১.
প্রথম চার সেট শেষে ম্যাচ দাঁড়িয়ে ২-২ সমতায়, স্বাভাবিক নিয়মেই ম্যাচ গড়ালো টাইব্রেকারে। পঞ্চম সেটে ফেদেরার এগিয়ে গেলেন ৮-৭ গেমে। ১৬ নম্বর গেমে ফেদেরার সার্ভ করছিলেন ২১তম বারের মতো গ্রান্ড স্ল্যামের শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে।
৪০-১৫ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েও ফেদেরার হেরে গিয়েছিলেন গেমটি, শেষতক ম্যাচটিও।
গ্যালারিতে বসে এসব কাণ্ডকারখানা দেখে ইভানিসেভিচ বোধহয় মুচকি হেসে উঠেছিলেন। ফেদেরার পারেননি, ইভানিসেভিচ তো পেরেছিলেন!
পেশাদার টেনিসে তখনও জোকোভিচের পা পড়েনি, নাদালেরও নয়। ফেদেরারই তো কেবল হাঁটতে শিখছেন, পায়ের তলায় মাটি খুঁজে না পেয়ে ফ্রেঞ্চ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালেই হেরে গিয়ে বাদ পড়েছিলেন, বাদ পড়েছিলেন উইম্বলডনেও। গোরান ইভানিসেভিচ সেবছরই উইম্বলডন জিতেছিলেন, ২০০১ সালে। পূর্বের নানা ঘটনায় যে শিরোপা জয় হয়ে উঠেছিল ‘ট্রফি জয়ের চেয়েও বেশি কিছু’!
২.
টেনিসের আদ্যোপান্ত খোঁজ-খবর রাখলে ইভানিসেভিচের সাথে আপনাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। সদ্য সমাপ্ত উইম্বলডনেও যিনি কোচিং করিয়েছেন নোভাক জোকোভিচকে।
ভদ্রলোক পেশাদার টেনিস ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন সেই ১৯৮৮ সালে। যুগোস্লাভিয়াকে ভেঙে ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো জন্ম নেবারও আগে। ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শেষ আট, ১৯৯০ সালে বরিস বেকারকে হারিয়ে ফ্রেঞ্চ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছানো, শুরুর সাপেক্ষে সাফল্য আসছিল বেশ দ্রুতগতিতেই। ১৯৯০ সালের ফ্রেঞ্চ ওপেনে তো পিটার কোরদাকে সাথে নিয়ে পৌঁছেছিলেন ফাইনাল পর্যন্তও।
ওই পৌঁছানো অব্দিই। ট্রফি ছুঁয়ে আর দেখা হয়নি পুরো নব্বইয়ের দশক জুড়ে, ডাবলস কিংবা সিঙ্গেলসে।
৩.
ডাবলসের মঞ্চে প্রথমবার ফাইনাল হারের যন্ত্রণা পেলেও এককেই আক্ষেপে পুড়েছেন বেশি।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৯২ সালের উইম্বলডন দিয়ে। ১৯৯০ সালে প্রথমবার শেষ চারে উঠলেও কোনো গ্রান্ড স্ল্যামের এককের মঞ্চে ফাইনালে উঠেছিলেন সেবারই প্রথম।
১ম, ২য়, এমনকি ৩য় রাউন্ডের বাধাও খুব সহসাই পেরিয়ে প্রথম গেরোতে পড়েছিলেন চতুর্থ রাউন্ডে। ইভান লেন্ডলের মুখোমুখি হওয়া সেই ম্যাচের প্রথম সেটই গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। টাইব্রেকে জিতলেও ইভান লেন্ডল পড়ে গিয়েছিলেন চোটের কবলে। চোটের কারণে পরবর্তীতে লেন্ডল ছেড়ে যান ম্যাচ, ইভানিসেভিচ উঠে যান কোয়ার্টার ফাইনালে।
সেখানে প্রতিপক্ষ ছিলেন তৎকালীন র্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে থাকা সুইডেনের স্টেফন এডবার্গ। পাঁচ সেটে গড়ানো সেই ম্যাচ ৬(১০)-৭(১২), ৭-৫, ৬-১, ৩-৬, ৬-৩ ব্যবধানে জিতে সেমিতে উঠেছিলেন পিট সাম্প্রাসের মুখোমুখি হতে।
আগের চার সাক্ষাতে দু’জনেরই দু’টি করে জয় থাকায় ম্যাচটি হয়ে উঠেছিল এগিয়ে যাবার লড়াই। ২ ঘণ্টা ১২ মিনিট স্থায়ী সে লড়াইতে ৬(৪)-৭(৭), ৭(৭)-৬(৫), ৬-৪, ৬-২ ব্যবধানে জিতে গোরান ইভানিসেভিচ উঠে গিয়েছিলেন উইম্বলডনের ফাইনালে। ৩৭ টি এইস আর প্রথম সার্ভে ৮৬ শতাংশ পয়েন্ট জিতেও ফাইনাল শেষে পরাজিত খেলোয়াড়ের নামটি ছিল গোরান ইভানিসেভিচ। সেই শুরু!
