ফুটবল বিশ্বকাপে বেশ কিছু ব্যক্তিগত পুরস্কার প্রদানের প্রচলন থাকলেও সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হচ্ছে পুরো আসরে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। ১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে ফিফা অ্যাডিডাসের সৌজন্যে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কে গোল্ডেন বল দেওয়া শুরু করলেও এর আগে অনুষ্ঠিত প্রতিটি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের নামও গোল্ডেন বল জয়ীদের তালিকায় রয়েছে। একজন খেলোয়াড়ের জীবনে অন্যতম বড় অর্জন বিশ্বমঞ্চে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতা। আজ আমরা বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরের সেরা খেলোয়াড়দের ব্যাপারেই জানবো।
১৯৩০ বিশ্বকাপ: প্রথম আসরেই এক ডিফেন্ডারের বাজিমাত
ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় উরুগুয়েতে আর ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় সেই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক উরুগুয়েই। উরুগুয়ের এই সাফল্যে বড় অবদান ছিল তাদের অধিনায়ক জোসে নাসাজ্জি ইয়ারজার। তিনি ছিলেন সেই উরুগুয়ে দলের সেরা ডিফেন্ডার। তার নেতৃত্বেই পুরো আসরে উরুগুয়ের ডিফেন্স মাত্র তিনটি গোল হজম করেছিলো। এ কারণেই একজন ডিফেন্ডার হওয়া সত্ত্বেও সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা তিনিই পান। অনেকের মতেই উরুগুয়ের ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হচ্ছেন নাসাজ্জি।
১৯৩৪ বিশ্বকাপ: মেয়াজ্জার নৈপুণ্যে ইতালির বিশ্বজয়
ইতালিতে অনুষ্ঠেয় ১৯৩৪ বিশ্বকাপটি ছিল নকআউট ফরম্যাটের। প্রথম আসরের মতো এই আসরের শিরোপাও যায় স্বাগতিক দলের কাছেই। আর ইতালির এই সাফল্যে বড় অবদান ছিল ফরোয়ার্ড মেয়াজ্জার। পুরো আসরে তিনি মাত্র দুই গোল করলেও ইতালির উপর তার প্রভাব ছিল অনেক বেশি। কোয়ার্টার ফাইনালে তার করা একমাত্র গোলেই স্পেনকে হারিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয় ইতালির।
সেমিফাইনালেও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ভালো খেলা উপহার দেন মেয়াজ্জা। অস্ট্রিয়ার এক ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে তিনি ডিবক্সে ঢুকে গেলে তাকে ঠেকাতে এগিয়ে আসেন অস্ট্রিয়ার গোলরক্ষক পিটার। মেয়াজ্জার শট পিটার ঠেকালেও তা চলে যায় ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা গুয়াইতার কাছে। ঐ এক গোলেই ফাইনাল নিশ্চিত হয় ইতালির।
ফাইনালেও দলের জয়ে অবদান রাখেন মেয়াজ্জা। চেকোস্লোভাকিয়ার সাথে নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে স্কোরলাইন ১-১ থাকলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেই ম্যাচে হালকা ব্যথা পাওয়ায় চেকোস্লোভাকিয়ার ডিফেন্ডাররা মেয়াজ্জাকে তেমন কড়া মার্কিংয়ে রাখেননি। এই সুযোগে তিনি ভালো একটি গোলের সুযোগ তৈরি করেন। তার তৈরি করা সুযোগেই ইতালি পেয়ে যায় জয়সূচক গোল। ইতালির বিশ্বজয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে জ্বলে ওঠায় টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা মেয়াজ্জাই জিতে নেন।
১৯৩৮ বিশ্বকাপ: লিওনিদাসের অদ্ভুতুড়ে এক বিশ্বকাপ
ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড লিওনিদাসের জন্য ১৯৩৮ বিশ্বকাপটি আসলেই বেশ অদ্ভুতুড়ে ছিল। আগের আসরের মতো এই আসরটিও ছিল নকআউট ফরম্যাটের। আগের দুই আসরে ব্যর্থ হলেও এই আসরে ব্রাজিল বেশ ভালোই খেলছিলো। রাউন্ড অফ সিক্সটিনের নাটকীয় এক ম্যাচে পোল্যান্ডকে ৬-৫ গোলে হারায় ব্রাজিল। এ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দলের জয়ে বড় অবদান রাখেন লিওনিদাস। কোয়ার্টার ফাইনালে তার করা দুই গোলেই চেকোস্লোভাকিয়াকে হারিয়ে ব্রাজিল পায় সেমিফাইনালের টিকিট।
