কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: ভীষ্ম পর্বের সারসংক্ষেপ || পর্ব–১

‘মহাভারত’ (সংস্কৃত: महाभारतम्) প্রাচীন ভারতবর্ষের দুটি সবচেয়ে বিখ্যাত মহাকাব্যের মধ্যে একটি এবং একে বিশ্বের বৃহত্তম মহাকাব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন (যিনি ‘ব্যাস’ বা ‘বেদব্যাস’ নামে সমধিক পরিচিত) কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই মহাকাব্যটিকে হিন্দুধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহাকাব্যটি ১৮টি পর্ব/অধ্যায়ে বিভক্ত এবং মহাকাব্যটির কাহিনীর মূল উপজীব্য হচ্ছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল তদানীন্তন কৌরব–শাসিত কুরু রাজ্য ও তাদের মিত্র রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে কুরু রাজবংশের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যহারা পাণ্ডব ও তাদের মিত্র রাজ্যগুলোর লড়াই।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, মহাভারতের ঘটনাক্রম, মূল আকৃতি, ঐতিহাসিক ভিত্তি প্রভৃতি সম্পর্কে নানাবিধ বিতর্ক রয়েছে। তদুপরি, বর্তমানে মহাভারতের বহু সংখ্যক সংস্করণ রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে বিবরণের ক্ষেত্রে নানা পার্থক্য রয়েছে। সাধারণভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে কৌরবদের বিরুদ্ধে পাণ্ডবদের ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, কিন্তু এই সংজ্ঞায়ন নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। সর্বোপরি, মহাভারত নিয়ে টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের ধারাবাহিক নাটক ও অন্যান্য অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে, এবং এগুলো যে মহাভারত বইয়ে লিখিত বিবরণকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করেছে, এমনটি মোটেই নয়।

কিন্তু এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এই নিবন্ধে মূলত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মূল ঘটনাবলিকে তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হবে। এক্ষেত্রে মহাভারতের যে সংস্করণ ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি হচ্ছে কিশোরীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় (যিনি ‘কে. এম. গাঙ্গুলি’ নামে সমধিক পরিচিত) কর্তৃক অনূদিত ‘The Mahabharata of Krishna-Dwaipayana Vyasa Translated into English Prose’। ১৮৮৩ থেকে ১৮৯৬ সালের মধ্যে তদানীন্তন ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতায় প্রকাশিত মহাভারতের এই সংস্করণটি ছিল মহাভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি অনুবাদ।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: কৌরব–পাণ্ডব দ্বন্দ্ব

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বিবরণ শুরুর পূর্বে অতি সংক্ষেপে এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট জেনে নেয়া যাক। কুরু রাজ্যের রাজবংশের দুটি শাখা ছিল — কৌরব ও পাণ্ডব। কৌরবরা ছিলেন কুরু রাজ্যের তদানীন্তন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান, আর পাণ্ডবরা ছিলেন কুরু রাজ্যের প্রাক্তন রাজা পাণ্ডুর সন্তান। ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন বয়সে পাণ্ডুর চেয়ে বড়, কিন্তু তিনি দৃষ্টিহীন ছিলেন বিধায় তার পরিবর্তে তার ছোট ভাই পাণ্ডুকে সিংহাসনে বসানো হয়েছিল। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত এক ঋষিকে হত্যা করার পর এর প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তিনি সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীকে নিয়ে বনবাসে চলে যান। এর ফলে ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কুরু রাজ্যের রক্ষাকর্তা ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতৃব্য মহাবীর ভীষ্ম, যিনি সিংহাসনে দাবি চিরদিনের জন্য ত্যাগ করেছিলেন এবং আজীবন অবিবাহিত থাকার শপথ নিয়েছিলেন।

চিত্রকর্মটিতে দেখা যাচ্ছে, মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন (বা বেদব্যাস) মহাভারতের লিখিত সংস্করণ পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছেন; Source: Gita Press Gorakhpur/Wikimedia Commons

পাণ্ডু ও কুন্তীর ছিল তিন ছেলে— যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন, আর পাণ্ডু ও মাদ্রীর ছিল দুই ছেলে — নকুল ও সহদেব। এই পাঁচ রাজপুত্র তাদের বাবার নামানুসারে ‘পাণ্ডব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কার্যত পাণ্ডুর ছেলেদের জন্ম হয়েছিল ‘নিয়োগ প্রথা’র মাধ্যমে, এবং সেদিক থেকে যুধিষ্ঠির ছিলেন যম/ধর্মদেবের ছেলে, ভীম ছিলেন পবনদেবের ছেলে, অর্জুন ছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রের ছেলে, এবং নকুল ও সহদেব ছিলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ছেলে। অন্যদিকে, ধৃতরাষ্ট্র ও তার স্ত্রী গান্ধারীর ছিল একশো ছেলে ও এক মেয়ে (উল্লেখ্য, গান্ধারীকে মহর্ষি বেদব্যাস শতপুত্র লাভের বর দিয়েছিলেন)। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছেলের নাম ছিল দুর্যোধন এবং তার পরবর্তী ছেলের নাম ছিল দুঃশাসন। মেয়েটির নাম ছিল দুঃশলা। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা তাদের পূর্বপুরুষ কুরুর নামানুসারে ‘কৌরব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

