বলা হয়ে থাকে, ক্রিকেট মাঠে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন আম্পায়াররা। তারা যে সিদ্ধান্তই দিন না কেন, ক্রিকেটাররা তা মানতে বাধ্য। বর্তমানে অবশ্য অবস্থা বদলেছে, ডিআরএসের (ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম) বদৌলতে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন মাঠের খেলোয়াড়রা। কিন্তু সবসময় তো এমন ছিল না। আর সব ক্রিকেটার যে একরকম ছিলেন না, সেটাও অজানা নয় কারো। গিলক্রিস্টের মতো ব্যাটসম্যান যেমন ছিলেন, আউট হওয়ার পর আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করেই হাঁটা দিতেন তিনি। আবার রানাতুঙ্গার মতো ক্রিকেটারও ছিলেন, সতীর্থের বলকে টানা নো-বল ডাকার প্রতিবাদে গোটা দল নিয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন মাঠ থেকে।
এ তো গেলো খেলোয়াড়দের কথা। আম্পায়াররাও যদি মারমুখী হয়ে ওঠেন, তাহলে?
১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ টেস্টে। মাঠে আম্পায়ার শাকুর রানার সাথে ভয়াবহ তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তৎকালীন ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইক গ্যাটিং।
শাকুর রানার পরিচয়টা দিয়ে নেয়া যাক। বিতর্ক জিনিসটা খুব পছন্দ ছিল পাকিস্তানি এই আম্পায়ারের, বিতর্ক ছাড়া যেন তিনি চলতেই পারতেন না। তার প্রথম কাণ্ড ছিল ১৯৭৮ সালে, দীর্ঘ ১৭ বছর পরে সেবার পাকিস্তানে খেলতে গিয়েছিল ভারত। এক টেস্টে মহিন্দর অমরনাথকে সতর্ক করে দেন রানা, অভিযোগ ছিল অমরনাথ নাকি পিচের ‘বিপদজনক’ এলাকায় ঘোরাঘুরি করছেন। এই অভিযোগের পরে ভারতের সহ-অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কার যান রানার কাছে। ইমরান খান এবং সরফরাজ নেওয়াজের পা অনেকবার দাগ পার হলেও রানা কেন কিছু বলেননি, এই মর্মে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেন তিনি। পরে কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। বলাই বাহুল্য, এই সমাধান পছন্দ হয়নি গাভাস্কারের।
নিউজিল্যান্ড দল সম্পর্কে তেমন কোনো বিতর্ক এখনও শোনা যায় না। ক্রিকেট যে আসলে ভদ্রলোকদেরই খেলা, সেটা সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় তাদেরকে দেখলেই। এরকম শান্তশিষ্ট নিউজিল্যান্ডাররাও ক্ষেপে গেলো ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে, করাচি টেস্টে। জাভেদ মিঁয়াদাদের বিপক্ষে আবেদন করলেও নাকচ করে দেন আম্পায়ার, নাম আবারও শাকুর রানা। রাগে, ক্ষোভে নিজের সতীর্থদের নিয়ে মাঠ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন জেরেমি কনি।
ফিরে আসা যাক পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ডের সেই ফয়সালাবাদ টেস্টে। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড করেছিল ২৯২ রান, জবাব দিতে নেমে ১০৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিলো পাকিস্তান। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হতে তখন আর বাকি মাত্র ৩ বল। বল করছিলেন অফ স্পিনার এডি হেমিংস, নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে ছিলেন সেলিম মালিক। সিঙ্গেল আটকানোর জন্য ডিপ শর্ট লেগ থেকে ডেভিড ক্যাপেলকে আরও কাছে নিয়ে এলেন গ্যাটিং, সেটা করার আগে সেলিমকে জানিয়েও দিলেন তিনি। এদিকে এডি যখন বল করার জন্য দৌঁড় শুরু করেছেন, তখন ক্যাপেলকে হাতের ইশারায় থামতে বলেন গ্যাটিং।
হেমিংস বল ছাড়ার সাথে সাথেই থামার কথা বলে চিৎকার করে উঠলেন আম্পায়ার শাকুর রানা। অন্য দিকে বলটিকে ডেড হিসেবে ঘোষণা করলেন আরেক আম্পায়ার খিজির হায়াত।
টেকনিক্যালি বলটা বৈধই ছিল বটে। কারণ ফিল্ডার এগিয়ে আনার আগে নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে থাকা সেলিমকে জানিয়েছিলেন গ্যাটিং, তার কোনো সমস্যা ছিল না। আবার ব্যাটিংয়ে থাকা আমের মালিকেরও কোনো সমস্যা ছিল না, কারণ ক্যাপেল ছিলেন তার দৃষ্টির আড়ালে।
খেলা থামিয়ে গ্যাটিং জানতে চাইলেন, কী কারণে বলটিকে ডেড হিসেবে ঘোষণা করা হলো। তখন শাকুর রানা বললেন,
