মানবজীবনের উত্থান-পতনের মতো প্রকৃতিও বছরের বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। কখনো প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যলীলা মানুষের সৌন্দর্যপিপাসু মনকে আন্দোলিত করে, সৌন্দর্যরসিক মানুষকে প্রকৃতি নিজের রূপে কখনো করে তোলে ভাবুক, সাড়া জাগায় মনের নিভৃতে। আবার প্রকৃতি কখনো রূদ্রমূর্তি নিয়ে হাজির হয়, ব্যাঘাত ঘটায় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে। প্রকৃতির এই প্রতিনিয়ত রূপ পরিবর্তনকে আমরা ঋতু বলি। বছরের পর বছর ধরে ঋতুর ক্রমপরিবর্তনের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে তৈরি হয় আবহাওয়া। অঞ্চলভেদে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে, পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যেও।
মধ্যপ্রাচ্যের মতো পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে সূর্যের আলো বেশি পৌঁছায়, সেসব অঞ্চল তুলনামূলকভাবে উষ্ণ থাকে, গ্রীষ্মকালে উচ্চ-তাপমাত্রার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী হয় গ্রীষ্মকাল। এর বিপরীত প্রক্রিয়া ঘটে উত্তর আমেরিকার মতো অঞ্চলগুলোতে, তুলনামূলকভাবে ক্ষণস্থায়ী হয় গ্রীষ্মকাল। ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ধরনও। আবার যেসব দেশে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয় শীতকাল, সেখানকার মানুষদেরও ভিন্ন ঘরানার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ দেখা যায় উষ্ণ অঞ্চলগুলো তুলনায়।
শীতে অধিক কার্যকর থাকে মস্তিষ্ক
সাধারণভাবে, শীতকালে সূর্যের আলো কম পৌঁছায়, মানুষের মধ্যেও অলস একটা আবহ ছড়িয়ে পড়ে। কম তাপমাত্রায় মানুষের সেরোটোনিনের নিঃসরণের হার কমে যায়, যা আনন্দ-বেদনার অনুভূতিকে কমিয়ে দেয়। ফলে একটা দীর্ঘ সময় ধরে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল, কম তাপমাত্রা জৈবিক কাজগুলো ধীর হয়ে যাওয়ায়, মানুষ শীতকালে বিষণ্নতায় ভোগে বেশি।
এই ব্যাপার নিয়ে ৩৫ হাজার আমেরিকানের উপর গবেষণা চালায় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স সংস্থা। এই বিশাল গবেষণায় তারা শীতকালে মানসিক বিষণ্নতা বৃদ্ধির কোনো আলামত পায়নি, বিষণ্নতার আলামতের উপরও কোনো ঋতুভিত্তিক প্রভাব তারা পায়নি।
অন্যদিকে, শারীরবৃত্তীয় কাজগুলোর পাশাপাশি কম তাপমাত্রায় মানুষের মস্তিষ্কও ধীরগতিতে কাজ করে, তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে হয় মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর মধ্যে যোগাযোগ। ফলে একটা দীর্ঘ সময় ধরে মনে করা হতো, কম তাপমাত্রায় মস্তিষ্ক ধীরগতিতে কাজ করায় কম তাপমাত্রায় মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতাও কমে যায়। কিন্তু গত কয়েক দশকের বেশ কয়েকটি গবেষণা দেখাচ্ছে, কম তাপমাত্রায় মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর মধ্যে যোগাযোগ তুলনামূলক ধীরগতিতে হলেও, মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতার হ্রাস ঘটে না। বরং ঘটে ঠিক তার উল্টোটা। কম তাপমাত্রায় ক্রিয়াশীল মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে অধিক তাপমাত্রায় ক্রিয়াশীল মস্তিষ্কের চেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কোনো কাজে দ্রুত দক্ষতা অর্জন করতে পারে, মস্তিষ্ককে সেই কাজের সাথে তুলনামূলকভাবে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