বনবাসে থাকা অবস্থাতেই পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যু ঘটে এবং কুন্তী তার পাঁচ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কুরু রাজ্যের রাজধানী হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন। তখন থেকেই কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। কৈশোরে কৌরব ও পাণ্ডবরা প্রথমে কৃপাচার্য ও পরবর্তীতে দ্রোণাচার্য নামক রণকৌশলে নিপুণ দুই ব্রাহ্মণের কাছে শিক্ষালাভ করেন। তাদের শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর তারা সকলেই দক্ষ যোদ্ধায় পরিণত হন, কিন্তু অর্জুন ছিলেন ধনুর্বিদ্যায় তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং দুর্যোধন ও ভীম ছিলেন গদাযুদ্ধে নিপুণ।

শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর যুবরাজ পদের জন্য কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যুধিষ্ঠির ছিলেন দুর্যোধনের চেয়ে বয়সে বড় এবং ধর্মসংক্রান্ত জ্ঞান ও ধার্মিক জীবনাচরণের জন্য কুরু রাজ্যের জনসাধারণের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। এর ভিত্তিতে যুধিষ্ঠির যুবরাজ পদের (এবং পরোক্ষভাবে কুরু রাজ্যের সিংহাসনের) দাবিদার ছিলেন। অন্যদিকে, দুর্যোধন ছিলেন তদানীন্তন রাজা বড় ছেলে এবং রাজার ছেলে হিসেবে তিনি নিজেকে যুবরাজ পদের (এবং পরোক্ষভাবে কুরু রাজ্যের সিংহাসনের) প্রকৃত দাবিদার হিসেবে বিবেচনা করতেন।

দুর্যোধনের মূল সহযোগী ছিলেন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু মহাবীর কর্ণ, মামা শকুনি এবং ভাই দুঃশাসন। কর্ণ ছিলেন সূর্যদেব ও কুন্তীর সন্তান, কিন্তু তাকে জন্মের পরপরই পরিত্যাগ করা হয় এবং এক সারথির পরিবারে তিনি লালিতপালিত হন। দুর্যোধন কর্ণের রণকুশলতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুরু রাজ্যের অন্তর্গত অঙ্গপ্রদেশের রাজা নিযুক্ত করেন। কর্ণ তার বন্ধু দুর্যোধনকে কুরু রাজ্যের সিংহাসনে দেখতে আগ্রহী ছিলেন এবং সেজন্য পাণ্ডবদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতেন। অন্যদিকে, শকুনি ছিলেন গান্ধার রাজ্যের রাজা, কিন্তু তিনি সিংহভাগ সময় কুরু রাজ্যেই অবস্থান করতেন। তিনিও নিজের ভাগ্নে দুর্যোধনকে কুরু রাজ্যের সিংহাসনে দেখতে আগ্রহী ছিলেন।

চিত্রকর্মে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী কর্তৃক শিবের আরাধনার দৃশ্য; Source: Mahavir Prasad Shiva/Wikimedia Commons

এমতাবস্থায় ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম, প্রধানমন্ত্রী বিদুর (ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সৎ ভাই), দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য প্রমুখের পরামর্শে ও জনমতের ভিত্তিতে যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ নিযুক্ত করেন। যুধিষ্ঠিরের যুবরাজ পদ লাভের ফলে দুর্যোধন ক্ষিপ্ত হন এবং কুন্তী ও পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চক্রান্ত করেন। কিন্তু কুন্তী ও পাণ্ডবরা প্রাণে বেঁচে যান এবং আত্মগোপন করেন। পরবর্তীতে পাণ্ডবরা পাঞ্চাল রাজ্যের রাজকুমারী দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হন এবং সেখানে অর্জুন একটি লক্ষ্যভেদ প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করে দ্রৌপদীকে লাভ করেন। পরে এক বিচিত্র ঘটনাচক্রের মধ্য দিয়ে পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গেই দ্রৌপদীর বিয়ে হয়।