৪.
মাঝে এক আসর বিরতি দিয়ে ১৯৯৪ সালে আবারও ইভানিসেভিচ হাজির ফাইনালে। টুর্নামেন্টের চতুর্থ বাছাই ইভানিসেভিচ ফাইনালে উঠেছিলেন খুব সহসাই। টাইব্রেকের মারপ্যাঁচে পড়তে হয়নি কোনো ম্যাচে, ফাইনালের আগে চতুর্থ সেটই খেলতে হয়েছিল মাত্র একবার।
ফাইনালও গড়ায়নি চতুর্থ সেটে৷ আগেরবারের হারের বদলা নিয়ে পিট সাম্প্রাস ম্যাচ জিতেছিলেন সরাসরি সেটে, ইভানিসেভিচকে ম্যাচ হারিয়েছিলেন ৭(৭)-৬(২), ৭(৭)- ৬(৫), ৬-০ গেমে। ইভানিসেভিচ আক্ষেপে পুড়েছিলেন, আরও একবার!
৫.
১৯৯৪ উইম্বলডনের আগ পর্যন্ত সাম্প্রাসের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে ইভানিসেভিচ এগিয়ে ছিলেন ৪-৩ ব্যবধানে। উইম্বলডনের ফাইনালে হারটা বোধহয় কাজ করেছিল জুজুর মত, নতুবা পরের দশ দেখায় ইভানিসেভিচের একবারমাত্র জয়ী হবার ব্যাখ্যা কী! ১৯৯৫ সালের উইম্বলডন, ১৯৯৬ সালের ইউএস ওপেন কিংবা অন্য যেকোনো এটিপি ট্যুর, জয়ী ওই সাম্প্রাসই।
১৯৯৮ সালের উইম্বলডনের ফাইনালেও তাই যখন আরেকটি সাম্প্রাস-ইভানিসেভিচ দ্বৈরথ উপস্থিত হয়, ম্যাচের ফল নিয়ে ভাবনা সামান্যই থাকে। সেবারে অবশ্য বিনা যুদ্ধে ইভানিসেভিচ ছেড়ে দেননি। প্রথম সেট তো তার পক্ষেই হেসেছিল, ৭(৭)-৬(২) গেমে হারিয়ে ইতিহাস বদলানোর আভাসও মিলেছিল।
কিন্তু ধ্রুবসত্যকে কি আর বদলানোর উপায় থাকে! ২ ঘণ্টা ৫২ মিনিটের ম্যাচশেষে ট্রফি যায় আটলান্টিকের ওপারে। সাম্প্রাসের বাড়ি যে আমেরিকাতে!
আর ৬(২)-৭(৭), ৭(১১)-৬(৯), ৬-৬, ৩-৬, ৬-২ স্কোরলাইনের ম্যাচে পরাজিত হয়ে ইভানিসেভিচ আবারও পুড়েছিলেন ‘এত কাছে, তবু এত দূরে’ আক্ষেপে, বরাবরের মতোই। ম্যাচশেষে ইভানিসেভিচ যে ক্ষণটিকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘জীবনের সবচেয়ে বাজে মুহূর্ত’ হিসেবে।
ইভানিসেভিচ মুষড়ে পড়েছিলেন এতটাই, ম্যাচপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেই বসেছিলেন, ‘আমি আত্মহত্যা করবো।’
৬.
নাহ, ইভানিসেভিচ আত্মহত্যা করেননি। বদলে পড়েছিলেন ইনজুরিতে, জীবন গিয়েছিল বিষিয়ে, জনমানুষের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রেখে ছয় মাস নিজেকে বানিয়েছিলেন একঘরে। টেনিস খেলছিলেন ‘খেলতে হবে’ বলে, আর কোনো কাজ পারেন না বলে!
একসময়ের দুই নম্বর র্যাংকিংধারী প্লেয়ার এমনও বছর কাটাতে শুরু করেছিলেন যে, বছরে ম্যাচ জেতেননি পাঁচটির বেশি। বাজে পারফরম্যান্সের প্রভাব পড়েছিল র্যাঙ্কিংয়ে, ছিটকে পড়েছিলেন একশ’র বাইরে। চিরকালীন নিপাট ভদ্রলোক বলে পরিচিত ইভানিসেভিচ ম্যাচ হেরেছিলেন ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ হয়ে, ম্যাচ চলাকালীন নিজের সবগুলো র্যাকেট ভেঙে ফেলে!
তিনবারের উইম্বলডন ফাইনালিস্ট আর ২১টি এটিপি ট্যুর শিরোপার মালিকের ক্যারিয়ার শেষ হচ্ছিল কোনো গ্রান্ড স্ল্যাম না জিতেই!
৭.
যে উইম্বলডন তাকে বারেবারে আফসোসের সাগরে ডুবিয়েছে, বিদায়টা সেই উইম্বলডনেই নেবেন বলে ভেবেছিলেন ইভানিসেভিচ। এই ঘাসের কোর্টকেই যে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন!
কিন্তু, পারফরম্যান্সের অবনতির কারণে বাছাই হিসেবে ডাক পাওয়াটা নিশ্চিত ছিল না ২০০১ উইম্বলডনে, তখন যে তার র্যাঙ্কিং ১২৫!
শেষ অব্দি করুণা দেখিয়েছিলেন উইম্বলডনের আয়োজকেরা। ইভানিসেভিচের ভালোবাসার মূল্য দিয়ে, অতীত রেকর্ড বিবেচনা করে ইভানিসেভিচকে মূল্য দিয়ে তারা নিশ্চিত করেছিলেন ইভানিসেভিচের ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ প্রাপ্তি। দুঃখিত পাঠক, ভুল বললাম। ওয়াইল্ড কার্ড তো নয়, ও যে ছিল ‘রূপকথার দরজা খোলার চাবি’!
৮.
পড়তি ফর্মে তার নামই সম্ভবত ভুলতে বসেছিলেন দর্শকেরা। তিনি নিজেই কি কিছু আশা করেছিলেন ২০০১ উইম্বলডনে?
কাঁধের চোট, বাজে ফর্ম, শূন্য আত্মবিশ্বাস দিয়ে আর কতদূরই বা যাওয়া যাবে! নিজেকে নিজেই তাই প্রত্যাশার সীমাটা বেঁধে দিয়েছিলেন, অন্তত ১ম রাউন্ড পেরোতে পারলেই হলো!
প্রথম রাউন্ডের প্রতিপক্ষকে তিন সেটেই ৬-৪ ব্যবধানে হারিয়ে সে প্রত্যাশা পূরণও করেছিলেন। তবে সুইডেনের ফ্রেডরিক জনসন ছিলেন এমনই প্রতিপক্ষ, অমন অবস্থাতেও গোরান ইভানিসেভিচের জয় পাওয়াটা কোনো বিস্ময় জাগায়নি।
সেটা জেগেছিল ২য় আর ৩য় রাউন্ডে। প্রথমে র্যাঙ্কিংয়ের ২১ নম্বরে থাকা কার্লোস ময়াকে, পরপরই ভবিষ্যতের তারকা হবার প্রতিশ্রুতি দেয়া অ্যান্ডি রডিককে হারিয়ে শিরোনাম করেছিলেন অঘটনের। কিছুটা এদিক-ওদিক হলেই যে ম্যাচগুলোর বিজয়ী হতে পারতেন অন্যজন!
কিন্তু দর্শকদের জন্য তো আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ঘরের ছেলে গ্রেগরি রুসিস্কিকে চতুর্থ রাউন্ডে খুব সহসাই হারিয়ে ইভানিসেভিচ পৌঁছে গিয়েছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে!
