আর্সেনালের আক্রমণভাগে অবামেয়াং, ল্যাকাজেড ও ওজিল। এছাড়াও একসময় ছিলেন সানচেজ। এখন রামজি, শাকাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন হেনরিখ মিখিতারিয়ান। কিন্ত তারপরও কেন আর্সেনালের ধারাবাহিক ব্যর্থতা? বিগত কয়েক বছরের আর্সেন ওয়েঙ্গার ও দলটি শুধুই ব্যর্থতার উপর ভর দিয়ে চলেছে। প্রতিটি মৌসুমে আর্সেনাল অধিকাংশ পয়েন্ট হারিয়েছে নিম্নসারির দলের কাছে আর বড় কোনো দলের মুখোমুখি হলে তো বিধ্বস্ত হওয়া ছাড়া কথাই নেই।
এত তারকা ফুটবলার দলে থাকলেও সমস্যা কোথায় আর্সেন ওয়েঙ্গার অবশ্যই জানতেন, জানতেন গানার্স সমর্থকেরাও। তবে এ বছরের শুরুতে ইংলিশ লিগ কাপ ফাইনালে আর্সেনালের হতাশাজনক পারফর্মেন্সের পর গ্যারি নেভিল আর্সেনালের সমস্যাকে সামনে এনে ভালোভাবে ব্যাখাসহ তুলে ধরেছেন। তার ব্যাখা ও ধারণা অমূলক নয়। ধারাবাহিকভাবে ম্যাচ খেলার মতো কোনো মিডফিল্ডার ও যথাযথ কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না থাকা আর্সেনাল দলে অতি পুরনো সমস্যা।
একটু বিস্তারিতভাবে বলা যাক। বর্তমান ফুটবলের ধারণা একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে। রোনালদো বা বাতিস্ততাদের যুগে যে পদ্ধতি ও ধারণা ছিলো তা আর এখন কার্যকারী নয়। একটা সময় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনকে কোনো তোয়াক্কা করা হতো না। যে পজিশনে কোনো সৌন্দর্য নেই, যে পজিশনের খেলোয়াড় পারে না গোল বা অ্যাসিস্ট করতে বা সঠিকভাবে রক্ষণ সামলাতে, তাকে দলে দরকারটা কী?
কিন্ত ক্লদ ম্যাকালেলে, গিলবার্তো সিলভা, জেনারো গাত্তুসো, এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোদের দেখে ধারণা পাল্টে যায়। মাঝমাঠ থেকে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া, বাধা সৃষ্টি করার নমুনা দেখে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনটা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ম্যাকালেলে বা ক্যাম্বিয়াসোর উত্তরসূরীই আজকের ম্যাটিচ, লুকাস বিলিয়া, ক্যাসেমিরো, কান্তে বা খেদিরারা। তাদের মূলমন্ত্র হলো, যেভাবে হোক রক্ষণ সামলানো।
তাদেরই আরেক ধাপ উচ্চমানের সংস্করণ হলো আরেক ধরনের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডাররা, যারা রক্ষণের পাশাপাশি মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ গড়ে দেওয়া যায় সেদিকেও দক্ষ। এরকম মানসিকতার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের গুরু সার্জিও বুসকেটস। তার দেখাদেখি গড়ে উঠেছেন মার্কো ভেরাত্তি, আদ্রিয়ান রাবিও, জর্জিনহো, নাইঙ্গোলানের মতো আক্রমণাত্মক কিন্ত রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডাররা। তাদের খেলার ধরণ অনেকটা মাইন্ড গেমের মতো। সময়ের উপর তারা যথেষ্ট জোর দেন। কারণ তাদের মূল দায়িত্ব মাঝমাঠ থেকে প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট করে বল কেড়ে নেওয়া। পাশাপাশি আক্রমণে সাহায্য করা। তাই কখনও নিজ পজিশন ছেড়ে উপরে উঠে গেলে তারা ঠিক সময়ে আবার নিজের আসল পজিশনে ফেরত যান।
