জোড়া শতক অর্থাৎ একই ম্যাচের দুই ইনিংসেই তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছানো টেস্ট ক্রিকেটে নেহাত অসাধারণ কোনো ঘটনা নয়। সেই যে ১৯০৯ সালে দ্য ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচের দুই ইনিংসে যথাক্রমে ১৩৬ ও ১৩০ রান করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ওয়ারেন বার্ডসলে, এরপর থেকে চলতি ২০২২ সালে উসমান খাওয়াজা আর ইমাম-উল-হকের ব্যাট থেকেও একই অর্জন, সব মিলিয়ে ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণটির ইতিহাসে এখন অবধি ৮৮ বার দেখা মিলেছে এমন দৃষ্টান্তের।
কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে জোড়া দ্বিশতক? কোনো ব্যাটসম্যানের নাম কি মনে পড়ছে এই মুহূর্তে, যার নামের পাশেও রয়েছে এমন অর্জনের স্মারকচিহ্ন? বাজি ধরে বলতে পারি, আপনার মনে পড়ছে না এমন একজনেরও নাম। কারণ, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেটে কোনো খেলোয়াড়ই তো এখন অবধি এমন কীর্তি গড়তে পারেননি। আর সেজন্যই ইংলিশ ক্রিকেটার আর্থার ফ্যাগ আজও সমান প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
কে এই ফ্যাগ? হয়তো তার নামটি আপনি আজই প্রথম শুনছেন, যদি না ক্রিকেট ইতিহাসের প্রতি আপনার মনে বিশেষ আগ্রহ থেকে থাকে। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে, দারুণ সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও ফ্যাগ ব্যর্থ হয়েছেন ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম খোদাই করে যেতে। আর যে কারণে তিনি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটিও খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত।
অল্প বয়সেই সাংঘাতিক বাতজ্বরে আক্রান্ত হন ফ্যাগ। তাই ১৯৩৬-৩৭ সালের অ্যাশেজ সিরিজের মাঝপথ থেকে ছিটকে তো যানই, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরের ক্রিকেটে তার অভিযাত্রারও পরিসমাপ্তি ঘটে মাত্র পাঁচ ম্যাচ পরে ই। সেই পাঁচ ম্যাচের আট ইনিংসে তিনি রান করতে পেরেছিলেন সর্বসাকুল্যে ১৫০, যেখানে সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৩৯।
তবে টেস্ট ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত না হলেও, ফ্যাগের প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেটের আয়ু ছিল বেশ লম্বা। ১৯৩২-৫৭ পর্যন্ত খেলেন তিনি; ৫৮টি শতক ও ১২৮টি অর্ধশতকসহ ৩৬.০৫ গড়ে মোট ২৭,২৯১ রান তোলেন। স্পিনের বিপক্ষে যেমন তেমন, দ্রুতগতির বোলিংয়ের বিপক্ষে তিনি ছিলেন ভীষণই উজ্জ্বল। ফিল্ডিংয়ে আবার খুব একটা ভালো ছিলেন না তিনি। অধিকাংশ কোচ ও অধিনায়কই তার জন্য নির্ধারিত রাখতেন স্লিপের কোনো একটি পজিশন। এদিকে উইকেটরক্ষক হিসেবেও মাঝেসাঝে তাকে কাজে লাগানো যেত, যখন কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকতেন নিয়মিত কিপাররা। সব মিলিয়ে তিনি সাতটি স্টাম্পিংয়ের পাশাপাশি ৪২৫টি ক্যাচ ধরেন গোটা ক্যারিয়ারে।
তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তের আগমন ঘটে ১৯৩৮ সালের ১৫ জুলাই, যখন ২৩ বছর বয়সী আর্থার ফ্যাগ প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এক ম্যাচেই টানা দুটি দ্বিশতক হাঁকিয়ে বসেন। অথচ বাতজ্বরের কারণে ১৯৩৭ সালের চ্যাম্পিয়নশিপের পুরোটাই মাঠের বাইরে বসে দেখতে হয়েছিল তাকে।
মধ্য-জুলাইয়ে ওই অবিশ্বাস্য রেকর্ড করার আগেও অবশ্য চলমান মৌসুমে ফ্যাগ দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন। কেন্টের হয়ে খেলতে নেমে উস্টারশায়ারের বিপক্ষে দুটি আলাদা ম্যাচে সেঞ্চুরি ছাড়াও সাউদাম্পটন ও ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষেও পেয়েছিলেন তিন অঙ্কের দেখা।
ফলে কোলচেস্টারে এসেক্সের বিপক্ষে খেলতে নেমে প্রথম দিনই লাঞ্চ বিরতির আগে শতক এবং পাঁচ ঘণ্টায় ২৪৪ রান করে ফেললেও খুব একটা অবাক হয়নি কেউ। ফ্যাগ যে ফর্মে ছিলেন, তাতে এমনটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সবাই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়, যখন ম্যাচের তৃতীয় দিনে, অর্থাৎ জুলাইয়ের ১৫ তারিখে, মাত্র ১৭০ মিনিটেই তিনি খেলে ফেলেন অপরাজিত ২০২ রানের আরেকটি ঝলমলে ইনিংস। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সারা দুনিয়ার ক্রিকেটপ্রেমীরা।
এমনকি, সুদূর কলকাতায় বসে ১৬ বছর বয়সী সত্যজিৎ রায়ও তার স্ক্র্যাপবইয়ে সেঁটে ফেলেন ফ্যাগের অনন্য কীর্তির খবরের পেপার কাটিং! ফ্যাগের ছবির নিচে তিন দফা শিরোনাম করে যাতে লেখা :