নিজের জয়ের চেয়েও ইভানিসেভিচ বোধ করি খুশি হয়েছিলেন আরেকজনের পরাজয়ে। চতুর্থ রাউন্ডেই বিদায় নিয়েছিলেন পিট সাম্প্রাস, রজার ফেদেরারের কাছে হেরে। সাম্প্রাস-জুজুতে পড়ার ভয়টাই যে আর থাকল না!
৯.
শেষ আটে মুখোমুখি হয়েছিলেন মারাত সাফিনের। যে ম্যাচ কোর্টে গড়াতেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল স্বর্ণালী সময়ের ইভানিসেভিচকে। সার্ভ তার সবসময়ের শক্তি, সেদিন যেন সার্ভগুলো হয়ে উঠেছিল আনপ্লেয়েবল! ম্যাচে এইস মেরেছিলেন ৩০টি। ইভানিসেভিচ ম্যাচ জয় করেছিলেন ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিটে।
রাগে-ক্ষোভে মারাত সাফিন ভাঙতে শুরু করেছিলেন র্যাকেট, ইভানিসেভিচের কাছে ম্যাচ হারাটা যে ছিল চূড়ান্ত অপ্রত্যাশিত!
১০.
সেমিতে প্রতিপক্ষ ছিল আরেক ব্রিটিশ। ব্রিটিশ বলার চেয়ে ‘উইম্বলডনের সন্তান’ বললেই যাকে পরিচয় করিয়ে দিতে সুবিধে হয়, সেই টিম হেনম্যান।
টিম হেনম্যান এর আগেও উইম্বলডনের সেমিফাইনালে উঠেছিলেন দুইবার, দু’বারই নাম লিখিয়েছিলেন পরাজিতের কাতারে। প্রতিপক্ষ বিবেচনায় হেনম্যানের জন্য তাই উইম্বলডনের শেষ অঙ্কে পৌঁছানোর সেরা সুযোগ ছিলো ২০০১ আসরেই। সেই আসরে যে প্রত্যেক ম্যাচই ইভানিসেভিচ শুরু করছিলেন আন্ডারডগ হিসেবে!
প্রথম সেট ইভানিসেভিচ জিতে নিলেও আন্ডারডগ হবার প্রমাণ রাখতে শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় সেট থেকে। টাইব্রেকে দ্বিতীয় সেটে পরাজয়ের পরে ৩য় সেটে হয়েছিলেন রীতিমতো বিধ্বস্ত, হেরেছিলেন ৬-০ সেটে।
ইভানিসেভিচকে এমন বিধ্বস্থ হতে দেখে দর্শকেরাও ধরে নিয়েছিলেন, ইভানিসেভিচের জারিজুরি ফুরিয়েছে। ফাইনালের মঞ্চ নিশ্চিত ভেবে ব্রিটিশ সমর্থকেরা যখন হর্ষধ্বনিতে মত্ত, তখনই বাদ সাধল প্রকৃতি, অঝোরে নামল বৃষ্টি; যে বৃষ্টিকে ইভানিসেভিচ বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের পাঠানো বৃষ্টি!’
বৃষ্টির কারণে পুরো ম্যাচ শেষ হতে সময় লাগল তিনদিন। বল পুনরায় কোর্টে গড়াতেই গ্যালারিভর্তি দর্শক আবিষ্কার করলেন, হেনম্যান ‘মোমেন্টাম’ হারিয়ে ফেলেছেন, ইভানিসেভিচ রূপকথা লিখেই চলেছেন।
পরাজয় থেকে মাত্র দুই পয়েন্ট পেছনে থাকতে, প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে, ৩৫টি এইসে ব্রিটিশদের হৃদয় চূর্ণ করে ইভানিসেভিচ চতুর্থ আর পঞ্চম সেট জিতে নিলেন যথাক্রমে ৭(৭)-৬(৫) আর ৬-৩ ব্যবধানে।
১১.
অল ইংল্যান্ড লন টেনিস ক্লাব কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ওয়াইল্ড কার্ড দেয়াটা সেবারই প্রথম নয়। উইম্বলডনে ওয়াইল্ড কার্ড দেবার এই প্রথা তো চলে আসছে ১৯৭৭ সাল থেকেই, যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। তবে, ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি নিয়ে ইভানিসেভিচের মতো রূপকথার দেশে ঘুরে আসতে পারেননি আর কেউ!