এদিকে এর ফলে পাণ্ডবরা যে বেঁচে আছেন সেটি প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং পাঞ্চালের মিত্রতায় বলীয়ান হয়ে তারা কুরু রাজ্যে ফিরে আসেন। এমতাবস্থায় কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য কুরু রাজ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। রাজধানী হস্তিনাপুরসহ কুরু রাজ্যের একাংশ রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও কৌরবদের অধীনে থেকে যায়, আর রাজ্যের অপর অংশ পাণ্ডবদের হস্তগত হয় এবং যুধিষ্ঠির উক্ত অংশের রাজা নিযুক্ত হন। পাণ্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জন করে। ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ভারতবর্ষের সকল রাজাকে পরাজিত করেন এবং ইন্দ্রপ্রস্থে মহাসমারোহে রাজসূয় যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু কৌরবরা এতে ঈর্ষান্বিত হন। তারা যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলার জন্য হস্তিনাপুরে আমন্ত্রণ জানান এবং জুয়ায় আসক্ত যুধিষ্ঠির এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এই খেলায় যুধিষ্ঠির তার রাজ্যকে, ভাইদেরকে এবং নিজেকেও বাজি রেখে হেরে যান এবং কৌরবদের দাসে পরিণত হন। অবশেষে তিনি স্ত্রী দ্রৌপদীকেও বাজি রাখেন এবং বাজিতে হারার ফলে দ্রৌপদী কৌরবদের দাসীতে পরিণত হন। এরপর দুঃশাসন দুর্যোধনের নির্দেশে দ্রৌপদীকে বলপূর্বক রাজদরবারে টেনে আনেন এবং তার বস্ত্রহরণের চেষ্টা করেন, কিন্তু কৃষ্ণ (দ্বারকা রাজ্যের প্রকৃত অধিকর্তা এবং দেবতা বিষ্ণুর ‘অষ্টম অবতার’ হিসেবে বিবেচিত) তাকে রক্ষা করেন। এই ঘটনার পর ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের দাসত্ব থেকে মুক্তি প্রদান করেন এবং তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দেন।

চিত্রকর্মে পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরের পরাজয় এবং দ্রৌপদীকে রাজসভায় উপস্থিত করার দৃশ্য; Source: Chore Bagan Art Studio/Wikimedia Commons

কিন্তু দুর্যোধনের চাপের মুখে আবার কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে পাশা খেলা অনুষ্ঠিত হয়, এবং এবারও পাণ্ডবরা পরাজিত হন। খেলার শর্তানুসারে তারা ১২ বছরের জন্য বনবাস ও এক বছরের জন্য অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন। এরপর কর্ণ দুর্যোধনের পক্ষে ভারতবর্ষের সকল রাজাকে পরাজিত করেন এবং হস্তিনাপুরে মহাসমারোহে বৈষ্ণব যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে ১২ বছর বনবাসে কাটানোর পর পাণ্ডবরা মৎস্য রাজ্যে আত্মগোপন করেন, কিন্তু বছরের শেষের দিকে কৌরবরা এটি অনুমান করে ফেলেন এবং মৎস্য রাজ্যের ওপর আক্রমণ চালান। কিন্তু তারা পাণ্ডবদের কাউকে খুঁজে বের করার আগেই অজ্ঞাতবাসের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।

এরপর পাণ্ডবরা তাদের রাজ্য ফেরত চান, কিন্তু দুর্যোধন তাতে অস্বীকৃতি জানান এবং কৃষ্ণের শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ইতোমধ্যে কুন্তী গোপনে কর্ণের সঙ্গে দেখা করেন এবং কর্ণের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরে তাকে পাণ্ডবদের পক্ষে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু কর্ণ নিজের বন্ধুকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। অবশ্য তিনি কুন্তীকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি যুদ্ধের সময় অর্জুন ছাড়া বাকি চার পাণ্ডবকে হত্যা করবেন না। কৌরব ও পাণ্ডবরা যুদ্ধের জন্য নিজেদের মিত্র রাজ্যগুলোকে সমবেত করতে শুরু করে, এবং কুরুক্ষেত্রের (বর্তমান ভারতের হরিয়ানায় অবস্থিত) ময়দানে যুদ্ধের জন্য সৈন্য সমাবেশ করে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংক্রান্ত নানাবিধ তথ্যাদি

