রূপকথার-যাত্রাটা তাহলে সেমিতেই শেষ হলো!
দেশে ফেরার উড়ানে চড়ে ক্যাসপার স্মাইকেল কথাটা ভাবতেই পারেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে সেভের পর সেভ করেছেন, এমনকি ম্যাচের নিষ্পত্তিসূচক গোলের উৎস পেনাল্টি কিকটাও তো ঠেকিয়েই দিয়েছিলেন প্রায়। তবুও গোলটা আটকাতে পারেননি, সেমিফাইনাল পেরিয়ে ফাইনালেও আর তার দলের ওঠা হয়নি। তবে ডেনমার্কের টুর্নামেন্টটা যেমন করে শুরু হয়েছিল, হ্যান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনও তো এর বেশি এগোতে অস্বীকৃতিই জানাতেন।
ঘরের মাটিতে প্রথমবারের মতো এলো ইউরোর মহোৎসব। সেই উৎসব ভাঙতে সময় লাগল ৪২ মিনিট, দলের সবচেয়ে বড় তারকা ছিটকে গেলেন পুরো টুর্নামেন্ট থেকে। কিন্তু হা-হুতাশ করার বদলে উল্টো সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করতে হলো অন্তর্যামীর কাছে। খেলার মধ্যেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়ে উল্টে পড়ে ছিলেন ওই তারকা, কোনোক্রমে বেঁচে ফিরেছেন; তুচ্ছ খেলা ছাপিয়ে জীবন-মৃত্যুই তো তখন হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
তার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাচও থেমে গিয়েছিল সেখানেই। তবে তিনি খানিকটা সুস্থ হতেই খেলা ফিরেছিল মাঠে। উৎসব ফেরাতে অবশ্য সময় লেগেছিল আরও কয়েকদিন। ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে মাঝপথে থেমে যাওয়া ম্যাচটায় নার্ভাসনেসের প্রমাণ ড্যানিশ খেলোয়াড়রা দিয়েছিলেন পায়ে পায়ে। ক্যাসপার স্মাইকেল অন্য সময় যে হেডটা আটকে দিতেন, সেটাই সেদিন ফসকে গেল হাত গলে। পেনাল্টিটা মিস করলেন হয়বিয়াও। ফিনল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম ম্যাচটা হেরে যেতে হলো ১-০ গোলে।
হেরে যেতে হলো বেলজিয়ামের বিপক্ষে পরের ম্যাচটাও। দ্বিতীয় রাউন্ডের স্বপ্নের ইস্তফাই হওয়ার কথা তখন, টুর্নামেন্টে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে পরের পর্বে ওঠার রেকর্ডটা তো কোনো দলেরই ছিল না এর আগে।
তবে সেখান থেকেই রচিত হলো রূপকথা। রাশিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে শেষ ষোল’তে উঠল ড্যানিশরা, সেখানে ওয়েলস আর শেষ আটে চেক প্রজাতন্ত্রকে হারিয়ে উঠে এলো সেমিতেও। সেখানেই ওই স্মাইকেল-বীরত্ব সত্ত্বেও আটকে যেতে হলো। ঠিকই আছে, রূপকথার কাহিনীতেও এর বেশি এগোলে সেটিকে ‘চরমতম অবাস্তব’ মনে হবে তো!
অবশ্য গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র যখন ড্যানিশরা, এমন রূপকথাকেও হার মানানো গল্প তো হতেই পারে। ওই যে মনে নেই, ‘৯২ ইউরোতে ড্যানিশরা বাস্তবেই এমন আষাঢ়ে গল্প লিখেছিল!
ডেনমার্ক কোথায়?
