কঠিন কোণ, সামান্য ফাঁকা জায়গা দিয়ে কিংবা দূরপাল্লার শটে গোল করা নামী খেলোয়াড়দের কাছে ডালভাতের ব্যাপারই। কিন্তু দশ গজ দূরত্ব থেকে ২৪ ফুটের গোলবারে বল জালে পাঠানো মাঝে মাঝে তাদের জন্যই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। হাজার হাজার দর্শক কিংবা একটি দেশের প্রত্যাশার চাপে ভেঙে পড়েন অনেক ফুটবলারই।
বলছিলাম ফুটবলের হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেওয়া স্পটকিকের কথা। স্পটকিকের একটি মূহুর্তই অনেক নায়ককে রুপান্তরিত করেছে খলনায়কে। চলুন দেখে আসা যাক ফুটবলের স্পটকিকের অন্যতম দশ ট্র্যাজিক হিরোদের।
আরিয়েন রোবেন
চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল
ঘরের মাঠ এলিয়েঞ্জ এরেনায় ৫ম চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার সুযোগ ছিলো বায়ার্নের। কিন্তু পেনাল্টি মিসে নিজ দর্শকদের সামনে ভিলেন বনে যান আরিয়েন রোবেন। নির্ধারিত সময়ে ১-১ থাকায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ৯৩ মিনিটে দ্রগবার করা ফাউলে পেনাল্টি পায় বায়ার্ন। কিন্তু রোবেনের দুর্বল পেনাল্টি শটটি ঠেকিয়ে দেন পিটার চেক। শেষপর্যন্ত টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে হারে বায়ার্ন মিউনিখ। চেলসি জিতে নেয় তাদের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। অবশ্য পরের সিজনেই নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেন রোবেন। তারই করা অন্তিম মূহুর্তের গোলে সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিলো বাভারিয়ানরা।
ডেভিড ত্রেজেগে
বিশ্বকাপ ফাইনাল
দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনাল গড়ায় পেনাল্টি শুট আউটে। প্রথমবার ব্রাজিল ইতালী পেনাল্টিতে শিরোপা খুইয়েছিলো ইতালী। তবে দ্বিতীয়বার আর কাঁদতে হয়নি এই ইউরোপিয়ান পরাশক্তিদের। টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে ৫-৪ হারিয়ে জিতে নেয় নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ। ফ্রান্সের হয়ে একমাত্র মিসটি করেন সেই সময়ের স্বনামধন্য স্ট্রাইকার ডেভিড ত্রেজেগে। ত্রেজেগের নেওয়া শটটি বুফনকে পরাস্ত করলেও ক্রসবারে লেগে গোললাইনের একটু সামনে ড্রপ খেয়ে ফিরে আসে। সেই সুযোগে ৫টি শটই গোলে রুপান্তর করে শিরোপা জিতে নেয় আজ্জুরিরা। ত্রেজেগের মিসে খালি হাতে ফিরে জিদানবাহিনী।
রাউল
ইউরো কোয়ার্টার ফাইনাল
ভালো টিম নিয়েও বড় মঞ্চে চাপ না সামলাতে পারার অপবাদ ছিলো স্পেনের। ২০০০ ইউরোতেও স্পেন টিম নিয়ে আশাবাদী ছিলেন অনেকেই। তবে এবারও চাপ সামলাতে পারেনি লা রোজারা। বলতে গেলে চাপ সামলাতে পারেননি স্পেনের পোস্টার বয় রাউল। কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের মুখোমুখি হয় তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। ম্যাচের শেষ মিনিটে পাওয়া পেনাল্টিতে গোল করতে পারলেই ম্যাচের স্কোরলাইন হতো ২-২। কিন্তু ৯০ মিনিটে নেওয়া রাউলের পেনাল্টি ফ্রান্স গোলকিপার ফাবিয়েন বার্থেজের মাথার অনেক উপর দিয়ে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত স্পেনের ইউরোযাত্রা থেমে যায় কোয়ার্টার ফাইনালেই। আর সেবারই ফ্রান্স জিতে নেয় তাদের দ্বিতীয় ইউরো শিরোপা।
