আধুনিক ক্রিকেটের জনক এবং ক্রিকেটের ‘অমর বুড়ো’ ডব্লিউ জি গ্রেস একবার টস সম্পর্কে বলেছিলেন,
“When I win the toss on a good pitch, I bat. When I win the toss on a doubtful pitch, I think about it a bit and then I bat. When I win the toss on a very bad pitch, I think about it a bit longer and then I bat.”
টেস্ট ম্যাচে একই পিচে তিন ইনিংস খেলার পর চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করা কিছুটা কষ্টসাধ্য। ব্যবহৃত পিচে বোলাররা একটু বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। তাই চতুর্থ ইনিংসে অনেক কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানও স্বাভাবিক ব্যাটিং করতে পারেন না। তাই দলগুলোও রান তাড়া করতে নেমে সফলতার মুখ দেখে না।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহক শচীন টেন্ডুলকার স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসেও সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহ করেছেন। তিনি ৬০ ইনিংস ব্যাট করে ৩৬.৯৩ ব্যাটিং গড়ে ১,৬২৫ রান সংগ্রহ করেছেন। তার টেস্ট ক্যারিয়ারে ব্যাটিং গড় যেখানে ৫৩.৭৮, সেখানে চতুর্থ ইনিংসে গড় ৩৬.৯৩। তার ৫১টি টেস্ট শতকের মধ্যে মাত্র চারটি এসেছে চতুর্থ ইনিংসে। চতুর্থ ইনিংসে শচীনসহ মোট ২৮ জন ব্যাটসম্যান সহস্রাধিক রান সংগ্রহ করেছেন। তার মধ্যে মাত্র ছ’জনের ব্যাটিং গড় ৫০-এর বেশি। আজকের লেখা চতুর্থ ইনিংসে ধারাবাহিকভাবে রান করা এই ছয়জন ব্যাটসম্যানকে দিয়ে সাজানো হয়েছে।
১. গ্রায়েম স্মিথ (দক্ষিণ আফ্রিকা)
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে একমাত্র অধিনায়ক হিসাবে দলকে শতাধিক ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি একমাত্র অধিনায়ক হিসাবে অর্ধশতাধিক জয় এনে দেওয়া গ্রায়েম স্মিথের ব্যাটিংয়ের বিশেষ দিক ছিল, তিনি চতুর্থ ইনিংসে তুলনামূলক ভালো খেলতেন। তিনি টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ৪১ বার ব্যাট করতে নেমে চারটি শতক এবং নয়টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫১.৯৬ ব্যাটিং গড়ে ১,৬১১ রান সংগ্রহ করেছেন। এই বাঁহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের টেস্ট ক্যারিয়ারের ব্যাটিং গড় ৪৮.২৫। সেখানে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং গড় ৫২ ছুঁই ছুঁই।
গ্রায়েম স্মিথ চতুর্থ ইনিংসে রানের দিক থেকে শচীনের চেয়ে মাত্র ১৪ রান পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় সর্বাধিক রান সংগ্রহ করেছেন। শতকের তালিকাতেও তার উপরে আছেন শুধুমাত্র পাকিস্তানের ইউনিস খান। চতুর্থ ইনিংসে গ্রায়েম স্মিথ প্রথম শতক হাঁকান ২০০৪ সালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে। স্বাগতিকদের বিপক্ষে ২৩৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৩৬ রানে টপ-অর্ডারের তিন উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর গ্যারি কারস্টেনের সহায়তায় দলকে ছয় উইকেটের জয় এনে দিয়েছিলেন স্মিথ। তিনি ২০৩ বলে ১৭টি চারের মারে ১২৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।
গ্রায়েম স্মিথ চতুর্থ ইনিংসে সেরা ইনিংস খেলেন ২০০৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। বার্মিংহামে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকাকে জয়ের জন্য ২৮১ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় ইংল্যান্ড। জবাবে ব্যাট করতে নেমে হাশিম আমলা, জ্যাক ক্যালিস এবং অ্যাশওয়েল প্রিন্স এক অংকের রান করে ফিরে গেলেও একপ্রান্ত আগলে রেখে দলকে পাঁচ উইকেটের জয় এনে দেন স্মিথ। তিনি প্রয়োজনীয় ২৮১ রানের মধ্যে একাই করেন ১৫৪ রান। তার ২৪৬ বলে অপরাজিত ১৫৪ রানের ইনিংসে ছিল ১৭টি চারের মার।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে শতক হাঁকানোর পর পরেরবার চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে আবারও শতক হাঁকান স্মিথ। পার্থে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া পাহাড়সম ৪১৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে তার ১৪৭ বলে ১০৮ রানের ইনিংসে জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা। পরে ডি ভিলিয়ার্সের অপরাজিত ১০৬ রানের উপর ভর করে ছয় উইকেটের জয় পায় তারা। গ্রায়েম স্মিথ চতুর্থ ইনিংসে সর্বশেষ শতক হাঁকান কেপটাউনের নাটকীয়তায় ভরপুর টেস্ট ম্যাচে। ২০১১ সালের ঐ ম্যাচে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৯৬ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পরেও আট উইকেটের জয় পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। নিজেরা ৯৬ রানে অল আউট হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ৪৭ রানে অল আউট করে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। জবাবে গ্রায়েম স্মিথের অপরাজিত ১০১ রান এবং হাশিম আমলার ১১২ রানের ইনিংসের উপর ভর করে আট উইকেটের জয় তুলে নেয়।
২. ইউনিস খান (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের তারকা ব্যাটসম্যান ইউনিস খান ১১৮ টেস্টে ৩৪টি শতক এবং ৩৩টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫২.০৫ ব্যাটিং গড়ে ১০,০৯৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তার ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল অর্ধশতককে শতকে রূপান্তর করা এবং চতুর্থ ইনিংসে রান করা। তিনি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি শতক হাঁকিয়েছেন। ইউনিস খান চতুর্থ ইনিংসে ৪০ বার ব্যাটিং করে ৫০.৫১ ব্যাটিং গড়ে ১,৪৬৫ রান সংগ্রহ করেছেন। শতক হাঁকিয়েছেন পাঁচটি এবং অর্ধশতক ছয়টি।
ইউনিস খান ২০০৭ সালে টানা তিনবার চতুর্থ ইনিংসে শতক হাঁকিয়ে দলকে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে ম্যাচ ড্র করতে সহায়তা করেছেন। এরপর ২০১০ সালেও দক্ষিণ আফ্রিকার ৪৫১ রানের জবাবে ব্যাট করতে নামা পাকিস্তানের পক্ষে ২৩০ বলে অপরাজিত ১৩১ রানের ইনিংস খেলে দলকে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচান। তিনি চতুর্থ ইনিংসে নিজেরা সেরা ইনিংস খেলেন ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার দেওয়া ৩৭৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৩ রানে দুই উইকেট হারায় পাকিস্তান। এরপর ইউনিস খান ব্যাট করতে নেমে শান মাসুদকে সাথে নিয়ে তৃতীয় উইকেটে ২৪২ রান যোগ করেন। মাসুদ ১২৫ রানে ফিরে গেলেও ২৭১ বলে ১৮টি চারের মারে অপরাজিত ১৭১ রানের ইনিংস খেলে দলকে সাত উইকেটের জয় এনে দেন তিনি।