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে কার্যত প্রাচীন ভারতবর্ষের ‘বিশ্বযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তদানীন্তন ভারতবর্ষের প্রায় সকল রাজ্য এই যুদ্ধে হয় কৌরবদের পক্ষে, নয়ত পাণ্ডবদের পক্ষে যোগদান করে। কৌরব–শাসিত কুরু রাজ্যের পক্ষে তাদের অধীনস্থ অঙ্গপ্রদেশ তো ছিলই, তদুপরি, গান্ধার, সিন্ধু, মদ্র, কম্বোজ, বাহ্লিক, ত্রিগার্তা, অবন্তী, প্রাগজ্যোতিষ ও আরো বিভিন্ন রাজ্যও কুরু রাজ্যের পক্ষে ছিল। তদুপরি, কৃষ্ণের নিজস্ব সৈন্যদল ‘নারায়ণী সেনা’ও এই যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে, রাজ্যবিহীন পাণ্ডবদের পক্ষে ছিল পাঞ্চাল, মৎস্য, মগধ, চেদি, কুন্তী, কাশী, কৈকেয়া ও আরো বিভিন্ন রাজ্য। তদুপরি, কৃষ্ণ নিজেও পাণ্ডবদের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু তিনি যোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং অর্জুনের রথের সারথি হিসেবে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

মহাভারতে প্রদত্ত বিবরণ অনুসারে, কৌরবদের মোট ১১ অক্ষৌহিণী সৈন্য ছিল, আর পাণ্ডবদের মোট ৭ অক্ষৌহিণী সৈন্য ছিল। ২১,৮৭০টি রথ, ২১,৮৭০টি হাতি, ৬৫,৬১০টি ঘোড়া এবং ১,০৯,৩৫০ জন পদাতিক সৈন্যের সমন্বয়ে এক অক্ষৌহিণী গঠিত হয়। সেই হিসেবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে কৌরবদের মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল ২৪,০৫,৭০০ জন, আর পাণ্ডবদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১৫,৩০,৯০০ জন। যুদ্ধের প্রাক্কালে কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন ভীষ্ম, আর পাণ্ডব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন ধৃষ্টদ্যুম্ন।

চিত্রকর্মে দুর্যোধন (ডানে) এবং শকুনি (বামে); Source: Ramanarayanadatta Astri/Wikimedia Commons

কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, জয়দ্রথ, কৃতবর্মা, ভগদত্ত, শল্য, ভুরিশ্রবা, অলম্বুষ, বৃষসেন প্রমুখ। অশ্বত্থামা ছিলেন দ্রোণাচার্যের ছেলে; জয়দ্রথ ছিলেন সিন্ধুর রাজা ও কৌরবদের ভগ্নিপতি; কৃতবর্মা ছিলেন কৃষ্ণের নারায়ণী সেনার সেনাপতি; ভগদত্ত ছিলেন প্রাগজ্যোতিষের রাজা; শল্য ছিলেন মদ্রের রাজা এবং নকুল ও সহদেবের মামা; ভুরিশ্রবা ছিলেন বাহ্লিক রাজ্যের রাজপুত্র; অলম্বুষ ছিলেন একজন রাক্ষস; এবং বৃষসেন ছিলেন কর্ণের বড় ছেলে। অন্যদিকে, পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন পঞ্চপাণ্ডব নিজেরা, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, অভিমন্যু, ঘটোৎকচ প্রমুখ। দ্রুপদ ছিলেন পাঞ্চালের রাজা; ধৃষ্টদ্যুম্ন ছিলেন দ্রুপদের ছেলে; সাত্যকি ছিলেন কৃষ্ণের নারায়ণী সেনার একজন সেনাপতি যিনি পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন; অভিমন্যু ছিলেন অর্জুন ও সুভদ্রার (কৃষ্ণের বোন) ছেলে; এবং ঘটোৎকচ ছিলেন ভীম ও রাক্ষসী হিড়িম্বার ছেলে।

উল্লেখ্য, টেলিভিশনে প্রচারিত মহাভারতের ওপর নির্মিত সিরিয়ালগুলোতে যে ধরনের যুদ্ধের দৃশ্য দেখানো হয়ে থাকে, মহাভারতে বর্ণিত যুদ্ধের দৃশ্যগুলো তার চেয়ে বহুলাংশে পৃথক। সিরিয়ালগুলোতে দেখানো হয়ে থাকে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তীরন্দাজরা কেবল তীর–ধনুক নিয়ে, গদাধারীরা কেবল গদা নিয়ে কিংবা অসিধারীরা কেবল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতেন। কিন্তু কার্যত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বড় বড় যোদ্ধাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল তীর–ধনুক। দ্বৈরথ যুদ্ধের সময় একজন বড় যোদ্ধা প্রধানত তীর–ধনুক নিয়েই যুদ্ধ করতেন এবং সাধারণত কেবল তূণীরের তীর শেষ হওয়া বা ধনুক কাটা পড়ার পরেই তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অন্য অস্ত্র (যেমন: গদা, বর্শা, তলোয়ার প্রভৃতি) ব্যবহার করতেন। বস্তুত ভীম ও দুর্যোধন উভয়েই ছিলেন প্রধানত গদাধারী, কিন্তু যুদ্ধের সময় তাদের প্রায় প্রতিটি দ্বৈরথ যুদ্ধেই তীর–ধনুক ব্যবহৃত হয়েছে।