মাঠে এ পজিশনের খেলোয়াড়ের প্রভাব বোঝা যায় না। কিন্ত ৯০ মিনিট খেলার জন্য একজন ডিফেন্ডিভ মিডফিল্ডার যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। অথচ বিগত অনেক বছর যাবত আর্সেনাল খেলে এসেছে এমন একজন খেলোয়াড় ছাড়াই।
আর্সেনাল একজন পূর্ণাঙ্গ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার শেষ কবে পেয়েছিলো? ২০০২ সালে গিলবার্তো সিলভাকে কিনেছিলো আর্সেনাল। কিন্ত তারপর থেকে এ পর্যন্ত একজন প্রথাগত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের দেখা মেলেনি গানার্স দলে। সিলভা থাকাকালীন ছয় মৌসুমে আর্সেনাল প্রতি মৌসুমে গড়ে ৩৩.৫টি গোল খেয়েছে। তার বিদায়ের পর সেই গড়ের পরিমাণ কখনও ৩৬ এর নিচে যায়নি। আর গত বছর তো রেকর্ড পরিমাণ গড়ে ৫১টি গোল খেয়েছে আর্সেনাল। তো, সম্পূর্ণ হিসাব করলে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি মৌসুমে আর্সেনালের গোল খাবার গড় হলো ৪১.৫।
গিলবার্তো সিলভার বিদায়ের পর কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার তবুও চেষ্টা করেছেন। আলেক্সান্ডার সং এবং সেস ফ্যাব্রিগাসকে তিনি নিজ হাতে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে তৈরির চেষ্টা করেছেন। কিন্ত তাদেরকে ক্লাবে ধরে রাখতে পারেনি আর্সেনাল। এ অবস্থায় সাধারণ মিডফিল্ডারকে দিয়েই এ পজিশনে তালি মেরে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুর দেখা মেলেনি।
মোহাম্মদ এলনেনিকে কিনেছিলো আর্সেনাল এ সমস্যার সমাধান করতে। কিন্ত এলনেনি সেই প্রত্যাশামাফিক খেলতে পারেননি। তাই ওয়েঙ্গার গত মৌসুমের শেষভাগে ফর্মেশনই বদলে দিলেন। ৪-৩-৩ ফর্মেশন থেকে নিয়মিত ব্যবহার করতে লাগলেন ৪-২-৩-১ ফর্মেশন। মধ্যমাঠে নিয়মিত খেলতে লাগলেন একই ধরনের বক্স-টু-বক্স খেলোয়াড় অ্যারন রামসি ও গ্রানিত ঝাকা। তারা কেউই একদম রক্ষণাত্মক খেলোয়াড় নয়, আবার আক্রমণ থেকে সোজা মধ্যমাঠে চলে আসবেন এমন পারদর্শীতাও তাদের ভেতর নেই। দলে আরেকজন ছিলেন প্রতিভাবান শৈল্পিক খেলোয়াড়, জ্যাক উইলশেয়ার। তিনি ঝাকা বা রামসিদের মতো নন, পাস দিতে পটু, ভালোবাসেন মাঠে শৈল্পিক কিছু তৈরি করতে। অনেকটা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার মতো খেলার ধরণ তার। কিন্ত আর্সেনাল দলে তিনি খেলেছেন কই! তার নিয়মিত সঙ্গী ছিলো ইনজুরি। ইনজুরি কাটিয়ে মাঠে ফিরলেও ফর্মের সাথে যুদ্ধ করতে হতো তাকে।
আবার অ্যারন রামসিরও বড্ড ইনজুরির সমস্যা। তিনিও মৌসুমের অধিকাংশ সময়ে ইনজুরিতে আক্রান্ত হতেই থাকেন। মাঠেও গ্রানিত ঝাকার সাথে সবসময় তার বনিবনা হয় না। আর্সেনালের মূল মধ্যমাঠের ভিত্তি বনিবনা না হবার কারণে জঘন্যতম ফুটবল খেলে বসেন। রামসি, উইলশেয়ার, ঝাকার এতসব সমস্যা থাকার পরও এদেরকে দিয়েই ওয়েঙ্গার মাঝমাঠ সাজাতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ মোহাম্মদ এলনেনি যে আগে থেকেই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ।