কিন্তু সেমিফাইনালে ব্রাজিল কোচ পিমেন্তা আদেমার করলেন অদ্ভুত এক পাগলামি। ফাইনালের কথা ভেবে তিনি তার দলের সেরা খেলোয়াড় লিওনিদাসকে সেমিফাইনালে বিশ্রামে রেখে দিলেন! তার এই ভুলের চড়া মাশুল দিতে হলো ব্রাজিলকে। ইতালির কাছে ২-১ গোলে হেরে বিদায় নেয় সেলেসাওরা। পরে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে জোড়া গোল করে লিওনিদাস প্রমাণ করেন, তাকে বসিয়ে রাখাটাই ছিল সেমিফাইনালে ব্রাজিলের হারার সবচেয়ে বড় কারণ। অবশ্য সাত গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার সাথে সেই আসরের সেরা খেলোয়াড়ও লিওনিদাসই হয়েছিলেন।
১৯৫০ বিশ্বকাপ: জিজিনহোর বিষাদময় কাব্য
১৯৫০ সালে ঘরের মাঠে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ ঘরে তোলার অভিযানে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলো ব্রাজিল। আর তাদের এই অভিযানে বড় অবদান ছিল মিডফিল্ডার জিজিনহোর। দলের মিডফিল্ড সামলানোর সাথে সেই আসরে দুটি গোলও করেছিলেন তিনি।
সেই আসরে ফাইনাল ম্যাচের নিয়ম ছিল না। সুপার ফোর সিস্টেমে যে দলের পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি থাকবে তারাই জয়ী হবে এটাই ছিল নিয়ম। সুপার ফোরের শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ড্র করলেই শিরোপা জিততো ব্রাজিল। কিন্তু মারাকানায় উরুগুয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ঘরের মাঠে প্রায় দুই লাখ দর্শকের সামনে ২-১ গোলে হেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পুরো ব্রাজিল। তবে পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ খেলায় সেই আসরের সেরা খেলোয়াড় জিজিনহোই হয়েছিলেন। কিন্তু সেরা খেলোয়াড় হওয়ার অর্জন বিষাদে ভরে গিয়েছিলো মারাকানাজোর ভারী আর্তনাদে।
১৯৫৪ বিশ্বকাপ: পুসকাসের আক্ষেপনামা
সর্বকালের অন্যতম সেরা দল নিয়ে ১৯৫৪ বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলো হাঙ্গেরি। সেই দলে হিডেগকুটি, ককেসিসের মতো তারকারা থাকলেও দলের মধ্যমণি ছিলেন ফেরেঙ্ক পুসকাস।
সেই বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির শুরুটাও বেশ ভালোভাবে হয়েছিলো। দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ গোলে হারানোর ম্যাচে পুসকাস জোড়া গোল করেন। পরের ম্যাচে পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে উড়িয়ে দিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে যায় হাঙ্গেরি। এ ম্যাচেও পুসকাস এক গোল করেন, কিন্তু জার্মান ডিফেন্ডার ওয়ের্নার লিয়েব্রিখের করা ফাউলে আহত হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনাল মিস করেন পুসকাস। তবে পুসকাসকে ছাড়াই ফাইনালে পৌঁছে যায় হাঙ্গেরি, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ আবারো সেই পশ্চিম জার্মানি।
পুরোপুরি ফিট না হলেও এই ম্যাচে শুরু থেকেই খেলেন হাঙ্গেরি অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাস। ম্যাচ শুরুর আট মিনিটের মাঝে পুসকাস ও জিবরের গোলে ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও একপর্যায়ে ৩-২ গোলে পিছিয়ে পড়ে হাঙ্গেরি। সেদিন পুসকাস হাঙ্গেরির হয়ে তৃতীয় গোল করলেও রেফারির ভুল সিদ্ধান্তে তা বাতিল হয়ে যায়। এই একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হাঙ্গেরির বিশ্বজয়ের স্বপ্নকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। টানা ৩১ ম্যাচ হারার পর হাঙ্গেরি হেরে বসে তাদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটিতেই! দল হারলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় পুসকাসই হয়েছিলেন, কিন্তু রেফারির ওই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে পুসকাসের আক্ষেপ সেই পুরস্কার দিয়ে কিছুতেই ঘোচানো যায়নি।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ: দিদির নৈপুণ্যে ব্রাজিলের বিশ্বজয়