বৃষ্টির কারণে টুর্নামেন্টের বাকি সূচি গিয়েছিল একদিন করে পিছিয়ে৷ পুরুষ এককের ফাইনাল রবিবার হবার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল সোমবারে, ইতিহাসে প্রথম এবং শেষবারের মতো পুরুষ এককের ফাইনাল সোমবার অনুষ্ঠিত হবার কীর্তি হয়েছিল সেবারই। কর্মদিবস থাকা সত্ত্বেও আরেক সেমিতে বিজয়ী অস্ট্রেলিয়ান প্যাট্রিক রাফটার আর ক্রোয়াট গোরান ইভানিসেভিচের খেলা দেখতে অল ইংল্যান্ড ক্লাবে ঝাঁকে ঝাঁকে এসেছিলেন অজি আর ক্রোয়াটরা, যে কারণে ২০০১ সালের ৮ জুলাই পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল ‘জনতার সোমবার’ নামে।
গ্যালারিভর্তি দর্শকের সামনে (যাদের বেশিরভাগই ছিলেন রাফটারের পক্ষে) ইভানিসেভিচ শুরুটা করেছিলেন দুর্দান্ত, ৬-৩য়ে জিতে নিয়েছিলেন প্রথম সেট। পরের সেটে নিজের অ্যাথলেটিসিজমকে কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন রাফটার, তবে তৃতীয় সেট শেষে ইভানিসেভিচই ছিলেন ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে।
চতুর্থ সেটে রাফটার জয়ী হয়ে নিশ্চিত করলেন, ফুটবলের মতো গমগম করা গ্যালারির উত্তেজনা এখনই থামছে না! ইভানিসেভিচও কি থেমেছিলেন?
সেই টুর্নামেন্টে ইভানিসেভিচের পয়েন্ট প্রাপ্তি মানেই ছিল উদ্দাম উল্লাস, আর পয়েন্ট হারানো মানেই ক্ষোভের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ! উইম্বলডন কর্তৃপক্ষের গাম্ভীর্যকে চপেটাঘাত করে টি-শার্ট খুলে ফেলছিলেন ম্যাচশেষে, আম্পায়ারের সাথে বাক-বিতণ্ডাতেও জড়িয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। থেমে যাননি ফাইনালেও, চতুর্থ সেটে একবার তো র্যাকেটকে লাথি মেরেই আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতি নিজের রূষ্টতা জানিয়েছিলেন।
১২.
পোড় খাওয়ার ইতিহাস তো প্যাট্রিক রাফটারেরও ছিলো। উইম্বলডনের আগের আসরেই তো পরাজয় বরণ করেছিলেন ফাইনালে, হন্তারক ছিলেন সেই পিট সাম্প্রাস! ২০০১ সালের আসর তাই রাফটার আর ইভানিসেভিচ, দু’জনের জন্যেই ছিল শেষ সুযোগ। বয়স যে ৩০য়ের ঘরে কড়া নাড়ছিল!
২-২ সমতায় থাকা ম্যাচে তাই দু’জনই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সর্বস্ব দিয়ে, দর্শক দেখেছিলেন দম বন্ধ করা টেনিস ম্যাচের অনুপম প্রদর্শনী। কখনো ইভানিসেভিচ এগিয়ে গিয়েছিলেন ০-৩০ ব্যবধানে, তো সেখান থেকে গেম জিতে নিয়েছিলেন রাফটার, কখনো বা আবার পরাজয় থেকে দুই পয়েন্ট দূরে থাকতে ম্যাচ বাঁচাচ্ছিলেন গোরান। পঞ্চম সেটেও তাই ব্যবধান করা যাচ্ছিল না দু’জনকে। ৪-৪ থেকে ৭-৭, সঙ্গ ছাড়ছিলেন কোথায়! কেউ তো কারও সার্ভিসই ব্রেক করতে পারছিলেন না!
অবশেষে ১৫ নম্বর গেমে, পঞ্চম সেটে প্রথমবারের মতো রাফটারের সার্ভিস ব্রেক করে ইভানিসেভিচ এগিয়ে গিয়েছিলেন ৮-৭ ব্যবধানে। নাটকের শেষ অঙ্কের সেই শুরু!
১৩.