ওয়েঙ্গারের ফেলে রাখা এতসব সমস্যা নিয়ে সম্ভবত উনাই এমেরি ভালোরকম পড়াশোনা করে এসেছেন। তাই আর্সেনালের দায়িত্ব নিয়েই মাঝমাঠ ঠিক করার দায়িত্ব নিলেন। সেখানে ইতিমধ্যে দুটো সাইনিং করে ফেলেছেন। সাম্পদোরিয়া থেকে কিনেছেন প্রথাগত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার লুকাস তোরেইরাকে এবং মাত্তেও গৌনদৌজি নামক ১৯ বছর বয়সী মিডফিল্ডারকে। তবে সবথেকে কার্যকর সাইনিং বলতে লুকাস তোরেইরা, কারণ দলের সমস্যা সমাধান করতে তার মতো একজনকেই গানার্স দলে প্রবলভাবে দরকার।
উরুগুইয়ান এ মিডফিল্ডার ইতালিতে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তাকে বলা হতো মার্কো ভেরাত্তির ক্ষুদে সংস্করণ। কোচ মার্কো জিয়ামপাওলোর অধীনে সাম্পদোরিয়াতে লুকাস তোরেইরা ৪-৪-২ এবং ৪-১-৩-২ ফর্মেশনে খেলেছেন। তবে যে ফর্মেশনেই খেলা হোক না কেন, তার কাজ ছিলো দুজন সেন্ট্রাল-ব্যাক ডিফেন্ডারের একটু সামনে অঘোষিত তৃতীয় সেন্ট্রাল-ব্যাক হয়ে খেলা। যিনি দেখভাল করেন রক্ষণ, যাতে দলের আক্রমণের সময় নিজেদের মধ্যমাঠ প্রতিপক্ষের সামনে উন্মুক্ত না হয়ে যায়। একইসাথে ছোট বা বড় পাসে দলের আক্রমণেও সহায়তা করা। তোরেইরা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নেবার পাশাপাশি পাস দেওয়াতে বেশ পটু। এজন্যই তাকে রাখা হচ্ছে সার্জিও বুসকেটসের মতো ডিফেন্সিভ ফুটবলারের কাতারে।
লুকাস তোরেইরার খেলার এক ঝলক দেখা গেছে বিশ্বকাপে। উরুগুয়ে বনাম পর্তুগাল ম্যাচে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে কড়া মার্কিংয়ে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন তোরেইরা। তার পা থেকে বল কেড়ে নিতেও দ্বিতীয়বার ভাবেননি। আর্সেনাল এজন্যই তোরেইরাকে দলে ভিড়িয়েছে। কোচ উনাই এমেরি সম্ভবত ৪-৩-৩ ফর্মেশনেই সাজাবেন আর্সেনালকে। আর এখানে ঝাকা আর রামসির মাঝে একটু নিচে থাকবেন তোরেইরা। এতে করে রামসি ও ঝাকা ফিরে যেতে পারবেন তাদের নিজস্ব খেলার ধরনে। নিচে নেমে এসে তাদেরকে গেম বিল্ডআপ বা রক্ষণ সামলাতে হবে না। কারণ যন্ত্রের মতো রক্ষণ ঠিক রেখে মাঝমাঠ থেকে বলের যোগান দেবার কাজটি তোরেইরাই করে দেবেন।
ম্যানসিটি বা টটেনহ্যাম হটস্পারের মতো দলের বিপক্ষে তাদের গতি ও প্রেসিংয়ের জোরে বরাবরই খেই হারিয়ে ফেলতো আর্সেনাল। মাঝমাঠে প্রেসিং ঠেকানোর মতো কোনো খেলোয়াড় না থাকার কারণে চোখের পলকে আক্রমণ নেমে আসতো আর্সেনাল ডি-বক্সে। তবে এবার তা হবার সম্ভবনা কম। তোরেইরার উপর যে পরিমাণ প্রত্যাশা আছে, তেমনটি মাঠে করে দেখাতে পারলে আর্সেনালের রূপই পাল্টে যাবে।
তোরেইরা থাকার কারণে আরও লাভবান হবে আর্সেনালের উইং। সিদ কলানসিচ ও হেকটর বেয়েরিনকে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় উইং দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করতে, কিন্ত তাদের কাছে সেভাবে বলের জোগান আসে না। কিন্ত তোরেইরা থাকার কারণে লম্বা লম্বা পাস পেতে পারেন বেয়েরিন ও কলানসিচ। এক্ষেত্রে আর্সেনালের আক্রমণ শানানোর মাত্রাও বেড়ে যাবে বহুগুণ। আর অবামেয়াং ও ল্যাকাজেড? তাদের সাথে তোরেইরার সম্পর্ক হতে পারে উরুগুয়েতে কাভানি আর সুয়ারেজের মতো।
লুকাস তোরেইরার বয়স মাত্র ২২। যদি আরেকটি মোহাম্মদ এলনেনি গল্প না হয়, তবে আর্সেনালের ভাগ্য নিশ্চিত বদলে যাবে। আর ফুটবল বিশ্ব অাবিষ্কার করবে আরেকজন প্রথাগত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকেও।