপ ভিড় করে আমাদের জীবনে নিয়মিত। এই অবস্থা কাটাতে শুনুন আপনার পছন্দের গান। অনেক রিল্যাক্স লাগবে। যদি কোনও কারণে মন খারাপ থাকে বা অবসাদে ভোগেন তাহলে গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করে দিন। আপনার মন ভাল হতে বাধ্য। একঘেয়েমি জীবন, মানসিক দুশ্চিন্তা, কর্মক্ষেত্রের চাপ ইত্যাদি নানা কারনে মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ থেকে মুক্তি পেতে গান খুব সাহায্য করে।

গান শুনতে শুনতে ব্যয়াম করলে ক্লান্তি আসে না।। ইমেজ সূত্র: facts-about-music.html

কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে গান টনিকের মতো কাজ করে। গান শুনতে শুনতে শারীরিক কাজ করলে শরীরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মনোবিদ্যার এক জার্নাল থেকে জানা যায় যে, যাদের একই ধরনের কাজ করতে করতে একঘেয়েমি আসে, তাদের জন্য গান একধরনের টনিক। এক্ষেত্রে রিদমিক মিউজিক বা ড্যান্স মিউজিক শুনলে শরীরে এক্সট্রা এনার্জি অনুভুত হয় যা কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে প্রভুত সাহায্য করে।

মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি প্রকাশে গান এক মৌলিক উপাদান হিসেবে কাজ করে

গান আপনার মুখমন্ডলে সুখী এবং দু:খিত মনের ভাব প্রকাশে সাহায্য করে। আনন্দিত অবস্থায় যেমন লাউড মিউজিক বা রিদমিক মিউজিক শুনতে পছন্দ করি, তেমনি দু:খিত মনের ভাব প্রকাশে স্যাড মিউজিক যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন মিউজিকের ধরণের উপর মানুষের মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকে।

অভিব্যক্তি প্রকাশে গান । ইমেজ সূত্র: curcumin95.ro

সঙ্গীত মস্তিষ্ক উদ্দীপক। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভাল রাখতেও সাহায্য করে ভাল গান। ব্যায়াম বাদে সমগ্র মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করতে ‍মিউজিকের জুড়ি মেলা ভার। দেখা গিয়েছে প্রধানত বয়স্ক মানুষদের ব্রেন স্বাস্থ্যবান রাখার জন্য কার্যকরী প্রভাব রয়েছে গানের।

মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করতে ‍মিউজিকের তুলনা অপরিসীম। ইমেজ সূত্র: listening-music-key-good-health.html

শারীরিক অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করতেও সাহায্য করে গান। প্রতিনিয়ত ব্যায়াম করতে করতে একঘেয়েমি চলে আসে, বিরুক্তি ‍ও ক্লান্তিবোধ হতে থাকে। এক্ষেত্রে গান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যদি আপনি গান শুনতে শুনতে ব্যায়াম করেন, তাহলে সহজে ক্লান্তি আসে না। শুনতে আশ্চর্যজনক হলেও ফ্রন্টিয়র সাইকোলজির একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, যাঁরা তাঁদের পছন্দের গান বেশি শোনেন তাঁরা তুলনামূলক বেশি উদার হন।

অদ্ভুত হলেও সত্য যে, গানের ছন্দের সঙ্গে প্রায় মিলে যায় আমাদের হৃদপিণ্ডের ছন্দও। উদ্বেগ, মানসিক চাপমুক্ত রেখে করোনারী হার্ট ডিজিজ থেকে রক্ষা পেতে কাজ করে মিউজিক। ১,৫০০ রোগীদের নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা প্রতিনিয়ত গান শুনেছেন তাদের রক্ত চাপ, হার্ট রেট এবং হৃদরোগ রোগীদের উদ্বেগ কমাতে সাহায়তা করেছে।

হার্ট রেট এবং হৃদরোগ রোগীদের উদ্বেগ কমাতে মিউজিক অনন্য।  ইমেজ সূত্র: listening-music-key-good-health.html

থেরাপি হিসেবে গানের উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রয়েছে

মিউজিক রোগীর শারীরিক ব্যথা উপশমে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এডভান্স নার্সিংয়ের উপর প্রকাশিত এক জার্নাল থেকে জানা যায়, থেরাপি হিসেবে মিউজিক ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থারাইটিস আক্রান্ত রোগীদের ২১ শতাংশ ব্যথা উপশমে এবং ২৫ শতাংশ বিষন্নতা কমাতে সাহায্য করে।

পারকিনসন্স রোগের থেরাপিতে হিসেবে সঙ্গীত। ইমেজ সূত্র: listening-music-key-good-health.html

আপনি কি জানেন ডিস্কোতে কেন লাউড মিউজিক বাজানো হয়? যাতে আপনি বেশি পানীয় খেতে পারেন। দেখা গিয়েছে, স্লো মিউজিকের তুলনায় লাউড মিউজিকে মানুষ বেশি পান করেন।

ডিস্কোতে মিউজিকে তারুণ্যের উন্মাদনা। ইমেজ সূত্র: facts-about-music.html

মনঃসংযোগ বৃদ্ধিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কোনো তুলনা নেই। গান শোনা এমনই একটি কাজ যাতে আমাদের সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক একসঙ্গে কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনানো হলে তারা দ্রুত শারীরিক অসুস্থতা হতে বেরিয়ে আসতে পারে।

মন:সংযোগ বৃদ্ধিতে সঙ্গীত। ইমেজ সূত্র: curcumin95.ro

গাছের বৃদ্ধিতে মিউজিকে ভুমিকা রয়েছে। অবাক হচ্ছেন বুঝি?

শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে গাছেদেরও অনুভূতি রয়েছে। দেখা গিয়েছে, মিউজিক্যাল পরিবেশের মধ্যে যদি গাছ রাখা হয় তাহলে তার বৃদ্ধি হয় অনেক তাড়াতাড়ি।

গাছের বৃদ্ধিতে মিউজিকে। ইমেজ সূত্র: facts-about-music.html

শিশুদের শান্ত রাখার এক অব্যর্থ ঔষধ হলো মিউজিক। এক গবেষণাভিত্তিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, শিশুদেরকে কিছু বলে শান্ত করার চেয়ে তাদের যদি পরিচিত কোনো গান শোনানো হয়, তাহলে তারা দ্রুত সাড়া দেয় এবং শান্ত হয়ে পড়ে।

শিশুদের শান্ত করতে সঙ্গীত। ইমেজ সূত্র: trickntrick.com

ব্যক্তিত্বের পূর্বাভাস দিতেও গানের একধরনের ভূমিকা রয়েছে

একজন মানুষ কি ধরনের গান পছন্দ করেন তার উপর ভিত্তি করে সে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা পাওয়া যায়। এই যেমন ধরুন:

  • শাস্ত্রীয় গানের ভক্তরা অন্তর্মূখী, উন্নত রুচির, উচ্চ আত্ম-সম্মানবোধ এবং নিশ্চিন্ত জীবনের অধিকারী।
  • অপেরা ভক্তরা ভদ্র, সৃষ্টিশীল এবং আভিজাত্যের অধিকারী।
  • দেশাত্মকবোধের গানের ভক্তরা বহির্মূখী, পরিশ্রমী এবং দেশের প্রতি অনুরক্ত।
  • ব্লুজ ও জাজ ভক্তরা উন্নত রুচির, উচ্চ আত্ম-সম্মানবোধ এবং সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী।

গান নিয়ে এতসব মজার মজার তথ্য জেনে অবাক হলেও এসব কিছুই কিন্তু বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা। কাজেই অন্য যা কিছু নিয়ে হেলাফেলা করেন না কেন, গান নিয়ে মোটেই না। গান আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বেঁচে থাকার ফুয়েল। প্রাত্যহিক কর্মচঞ্চলাতাকে রিলিফ দেয়ার এক মহা ঔষধ হচ্ছে মিউজিক।

তথ্যসূত্র

১) quora.com/What-are-some-of-the-interesting-facts-about-listening-to-music

২) blog.bufferapp.com/music-and-the-brain

৩) oakcreek-village.com/blog/10-interesting-facts-about-music

৪) unbelievable-facts.com/2015/04/facts-about-music.html

৫) dailymail.co.uk/health/article-137116/Why-listening-music-key-good-health.html

৬) https://psychcentral.com/lib/preferred-music-style-is-tied-to-personality/

Featured Image: lag.vm

Description: This article is in Bangla language. It's about some interesting facts about music.

Related Articles

Exit mobile version