ধরুন, একটি আইনি সহায়তার জন্য আপনি আইনজীবীর কাছে যাবেন। আপনি যদি তরুণ, অনভিজ্ঞ একজন আইনজীবীর কাছে যান, তিনি অধিকাংশ সময়ই আপনার সমস্যা বলার সময় বাধা দেবেন, আপনি সমস্যাটি হয়তো তরুণ আইনজীবীর কাছে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবেন না। আবার, তিনি যখন সমস্যার সমাধান দেবেন, তিনি আপনাকে দ্রুত কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ সমাধানের দিকে ধাবিত করবেন। অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে অভিজ্ঞ আইনজীবীর কাছে গেলে তিনি আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, আপনার কথার মধ্যে বাধা দেবেন কম। ফলে আইনজীবীর কাছে আপনি আপনার সমস্যা ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবেন। তিনি আপনাকে তুলনামূলকভাবে সময়সাশ্রয়ী এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ প্যাকেজের সমাধান দিতে পারবেন।
তাপমাত্রার পার্থক্যের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপার দেখা যায়। অধিক তাপমাত্রায় মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করে তরুণ আর অনভিজ্ঞ আইনজীবীর মতো, যেখানে কম তাপমাত্রায় মস্তিষ্ক কাজ করে তুলনামূলকভাবে অভিজ্ঞ আইনজীবীর মতো।
বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উপর আবহাওয়ার প্রভাব
কম তাপমাত্রায় মস্তিষ্কের অধিক কার্যকারিতার কারণ নিয়ে গত কয়েক দশকে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে, বাড়ছে এই জগতে মানুষের জানার পরিধি। এই ইস্যুতে গত দুই দশকে গবেষণা হয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও, গবেষণায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ সব কারণ।
প্রথমত, অধিক তাপমাত্রা মানুষের মানসিক ধকল বাড়িয়ে দেয়, প্রভাবিত করে কগনিটিভ ফাংশনকে। কগনিটিভ ফাংশন প্রভাবিত হওয়ার কারণে, অধিক তাপমাত্রায় মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কম থাকে, মনোযোগে ঘাটতি তৈরি হয়, কম তাপমাত্রার অঞ্চলের মস্তিষ্কের চেয়ে কম থাকে স্মৃতিশক্তি। ফলে তাপমাত্রা আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের মৌলিক জিনিসগুলোকে প্রভাবিত করে।
দ্বিতীয়ত, কম তাপমাত্রার পরিবেশে সাধারণত সূর্যের আলোর উপস্থিতি কম থাকে। মানুষের মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো কম তাপমাত্রায় মস্তিষ্কে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি হয়। ফলে কম আলোতে অধিক কার্যকর থাকে মস্তিষ্ক, মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ তৈরি হয় পরিস্থিতির নিরিখে। ফলে কম তাপমাত্রার অঞ্চলের মানুষের মস্তিষ্ক অধিক কার্যকারিতা দেখায় যেকোনো সমস্যার বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধানে।
তৃতীয়ত, যেকোনো কাজ করতে শরীরের অন্যান্য অংশের মতো মস্তিষ্কেরও শক্তির প্রয়োজন হয়। মস্তিষ্কের এই শক্তির যোগানের প্রাথমিক উৎস হচ্ছে গ্লুকোজ। পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তির সরবরাহ পেলে মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে কার্যকরভাবে ভাবতে পারে, বের করতে পারে ভালো সমাধান।
মানুষের শরীর অধিক তাপমাত্রায় থাকলে অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরকে শীতল করা হয়, আবার ঠান্ডায় থাকলে শরীরে চলে উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ওঠানামার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়াতেও শক্তির যোগানদাতা হিসেবে কাজ করে গ্লুকোজ। শরীরকে উষ্ণ করার চেয়ে তুলনামূলকভাবে শরীরকে শীতল করতে অধিক শক্তি খরচ হয়। ফলে অধিক তাপমাত্রার অঞ্চলে যে মানুষটি আছেন, তার শরীরে উৎপাদিত শক্তির একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য রাখতে। ফলে মস্তিষ্ক কম শক্তি পাচ্ছে কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য। কম তাপমাত্রার অঞ্চলে থাকা মানুষটির শরীরের তাপীয় ভারসাম্য রাখতে কম শক্তি খরচ হওয়ায়, মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে অধিক শক্তি পায়, মসৃণ হয় কগনিটিভ ফাংশন।
