ইউরোপের সেরা লিগগুলোর মধ্যে সেরা গোলরক্ষকদের তালিকায় অবশ্যই ডে হেয়া, নয়্যার, স্টেগান, কর্তোয়ার মতো গোলরক্ষকরা অতি পরিচিত মুখ। দলের রক্ষণের অবস্থা যেমনই হোক, যেকোনো ফুটবলভক্ত অনায়াসে এই সময়ের সেরা গোলরক্ষকদের উপর চোখ বন্ধ করে নির্ভর করবে যেকোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই। কিন্তু, অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এই সেরা গোলরক্ষকদের ফর্ম তেমন একটা ভালো যাচ্ছে না। ভালো যাচ্ছে এই অর্থে যে, তাদের নিকট মৌসুমের পারফরম্যান্সের সাথে এখন পর্যন্ত এই মৌসুমের পারফরম্যান্স তুলনা করলে মনে হবে, খানিকটা ফর্মহীনতায় ভুগছেন তারা। যদিও মৌসুমের অর্ধেক সময়ও শেষ হয়নি, মৌসুম শেষে তাদের চেনা ফর্মে দেখা যেতেও পারে। তবে, এখন পর্যন্ত এই গোলরক্ষকদের পরিসংখ্যান তাদের নামের বিচারে ও গত মৌসুমের তুলনায় বেশ ম্লান।
ইউরোপের অন্যতম জনপ্রিয় লিগের সেরা গোলরক্ষকদের একজন, ডেভিড ডে হেয়া দিয়েই শুরু করি। লিগে তার দলের বর্তমান অবস্থান ষষ্ঠ, ১৬ ম্যাচে মাত্র ৭টিতে তারা জয়লাভ করেছে এবং তাদের সামগ্রিক গোল ব্যবধান মাত্র +২! গোল ব্যবধান থেকে সহজে ধারণা করা যাচ্ছে, ইউনাইটেড দলের বর্তমান ফর্ম এবং সেই সাথে দলের গোলরক্ষক ডে হেয়ার ফর্মের বর্তমান অবস্থাও। প্রিমিয়ার লিগের ১৬ ম্যাচের মাত্র ২টিতে কোনো গোল হজম করেনি অর্থাৎ ক্লিন শিট রাখতে পেরেছে ডে হেয়া ও তার দল ম্যানইউ। তর্কের খাতিরে বলা যায়, ক্লিন শিট রাখতে না পারার ব্যর্থতা শুধুমাত্র শুধুমাত্র গোলরক্ষকের উপর বর্তাতে পারে না, এই দায় দলের রক্ষণভাগেরও। রক্ষণের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, ডে হেয়া ছিলেন স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে চারবারই ইউনাইটেডের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
এমনকি গত মৌসুমেই তিনি জিতে নিয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার, যেখানে তার অন টার্গেটে থাকা শট সেভ করার হার ছিল ৮১.৫%। ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় অবস্থানে, তার উপরে ছিলেন শুধুমাত্র অবলাক। এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত স্প্যানিশ এই গোলরক্ষকের সেভ করার হার নেমে এসেছে ৬৯% এর নিচে। গত মৌসুমে ইউনাইটেড গোলরক্ষক ৩৭ ম্যাচের মধ্যে ১৮টি ম্যাচেই ক্লিন শিট বজায় রেখেছিলেন, যা ছিল শতকরা হিসাবে ৪৯% এবং এখন পর্যন্ত এই মৌসুমে এই হার মাত্র ১৫%!
প্রিমিয়ার লিগের পর এবারে চোখ ফেরান যাক ইউরোপের আরেকটি জনপ্রিয় লিগ লা লিগার দিকে। স্পেনের এই লিগের সেরা দল রিয়াল মাদ্রিদের বেলজিয়ান গোলরক্ষক কর্তোয়ার ফর্মের গ্রাফও নিম্নমুখী। লিগে ১৩ ম্যাচে তার ক্লিন শিট ৫টি এবং সেভ করার হার প্রায় ৬২.৫%। অথচ প্রিমিয়ার লিগেই চেলসির হয়ে এই বেলজিয়ানের সেভ করার হার ছিল ৭০.৪%। জাতীয় দলের হয়েও তেমন একটা সুসময় যাচ্ছে না এই গোলরক্ষকের। উয়েফা নেশনস লিগের শেষ ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের কাছে তার দল হেরেছে ৫-২ গোলের বড় ব্যবধানে।
লা লিগা ও নেশনস লিগে তার ম্যাচ প্রতি গড় সেভ যথাক্রমে ২.৬ ও ২.৫। কর্তোয়ার দল, রিয়াল মাদ্রিদ বর্তমানে লিগ তালিকার চতুর্থ অবস্থানে এবং শীর্ষে থাকা বার্সেলোনা থেকে মাত্র পাঁচ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছে। সামগ্রিক দিক দিয়ে যে দলের পারফরম্যান্স খুব একটা ইতিবাচক নয়, তা রিয়ালের প্রতিপক্ষের জালে গোল দেওয়া (২৩) ও গোল হজম (১৯) করার পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে।
লা লিগার পয়েন্ট তালিকায় থাকা বার্সেলোনার গোলরক্ষক স্টেগানের পারফরম্যান্স অবশ্য এই মৌসুমে বিগত মৌসুমের তুলনায় বেশ নিম্নমুখী। ২২ গোল ব্যবধান নিয়ে শীর্ষে থাকা বার্সায় স্টেগানের ফর্মের পতন তেমন একটা না যে সমস্যার সৃষ্টি করছে না তা অনুমেয়। কিন্তু গত মৌসুমে ৭৬.৬% অন টার্গেট শট ঠেকানো জার্মান গোলরক্ষকের এই মৌসুমের সফলতার হার মাত্র ৬৪.২%। লিগের ১৫ ম্যাচের মধ্যে স্টেগান ও বার্সার ক্লিন শিট মাত্র ৪টি ম্যাচে অর্থাৎ ক্লিন শিটের হার মাত্র ২৬.৭%। এত কম ক্লিন শিট নিয়েও বার্সার লিগ তালিকার শীর্ষে থাকার অন্যতম কৃতিত্বের দাবিদার তাদের দুর্দান্ত আক্রমণভাগ।
ইউরোপের বড় লিগগুলোর গোলরক্ষকদের লক্ষ্যে থাকা শট ঠেকানোর গড় হার প্রায় ৬৯%। ইতোমধ্যে আলোচিত অন্য সেরা গোলরক্ষকদের মতো শট ঠেকানোর হার এই গড়ের নিচে না নামলেও, এই মৌসুমে অবলাকের পারফরম্যান্স গত মৌসুমের তুলনায় যথেষ্ট হতাশাজনক। গত মৌসুমেই তার সেভ করার হার ছিল ৮৫.৮%, যা চলতি মৌসুমের এই সময়ে নেমে এসেছে ৭৬.৯% এ। অন্যদিকে চেলসির বর্তমান গোলরক্ষক কেপার এই মৌসুমে অন টার্গেট শট ঠেকানোর হার ৬৯% এর আশেপাশে হলেও, গত মৌসুমেই এই হার ছিল শতকরা ৭২ ভাগের উপরে।
আলোচিত গোলরক্ষকদের মধ্যে এই মৌসুমে সবচেয়ে বাজে ফর্ম যাচ্ছে বিশ্বকাপজয়ী বায়ার্নের জার্মান গোলরক্ষক নয়্যারের। নয়্যার তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় পার করছেন। এমনকি, ইউরোপের সেরা লিগগুলোর গোলরক্ষকদের মধ্যে নয়্যারের পরিসংখ্যান সবচেয়ে নিচের দিকে। জার্মান এই কিংবদন্তির ফর্মের সাথে খারাপ সময় যাচ্ছে তার ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখেরও। লিগে দলটি তালিকার তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এবং শীর্ষে থাকা ডর্টমুন্ডের সাথে তাদের ব্যবধান ৯ পয়েন্ট।
নয়্যারের ফর্মের সাথে তার দলের অবস্থানও বেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলা চলে। লিগের ১৪ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৩টিতে কোনো গোল হজম করেনি তার দল। বরাবরের মতো যদি প্রশ্ন ওঠে যে, গোল হজমের দায় একা গোলরক্ষকের নয়, তাহলে এক্ষেত্রে নয়্যারের পক্ষে পরিসংখ্যান কথা বলছে না। লিগে তার দলের বিপক্ষে অন টার্গেটের সংখ্যা সবচেয়ে কম হলেও এখন পর্যন্ত ১৮ বার বল বায়ার্নের জালে জড়িয়েছে। এই মৌসুমে নয়্যারের সেভ করার হার মাত্র ৪৩.৮%, যা ইউরোপের সেরা লিগগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন তালিকার অন্যতম। নয়্যার তিনজনের ছোট তালিকার একজন, ইউরোপে এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত যাদের হাত গলে সবচেয়ে বেশি গোল হয়েছে। নয়্যারের মতো একজন গোলরক্ষকের সাথে এই পরিসংখ্যান বড় বেশি বেমানান। লিগে ম্যাচ প্রতি নয়্যারের সেভ সংখ্যা মাত্র ১.২টি!
নয়্যারের ফর্মহীনতার বিবর্ণ রূপ ফুটে উঠেছে উয়েফা নেশনস লিগ থেকে জার্মানির বিদায়েও, চার ম্যাচে একটিও না জিতে এই আসর থেকে বিদায় নিয়েছে তার জাতীয় দল। যদিও বেশ দীর্ঘ একটা সময় ইনজুরির সাথে লড়াই করেছেন নয়্যার, তবে তার পারফরম্যান্সের এতটা পতন হয়তো কোনো ফুটবলভক্তই আশা করেনি, যেখানে বুন্দেসলিগায় তার শেষ মৌসুমে লক্ষ্যে থাকা শট ঠেকানোর হার ছিল ৭৯.৭%।
চলতি মৌসুমের অর্ধেক সময়ও পার হয়নি, আলোচিত গোলরক্ষকদের প্রত্যেকে কিংবা বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই হয়তো মৌসুম শেষ করবেন সেরাদের তালিকায় থেকে। কারণ, ইউরোপের সেরা গোলরক্ষকদের ছোট তালিকায় তারা নিজেদের সেরা প্রমাণ করেছেন আগেই। তবুও, তুলনামূলক ফর্মের পতন সংশ্লিষ্ট ক্লাব ভক্তদের কপালে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও চিন্তার ভাজ ফেলবে।