‘৮৮তে নির্ধারিত হয়েছিল, টুর্নামেন্ট বসবে সুইডেনের চার শহরে। টুর্নামেন্টের থিম সং হবে ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’, তাই টুর্নামেন্টের দৈর্ঘ্যও হওয়া যাবে না ১৫ ম্যাচের বেশি। আর ১৫ ম্যাচে শেষ করতে হবে বলে দল হওয়া যাবে না ৮টির বেশি। স্বাগতিক সুইডেন সুযোগ পেয়েছিল সরাসরি; ফ্রান্স, স্কটল্যান্ড, সিআইএস, যুগোস্লাভিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড এসেছিল বাছাইপর্বের ঝক্কি পেরিয়ে। প্রশ্ন জাগল তো? ডেনমার্ক যে টুর্নামেন্টে শিরোপা জিতল, সেখানে ডেনমার্ককেই তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! তা ডেনমার্ককে তো টুর্নামেন্ট শুরুর দিনদশেক আগেও আয়োজক দেশেই পাওয়া যাচ্ছিল না।
ঝেড়েই কাশা যাক। বাছাইপর্বে ডেনমার্ক ছিল যুগোস্লাভিয়ার গ্রুপে। গ্রুপ-ই’তে তাদের সঙ্গে ছিল উত্তর আয়ারল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়া। শুরুটা করেছিল উত্তর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে, ঘরের মাঠে পরের ম্যাচে হেরে গিয়েছিল যুগোস্লাভিয়ার কাছে।
ডেনমার্কের ফুটবলের অধঃগতি দেখা যাচ্ছিল বেশ কয়েক বছর থেকেই। ১৯৮৪ ইউরোর সেমিতে ওঠা দলটা গ্রুপপর্ব পেরিয়েছিল ‘৮৬র বিশ্বকাপেও। জার্মান কোচ সেপ পিয়ানটেকের অধীনে দলটা হাততালিও কুড়িয়েছিল সর্ব মহলেই। ওই দলের মাইকেল লাউড্রপ আর প্রেবেন এলকায়ারের জুটিকে তো ‘স্বর্গ থেকে আগত’ বলেও আখ্যা দিতেন কেউ কেউ। তবে ‘৮৮ থেকেই পতনের শুরু; ইউরোটা কেটেছিল নিদারুণ ব্যর্থতায়, অলিম্পিকের বাছাইপর্ব পেরোনো খুব সম্ভব মনে হলেও বিতর্তিকভাবে বাদ পড়তে হয় অযোগ্য এক খেলোয়াড়কে খেলিয়ে। পিয়ানটেক তাই সরে দাঁড়াতে এক প্রকার বাধ্যই হন বিরূপ পরিস্থিতিতে।
তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন এতদিন তারই সহকারী হিসেবে কাজ করা রিচার্ড মোলার নিয়েলসেন। ‘সৌন্দর্যের পূজা বহু হয়েছে, এবার খেলতে হবে ফলদায়ক ফুটবল’ – এই নীতি মেনে মোলার নিয়েলসেন শুরু থেকেই বেছে নেন ডিরেক্ট ফুটবলের পথ।
কোচের সঙ্গে এ নিয়ে লাউড্রপ (মাইকেল ও ব্রায়ান) ভাইদের মতানৈক্য চলছিল আগে থেকেই। সেই ফলটাও যখন আসছে না, রাগে-ক্ষোভে মাইকেল জাতীয় দলকে বিদায় বলে দেন ইউরো বাছাইপর্বের তিন ম্যাচ খেলেই, তখন তিনি ২৬। নিয়েলসেনের অধীনে খেলা অসম্ভব মেনে সরে দাঁড়ান ছোট ভাই ব্রায়ানও।
তবে দলের সবচেয়ে বড় দুই তারকার সরে যাওয়াটা শাপেবর হয়েই এসেছিল ড্যানিশদের জন্য। বাছাইপর্বের শেষ পাঁচ ম্যাচই জিতেছিল ড্যানিশরা, যদিও শুরুর ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠা আর হয়নি। শেষ করেছিল যুগোস্লাভদের পেছনে থেকে। এবং পূর্বনির্ধারিত নিয়মানুযায়ী, বাছাইপর্বে গ্রুপের শীর্ষে থেকে শেষ করা দলটারই কেবল সুযোগ পাওয়ার কথা মূল পর্বে।
সে হিসেবে যুগোস্লাভরাই চড়েছিল সুইডেনের বিমানে। কিন্তু সুইডেনের লেকস্যান্ডে বসেই তারা খবর পেলেন, যুগোস্লাভিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বলকান যুদ্ধ। আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খেলোয়াড়েরা টের পেলেন ভিনদেশে বসেই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল যুগোস্লাভিয়া নামধারী যেকোনো দলের সকল ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ওপর। উয়েফাও মেনে নেয় সে সিদ্ধান্ত, যুগোস্লাভ ফুটবলারদের ফেরত পাঠানো হয় বেলগ্রেডে।
টুর্নামেন্ট কি তাহলে সাত দল নিয়েই হবে? তা কেন, যুগোস্লাভিয়ার গ্রুপে দ্বিতীয় স্থানে থাকা দলকে ডাকলেই তো চলছে! সুইডেনে ডাক পড়ল ডেনমার্ক ফুটবল দলের। ‘৯২র তখন ৩০ মে। ওদিকে টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার কথা ১১ জুন।
পুরো ব্যাপারটা বোঝাতেই বোধ হয় বাংলায় চালু হয়েছিল ওই প্রবাদটা, ‘উঠ্ ছুড়ি, তোর বিয়ে!’
ডেনমার্ক এলো
ফিসফাস, কানকথা আগে থেকেই ভাসছিল বাতাসে। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পরই তো তড়িঘড়ির শুরু। উয়েফার আবেদন ফিরিয়ে দেবে, এমন চিন্তা ড্যানিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কখনোই ছিল না। কিংবা সম্পর্কে অবনতির আশঙ্কায় ‘না’ করবার সাহসটাই তাদের ছিল না।
শোনা যায়, মৌসুম শেষে ড্যানিশ ফুটবলাররা তখন সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পিটার স্মাইকেল অবশ্য দ্বিমতই করছেন কথার সঙ্গে,
‘অনেকে গল্প ফাঁদে, আমরা নাকি সৈকতে অবকাশ যাপন করছিলাম তখন। একদম ভুয়া কথা। আমরা সুইচড-অফ থাকলেও ম্যাচ ফিট ছিলাম। আমাদের কেবল খেলার উদ্দীপনাটা যোগাড় করারই প্রয়োজন ছিল।’
এমন উদ্দীপনা খুঁজে পাওয়া বিশজনকে তড়িঘড়ি করে কাপড় গোছাতে বলেছিলেন কোচ রিচার্ড মোলার নিয়েলসেন। আর ‘৯০-এর অক্টোবর থেকেই জাতীয় দলকে এড়িয়ে যাওয়া মাইকেল লাউড্রপ এই দফাতেও দলকে অগ্রাহ্য করেছিলেন জাতীয় দলকে। তখন কি আর জানতেন, কী এক রূপকথার যাত্রা মিস করতে যাচ্ছেন!