মারাকানাজোর পর ব্রাজিলের ফুটবলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিলো। সেই পরিবর্তনের পর ১৯৫৪ বিশ্বকাপে সাফল্য না পেলেও ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ঠিকই সফল হয় ব্রাজিল। আর ব্রাজিলের এই সাফল্যের নেপথ্য কারিগর ছিলেন দিদি। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের পুরোটা সময় ব্রাজিলের মিডফিল্ড ভালোভাবে সামলেছিলেন এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণের সাথে দিদির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ডিফেন্স ও অ্যাটাকিং লাইনে সমন্বয় আনা। মিডফিল্ড সামলানোর সাথে সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ৩০ গজ দূর থেকে অসাধারণ একটি গোলও করেছিলেন তিনি। ব্রাজিলের প্রথমবারের মতোন বিশ্বজয়ে দিদির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এজন্যই ফিফা সেই আসরের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে দিদির নাম ঘোষণা করে।
১৯৬২ বিশ্বকাপ: গারিঞ্চার বাঁকা পায়ের জাদু
১৯৫৮ বিশ্বকাপে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই পেলের অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের পর সবার প্রত্যাশা ছিল ১৯৬২ বিশ্বকাপে পরিণত পেলে আরো দুরন্ত পারফর্মেন্স উপহার দিবেন। কিন্তু হায়! চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ইনজুরিতে পড়ে পেলের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায়। তখন মনে হচ্ছিলো, ব্রাজিলের টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বজয় বুঝি আর হচ্ছে ন। কিন্তু তখনই নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন দলের আরেক তারকা গারিঞ্চা। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে স্পেনের বিপক্ষে ব্রাজিলের ম্যাচটি যখন ১-১ সমতায় এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখন রাইট উইং দিয়ে দুজন ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে বল বাড়িয়ে দেন আরমাল্ডোর দিকে। গারিঞ্চার অ্যাসিস্ট থেকে আরমাল্ডোর শেষমুহূর্তের গোলেই নিশ্চিত হয় ব্রাজিলের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে জোড়া গোল করে ব্রাজিলকে সেমিফাইনালে নিয়ে যান গারিঞ্চা। সেমিফাইনালে চিলির বিপক্ষে ব্রাজিলের ৪-২ গোলের জয়েও বড় অবদান ছিল তার। সেই ম্যাচেও জোড়া গোল করেছিলেন এই লিটল বার্ড। ফাইনালে কিছুটা অসুস্থ থাকায় তিনি নিজের সেরাটা না দিতে পারলেও চেকোস্লোভাকিয়াকে হারিয়ে ব্রাজিল জিতে নেয় তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। চার গোল করে সেই আসরে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন গারিঞ্চা। আর ব্রাজিলকে বিপদের সময়ে বারবার বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে সেই আসরের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন বাঁকা পায়ের এই জাদুকর।
১৯৬৬ বিশ্বকাপ: ইংলিশদের প্রথম বিশ্বজয়ের নায়ক চার্লটন
ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনে বড় কারণ ছিল স্যার ববি চার্লটনের অসাধারণ পারফর্মেন্স। গ্রুপপর্বে তিন ম্যাচে একগোল করা চার্লটন জ্বলে ওঠেন সেমিফাইনালে। সেই আসরে ইউসেবিওর পর্তুগাল অসাধারণ খেলছিলো। তাদের বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে ফাইনালে নিয়ে যান চার্লটন।
ফাইনালে পুরোটা সময় ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার চার্লটনকে কড়া মার্কিংয়ে রাখেন। তাই সেভাবে ফাইনালে কিছু করতে পারেননি তিনি। তবে চার্লটন জ্বলে না উঠলেও পশ্চিম জার্মানিকে অতিরিক্ত সময়ে ৪-২ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। আর স্যার ববি চার্লটন সেই আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।
১৯৭০ বিশ্বকাপ: রাজার মাথায় উঠলো মুকুট
১৯৬২ ও ১৯৬৬ বিশ্বকাপে রাফ ট্যাকলিংয়ের শিকার হয়ে বিশ্বকাপ মিস করায় অভিমান করে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকেই সরে যেতে চেয়েছিলেন পেলে! কিন্তু শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপটা খেলার সিদ্ধান্তই নেন তিনি। সেবার দল হিসেবে দুর্দান্ত ছিল ব্রাজিল। তবে সেই দুরন্ত খেলোয়াড়দের মাঝে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ছিলেন পেলে। আগের আসরগুলোতে স্ট্রাইকার হিসেবে খেললেও এই আসরে তিনি কিছুটা নিচে নেমে এসে প্লে-মেকারের ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে সেবার চার গোলের বিপরীতে পেলের অ্যাসিস্ট ছিল পাঁচটি!