তদুপরি, সিরিয়ালগুলোতে যেরকম দেখানো হয় যে, তীরন্দাজদের তীর কখনো নিঃশেষ হতো না, মহাভারতের বর্ণনায় সেরকম কিছু পাওয়া যায় না, বরং তূণীরের তীর শেষ হয়ে গেলে যোদ্ধাদের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতো। সর্বোপরি, সিরিয়ালগুলোতে দেখানো হয়ে থাকে যে, একাধিক যোদ্ধা কর্তৃক একজন যোদ্ধার ওপর আক্রমণ পরিচালনা ছিল খুবই বিরল ব্যাপার ও নীতিগতভাবে গর্হিত, কিন্তু মহাভারতের কাহিনীতে দেখা যায় যে, একাধিক যোদ্ধা কর্তৃক একজন যোদ্ধার ওপর আক্রমণ পরিচালনা নিষিদ্ধ ছিল বটে, কিন্তু এটি ছিল খুবই প্রচলিত ঘটনা।

যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে কৌরব ও পাণ্ডবরা যুদ্ধের নিয়মাবলি ঠিক করে নেয়। এগুলো মধ্যে ছিল:

(১) একজন রথী কেবল অপর একজন রথীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, হাতির ওপরে আরোহণকারী একজন যোদ্ধা কেবল হাতির ওপরে আরোহণকারী অপর একজন যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, একজন অশ্বারোহী কেবল অপর একজন অশ্বারোহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং একজন পদাতিক সৈন্য কেবল অপর একজন পদাতিক সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

(২) একজন যোদ্ধা অপর একজন যোদ্ধাকে আক্রমণ করার আগে তাকে সতর্ক করবে।

(৩) কোনো যোদ্ধা অপ্রস্তুত বা আতঙ্কগ্রস্ত থাকলে তার ওপর আক্রমণ চালানো যাবে না।

(৪) কোনো যোদ্ধা যদি অন্য কোনো যোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে তাহলে তার ওপর আক্রমণ চালানো যাবে না।

(৫) কোনো যোদ্ধা যদি দয়াভিক্ষা করে বা পশ্চাৎপসরণ করে, তার ওপর আক্রমণ চালানো যাবে না।

(৬) কোনো যোদ্ধার অস্ত্র অকেজো হয়ে পড়লে বা কোনো যোদ্ধার শরীরে বর্ম না থাকলে তার ওপর আক্রমণ চালানো যাবে না।

(৭) রথের সারথি, রথের সঙ্গে সংযুক্ত পশু, অস্ত্রবাহী পশু বা মানুষ, ঢাকবাদক এবং শঙ্খবাদকদের ওপর আক্রমণ চালানো যাবে না।

অবশ্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালে এই নিয়মগুলো যতটা না পালিত হয়েছে, তার চাইতে বেশি ভঙ্গ করা হয়েছে। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই উভয় পক্ষ এই নিয়মগুলো ভাঙতে শুরু করে এবং যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে মেবারে অঙ্কিত একটি চিত্রকর্মে কুরুক্ষেত্রের ময়দানে কৌরব ও পাণ্ডব বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্য; Source: Wikimedia Commons

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের স্থায়ীত্ব ছিল মোট ১৮ দিন, এবং মহাভারতের ১৮টি পর্বের মধ্যে ৫টি পর্বে এই যুদ্ধের বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। এই ৫টি পর্ব হচ্ছে ভীষ্ম পর্ব, দ্রোণ পর্ব, কর্ণ পর্ব, শল্য পর্ব এবং সৌপ্তিক পর্ব। যুদ্ধের প্রথম ১০ দিন ভীষ্ম কৌরব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন, এবং যে পর্বটিতে এই ১০ দিনের যুদ্ধের বিবরণ প্রদান করা হয়েছে, সেটির নামকরণ করা হয়েছে ভীষ্মের নামে।

উল্লেখ্য, যুদ্ধ শুরুর আগে ভীষ্ম কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের সামনে কৌরব ও পাণ্ডব উভয় বাহিনীর প্রধান যোদ্ধাদের ‘র‍্যাঙ্কিং’ করেন। এক্ষেত্রে তিনি সকল যোদ্ধাকেই সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেন, কিন্তু কর্ণকে তিনি একজন ‘অর্ধ রথী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত কর্ণ যে প্রকৃতপক্ষে পাণ্ডবদের ভাই, এই গোপন বিষয়টি ভীষ্মের জানা ছিল এবং সেজন্য ভীষ্ম ইচ্ছাকৃতভাবে কর্ণকে এভাবে অপমানিত করেছিলেন, যাতে আত্মাভিমানী কর্ণ ক্ষিপ্ত হয়ে তার অধীনে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ না হয়। ভীষ্মের প্রকৃত মনোভাব কর্ণের জানা ছিল না এবং তিনি এই অপমানের কারণে ভীষ্মের ওপর মারাত্মক ক্ষিপ্ত হন। তিনি ভীষ্মের অধীনে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি তো জানানই, তদুপরি তিনি ভীষ্মকে পরিত্যাগ করার জন্য দুর্যোধনকে পরামর্শ দেন এবং ভীষ্মকে তার সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধের আহ্বান জানান।