অবশ্য এমন কিছুর স্বপ্ন কে-ই বা দেখেছিলেন! পড়ে পাওয়া সুযোগ পেয়ে ড্যানিশ ফুটবলাররা তখন হতবিহ্বল। ‘যেতে হবে, তাই যাচ্ছি’ ধারণা নিয়েই সুইডেনের বিমানে চড়েছিলেন সবাই। দলের সদস্য জনি মলবি যেমন বলছেন,
‘শুনে তো আমরা হাসছিলাম। আমাদের ওপরে কারও কোনো আশা ছিল না। দেরিতে টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলাম বলে সবাই বেশ করুণার চোখেই তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে।’
ডেনমার্ক দেখল
মূল পর্বে ডেনমার্ক পড়েছিল গ্রুপ-এ’তে। সঙ্গে পেয়েছিল স্বাগতিক সুইডেন, ফ্রান্স, আর ইংল্যান্ডকে। কিছুদিন প্রস্তুতি নিয়েছে কি নেয়নি, নেমে যেতে হয়েছিল গ্রুপপর্বের ম্যাচে। তবে ডেনমার্কের খেলা দেখে কে বুঝতে পেরেছিল প্রস্তুতি ঘাটতির কথা! মালমোতে প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড, যে দলে তখন খেলছেন গ্যারি লিনেকার, পল মারসন, ডেভিড প্ল্যাটের মতো ফুটবলার। কিন্তু গোল করার সেরা সুযোগটা পেয়েছিল ডেনমার্কই। জন জেনসেনের শটটা পোস্টে লেগে ফেরত না আসলে জয়ী দলের নাম হতে পারত ডেনমার্কও।
অবশ্য ওই ম্যাচে গোল করতে পারেনি ইংল্যান্ডও। দ্বিতীয়ার্ধে টনি ডিলানির শট ঠেকিয়েছিলেন পিটার স্মাইকেল, বিরতির আগে অ্যালান স্মিথও পৌঁছে গিয়েছিলেন গোলের কাছে। তবে গোলটা আর হয়নি, ম্যাচ শেষ হয়েছিল ০-০ সমতায়। ওদিকে ফ্রান্স-সুইডেন ম্যাচও শেষ হয়েছিল ১-১ সমতায়। প্রথম ম্যাচ শেষে চার দলেরই পয়েন্ট তাই ১।
দ্বিতীয় ম্যাচেই অবশ্য হার জুটেছিল ড্যানিশদের কপালে। বারকয়েক সুযোগ মিলেছিল, ফ্লেমিং পভসেনের শটটা চলে গিয়েছিল বারের সামান্য উঁচু দিয়ে, বুকের ছোঁয়ায় জালের দিকে ঠেলে দেওয়া কিম ভিলফোর্টের বলটাও ধরে ফেলেছিলেন সুইডিশ গোলকিপার থমাস রাভেল্লি, পরে আটকে দিয়েছিলেন কিম ক্রিস্টোফটের জোরালো ফ্রি-কিকটাও। বদলে গোল করেছিল স্বাগতিক সুইডেন। বক্সে কেন্ট নিয়েলসেনের ফেলা ক্রস থেকে টমাস ব্রলিন। সুইডেন জিতেছিল ওই ১ গোলেই।
দুই ম্যাচ শেষে সুইডেনের পয়েন্ট দাঁড়াল ৩, ডেনমার্কের ১। পরের পর্বে ওঠার সমীকরণ বোঝার চেয়ে ড্যানিশরা তখন আংশিক সমাকলনই বুঝতে পারতেন সহজে।
ডেনমার্ক জয় করল
ফ্রান্স ইউরোতে এসেছিল শিরোপার দাবি নিয়েই, জিতেছিল বাছাইপর্বের আট ম্যাচের সবগুলোই। টুর্নামেন্টের শুরুর দুই ম্যাচ ড্র করলেও ঘাবড়ে যাবার কোনো কারণ ছিল না মিশেল প্লাতিনির দলের। শেষ ম্যাচে প্রতিপক্ষ ডেনমার্ক, যাদের নিয়ে প্রত্যাশাটা খোদ ড্যানিশরাই করছে না, তাদের বিরুদ্ধে জয় পেলেই তো চলত ফরাসিদের।
অথচ ম্যাচটা ডেনমার্ক জিতে নিল ২-১ গোলে! ম্যাচের আট মিনিটেই গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়েছিলেন হেনরিক লারসেন। খানিক বাদে প্রায় হয়ে যাওয়া গোলটা মিস না করলে ব্যবধান বাড়াতে পারতেন টরবেন ফ্র্যাঙ্কও, যে গোলটা পরে করেছিলেন লারস এলস্ট্রুপ। তবে দুয়ের মাঝে খেলার ধারার বিপরীতে গোল করে জ্যাঁ-ফিলিপ দুর্যাঁদ সমতায় ফিরিয়েছিলেন ফ্রান্সকে, যদিও শেষতক আর লাভ হয়নি।
ফ্রান্স ধরল বাড়ির পথ, ওদিকে সুইডেনের কাছেও ২-১ ব্যবধানে হেরে তাদের সঙ্গী ইংল্যান্ড। আট দলের টুর্নামেন্ট, চার দল উঠবে সেমিফাইনালে। শূন্যতা পূরণে টুর্নামেন্টে আসা ডেনমার্ক তাই গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে উঠে গেল সেমিফাইনালে!
