রিয়াল নাকি বার্সা? ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা? মেসি নাকি রোনালদো? ফুটবল বলতে বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশের মস্তিস্কে এই নামগুলোই চলে আসে সর্বাগ্রে। সারা বছর রাত জেগে তারা উপভোগ করে বিভিন্ন বিদেশি লিগের রাইভালদের ম্যাচ। লিগ ম্যাচের সাথে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা আমেরিকা, ইউরো কাপের সাথে বিশ্বকাপ ফুটবল তো আছেই। বিদেশি এত ফুটবলের ভিড় ছাড়াও তরুণদের মাতিয়ে রাখার জন্য রয়েছে ফিফা ফুটবল গেম। প্রতি বছরই বের হচ্ছে এসব গেমসের বিভিন্ন ভার্সন। গেম বের হবার সাথে সাথেই তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ব্যাপক উত্তেজনা। তরুণেরা কি-বোর্ড কিংবা জয়স্টিক হাতে প্রোগ্রামারদের সার্থক করতে লেগে যাচ্ছে উঠেপড়ে। তাই বছরান্তেই এসব গেমসের নাড়ি-নক্ষত্র জানা হয়ে যায় গেমারদের।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এসব গেমসের কোথাও বাংলাদেশের কোনো নাম-গন্ধও দেখা যায় না। দেখা যাওয়ার অবশ্য কথাও না, কারণ বাংলাদেশের ফুটবল তার জৌলুস হারিয়েছে বহু আগেই। তাই মাঠের খেলা তো দূরে থাক, মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের জগতেও আর দেশের ফুটবলারদের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠা হয় না তাদের। আর এত উত্তেজনার মাঝে বাংলাদেশের খবর রাখার সময় কই? এভাবে ধীরে ধীরে তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে বাংলাদেশের ফুটবলের প্রতি আগ্রহের জায়গাটা একেবারেই মিইয়ে গেছে। অথচ এক কুড়ি কিংবা দেড় কুড়ি বছর আগেও বাংলাদেশে ফুটবল বলতে সবার আগে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতো মোহামেডান নাকি আবাহনী?
মোহামেডান-আবাহনী দ্বৈরথ
এখন যেমন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কিংবা রিয়াল-বার্সা খেলা হবার দু-চার দিন আগে থেকেই সমর্থকদের মধ্যে চলে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ, ঠিক তেমনটাই হতো তখন। পার্থক্য হলো, সেই হিসাব-নিকাশ চলতো দেশের ক্লাব ফুটবলের দুই মহারথী আবাহনী ও মোহামেডানকে নিয়ে। পাড়ার খেলার মাঠ থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত সর্বত্রই লেগে থাকতো তর্ক-বিতর্ক। কে সেরা কিংবা কে জিতবে সেই প্রশ্ন শেষ হতো না কখনোই। পাড়ায় দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে আয়োজন হতো ফুটবল খেলার। দুই দলের জার্সি গায়ে পাড়ার ছেলেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতো। সে খেলা দেখতে কখনো জমে যেত এলাকার হাজার দর্শক। আকাশি জার্সি গায়ে খেলতো আবাহনী আর মোহামেডানের জার্সি ছিল সাদা-কালো।
সাদা-কালো ও আকাশি জার্সি গায়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো অধিকাংশ খেলোয়াড় খেলতেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের নিয়মিত একাদশের হয়ে। যেমন- মোহামেডানে তখন খেলতেন কায়সার হামিদ, কানন, জুয়েল রানা, ওয়ালী সাব্বিরের মতো খেলোয়াড়রা। আবাহনীতে খেলতেন মোনেম মুন্না, আসলাম, এফ আই কামালের মতো খেলোয়াড়রা। এদের অনেকেই আবার খেলেছেন কলকাতার বিভিন্ন ক্লাবে। এছাড়াও পরবর্তীতে মতিউর মুন্না, আলফাজ, জয়, কাঞ্চন, ফরহাদের মতো দেশসেরা তারকারাও খেলেছেন এই ঐতিহ্যবাহী দুটি ক্লাবের হয়ে।
খেলার ধরনেও ছিল তখন আভিজাত্যের ছোঁয়া। বিভিন্ন বিদেশি কোচেরা দায়িত্ব নিতেন এসব ক্লাবের। মিরপুর স্টেডিয়াম তখন ছিল আবাহনী সমর্থকদের দখলে আর গুলিস্তান মোহামেডানের। নীল জার্সির আবাহনী খেলতো ছোট ছোট পাসে, অনেকটা বার্সেলোনার মতো। আর সাদা-কালোরা খেলতো ঠিক তার উল্টো খেলাটা। রিয়াল মাদ্রিদের মতো লং পাস করে পাওয়ার ফুটবলের সেরা ছিল তারা। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের সমৃদ্ধ খেলায় উত্তেজনা বিরাজ করতো খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আবাহনী-মোহামেডানের তখনকার খেলাকে তাই বাংলাদেশি এল-ক্লাসিকো বললে বোধহয় খুব বেশি ভুল হবে না!
বাংলাদেশি এল-ক্লাসিকোর জনপ্রিয়তা
খেলা শুরু হবার দুই/এক দিন আগে থেকে ঢাকার অনেক বাড়ির ছাদে আকাশি কিংবা সাদা কালোদের পতাকা উড়তে দেখা যেত, ঠিক যেমন আমরা এখন দেখি বিশ্বকাপের সময়। স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডান দর্শকদের বসার জায়গায়ও ছিল নির্ধারিত। একপাশে মোহামেডান এবং অন্য একপাশে আবাহনী। ভুল করেও কোনো মোহামেডান সমর্থক যদি আবাহনী শিবিরে কিংবা কোনো আবাহনী সমর্থক যদি মোহামেডান শিবিরে বসে পড়তো তাহলে তার আর সেদিনের খেলা উপভোগ করতে হতো না! বিপক্ষ দলের টিটকারি হজম করেই বাসায় ফিরে যেতে হতো!
খেলার দিন সকাল থেকেই টিকিটের লাইনে লেগে থাকতো উপচে পড়া ভিড়। মাঠে দর্শকের পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষ টিকিট না পেয়ে অবস্থান করতো স্টেডিয়াম চত্বরে। খেলা শুরু হবার তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে থেকেই দর্শকরা মাঠে আসতে শুরু করতেন। খেলা শুরু হবার প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা পূর্বেই সমগ্র স্টেডিয়াম ভরে যেত কানায়-কানায়। দেরি করে আসা অনেক দর্শককেই খেলা দেখতে হতো দাঁড়িয়ে। তবুও যেন মাঠে ঢুকতে পেরেই খুশি হতেন তারা। বিপুল পরিমাণ এই সমর্থক গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা মাঠের নিরাপত্তা কর্মীদের পক্ষে সহজ ছিল না। মাঠের বাইরেও পুলিশকে সর্বদা সজাগ থাকতে হতো, কেননা মাঠের উত্তাপ প্রায়শই ছড়িয়ে পড়তো মাঠের বাইরে। গুলিস্তান, বাইতুল মোকাররমসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এই খেলাকে কেন্দ্র করে ঘটতো সংঘর্ষের মতো ঘটনা। সংঘর্ষে আহতও হতেন অনেকে। এমনকি ১৯৮৭ সালে আবাহনী-মোহামেডানের খেলাকে ঘিরে সমর্থকদের সম্ভাব্য সংঘর্ষ ও রক্তপাতের আশঙ্কায় দর্শকশূন্য আর্মি স্টেডিয়ামে খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবার কল্পনা করুন, কতটা উত্তেজনা বিরাজমান থাকলে খেলার মাঠ ছাপিয়ে মাঠের বাইরে এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে!
ঢাকা লিগে বিশ্বকাপ মাতানো খেলোয়াড়
এই তো ক’দিন আগেই শেষ হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। সমগ্র বিশ্বের নজর তখন বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলারদের দিকে। সেসব ফুটবলারদের কেউ খেলবে বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগে, ভাবা যায়? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, তিন দশক আগেও সদ্য বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার খেলে গেছেন বাংলাদেশের ফুটবল লিগে।
১৯৮৬ সালে মেক্সিকো, প্যারাগুয়ে ও বেলজিয়ামের বিপক্ষে খেলা ইরাকের নিয়মিত ফুটবলার শামির সাকির ও করিম মোহাম্মদ ১৯৮৭ সালে খেলেন আবাহনীর জার্সি গায়ে। ১৯৭৮ সালে ইরানের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা নাসের হেজাজি খেলেন মোহামেডানের হয়ে। পরবর্তীতে তিনি মোহামেডানের কোচের দায়িত্বও পালন করে গেছেন। মোহামেডানের হয়ে খেলা আরেক বিদেশি ফুটবলার এমেকাকেও ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ মাতাতে দেখা যায় নাইজেরিয়ার জার্সি গায়ে। রূপকথার মতো শোনালেও এগুলোই বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালি অতীত।
আবাহনী-মোহামেডানের মিলন
ফুটবল-ক্রিকেট-হকি সব খেলাতেই যেখানে দুই দল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেখানে সন্ধির চিন্তা করা অলীক কল্পনা। তবে এমন দিনও ফুটবলে এসেছিল, যখন সত্যি-সত্যিই খেলার মাঠে সন্ধি হয়েছিল আবাহনী-মোহামেডানের।
১৯৮৭ সালে লিগ ফুটবলের শেষ ম্যাচ। মুখোমুখি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডান। শেষ ম্যাচে লিগ জিততে আবাহনীর প্রয়োজন ড্র, কিন্তু মোহামেডানের জয়ের কোনো বিকল্প নেই। জিতলে দু’দলের পয়েন্ট হবে সমান। ৬ সেপ্টেম্বর সেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় ৩-২ গোলে আবাহনীকে হারিয়ে দেয় সাদা-কালো জার্সিধারীরা। অবিশ্বাস্য জয়ে তখন দুই দলের পয়েন্ট হয় সমান, ফলে প্লে অফ খেলা হয় অনিবার্য।
৯ সেপ্টেম্বর সেই অঘোষিত ফাইনালের তারিখ ঠিক করা হয়। ততদিনে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি ঘরে ঘরে। খেলার দিন স্টেডিয়াম পাড়ায় হয় উপচে পড়া ভিড়। আবাহনী-মোহামেডানের লিগ নির্ধারণী খেলা বলে কথা। সেদিনের খেলার কথা স্মৃতিচারণ করে সেই ম্যাচে আবাহনীর অধিনায়ক শেখ মোহাম্মদ আসলাম বলেন,
“কী বলব, জীবনে অনেক আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলেছি। কিন্তু সেদিনকার মতো উত্তেজনা কখনোই দেখিনি। গ্যালারি কানায় কানায় ভরা। খেলার আগে মাঠে ঢোকার সময় বাইরেও হাজার হাজার দর্শক দেখেছি”।
তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ সেই খেলায় অধিকাংশ খেলোয়াড়ী তাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। বারবার তারা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ছিলেন। এমনকি খেলা থামিয়ে মাঠে পুলিশ ঢুকিয়ে সেসব হাতাহাতি থামাতে হয়েছিল রেফারিকে। শাস্তি হিসেবে দুই দলের দুজনকে লাল কার্ডও প্রদর্শন করেন তিনি। এভাবে নানা গণ্ডগোল পেরিয়ে নির্ধারিত ৯০ মিনিটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর খেলার ফলাফল হয় গোলশূন্য ড্র। খেলার নিয়ম অনুযায়ী অতিরিক্ত সময় এবং পরবর্তীতে টাইব্রেকারে খেলার নিষ্পত্তি করার কথা। এদিকে দু’দলের খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের মনোভাব তখনও ছিল বেশ উত্তেজিত। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে সে ম্যাচে মোহামেডানের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা রনজিত সাহা বলেন,
“ম্যাচটা যে দলই হারতো, সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াতো ভয়াবহভাবেই, আমরা বাজে কিছুর আশঙ্কা করছিলাম। এমনিতে মাঠে আমরা খুব ভালো আচরণ করিনি সেদিন। দর্শকেরাও উত্তেজিত ছিল। ওই ম্যাচে যে দলই হারতো, মাঠে গন্ডগোল হতো”।
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনার জন্ম দিলেন মোহামেডান ও আবাহনীর খেলোয়াড়রা। দু’দলের দুজন সদস্য দলের বড় পতাকা নিয়ে মাঠে ল্যাপ অব অনার দেয়া শুরু করেন, সাথে যোগ দেন বাকি সদস্যরাও। নিজেরাই নিজেদের দু’দলকেই জয়ী হিসেবে ঘোষণা দেন। গ্যালারি ভর্তি প্রায় অর্ধলাখ দর্শক অবিশ্বাস্যভাবে সেই সিদ্ধান্তে সায় দেন। আর এভাবেই আবাহনী-মোহামেডানের মিলনের মাধ্যমে একটি সম্ভাব্য রক্তপাত থেমে যায় নিমিষেই।
তবে বাফুফে ব্যাপারটি সহজভাবে নেয়নি। এবং সন্ধি করায় দু’দলের অধিনায়ককেও শাস্তির আওতায় আনা হয় এবং লিগের চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণের লক্ষে আবারও সেই ম্যাচের আয়োজন করা হয়। তবে সমর্থকদের সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়াতে আর্মি স্টেডিয়ামে খেলাটির আয়োজন করা হয় এবং দর্শকদের প্রবেশাধিকার থাকে নিষিদ্ধ। দর্শকবিহীন সেই ম্যাচে ২ – ০ গোলে জিতে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান।
আক্ষেপ
মাত্র ২৫ বছর আগে ১৯৯৩ সালে ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০, আর ভারতের অবস্থান ছিল ১২৯। জনপ্রিয়তার দিক থেকেও ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান, আবাহনী-মোহামেডান ছিল একই পর্যায়ের। তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। ৯৩-এর র্যাংকিং-এ ১১৭ নম্বরে থাকা ক্রেয়েশিয়া খেলেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল। ভারতও অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েছে, এগিয়ে নিয়ে গেছে দেশের ফুটবল। আর যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। যার ফলাফল, ২০১৮ সালের ফিফার সর্বশেষ তালিকাতে ভারতের অবস্থান ৯৬ তম আর বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৪!
বাংলাদেশের ফুটবল বর্তমানে এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সাউথ এশিয়ান গেমস কিংবা সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে আশা জাগানিয়া ফলাফল করলেও এগোতে পারছে না খুব বেশি দূর। আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রভাব পড়েছে ঘরোয়া ফুটবলের মাঝেও। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় আজও কলকাতা ডার্বির দিন স্টেডিয়াম চত্বরে সমর্থকেরা ভিড় করে, যেমন ঠিক যেমনটা করতো আশির দশকের আবাহনী-মোহামেডানের খেলাকে ঘিরে।
ফুটবল দর্শকদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের ফুটবলে আবারও সেই সুদিন ফিরে আসবে, মানুষের ঘরে ঘরে নতুন করে বেজে উঠবে সেই পুরনো গান, “জয় আবাহনী, জয় মোহামেডান”।
ফিচার ইমেজ – epicwallpaperz.com