চতুর্থত, অধিক তাপমাত্রায় মানুষের শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যায়, বাড়ে মানসিক ও শারীরিক চাপ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন নিসঃরণের হার। পাশাপাশি, ডোপেমিনের নিঃসরণেও গোলযোগ দেখা দেয় অধিক তাপমাত্রায়, অনিয়মিত হয়ে পড়ে সেরোটোনিনের কার্যক্রমও। ফলে অধিক তাপমাত্রায় মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়, দ্রুত মেজাজ হারানোর প্রবণতা দেখা যায়, বাড়িয়ে দেয় মানসিক অসুস্থতার সম্ভাবনাও। এর পাশাপাশি, অধিক তাপমাত্রায় ক্রিয়াশীল মস্তিষ্কের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়, ফলে বেড়ে যায় যেকোনো সমস্যা সমাধানে সংঘাতময় পথ বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা।
আবহাওয়া ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সম্পর্ক পর্যালোচনায় কিছু গবেষণা
ইউনিভার্সিটি অব কালিফোর্নিয়ার একটি গবেষক দল গবেষণা করেছে, তাপমাত্রার তারতম্য আসলে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উপর প্রভাবিত করে কিনা তার উপর। গবেষণাতে তারা দেখেছেন, মরু অঞ্চলের মতো অধিক তাপমাত্রায় বেড়ে ওঠা শিশুরা শীতপ্রধান অঞ্চলের শিশুদের চেয়ে দেরিতে কথা বলতে শেখে, দেরিতে পূর্ণ বাক্য বলা শেখে। শীতপ্রধান অঞ্চলের শিশুরা দ্রুত এই দক্ষতাগুলো অর্জন করার পাশাপাশি গাণিতিক সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করতে শেখে, ভালো করে বানান মনে রাখার ক্ষেত্রেও।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তীতে আরেকটি গবেষণা চালায় বিভিন্ন অঞ্চলের স্কলারদের মধ্যে। সেই গবেষণায় গবেষকরা দেখেন, তুলনামূলকভাবে অধিক তাপমাত্রার অঞ্চলে বাস করা স্কলারদেরও কগনিটিভ ফাংশন প্রভাবিত হয় গরমের কারণে। ফলে কম তাপমাত্রার অঞ্চলে বসবাসকারী স্কলারদের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পিছিয়ে থাকেন তারা।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মার্টিন রেইচফ এক গবেষণা করেন আবহাওয়ার সাথে মানুষের অপরাধপ্রবণতার সম্পর্ক নিয়ে। গবেষণাকর্মটির একটি বড় অংশ আবর্তিত হয়েছে অধিক তাপমাত্রায় কীভাবে মানুষের মস্তিষ্ক ভিন্নভাবে কাজ করে তার উপর। মার্টিন দেখিয়েছেন, অধিক তাপমাত্রায় মানুষের কগনিটিভ ফাংশন প্রভাবিত হয়, তার অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়।
এই গবেষণাগুলোর বাইরেও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সাধারণ ইতিহাসের পর্যালোচনা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উপর আবহাওয়ার প্রভাবের প্রমাণ দিতে পারে। গত পাঁচশ বছর ধরে বৈশ্বিক নেতৃত্ব তুলনামূলকভাবে কম তাপমাত্রার দেশগুলোর হাতে রয়েছে, পৃথিবীর শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনগুলোও শুরু হয়েছে সেখান থেকেই। বর্তমানে উদ্ভাবনী কৌশলেও এগিয়ে আছে তুলনামূলকভাবে শীতপ্রধান দেশগুলো, পৃথিবীকে বদলে দেওয়া তত্ত্বগুলোর প্রকাশও হচ্ছে সেসব দেশ থেকেই। একই রকম প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও, উষ্ণ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটাদাগে পিছিয়ে রয়েছে র্যাংকিংয়ে।