আর মাত্র ‘এক’ ম্যাচ
গ্রুপ বি’তে শীর্ষে থেকে সেমিফাইনালে উঠেছিল হল্যান্ড, সুইডেনে যারা এসেছিল ‘ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন’ তকমা নিয়ে। ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড, ডেনিস বার্গক্যাম্প, রোনাল্ড ক্যোমানদের দলের বিরুদ্ধে ডেনমার্কই তাই ছিল ‘আন্ডারডগ’। ড্যানিশরা অবশ্য বলবেন, তা টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই তো আমরা তা-ই ছিলাম।
বিশেষণের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল বলে ডেনমার্কের খেলায় দেখা যায়নি স্নায়ুচাপের ছিটেফোঁটাও, ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ তো বলতে গেলে নিয়ন্ত্রণ করেছিল তারাই। এগিয়ে যায় অবশ্য প্রথমার্ধের শুরুতেই। ভাই মাইকেল না এলেও ব্রায়ান লাউড্রপ ঠিকই সাড়া দিয়েছিলেন কোচের আহ্বানে, জ্বলে উঠেছিলেন সেমিফাইনালেও। তার কম্পাস মাপা ক্রসে হেড করেই ম্যাচের ৫ মিনিটে গোল করেন লারসেন, লারসেন পরে গোল করেছিলেন আরও একটি। তবে ম্যাচের ২৩ মিনিটে গোল করে ডাচদের প্রথমবার সমতায় ফিরিয়েছিলেন বার্গক্যাম্প, নির্ধারিত সময়ের ৪ মিনিট বাকি থাকতে দ্বিতীয়বার সমতায় ফিরিয়েছিলেন রুদ খুলিত।
অতিরিক্ত ৩০ মিনিট ডেনমার্কের জন্য অনন্তকাল মনে হতে বাধ্য। গোল করার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল রয়, তবে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন স্মাইকেল। ম্যাচ গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে, সেখানে বাঁয়ে ঝাঁপিয়ে ফন বাস্তেনকেও আটকেছিলেন স্মাইকেল।
ড্যানিশ খেলোয়াড়দের কেউই হাতছাড়া (পড়ুন পা-ছাড়া) করেননি সুযোগ। ব্যবধানটা তাই থেকে গিয়েছিল ৫-৪। ফলাফল? ডেনমার্ক ফাইনালে।
এবং রূপকথা!
যা হচ্ছে, সবার কাছে স্বপ্ন-স্বপ্ন মনে হলেও কিম ভিলফোর্টের গল্পটা কিছু আলাদা। এই স্বর্গানুভূতির মাঝে-মাঝেই যে নরক ঘুরে আসতে হচ্ছিল তাকে!