WORLD CRICKET RECORD
FAGG’S ACHIEVEMENT
TWO DOUBLE CENTURIES IN ONE MATCH
ঠিক কতটা অনন্য ও অসাধারণ ছিল ফ্যাগের অর্জন? ব্যাপারটি বুঝতে শুধু একটি তথ্যই যথেষ্ট: ফ্যাগের বিশ্বরেকর্ডের পর দীর্ঘ ৮০ বছর প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেটে আর কেউ করতে পারেনি এমন কীর্তির পুনরাবৃত্তি। অবশেষে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সেটি করেন শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো পেরেরা। কলম্বোর ননডেস্ক্রিপ্টস ক্রিকেট ক্লাবের অধিনায়ক হিসেবে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের বিপক্ষে ম্যাচে ২০১ ও ২৩১ রান করেন তিনি।
আবার ফিরে আসি ১৯৩৮ সালের সেই ম্যাচে। বৃষ্টির উপদ্রবে ম্যাচে কিন্তু কোনো দলই শেষ হাসি হাসতে পারেনি। বরং আক্ষেপে পুড়তে হয়েছে ফ্যাগদের। এসেক্স তো মাত্র ৮ রানেই দুই উইকেট খুইয়ে ফেলেছিল। জেতার জন্য তখনও তাদের প্রয়োজন ছিল ৩৮৫ রান।
এই ম্যাচে যেমন ফ্যাগ, কিংবা গোটা কেন্ট দল, তাদের আশানুরূপ ফলাফল পায়নি, পুরো মৌসুমটাই আসলে তাদের জন্য ছিল একই রকম। ব্যাটিং অর্ডারে ফ্যাগের মতো এমন একজন ফর্মের তুঙ্গে থাকা, জাত মারকুটে ব্যাটসম্যানের উপস্থিতি সত্ত্বেও পয়েন্ট টেবিলের নয়ে থেকে মৌসুম শেষ করে কেন্ট। এদিকে ফ্যাগ তার প্রতিপক্ষদের রানের বন্যায় ভাসান ঠিকই, এবং নয়টি সেঞ্চুরিতে ৫৪.৬৯ গড়ে ২,২৯৭ রানও করেন চ্যাম্পিয়নশিপে, তবু সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় প্রথম স্থানটি হাতছাড়া হয় তার। কেননা তার চেয়েও পাঁচ রান বেশি করেছিলেন জন ল্যাংরিজ। এছাড়া ফ্যাগের নয়টি শতকের বিপরীতে ওয়ালি হ্যামন্ডের শতকও ছিল ঢের বেশি, ১৩টি!
জুলাই মাসে যেমন ফ্যাগ বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন, তেমনই আরো দুটি কারণেও এই মাসটি তার জন্য ছিল চিরস্মরণীয়। ১৯৩৬ সালের এই মাসেই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টেস্টে আত্মপ্রকাশ ঘটে তার। এদিকে ১৯৩৯ সালের এই মাসেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিজের ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেন তিনি। উভয় ম্যাচেরই ভেন্যু ছিল ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড।
১৯৫৭ সালে খেলোয়াড়ি জীবনে ইতি টানলেও, ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় বলেননি ফ্যাগ। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে তিনি ১৮টি টেস্ট ও সাতটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেন। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সম্মানিত আম্পায়ারদের একজন হিসেবে বিবেচিত হন তিনি।
একজন টেস্ট আম্পায়ার হিসেবেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন ফ্যাগ। সেই সঙ্গে রসদ জুগিয়েছেন বিতর্কেরও। ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার এজবাস্টন টেস্ট চলাকালীন দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে তিনি হুমকি দেন, পরদিন আর মাঠে নামবেন না তিনি। কারণ? ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দলের কেউ কেউ তার একটি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। সেই ‘অসদাচরণ’ বরদাস্ত করেননি ফ্যাগ। এবং সত্যি সত্যিই, তৃতীয় দিন সকালের প্রথম ওভারটি কেটেছিল ফ্যাগের অনুপস্থিতিতেই। ওই ওভারে তার বদলি হিসেবে ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন ওয়ারউইকশায়ারের কোচ অ্যালান ওকম্যান। এরপর অনেক নাটকীয়তা শেষে নিজ দায়িত্বে ফেরেন ফ্যাগ। ওই ঘটনায় অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হলেও, ব্যাপক সহানুভূতি ও সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি।
তবে যতই শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন না কেন, শারীরিক অসুস্থতার কাছে ফের হার মানতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তড়িঘড়ি করে বিদায় জানিয়েছেন আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারকে। এরপর ১৯৭৭ সালে টানব্রিজ ওয়েলসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফ্যাগ।
মৃত্যুর আগে উইলো কাঠের ব্যাট দিয়ে, কালেভদ্রে কিপিং গ্লাভস হাতে, কিংবা তর্জনি উঁচিয়ে, ক্রিকেট ইতিহাসের নানা রং-বেরঙের অধ্যায়ই রচনা করে গেছেন তিনি। দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই যে, আজ আর চর্চিত হয় না সেসব অধ্যায়। মানুষের মনে তার স্মৃতি ক্রমশই হয়ে উঠছে বিরল, ঠিক যেমন বিরল তার কীর্তি।