ইভানিসেভিচ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। র্যাকেটটাকে দুই হাতে চেপে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিধাতাকেই কিছু বোঝাতে চাইলেন বোধহয়। ইভানিসেভিচ মুখ ফুটে কিছু না বললেও গ্যালারিতে কিংবা টিভি-পর্দায় চোখ রাখা শত কোটি দর্শক ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন সে অনুভূতি, ‘ঈশ্বর, এবারে অন্তত!’
সার্ভিস সবসময়ই তার শক্তির জায়গা, এমনকি ২০০১ সালের উইম্বলডনে তাকে ‘একমাত্রিক প্লেয়ার’ বলে বাতিলের খাতায় ফেলে দিলেও কিংবদন্তি জন ম্যাকেনরো স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ইভানিসেভিচের সার্ভের আসলেই তুলনা নেই।
সেটার প্রমাণ রাখছিলেন ফাইনালের মঞ্চেও। ১৬ নম্বর গেমে ইভানিসেভিচ এইস মেরেছিলেন দুইটি, এমনকি রাফটার রিটার্ন করেছিলেন আর বল কোর্টে ছিল, এমন ঘটনাও সে সেটে ঘটেছিল মাত্র একবার। তবুও যে তিনবার ডিউস হলো, ইভানিসেভিচকে প্রার্থনায় বসতে হলো, তার কারণ আর কিছু নয়, ইভানিসেভিচকে পেয়ে বসা চাপ। কে জানে, সম্ভবত রূপকথার গল্পগুলো এমনভাবেই লেখা হয়।
কখনো কোর্টের বাইরের বল টেনে এনে রাফটারকে পয়েন্ট উপহার দিচ্ছেন, কখনো ডাবল ফল্ট করে রাফটারকে পয়েন্ট বিলাচ্ছেন, প্রতিপক্ষ রাফটারও নিশ্চিত করেই স্বীকার করবেন, ইভানিসেভিচের কারণেই গেম গড়িয়েছিলো ডিউস অব্দি।
সেখানেও কি কম নাটক? ১ম ডিউসে অ্যাডভান্টেজ হারিয়েও যে রাফটার ম্যাচ হেরে গেলেন না, তাতে তার কোনো হাতই ছিল না। ইভানিসেভিচ যে রাফটারের কোর্টে বলই পাঠাতে পারেননি পরের দুই সার্ভে! ফলাফল, ২য় ডিউস!
২য় ডিউসেও অ্যাডভান্টেজটা ইভানিসেভিচই পেলেন, রাফটারের রিটার্ন পড়েছিল কোর্টের চুল পরিমাণ বাইরে! আর তারপরেই হাঁটু গেড়ে ইভানিসেভিচের সেই বিখ্যাত প্রার্থনা, ধারাভাষ্যকার যার বর্ণনা করেছিলেন এভাবে:
‘He (Ivanisevic) is praying on the point!’
১৪.
বিধাতার কাছে সেই প্রার্থনা পৌঁছাতে আরও একটু সময় লেগেছিল বোধহয়। নইলে ম্যাচ ৩য় ডিউসে গড়াবে কেন! সেটাও তো ইভানিসেভিচের ভুলেই। পুরো কোর্ট খালি থাকতেও বল তুলে দিয়েছিলেন রাফটারের র্যাকেটে, সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিতে রাফটার ভুল করেননি।
কিন্তু দান দান তিন দানে আর ইভানিসেভিচকে ফেরানো যায়নি। রাফটার পারেননি ম্যাচকে আরেকটি ডিউসে গড়াতে। রাফটারের রিটার্ন নেটে ফিরতেই ইভানিসেভিচ কোর্টে শুয়ে পড়লেন, কান্না লুকোতেই হয়তো!
তা আর পারলেন কই! রাফটার আর আম্পায়ারের সঙ্গে হাত মেলাতে হলো, উঠে দৌঁড়ে বাবার সঙ্গে আর বন্ধুদের সঙ্গে গলা মেলাতে হলো, সবই ওই ছলছল চোখেই। ফাঁকেতালে বিধাতাকেও কৃতজ্ঞতা জানাতে হলো। ওয়াইল্ড কার্ড পেয়ে উইম্বলডন জেতার এমন অদ্ভুতুড়ে চিত্রনাট্য তো ওই একজনই লিখতে পারেন!
ইভানিসেভিচ নিজেই তো বলে দিয়েছেন,
‘It was an unsolved mystery how I won!’