পেলের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল যে, তিনি দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়েই জ্বলে উঠতেন। সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ব্রাজিল উরুগুয়েকে হারায় ৩-১ গোলে। এ ম্যাচে ব্রাজিলের তৃতীয় গোলটির অ্যাসিস্ট ছিল পেলের। আর ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে ব্রাজিলের করা চার গোলের মধ্যে পেলে একাই তিনটি গোলে অবদান রাখেন (এক গোল ও দুই অ্যাসিস্ট)। পেলের এই রাজকীয় পারফর্মেন্সে ভর করেই ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে ব্রাজিল তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তোলে।
পেলে নিজেও এক নতুন ইতিহাস গড়েন। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য হিসেবে থাকার গৌরব অর্জন করেন তিনি। এই আসরটি তার জন্য আরো স্মরণীয় হয়ে থাকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়ায়। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের নক আউট রাউন্ডে অবিশ্বাস্য পারফর্ম করেও যে পুরস্কারটি সেবার গ্রুপপর্বের ম্যাচ মিস করায় হাত থেকে ফসকে গিয়েছিলো, নিজের শেষ বিশ্বকাপে সেই পুরস্কারটি পেয়ে অর্জনের খাতা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় পেলের।
১৯৭৪ বিশ্বকাপ: হেরেও ইতিহাসের পাতায় অম্লান ক্রুইফ
ইয়োহান ক্রুইফের ব্যাপারে বলতে গেলে সবার আগে একটা কথা বলতে হয়। ক্রুইফ একজন খেলোয়াড়ের চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন। কোচ রাইনাস মিশেলকে সাথে নিয়ে ইয়োহান ক্রুইফ বিশ্ববাসীকে টোটাল ফুটবলের সাথে পরিচিত করিয়ে দেন। সেই টোটাল ফুটবল দিয়েই ক্রুইফের নেদারল্যান্ডস ১৯৭৪ বিশ্বকাপে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলো। শুধু ট্যাকটিস দিয়েই নয়, মাঠের পারফর্মেন্সেও সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন ক্রুইফ।
সেই আসরে ক্রুইফ তিন গোলের সাথে তিনটি গোলে অ্যাসিস্টও করেছিলেন। তিনটি গোলই ছিল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো শক্তিশালী দুই দলের বিপক্ষে। মাঠ ও মাঠের বাইরে ক্রুইফের এমন পারফর্মেন্সে ভর করেই নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠে ক্রুইফের নেদারল্যান্ডস। ফাইনালে স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষেও শুরুটা দারুণ ছিল ডাচদের। খেলার দুই মিনিটের মাথায় ক্রুইফকে পেনাল্টি বক্সে ফাউল করায় পেনাল্টি পায় নেদারল্যান্ডস। সেই পেনাল্টি থেকে গোল করে ডাচদের এগিয়ে দেন ইয়োহান নেসকেন্স। কিন্তু এরপরেই খেই হারিয়ে ফেলে ডাচরা। শেষপর্যন্ত পশ্চিম জার্মানির কাছে ২-১ গোলে হেরে ভেঙ্গে যায় নেদারল্যান্ডসের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। তবে পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ পারফর্ম করে ডাচদের ফাইনালে তোলার পুরস্কার হিসেবে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা ক্রুইফই জিতে নেন।
১৯৭৮ বিশ্বকাপ: আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিলেন কেম্পেস
আগে কখনো বিশ্বকাপ জিততে না পারা আর্জেন্টিনা ঘরের মাঠে ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জয়ের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিল। আর্জেন্টিনার এই অভিযানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মারিও কেম্পেস। তিনি গ্রুপপর্বে একটিও করতে পারেননি, তবে জ্বলে ওঠেন দ্বিতীয় রাউন্ডে। পোল্যান্ড ও পেরুর বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে নিয়ে যান ফাইনালের মঞ্চে।
ফাইনালেও গোলের ধারা অব্যাহত রাখেন তিনি। তার জোড়া গোলেই নেদারল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা। আর ছয় গোল ও এক অ্যাসিস্ট নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার সাথে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে আর্জেন্টিনার জাতীয় বীরে পরিণত হন কেম্পেস।