দুর্যোধন কর্ণের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন সুচতুর ও বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। ভীষ্ম অত্যন্ত সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন এবং তার ইচ্ছামৃত্যুর বর ছিল, অর্থাৎ তিনি নিজে মৃত্যুবরণের ইচ্ছা না করলে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল না। অর্থাৎ, ভীষ্ম ছিলেন কার্যত অমর। এর বিপরীতে কর্ণ অত্যন্ত সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি অমর ছিলেন না (কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বহুদিন আগেই কর্ণ তার বিখ্যাত সহজাত কবচ–কুণ্ডল হারিয়েছিলেন)। সুতরাং দুর্যোধন ভীষ্মকেই প্রধান সেনাপতি হিসেবে বহাল রাখেন এবং এর ফলে ভীষ্মের সেনাপতিত্বের সময়ে (যুদ্ধের প্রথম ১০ দিনে) কর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। অর্থাৎ, ভীষ্মের পরিকল্পনা সফল হয়।

যুদ্ধের প্রথম দিন: উত্তরের মৃত্যু এবং কৌরবদের বিজয়

যুদ্ধের প্রথম দিনে ভীষ্ম কৌরব বাহিনীকে এমন একটি ব্যূহের আকারে সজ্জিত করেন, যেটির ‘মস্তিষ্ক’ (সম্মুখভাগে) ছিল রথীরা, যেটির ‘দেহ’ (কেন্দ্রে) ছিল হস্তীবাহিনী এবং যেটির ‘ডানা’ (উভয় পার্শ্বে) ছিল অশ্বারোহী বাহিনী। এর বিপরীতে যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে অর্জুন পাণ্ডব বাহিনীকে ‘বজ্রব্যূহে’র আকারে সজ্জিত করেন।

কিন্তু শত্রুদের সম্মুখভাগে নিজের স্বজনদের দেখে অর্জুন আকস্মিকভাবে যুদ্ধ করার উদ্যম হারিয়ে ফেলেন এবং অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে কৃষ্ণের কাছে পরামর্শ চান। এসময় কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে একটি বিস্তৃত সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়, এবং কৃষ্ণ অর্জুনের উদ্দেশ্যে নানাবিধ আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক বক্তব্য প্রদান করেন। এই সংলাপ ‘শ্রীমদভগবদগীতা’ বা ‘গীতা’ হিসেবে সংকলিত হয়েছে এবং একে হিন্দুধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলোর অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন মনোবল ফিরে পান এবং পুনরায় হাতে ধনুক উঠিয়ে নেন।

চিত্রকর্মে শ্রীমদভগবদগীতার সংলাপের প্রাক্কালে কুরুক্ষেত্রের ময়দানের মাঝখানে অর্জুন ও কৃষ্ণের রথের দৃশ্য; Source: Indus.heartstrings

এরপর যুধিষ্ঠির তার অস্ত্রশস্ত্র ও বর্ম ত্যাগ করে রথ থেকে নামেন এবং সকলকে হতবাক করে দিয়ে কৌরব বাহিনীর দিকে অগ্রসর হন। তিনি কৌরব বাহিনীর সম্মুখভাগে পৌঁছে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য ও শল্যের কাছে যুদ্ধ শুরুর অনুমতি প্রার্থনা করেন এবং যুদ্ধ জয়ের জন্য তাদের আশীর্বাদ কামনা করেন। তারা প্রত্যেকেই যুধিষ্ঠিরের এই নম্রতার প্রশংসা করে তাকে আশীর্বাদ করেন এবং প্রত্যেকেই যুধিষ্ঠিরকে একটি করে বর প্রদানের প্রস্তাব করেন। যুধিষ্ঠির সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তিনি ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যের কাছে জানতে চান যে, কীভাবে তাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করা সম্ভব। ভীষ্ম ও কৃপাচার্য জানান যে, তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করা সম্ভব নয়, আর দ্রোণাচার্য জানান যে, তিনি স্বেচ্ছায় অস্ত্র ত্যাগ করলে তবেই কেবল তাকে হত্যা করা সম্ভব।