“বল করার সময় আপনি হাত নাড়াচ্ছিলেন। নির্লজ্জ এক প্রতারণা এটা। আপনি এটা করতে পারেন না।”
এটাও হয়তো সহ্য করে নিতেন, কিন্তু পরের কথায় মাথায় আগুন ধরে গেল গ্যাটিংয়ের। তাকে রানা বললেন,
“আপনি একজন প্রতারক।”
এর আগের টেস্ট, অর্থাৎ প্রথম টেস্ট হয়েছিল লাহোরে। সেই টেস্টে কিছু সিদ্ধান্ত মনঃপুত হয়নি গ্যাটিংয়ের, সাথে জ্যাকেটের নিচে পাকিস্তান দলের একটা সোয়েটার পরায় রানার উপর ক্ষেপে ছিলেন গ্যাটিং। রানার এই কথায় বারুদে আগুন পড়লো। মাঠের মধ্যেই বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন তারা দুজন। কেন তিনি প্রতারক, তা জানতে চাইলেন গ্যাটিং। জবাবে রানা বললেন,
“বোলার বল করছে, এই অবস্থায় ফিল্ডার সরানোর নিয়ম নেই।”
জবাবে উত্তপ্ত গলায় গ্যাটিং বললেন,
“নিয়মটা আমরাই বানিয়েছি।”
মাঠের এই আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। সেদিন সন্ধ্যায় রানা সাফ জানিয়ে দেন, গ্যাটিং ক্ষমা না চাইলে তিনি আর খেলা পরিচালনা করতে মাঠে নামবেন না। তার কথাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি কেউই। কিন্তু পরদিন সকালেই প্রমাণ হয়ে যায়, রানা রাগের মাথায় কিছু বলেননি। আম্পায়ার আসেননি, আসেনি পাকিস্তান দলও। পুরো ইংল্যান্ড দল মাঠে আসলেও খেলা হয়নি একটা বলও!
এই ঘটনা গড়ায় ইংল্যান্ডের দূতাবাস পর্যন্ত। পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার নিকোলাস ব্যারিংটন লন্ডনের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠান এই বলে,
“মাঠে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে এই ট্যুর বাতিলও করা লাগতে পারে।”
এর পরই ইসিবি থেকে কঠোর ভাষায় গ্যাটিংকে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখতে বলা হয়। উপায়ান্তর না দেখে রানার কাছে চিঠি লেখেন গ্যাটিং। ১০ ডিসেম্বর ছিল টেস্টের রেস্ট ডে। গ্যাটিংয়ের চিঠি পেয়ে অবশেষে ১১ ডিসেম্বর খেলা পরিচালনা করতে মাঠে নামেন রানা। তবে সেই টেস্টটা শেষ পর্যন্ত ড্র হয়, টেস্টের মূল কুশীলব হয়ে থাকেন গ্যাটিং আর রানাই।
পরের টেস্ট ছিল করাচিতে। সেই টেস্টেও রানাকে আম্পায়ার হিসেবে নিযুক্ত করে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। আরেক আম্পায়ার ছিলেন শাকিল খান। লাহোরে এই দুজনই আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু এবার ইসিবির তীব্র প্রতিবাদের মুখে পিছু হটে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। এই দু’জনের বদলে অন্য দু’জনকে আম্পায়ার নিযুক্ত করে। ড্র হয় এই টেস্ট। প্রথম টেস্ট জেতায় সিরিজ জিতে নেয় পাকিস্তান।
রানা গ্যাটিংয়ের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পুষে রাখেননি। তবে গ্যাটিং যে রেখেছেন, তা তার আচরণেই স্পষ্ট বোঝা যায়। নিজে যে দোষ করেছিলেন, সেটা স্বীকার করেছেন। কিন্তু রানাকে কিছু না বলে শুধু তার কাছ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠি আদায় করে নেয়াটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। গ্যাটিংয়ের ভাষায়,
“আমার জন্য ব্যাপারটা খুব গর্ব করার মতো কিছু ছিল না। এই ঘটনাটা কখনো ভুলবে না কেউ। কাজটা করা ঠিক হয়নি আমাদের। তবে এটাও ঠিক, এরপর থেকেই নিরপেক্ষ আম্পায়ারের দাবিটা আরো জোরালো হয়। এই ঘটনার জের ধরে অধিনায়কত্ব থেকে অপসারণ করা হয় আমাকে। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার মতো সক্ষম থাকলেও, নির্ধারিত সময়ের অন্তত তিন বছর আগেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় আমার।”
এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পরে এক ব্রিটিশ পত্রিকার আমন্ত্রণে লর্ডসে যান রানা। সেখানে দেখা হয় গ্যাটিংয়ের সাথে। ‘এখানেও আপনি?’ বলে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে যান গ্যাটিং।
২০০১ সালে রানা মারা যান। মারা যাওয়ার আগে সাক্ষাৎকারে বলেন,
“যেহেতু আমি ভুল কিছু করিনি, তাই আমার অনুতপ্ত হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। গ্যাটিংয়ের সেই ক্ষমা চেয়ে লেখা চিঠিটা এখনও আমার কাছে আছে। বালিশের নিচে থাকে, ইচ্ছে করলেই বের করে পড়ি।”