১৯৮২ বিশ্বকাপ: পাওলো রসির রাজকীয় প্রত্যাবর্তন
১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকেই অ্যাডিডাসের সৌজন্যে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাকে গোল্ডেন বুট ও বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কে গোল্ডেন বল দেওয়া শুরু করে ফিফা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুটি পুরস্কার একাই জিতে নেন পাওলো রসি। অথচ এই রসি বিশ্বকাপের আগের দুই মৌসুম ম্যাচ গড়াপেটার দায়ে ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ থাকায় বিশ্বকাপ খেলাটাই অনিশ্চিত ছিল তার। কিন্তু তৎকালীন ইতালি কোচ এনজো বেয়ারজোট শেষপর্যন্ত রসির উপরই আস্থা রাখেন।
টুর্নামেন্টের প্রথম চার ম্যাচে গোল পাওয়া তো দূরে থাক, মাঠে রসির পারফর্মেন্স এতটাই জঘন্য ছিল যে ব্রাজিলের বিপক্ষে ইতালির জীবন-মরণ ম্যাচে সবাই রসিকে বেঞ্চে বসানোর কথাই বলেছিলো।
কিন্তু ইতালির কোচ বেয়ারজোট আবারো রসির উপরই আস্থা রাখেন। এবার আর রসি তার কোচকে হতাশ করলেন না। তার হ্যাটট্রিকে ভর করেই সেসময়ের ভীষণ শক্তিশালী দল ব্রাজিলকে ৩-২ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় ইতালি। সেমিফাইনালেও রসির চমক। তার জোড়া গোলে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে যায় ইতালি। ফাইনালেও এক গোল করেন রসি। শেষপর্যন্ত পশ্চিম জার্মানিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তোলে ইতালি। আর ছয় গোল ও এক অ্যাসিস্টে গোল্ডেন বুটের সাথে গোল্ডেন বলটাও জিতে নেন রসি।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ: ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যে মন্ত্রমুগ্ধ ফুটবলবিশ্ব
১৯৮৬ বিশ্বকাপে একক নৈপুণ্য দিয়ে একটা সাধারণ দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে ম্যারাডোনা যে নজির গড়েছিলেন, সেটা ইতিহাসের পাতায় চিরঅম্লান হয়ে থাকবে। ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা মোট ১৪টি গোল করেছিলো। এর মধ্যে ১০টি গোলেই সরাসরি অবদান রেখেছিলেন ম্যারাডোনা।
কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে ম্যারাডোনা গড়েন নতুন ইতিহাস। ওই এক ম্যাচেই ম্যারাডোনা করেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত গোল আর বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর গোল। তার এই দুই গোলে ভর করেই ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় আর্জেন্টিনা।
সেমিফাইনালেও ম্যারাডোনার দাপট। বেলজিমায়ের বিপক্ষে তার জোড়া গোলেই বেলজিয়ামকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে যায় আর্জেন্টিনা। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির ডিফেন্ডাররা তাকে কড়া মার্কিংয়ে রাখায় সেই ম্যাচে ম্যারাডোনা ঠিক সুবিধা করতে পারছিলেন না। খেলার সময় তখন ৮৩ মিনিট, স্কোরলাইন ২-২। দলের এই ক্রান্তিলগ্নে আবারো জ্বলে উঠলেন ম্যারাডোনা। তার অসাধারণ পাস থেকে গোল করে আর্জেন্টিনাকে ৩-২ গোলে এগিয়ে নেন বুরুচাগা। শেষপর্যন্ত ওই গোলটাই ফাইনালে ব্যবধান গড়ে দেয়, আর্জেন্টিনা ঘরে তোলে তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। আর পাঁচ গোলের সাথে পাঁচ অ্যাসিস্টে গোল্ডেন বল জিতে নেন ম্যারাডোনা।
বিশ্বকাপের এক আসরের পারফর্মেন্স হিসেব করলে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার পারফর্মেন্স সবার চেয়ে কিছুটা হলেও এগিয়েই থাকবে।
১৯৯০ বিশ্বকাপ: শিলাচির দাপুটে পারফর্মেন্স
১৯৯০ বিশ্বকাপে স্যালভেটর শিলাচি বলতে গেলে একাই স্বাগতিক ইতালিকে সেমিফাইনালে নিয়ে যান। প্রথম ম্যাচে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ৭৮ মিনিটে গোল করে ইতালির জয় নিশ্চিত করেন তিনি। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ইতালির হয়ে প্রথম গোলটিও করেন শিলাচি।
রাউন্ড অফ সিক্সটিনে উরুগুয়ের বিপক্ষে ডেডলক ভাঙ্গেন সেই শিলাচিই। কোয়ার্টার ফাইনালে তার করা একমাত্র গোলেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয় ইতালির। সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষেও গোল পান তিনি। কিন্তু তার দল হেরে যায় টাইব্রেকারে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তার শেষ মুহূর্তের গোলেই জয় পায় ইতালি। পুরো আসরে ছয় গোল ও এক অ্যাসিস্টে গোল্ডেন বুট জেতার সাথে গোল্ডেন বলটাও সেবার জিতে নেন শিলাচি।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ: খামখেয়ালি রোমারিওর রাজকীয় পারফর্মেন্স
১৯৭০ বিশ্বকাপের পর দীর্ঘদিন বিশ্বকাপ খরায় ভুগছিলো ব্রাজিল। ২৪ বছর বহু চেষ্টা করেও কিছুতেই বিশ্বকাপের দেখা পাচ্ছিলো না। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ের জন্য বেশ ভালো পরিকল্পনা করে নামে ব্রাজিল। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী জোগো বনিতার উপর ভর না করে ট্যাকটিক্যাল ফুটবলে জোর দেয় কার্লোস আলবার্তো পেরেইরার দল। ট্যাকটিক্যাল ফুটবল খেললেও ওই ব্রাজিলের খেলায় সৌন্দর্যের যে ছোঁয়া ছিল তাতে বড় অবদান ছিল রোমারিওর। অথচ এই রোমারিওকে খামখেয়ালি আচরণের জন্য বিশ্বকাপ দলে না রাখার কথাই ভাবছিলেন ব্রাজিলের কোচিং স্টাফরা। তবে বাছাইপর্বে ব্রাজিলকে বিপদমুক্ত করায় শেষপর্যন্ত দলে জায়গা পান তিনি।
বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েই নিজেকে পুরোপুরি প্রমাণ করেন এই জাত স্ট্রাইকার। আরেক স্ট্রাইকার বেবেতোকে সাথে নিয়ে গড়েন দুর্দান্ত এক জুটি। গ্রুপপর্বে তিন ম্যাচেই গোল করেন রোমারিও। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে বেবেতোর করা গোলে অ্যাসিস্ট ছিল রোমারিওর। কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডকে ৩-২ গোলে হারায় ব্রাজিল। সেই ম্যাচে ব্রাজিলের হয়ে প্রথম গোলটি ছিল রোমারিওরই।
সেমিফাইনালে সুইডেনের সাথে হাড্ডাহাড্ডি এক লড়াইয়ের সম্মুখীন হয় ব্রাজিল। তবে খেলা শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে রোমারিওর করা গোলে ফাইনালে চলে যায় ব্রাজিল। ফাইনালে রোমারিও কোনো গোল পাননি, ব্রাজিলও আর ডেডলক ভাঙ্গতে পারেনি। ফলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে রোমারিও ব্রাজিলের হয়ে একটি গোল করেন। শেষপর্যন্ত ইতালিকে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারিয়ে দীর্ঘ ২৪ বছর পর আবারও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। পুরো টুর্নামেন্টে পাঁচ গোল ও দুই অ্যাসিস্টে ব্রাজিলের টেট্রাজয়ে বড় অবদান রেখে গোল্ডেন বল জিতে নেন রোমারিও।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ: রহস্যময় ইনজুরিতে ম্লান রোনালদোর গোল্ডেন বল
১৯৯৮ বিশ্বকাপের রোনালদোকে শুধুমাত্র গোল কিংবা অ্যাসিস্ট দিয়ে বর্ণনা করা যাবে না। নিজের সেরা ফর্মে থাকা রোনালদো সেই বিশ্বকাপে কতটা ভয়ঙ্কর ছিলেন, সেটা ঐ সময়ে যারা খেলা দেখেছেন তারা ভালোই নলতে পারবেন। প্রতি ম্যাচে প্রতিপক্ষের ডিবক্সে ত্রাস ছড়ানোর সাথে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল কিংবা অ্যাসিস্টও পাচ্ছিলেন রোনালদো।
রাউন্ড অফ সিক্সটিনে চিলির বিপক্ষে করেছিলেন জোড়া গোল, কোয়ার্টার ফাইনালে ডেনমার্কের বিপক্ষে করেছিলেন জোড়া অ্যাসিস্ট। সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে দলের একমাত্র গোলটিও ছিল তারই। ফাইনালে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে যখন রোনালদোকে কেন্দ্র করে সব পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলো ব্রাজিল, তখনই এক রহস্যময় ইনজুরিতে পড়েন রোনালদো। শেষপর্যন্ত তিনি ফাইনাল খেললেও পুরোপুরি ফিট না থাকায় সেদিন নিষ্প্রভ হয়েই থাকতে হয় দ্য ফেনোমেননকে, ব্রাজিলও ফ্রান্সের সাথে আর পেরে ওঠেনি। তাই চার গোল ও তিন অ্যাসিস্টে সেবার গোল্ডেন বল জিতলেও বিশ্বজয় করতে না পারার দুঃখে সেই অর্জনটা রোনালদোর কাছে ম্লানই হয়ে গিয়েছিলো।
২০০২ বিশ্বকাপ: জার্মানির প্রাচীর যখন অলিভার কান
বিশ্বকাপের ইতিহাসে গোলকিপারদের গোল্ডেন বল জেতার নজির আছে একটিই। ২০০২ সালে সেই নজির গড়েছিলেন জার্মানির অলিভার কান। সেই বিশ্বকাপে অলিভার কান আক্ষরিক অর্থেই জার্মানির প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই আসরে বেশ গড়পড়তা দল নিয়ে খেলতে এসেছিলো জার্মানি। তাদের ফাইনালে খেলার বড় কারণ ছিল অলিভার কানের অবিশ্বাস্য সব সেভ। ফাইনালের আগে পুরো আসরে জার্মানি গোল হজম করেছিলো মাত্র একটি। ফাইনালের প্রথমার্ধেও দুর্দান্ত সব সেভ করে ব্রাজিলের বাঘা বাঘা ফরোয়ার্ডদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন কান। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে রিভালদোর দুর্বল শট কান ঠিকমত গ্রিপ করতে না পারায় ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা রোনালদো সহজেই গোল করে বসেন! পুরো টুর্নামেন্টের নায়কের শেষটা হয়ে গেলো ট্র্যাজিক! তবে দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হলেও গোলকিপিংকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ায় অলিভার কান ঠিকই জিতে নেন গোল্ডেন বলের পুরস্কার।
২০০৬ বিশ্বকাপ: এক ঢুঁসে এলোমেলো সবকিছু!
২০০৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ফ্রান্স যখন খোঁড়াচ্ছিলো, তখন দলকে বাঁচাতে অবসর থেকে ফিরে আসেন জিনেদিন জিদান। তার হাত ধরেই বাছাইপর্ব টপকে বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে পা দেয় ফ্রান্স। কিন্তু গ্রুপপর্বে আবারো ছন্নছাড়া ফ্রান্স! কোনোমতে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে রাউন্ড অফ সিক্সটিন নিশ্চিত করে ফ্রান্স। গ্রুপপর্বে বলার মতো কিছুই করতে পারেননি জিদান। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে স্পেনের বিপক্ষে ফ্রান্সের ৩-১ গোলের জয়ে শেষ গোলটি করেন তিনি।
জিদান আসল খেলাটা দেখান কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে। সেসময়ে তারকায় ঠাসা ব্রাজিলকে পুরো ম্যাচে একাই নাচিয়ে ছাড়েন। ৫৭ মিনিটে জিদানের নেওয়া ফ্রি কিক থেকে গোল করে ফ্রান্সকে সেমিফাইনালে নিয়ে যান থিয়েরি অঁরি।
সেমিফাইনালেও জিদানের চমক। পর্তুগালের বিপক্ষে জিদানের একমাত্র গোলে জয় পেয়ে ফাইনালে চলে যায় ফ্রান্স। ফাইনালেও গোল পান জিদান। কিন্তু ইতালির মাতেরাজ্জি গোল করে খেলায় সমতা ফেরান। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে, সেখানেও দুই দল কিছুতেই আর গোল করতে পারছিলো না।
টাইব্রেকার থেকে দুই দল যখন মাত্র ১০ মিনিট দূরে, তখনই সেই অদ্ভুতুড়ে কান্ড ঘটিয়ে বসলেন জিদান। মাতেরাজ্জি জিদানের বোনকে উদ্দেশ্য করে গালি দেওয়ায় রাগে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাকে মাথা দিয়ে ঢুঁস দিয়ে বসেন জিদান। রেফারি সাথে সাথে জিদানকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেন। নিজেদের নেতাকে হারিয়ে টাইব্রেকারে ইতালির সাথে আর পেরে ওঠেনি ফ্রান্স। সেবার বিশ্বকাপটা জিতলে পেলে-ম্যারাডোনার সাথেই জিদানের নামটা উচ্চারিত হতো। কিন্তু হঠকারী একমুহূর্তে এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। তবে এই কাণ্ডের পরেও সেই আসরের গোল্ডেন বল জিদানই জিতে নেন।
২০১০ বিশ্বকাপ: দিয়েগো ফোরলানের চমক