শল্যের কাছে যুধিষ্ঠির একটি ভিন্ন ধরনের বর প্রার্থনা করেন। তিনি শল্যকে অনুরোধ করেন যে, শল্য যেন যুদ্ধের সময় কর্ণের শক্তি ক্ষয় করেন। উল্লেখ্য, কর্ণ ছিলেন অর্জুনের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এবং যুদ্ধের একপর্যায়ে তারা যে পরস্পরের মুখোমুখি হবেন, এটি ছিল নিশ্চিত। অর্জুনের সারথি ছিলেন কৃষ্ণ স্বয়ং, কিন্তু কর্ণের কৃষ্ণের সমতুল্য কোনো সারথি ছিল না। শল্য রথ চালনায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং যুধিষ্ঠির আন্দাজ করেছিলেন যে, কর্ণ যুদ্ধে প্রবেশ করলে শল্যকে কর্ণের সারথি হিসেবে নিযুক্ত করা হতে পারে। সেই হিসেব থেকে যুধিষ্ঠির আগেভাগেই শল্যের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন যে, এরকম হলে শল্য যেন কর্ণের শক্তিক্ষয় ঘটান। বস্তুত যুধিষ্ঠির ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য ও শল্যের কাছে যেসব বর চেয়েছিলেন, তার থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যুধিষ্ঠির অত্যন্ত চতুর একজন রণনীতি বিশারদ ছিলেন।

এদিকে একই সময়ে কৃষ্ণ কর্ণের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রস্তাব দেন। ইতিপূর্বে হস্তিনাপুরে শান্তিদূত হিসেবে যাওয়ার পরও কৃষ্ণ কর্ণকে অনুরূপ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই কর্ণ কৃষ্ণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

এদিকে কৌরব বাহিনীর সম্মুখভাগ থেকে নিজস্ব অবস্থানে প্রত্যাবর্তনের পর যুধিষ্ঠির ঘোষণা করেন যে, কেউ যদি কৌরব বাহিনী ত্যাগ করে পাণ্ডব বাহিনীতে যোগদান করতে চায়, তাহলে তারা তাকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবেন। এই ঘোষণার পর কৌরবদের ভাই যুযুৎসু কৌরব বাহিনী ত্যাগ করে পাণ্ডব বাহিনীতে যোগদান করেন এবং যুধিষ্ঠির তাকে সাদরে বরণ করে নেন। উল্লেখ্য, যুযুৎসু কৌরবদের আপন ভাই ছিলেন না, অর্থাৎ রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সন্তান ছিলেন না। তিনি ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র ও একজন দাসীর সন্তান। মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী, এজন্য শৈশবে যুযুৎসু বাকি কৌরবদের ব্যঙ্গবিদ্রূপের পাত্র ছিলেন এবং এটি কৌরবদের বিরুদ্ধে তার মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করে থাকতে পারে।

এই নাটকীয় ঘটনাবলির পর কৌরব ও পাণ্ডব বাহিনী একে অপরের ওপর আক্রমণ শুরু করে এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। ভীষ্ম অর্জুনের বিরুদ্ধে, দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নের বিরুদ্ধে, কৃতবর্মা সাত্যকির বিরুদ্ধে, দুর্যোধন ভীমের বিরুদ্ধে, ভুরিশ্রবা শঙ্খের (মৎস্য রাজ্যের রাজা বিরাটের ছেলে) বিরুদ্ধে, অলম্বুষ ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে, শল্য যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে, অশ্বত্থামা শিখণ্ডীর (পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদের ছেলে) বিরুদ্ধে, ভগদত্ত বিরাটের বিরুদ্ধে, জয়দ্রথ দ্রুপদের বিরুদ্ধে এবং বাহ্লিক (বাহ্লিক রাজ্যের রাজা) চেদির রাজা দৃষ্টকেতুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অনুরূপভাবে, দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ সুতসোমের (ভীম ও দ্রৌপদীর ছেলে) বিরুদ্ধে, শকুনি প্রতিবিন্ধ্যের (যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর ছেলে) বিরুদ্ধে, কম্বোজের রাজা সুদক্ষিণ শ্রুতকর্মার (সহদেব ও দ্রৌপদীর ছেলে) বিরুদ্ধে, দুর্যোধনের ভাই বীরবাহু উত্তরের (বিরাটের ছেলে) বিরুদ্ধে, অবন্তীর রাজপুত্র বিন্দ ও অনুবিন্দ যথাক্রমে কুন্তী রাজ্যের রাজা কুন্তীভোজ ও কুন্তীভোজের ছেলের বিরুদ্ধে এবং ত্রিগার্তার রাজা সুশর্মা পাণ্ডব বীর চেকিতনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন।

চিত্রকর্মে ভীষ্ম ও অর্জুনের মধ্যেকার দ্বৈরথ যুদ্ধের দৃশ্য; Source: Wikimedia Commons