টুর্নামেন্টের আগে থেকেই তার সাত বছরের মেয়ে লাইন তখন লড়ছিলেন লিউকেমিয়ার সঙ্গে, তবে চিকিৎসায় একটু ইতিবাচক সাড়া দেওয়ায় ভিলফোর্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন টুর্নামেন্টে যাওয়ার। তবে টুর্নামেন্ট ছেড়েছিলেন গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচ শেষেই। লাইনের শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল আবারও। খেলা নিয়ে ভাবনা তো দূর অস্ত; যদি ভেবেও থাকেন, তা ‘দলের বাদবাকিরাও খুব শিগগিরই ফিরে আসবে দেশে’ ভাবনাকে না ছাপানোরই কথা।
তবে তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করলেন সতীর্থরা। যদিও স্ত্রী আর কন্যাকে ছেড়ে সুইডেনে ফেরত যাবেন, এমন কিছুর কথা ভাবনাতেই আনছিলেন না ভিলফোর্ট। তবে পরিবারের সদস্যরা বুঝিয়েছিলেন,
‘অল্প ক’দিনেরই তো ব্যাপার, বড়জোর দুটো ম্যাচ। কেটে যাবে দেখতে দেখতেই। খেলে আসো।’
ভিলফোর্টের জায়গায় সুযোগ পেয়ে হেনরিক লারসেন ফ্রান্সের বিপক্ষে খেলেছিলেনও দুর্দান্ত। ভিলফোর্টের তাই ফেরত না আসার কথা ভাবছিলেন আরও বেশি। তবে ফেরত আসার পর জানলেন, কোচ নিয়েলসেন লারসেনের সঙ্গে দলে রেখেছেন তাকেও। মিডফিল্ডে সেদিন ডাচদের সংখ্যালঘু করতে ভূমিকা রেখেছেন, চাপের মুখেও খেই হারাননি ভিলফোর্ট। ‘আমার সেরা ম্যাচটা হল্যান্ডের বিপক্ষেই খেলেছিলাম’, বহু বছর বাদে জানিয়েছিলেন ভিলফোর্ট নিজেই।
হল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল খেলে আবারও ডেনমার্কে ফেরত এসেছিলেন ভিলফোর্ট, আরও একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফাইনাল না খেলার। তবে এবার তার কাছে আবদার এলো লাইনের কাছ থেকে। মেয়ের অনুরোধেই আরও একবার দলের সঙ্গে যোগ দিতে হয় ভিলফোর্টকে, ম্যাচের ঠিক আগের সন্ধ্যায়।
হল্যান্ডের বিপক্ষে সেরা ম্যাচ খেললেও গোলটা অবশ্য সেদিন পাওয়া হয়নি। যা পেয়েছিলেন, ফাইনালে। দুই জার্মানি একত্র হওয়ার পর প্রথম দানেই উঠেছিল ফাইনালে। জেনসেনের গোলে প্রথমে পিছিয়ে পড়লেও জার্মানরা গোলের খুব কাছে ছিল পুরো ম্যাচজুড়েই, তবে বারবারই ফেরত যাচ্ছিল পিটার স্মাইকেলের দ্বারে। কিম ভিলফোর্টের মুহূর্তটা এলো এর পরেই। ম্যাচের ১১ মিনিট বাকি থাকতে জার্মান ডি-বক্সের খানিকটা বাইরে থেকে বাঁ পায়ে শট নিলেন তিনি, দূরের পোস্ট ঘেঁষে বলটা ঢুকে গেল জালে।
লাইন লিউকেমিয়ার কাছে পরাজয় মেনেছিলেন ওই টুর্নামেন্ট শেষের মাসখানেকের মাঝেই। তবে পরাজয়ের আগে দেখে গিয়েছিলেন এক রূপকথা, যে রূপকথার ইতি ঘটেছিল তার বাবারই পায়ে।
হ্যান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনের নামটা এই লেখাতে আগেও এসেছে একবার। আসছে আবারও। কিংবদন্তি এই ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দুঃসাহসও দেখাচ্ছি এই সুযোগে। জাতে ছিলেন ড্যানিশ, সঙ্গে ছিলেন রূপকথা গল্পের লেখক। তবে ভেতরে যতই স্বজাত্যবোধ আর গল্পের গরুকে গাছে চড়ানোর বাতিক থাকুক, ‘৯২তে ডেনমার্কের ইউরোপ জয়ের যে গল্পটা এতক্ষণ ধরে পড়ে এলেন, সে রূপকথা লেখার সাহস হ্যান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনেরও কি হতো?