৩. রিকি পন্টিং (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়া সর্বকালের সেরা রান সংগ্রাহক রিকি পন্টিং ১৬৮ ম্যাচে ৫১.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ১৩,৩৭৮ রান সংগ্রহ করেছেন। ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসেও তার ব্যাট সমানভাবে কথা বলত। তিনি ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ৪৩ বার ব্যাট করে ৫০.৪১ ব্যাটিং গড়ে ১,৪৬২ রান সংগ্রহ করেছেন। শতক হাঁকিয়েছেন চারটি এবং অর্ধশতক ছয়টি। এই অজি কিংবদন্তি চতুর্থ ইনিংসে সর্বপ্রথম শতক হাঁকান ২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কেপটাউনে। দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া ৩৩১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১৬০ বলে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস খেলেন। তার শতকের উপর ভর করেই চার উইকেটের জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
পন্টিং চতুর্থ ইনিংসে ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেছিলেন ২০০৫ সালের ঐতিহাসিক অ্যাশেজে। ম্যানচেস্টারে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের দেওয়া ৪২৩ রানে জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামে অস্ট্রেলিয়া। জয়ের জন্য কমপক্ষে ১০৮ ওভার হাতে ছিল তাদের কাছে। শেষদিনে পুরো দশ উইকেট হাতে থাকা অস্ট্রেলিয়া ড্রয়ের জন্য না খেলে ওভারপ্রতি চার রান তাড়া করে জয়ের জন্য খেলে। যার ফলে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে তারা। একপ্রান্ত আগলে রেখে নিজের শতক তুলে নেওয়া রিকি পন্টিং দলের নবম ব্যাটসম্যান হিসাবে আউট হওয়ার আগে ২৭৫ বলে ১৫৬ রান করেছিলেন। তার বিদায়ের পর ম্যাচ ড্র করতে ব্রেট লি এবং গ্লেন ম্যাকগ্রাকে খেলতে হতো আরও চার ওভার। তারা দুইজন ঐ চার ওভার ব্যাট করে দলকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।
পন্টিং ২০০৬ সালে চতুর্থ ইনিংসে দু’টি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন। প্রথমটি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিডনিতে, দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের বিপক্ষে ফতুল্লাতে। সিডনিতে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের দুই ইনিংসেই ডিক্লেয়ার করার পরও পন্টিংয়ের দুর্দান্ত ইনিংসের সামনে পরাজয়ের স্বাদ পায়। ম্যাচের শেষ দুই সেশনে অস্ট্রেলিয়াকে ২৮৭ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়ে ইনিংস ঘোষণা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া লক্ষ্যে শুরু থেকেই জয়ের জন্য ব্যাট করতে থাকে অস্ট্রেলিয়া। মাত্র ৬০.৩ ওভারে আট উইকেট হাতে রেখে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে যায় তারা। জয়ের মূল কারিগর পন্টিং ১৫৯ বলে ১৬টি চারের মারে ১৪৩ রান করেছিলেন। একই বছর ফতুল্লাতে বাংলাদেশের বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের দেওয়া ৩০৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অপরাজিত ১১৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
৪. সুনীল গাভাস্কার (ভারত)
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে দশ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার। তিনি ১২৫ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৫১.১২ ব্যাটিং গড়ে ১০,১২২ রান করেছিলেন। শতক হাঁকিয়েছিলেন ৩৪টি, এবং অর্ধশতক ৪৫টি। তিনি ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে অসাধারণ ব্যাট করতেন, যার ফলশ্রুতিতে ‘৭০ ও ‘৮০-এর দশকে ভারত বহু ম্যাচে শেষ হাসি হাসতে পেরেছিল। তার ক্যারিয়ারের ব্যাটিং গড় যেখানে ৫১.১২, সেখানে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং গড় ৫৮.২৫। চতুর্থ ইনিংসে ৩৩ বার ব্যাট করে চারটি শতক ও আটটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১,৩৯৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম বছরেই তিনি তার প্রতিভার জানান দেন। বারবাডোসে ১৯৭১ সালে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া ৩৩৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামে ভারত। জয়ের পিছে না ছুটে তারা ড্রয়ের চিন্তায় ব্যাট করেন। দলের হয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে ৩১৫ মিনিট ব্যাট করে অপরাজিত ১১৭ রানের ইনিংস খেলেন গাভাস্কার, যার ফলে ভারত ১০৩ ওভার ব্যাট করে ম্যাচ ড্র করতে সক্ষম হয়।
এরপরের শতক হাঁকান ১৯৭৬ সালে। এইবার আর ড্রয়ের জন্য খেলেনি ভারত। পর্যাপ্ত সময় পেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া ৪০৩ রানের লক্ষ্য টপকে যায় ছয় উইকেট হাতে রেখেই। দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০২ রান করেছিলেন গাভাস্কার।
টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে মোট পাঁচজন ব্যাটসম্যান দ্বিশতক হাঁকিয়েছেন। তার মধ্যে একজন সুনীল গাভাস্কার। তিনি ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কেনিংটন ওভালে এই মহাকাব্যিক ইনিংস রচনা করেছিলেন। ইংল্যান্ডের দেওয়া ৪৩৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ভারতকে জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন তিনি। উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে চেতন চৌহানের সাথে ২১৩ রান যোগ করাত পর দিলীপ ভেঙ্সরকারের সাথে যোগ করেন ১৫৩ রান। এক উইকেটে ৩৬৬ রান করা ভারতের সামনে তখন রেকর্ড জয় হাতছানি দিচ্ছিল। কিন্তু ২২১ রান করে গাভাস্কার ফিরে গেলে আর জয়ের দেখা পায়নি ভারত। আট উইকেটে ৪২৯ রান করার পর নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যায়। গাভাস্কারের ২২১ রানের ইনিংসটি এখনও চতুর্থ ইনিংসে তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস।
৫. স্যার গর্ডন গ্রিনিজ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
সম্প্রতি ‘নাইটেড’ হয়ে স্যার উপাধিতে ভূষিত হওয়া গর্ডন গ্রিনিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের অপরাজেয় দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। এই কিংবদন্তি ওপেনার ১০৮ টেস্ট ম্যাচ খেলে ৪৪.৭২ ব্যাটিং গড়ে ৭,৫৫৮ রান সংগ্রহ করেছেন। শতক হাঁকিয়েছেন ১৯টি এবং অর্ধশতক ৩৪টি। ম্যাচের তিন ইনিংস শেষ হওয়ার পর চতুর্থ ইনিংসে দুর্দান্ত সব ইনিংস খেলে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। তিনি চতুর্থ ইনিংসে ৩৮ বার ব্যাট করে ৫৩.১৯ ব্যাটিং গড়ে ১,৩৮৩ রান সংগ্রহ করেছেন। একটি দ্বিশতকসহ তিনটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন।
লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৮৪ সালে তার খেলা অপরাজিত ২১৪ রানের ইনিংসটি চতুর্থ ইনিংসের অন্যতম সেরা নৈপুণ্য হিসাবে রেকর্ডের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৪১ রানের লিড নেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে নয় উইকেটে ৩০০ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। এতে করে জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩৪২ রানের, যা গ্রিনিজের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে সহজেই টপকে যায় উইন্ডিজ। মাত্র ৬৬.১ ওভারে এক উইকেট হারিয়ে ৩৪৪ রান করে নয় উইকেটের জয় পেয়েছিল তারা। গ্রিনিজ মাত্র ২৪২ বলে ২৯টি চার এবং দুটি ছয়ের মারে অপরাজিত ২১৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।
জয়ের তাগিদে যেমন বিধ্বংসী ব্যাটিং করতে পারেন, তেমনি ম্যাচ বাঁচানোর সময় নিজেকে খোলসে বন্দীও করতে পারেন তিনি। এমনটাই করে দেখিয়েছিলেন অ্যাডিলেইডে, ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ম্যাচের শেষদিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জয়ের জন্য ৩৭১ রানের টার্গেট দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এই লক্ষ্যের পিছে না ছুটে ড্রয়ের দিকে মনোযোগী হয়ে ২৪৯ বলে ১০৪ রানের ইনিংস খেলেন গ্রিনিজ; যার ফলে শেষ দিনে ৮১ ওভারে চার উইকেটে ২৩৩ রান করে ম্যাচ ড্র করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
৬. জিওফ বয়কট (ইংল্যান্ড)
টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে কমপক্ষে এক হাজার রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় জিওফ বয়কটের। ইংল্যান্ডের এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান চতুর্থ ইনিংসে ৩৪ বার ব্যাট করে তিনটি শতক এবং সাতটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৮.৭৬ ব্যাটিং গড়ে ১,২৩৪ রান সংগ্রহ করেছেন। এই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ইংল্যান্ডের হয়ে ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ১০৮ ম্যাচ খেলে ৪৭.৭২ ব্যাটিং গড়ে ৮,১১৪ রান সংগ্রহ করেছেন। শতক হাঁকিয়েছেন ২২টি এবং অর্ধশতক ৪২টি।
তার খেলা ১০৮ ম্যাচের মধ্যে ইংল্যান্ড মাত্র ২০ ম্যাচে পরাজিত হয়েছে। সেসময় ইংল্যান্ডের সাফল্যের অনেকটা নির্ভর করতো তার উপর। তিনি যতক্ষণ ক্রিজে থাকতেন, ততক্ষণ ম্যাচে টিকে থাকত ইংল্যান্ড। তার খেলা যে ২০ ম্যাচে ইংল্যান্ড পরাজিত হয়েছিল, একটিতেও শতক হাঁকাতে পারেননি তিনি। ২২টি শতকের মধ্যে দলের জয়ে দশটি এবং ড্র হওয়া ম্যাচে ১২টি হাঁকিয়েছেন। তার চতুর্থ ইনিংসের তিনটি শতক ছিল ম্যাচ বাঁচানো শতক।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লর্ডসে ১৯৬৯ সালে চতুর্থ ইনিংসে প্রথম শতক হাঁকান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া ৩৩২ রানের জবাবে তিনি ২৭৭ বলে ১০৬ রান করলে ইংল্যান্ড ম্যাচ ড্র করতে সক্ষম হয়। তিনি শেষদিকে আউট না হলে হয়তো জয়ও পেয়ে যেত তারা। এরপর ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের হায়দরাবাদে ৩৪৪ রানের লক্ষ্যে শেষদিনে ম্যাচ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ব্যাট করতে নেমে ৩০৩ বলে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস খেলেন। দুই বছর পর ১৯৮০ সালে লর্ডসে এইবার জয় থেকে বঞ্চিত করেছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে। অস্ট্রেলিয়া চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য ইংল্যান্ডকে ৩৭০ রানের টার্গেট দেয়। একদিনের কম সময়ে ৩৭০ রান তোলার পিছে না ছুটে জিওফ বয়কট ম্যাচ ড্র করার লক্ষ্যে ব্যাট করে ২৫২ বলে ১২৮ রানের ইনিংস খেলেন, যাতে করে ৮২ ওভারে তিন উইকেটে ২৪৪ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড।
চতুর্থ ইনিংসে রান তোলা কতটা কঠিন, তা বর্তমানের সেরা ব্যাটসম্যানগুলোর ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায়। কেন উইলিয়ামসন ছাড়া আর কোনো তারকা ব্যাটসম্যানই চতুর্থ ইনিংসে ততটা সফলতা পাননি। বিরাট কোহলি ধীরে ধীরে সফলতা পাওয়া শুরু করলেও স্টিভ স্মিথের চতুর্থ ইনিংসের পারফরম্যান্স হতাশাজনক। ৭৩ টেস্টে ৬২.৮৪ গড়ে রান করা এই ব্যাটসম্যান চতুর্থ ইনিংসে ২১ ইনিংসে রান করেছেন মাত্র ৩০.৬৮ গড়ে। জো রুট ২৭ ইনিংসে করেছেন ৩৪.৯৫ গড়ে। স্মিথ, রুট কেউই এখনও চতুর্থ ইনিংসে শতক হাঁকাতে পারেননি।