কোশলের রাজা বৃহদ্বল অভিমন্যুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। এসময় বৃহদ্বলের তীরের আঘাতে অভিমন্যুর রথের সারথি নিহত হয় এবং অভিমন্যুর তীরের আঘাতে বৃহদ্বলের সারথি ও একজন পার্শ্বনী (রথের চাকার রক্ষী) নিহত হয়। দুঃশাসন নকুলের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, এবং এসময় দুঃশাসনের তীরের আঘাতে নকুলের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। দুর্মুখ (দুর্যোধনের ভাই) সহদেবের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, এবং এসময় সহদেবের তীরের আঘাতে দুর্মুখের রথের সারথি নিহত হয়। কৃপাচার্য কৈকেয়ার রাজার বৃহদক্ষত্রের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, এবং এসময় তাদের তীরের আঘাতে তাদের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। রাজা শ্রুতায়ুশ ইরাবানের (অর্জুন ও নাগ রাজকন্যা উলুপির ছেলে) বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। এসময় ইরাবানের তীরের আঘাতে শ্রুতায়ুশের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং শ্রুতায়ুশের নিক্ষিপ্ত গদার আঘাতে ইরাবানের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। অর্থাৎ, যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই উভয় পক্ষের যোদ্ধারা যুদ্ধের নিয়মাবলি ভঙ্গ করতে শুরু করেন।

সেদিন দুপুরের প্রাক্কালে ভীষ্মের হাতে পাণ্ডব পক্ষের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্চাল, চেদি, কাশী ও করুশ রাজ্যের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। কৃতবর্মা, কৃপাচার্য ও শল্য এবং দুর্যোধনের ভাই দুর্মুখ ও বিবিংশতি ভীষ্মকে সুরক্ষা দিচ্ছিলেন। এসময় অভিমন্যু অগ্রসর হয়ে তাদেরকে আক্রমণ করেন। অভিমন্যুর তীরের আঘাতে দুর্মুখের রথের সারথি নিহত হয়, কৃপাচার্যের ধনুক কাটা পড়ে এবং ভীষ্মের রথের ঝাণ্ডা পড়ে যায়। কিন্তু শীঘ্রই ভীষ্মের ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত অজস্র তীর অভিমন্যুকে ঘিরে ফেলে। এসময় অভিমন্যুকে রক্ষা করার জন্য ১০ জন পাণ্ডব বীর (সাত্যকি, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, উত্তর ও ৫ জন কৈকেয়া রাজপুত্র) সেদিকে অগ্রসর হন এবং কৌরব যোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

মৎস্য রাজ্যের রাজপুত্র উত্তর একটি হাতির পিঠে চেপে শল্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তার হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে শল্যের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। এরপর শল্যের নিক্ষিপ্ত একটি তীরের আঘাতে উত্তর নিহত হন এবং শল্য তার অচল রথ থেকে নেমে তলোয়ারের আঘাতে উত্তরের হাতিকেও হত্যা করেন। উত্তর ও উত্তরের হাতিটিকে হত্যা করার পর শল্য কৃতবর্মার রথে আরোহণ করেন। উত্তর নিহত হওয়ার পর তার ভাই শঙ্খ এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য শল্য ও কৃতবর্মার রথের দিকে অগ্রসর হন। এটি দেখে ভীষ্ম শঙ্খের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু অর্জুন দ্রুত ভীষ্ম ও শঙ্খের মাঝখানে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ভীষ্মের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ইতোমধ্যে শল্য একটি গদা হাতে কৃতবর্মার রথ থেকে নেমে পড়েন এবং ক্ষিপ্রগতিতে শঙ্খের রথের কাছে এসে সেটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে হত্যা করেন। শঙ্খ ভীত হয়ে তলোয়ার হাতে তার অচল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং দৌড়ে গিয়ে অর্জুনের রথে আরোহণ করেন।

এদিকে ভীষ্ম অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধরত থাকা অবস্থাতেই তার তীরের আঘাতে পাণ্ডব পক্ষের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্চাল, মৎস্য, কৈকেয়া ও প্রভদ্রক রাজ্যের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অর্জুনের সঙ্গে দ্বৈরথ পরিত্যাগ করে দ্রুপদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি দ্রুপদকে পরাজিত করেন এবং তার তীরের আঘাতে দ্রুপদের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। এই পর্যায়ে কৌরব বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাণ্ডব বাহিনীর সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয়। ভীষ্ম পাণ্ডব বাহিনীর রথীদের নাম ধরে ডেকে ডেকে তাদেরকে হত্যা করতে শুরু করেন। সূর্যাস্ত নাগাদ পাণ্ডবদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এভাবে পাণ্ডবদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রথম দিনের অবসান ঘটে।

Related Articles

Exit mobile version