২০১০ বিশ্বকাপ শুরুর আগে যদি কেউ বলতো যে, দিয়েগো ফোরলান সেই আসরে গোল্ডেন বল জিতবেন, তবে খুব কম মানুষই সেটা বিশ্বাস করতো। কিন্তু সেটাই করে দেখিয়েছিলেন দিয়েগো ফোরলান। ২০০৬ বিশ্বকাপে বাছাইপর্ব পার হতে না পারায় ২০১০ বিশ্বকাপে ফিরে এসে শুরু থেকেই ভালো করার ব্যাপারে আলাদা একটা চাপ অনুভব করছিলো উরুগুয়ে।
তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন দিয়েগো ফোরলান। গ্রুপপর্বে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনি করেন জোড়া গোল। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে তিনি কোনো গোল না পেলেও কোয়ার্টার ফাইনালে ঘানার বিপক্ষে তার দল যখন ০-১ গোলে পিছিয়ে, তখন অসাধারণ এক দূরপাল্লার গোল করে উরুগুয়েকে সমতায় ফেরান ফোরলান। সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষেও গোল পান তিনি, কিন্তু উরুগুয়ে ম্যাচটা হেরে যায় ৩-২ গোলে। তবে পাঁচ গোল ও এক অ্যাসিস্টে উরুগুয়েকে সেমিফাইনালে নিয়ে আসায় সেবারের গোল্ডেন বল ফোরলানই জিতে নেন।
২০১৪ বিশ্বকাপ: ম্যারাডোনা হতে পারলেন না মেসি
২০১৪ বিশ্বকাপে মেসির ব্যাপারে আর্জেন্টিনার প্রত্যাশার পারদ ছিল অনেক উঁচুতে। ২৮ বছর আগে ম্যারাডোনা যেভাবে একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন, সেভাবে মেসিও দলকে বিশ্বকাপ এনে দিবেন এমনটাই প্রত্যাশা ছিল সবার। সেই লক্ষ্যপূরণে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন লিওনেল মেসি। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে বসনিয়ার বিপক্ষে গোল পান তিনি। আর্জেন্টিনা ম্যাচটা জেতে ২-১ গোলে। পরের ম্যাচে ইরানের ডিফেন্স ভেদ করে যখন কিছুতেই আর্জেন্টিনা গোল পাচ্ছিলো না, তখনই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভাব মেসির। অসাধারণ এক গোলে আর্জেন্টিনাকে জয় এনে দেন মেসি। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে জোড়া গোল করে আর্জেন্টিনার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিশ্চিত করেন তিনি।
রাউন্ড অফ সিক্সটিনে আবারো বিপাকে আর্জেন্টিনা। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা যখন কিছুতেই গোল পাচ্ছিলো না তখন আবারো মেসি ম্যাজিক। ১১৮ মিনিটে তার দুর্দান্ত এক মুভ থেকে ফাঁকায় বল পেয়ে গোল করে আর্জেন্টিনাকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যান ডি মারিয়া। কোয়ার্টার ফাইনালে হিগুয়াইনের জয়সূচক গোলটির উৎসও ছিল মেসির একটি দারুণ মুভ। সেমিফাইনালে মেসি তেমন কিছু না করতে পারলেও টাইব্রেকারে জিতে ফাইনালে চলে যায় আর্জেন্টিনা। ফাইনালে একবুক আশা নিয়ে সব আর্জেন্টিনা ভক্ত তাকিয়ে ছিল মেসির দিকে। কিন্তু সেদিন তিনি কিছু করতে পারলেন না, আর্জেন্টিনাও আর পেরে উঠলো না জার্মানির কাছে। ম্যারাডোনার মতো আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিতে না পারলেও ম্যারাডোনার মতো গোল্ডেন বলটা ঠিকই জিতেছিলেন মেসি।
এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা। সব মিলিয়ে সাতজন ব্রাজিলিয়ান বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন। এছাড়া এখন পর্যন্ত হওয়া বিশটি বিশ্বকাপের মধ্যে দশটি বিশ্বকাপেই সেরা খেলোয়াড় হয়েছে চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়েরা। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, গোল্ডেন বুটের তুলনায় গোল্ডেন বল জয়ের ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়দের দাপট অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের পর টানা পাঁচটি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন দলের কেউ গোল্ডেন বল জিততে পারেননি। এবার দেখা যাক, সেই ধারা ভেঙ্গে চ্যাম্পিয়ন দলের কেউই কি গোল্ডেন বল জিতে নেন নাকি আবারো এই ধারাটা আরো দীর্ঘায়িত হয়। সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে রাশিয়া বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত।
ফিচার ইমেজ : FootTheBall