জিকো
বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল
১৯৮৬ সালের ব্রাজিল টিমের বিশ্বকাপ না পাওয়া এখনো ফুটবলের বড় ট্র্যাজেডি। জিকো, সক্রেটিসদের সেই টিমকে এখনো ব্রাজিলের সেরা টিম হিসেবে মানেন অনেক ফুটবলবোদ্ধারা। তবে এই ব্যর্থতার দায়ভার অনেকাংশেই নিতে হবে সাদা পেলে খ্যাত জিকোকে। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় ফ্রান্স। প্রথমে ব্রাজিল এগিয়ে গেলেও প্লাতিনির গোলে সমতায় ফেরে ফ্রান্স। দ্বিতীয়ার্ধে এসে পেনাল্টি পায় ব্রাজিল। কিন্তু জিকোর নেওয়া দুর্বল স্পট কিকটি ফিরিয়ে দেন ফ্রান্স গোলকিপার জোয়েল ব্যাটস। আর কোনো গোল না হওয়ায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে জিকো তার শটটি গোলে পরিণত করলেও ৩-৪ গোলে হেরে বাদ পড়ে সেলেসাওরা।
এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো
বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল
রিকুয়েলমে, স্যাভিওলা, ক্রেসপো, মেসিরা ছিলেন ২০০৬ বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালেই সেইবার যাত্রা থেমে যায় লা আলবিসেলেস্তেদের। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় শেষে ১-১ স্কোরলাইনে খেলা শেষ হওয়ায় টাইব্রেকারে যেতে হয় দুই দলকে। আর্জেন্টিনার হয়ে দ্বিতীয় শটটি মিস করেন আয়ালা। সেজন্য চতুর্থ শটটি গোল করতেই হবে এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সেটি মিস করেন বসেন ক্যাম্বিয়াসো। কাগজের টুকরায় কোন খেলোয়াড় কোনদিকে শট নেওয়ার চান্স বেশি তা লিখে নিয়ে আসেন জার্মান গোলকিপার লেহম্যান। সেই অনুযায়ী ডাইভ দিয়ে সেভ করেন ক্যাম্বিয়াসোর শটটি। গুরুত্বপূর্ণ শটটি মিস করে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার।
আসামোয়াহ জিয়ান
বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল
২০১০ বিশ্বকাপে ঘানার অতিমানবীয় আর স্বপ্নের মত পারফরম্যান্সের মূল কারিগর ছিলেন আসামোয়াহ জিয়ান। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনাল শেষে তিনিই ট্র্যাজিক হিরোতে পরিণত হলেন। ৯০ মিনিট শেষে স্কোরলাইন ১-১ অতিরিক্ত ৩০ মিনিট যোগ হয়। খেলার ১২০ মিনিটে ঘানার নিশ্চিত গোল হাত দিয়ে আটকিয়ে দেন লুইস সুয়ারেজ। অন্তিম মূহুর্তে পেনাল্টি পায় ঘানা। গোলটি করতে পারলেই প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে যাওয়ার সুযোগ ছিলো ঘানার। কিন্তু দলের প্রাণভোমরা আসামোয়াহ জিয়ানের শটটি ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। ১২২ মিনিটে মিস করা পেনাল্টির কড়া মাশুল দিতে হয় ঘানাকে। টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হেরে বাদ পড়ে আফ্রিকান পরাশক্তিরা। অশ্রুসিক্ত চোখে মাঠ ছাড়েন আসামোয়াহ জিয়ান।
জন টেরি
চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল
মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ জায়ান্ট চেলসি ও ম্যানচেস্টার ইউনাউটেড। ১২০ মিনিট শেষে দুই দলই একটি করে গোল করায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে দ্বিতীয় শটটি মিস করে বসেন দলের তারকা খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তাই চারটি শট পরে স্কোর দাঁড়ায় ৪-৩। পঞ্চম শটটি গোল করলেই প্রথমবারের মতো চেলসির ঘরে শিরোপা যাবে। কিন্তু জন টেরির পিছলে যাওয়া শটটি সাইডবারে লেগে ফিরে আসে। শেষপর্যন্ত সাডেন ডেথে ৬-৫ গোলে ম্যাচ জিতে যায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। খলনায়ক বনে যান জন টেরি।
জুয়ান রিকুয়েলমে
চ্যাম্পিয়নস লীগ সেমিফাইনাল
২০০৫-০৬ সিজনে ভিলারিয়ালের অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের মূল নায়ক ছিলেন এই আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার। কিন্তু শেষ মিনিটের পেনাল্টি মিসে ঘরের মাঠে নিজ দর্শকের সামনে ভিলেন বনে যান তিনি। এমিরেটস স্টেডিয়ামে প্রথম লেগটি আর্সেনাল ১-০ গোলে জিতে নেয়। তাই দ্বিতীয় লেগে ন্যূনতম ব্যবধানে জিততেই হবে এমন সমীকরণে খেলতে নামে ভিলারিয়াল। স্কোরলাইন যখন ০-০ ঠিক সেই অন্তিম সময়ে পেনাল্টি পায় ভিলারিয়াল। ৯০ মিনিটে পাওয়া স্পটকিক থেকে গোল করতে পারলেই খেলা গড়াতো অতিরিক্ত সময়ে। কিন্তু রিকুয়েলমের নেওয়া পেনাল্টিটি বাম দিকে ঝাঁপিয়ে সেভ করেন আর্সেনাল গোলকিপার লেহম্যান। ভিলারিয়ালের স্বপ্নযাত্রা শেষ হয় সেমিফাইনালেই।
লিওনেল মেসি
কোপা আমেরিকা ফাইনাল
টানা দুটি ফাইনাল হারের পর এই ট্রফিটি খুব করে দরকার ছিলো আর্জেন্টিনার। বিশেষ করে লিওনেল মেসির। জাতীয় দলে ব্যর্থ অপবাদ ঝেড়ে ফেলার বদলে পরিণত হলেন ভিলেনে। ১২০ মিনিটে কোনো দলই গোল করতে না পারলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। চিলির হয়ে প্রথম শটটি মিস করেন ভিদাল। সেই সুবাদে মেসির সামনে সুযোগ আসে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেওয়ার। কিন্তু মেটলাইফ স্টেডিয়ামে বসা ৮৩ হাজার দর্শকের সামনে চাপে ভেঙে পড়ে পেনাল্টিটি মেরে বসেন ক্রসবারের উপর দিয়ে। পরে লুকাস বিলিয়ার মিসে ৪-২ গোলে হেরে টানা তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে হারার তিক্ত স্বাদ পেতে হয় লা আলবিসেলেস্তেদের। তার জন্য অনেকাংশে দায়ী দলনেতা মেসি। পেনাল্টি মিসের পর অভিমানে আকস্মিকভাবে জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণাও দিয়ে বসেন এই ক্ষুদে জাদুকর। যদিও পরে ভক্তদের ভালবাসায় আবার ফেরেন জাতীয় দলে।
রবার্তো ব্যাজ্জিও
বিশ্বকাপ ফাইনাল
তর্কাতীতভাবে এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় পেনাল্টি। পুরা টুর্নামেন্ট জুড়ে ইতালীর ত্রাণকর্তা ফাইনালের শেষ মূহুর্তে এসে পরিণত হলেন চক্ষুশূলে। ০-০ ড্র হওয়া ম্যাচটি যায় পেনাল্টিতে। প্রথমবারের মতো কোনো বিশ্বকাপ ফাইনালের ফলাফল নির্ভর করে টাইব্রেকারের উপর। ইতালীকে বাঁচাতে হলে শেষ শটটি যেকোনো মূল্যে জালে ঢুকাতে হতই এই তারকা স্ট্রাইকারকে। কিন্তু আসরের সিলভার বল জয়ী রবার্তো ব্যাজ্জিওর শটটি বারের উপর দিয়ে চলে যায়। ফলাফল ৩-২ গোলে হেরে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ইতালীকে। রোমারিওর ব্রাজিল জিতে নেয় চতুর্থ শিরোপা।