২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮। দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের ফাইনালে শক্তিশালী ভারতের মুখোমুখি সাকিববিহীন বাংলাদেশ। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ সেই ম্যাচে শেষ বলে বাংলাদেশ হারলেও পুরো ক্রিকেটবিশ্বকে চমকে দিয়েছিল তরুণ বাংলাদেশী ওপেনার লিটন কুমার দাস। পাঁঁচবারের এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন ভারতের বোলারদের তুলোধনা করে খেলেছিলেন ১১৭ বলে ১২১ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। ফাইনালে বাংলাদেশ হারলেও ম্যাচ সেরার পুরষ্কারও জিতেছিলেন লিটন দাসই। আর এই ম্যাচের পরই বাংলাদেশ ক্রিকেট খুঁজে পায় এক আত্মবিশ্বাসী ও ধারাবাহিক লিটন দাসকে।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের নিয়মিত ওপেনার লিটন কুমার দাসের জন্ম ১৯৯৪ সালের ১৩ই অক্টোবর দিনাজপুর শহরে। দিনাজপুর শহরেই বেড়ে ওঠা লিটনের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে রংপুর বিভাগের হয়ে। ২০১২ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন লিটন। ঠিক ২ বছর পরের ২০১৪ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে মাত্র ৪ ম্যাচে ২৩৯ রান করে সবার নজর কেড়েছিলেন তিনি।
২০১৪-১৫ জাতীয় ক্রিকেট লিগে রংপুর বিভাগের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে সিংহভাগ অবদানই ছিল লিটন দাসের। ৭ ম্যাচে ৫ সেঞ্চুরিসহ ৮৫.৩৩ গড়ে করেছিলেন ১,০২৪ রান। একই বছর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে হয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। উড়ন্ত ফর্মে থাকা লিটন দাস ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় লিটনের। উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে সুযোগ পাওয়া লিটন ভারত টেস্টের প্রথম ইনিংসেই দলের বিপর্যয়ের সময় ৪৪ রানের একটি চোখ ধাঁধানো ইনিংস খেলেন। ৮ চার ও ১ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি ছিল এককথায় অসাধারণ। জুনেই ভারতের ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ৭৮ রান করেন। এরপরেই জাতীয় দলের নিয়মিত ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু হয় লিটনের।
২০১৫ সালের শেষের দিকে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-সাউথ আফ্রিকার ওয়ানডে সিরিজে দল সাফল্য পেলেও লিটন ছিলেন অনুজ্জ্বল। ৩ ওয়ানডে ও ২ টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে তার সর্বমোট রান ছিল মাত্র ৫৪। একই বছরের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সফরে আসে জিম্বাবুয়ে। ৩ ওয়ানডে ও ১ টি-টোয়েন্টিতে লিটন দাসের মাত্র ৪১ রান সেবার কড়া সমালোচনার মুখেই ফেলেছিল তাকে। ফলে ২০১৬ সালের শুরুতে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ৪ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ এবং এশিয়া কাপের দলেই জায়গা হয়নি তার। একই বছরে ভারতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ দলে জায়গা পাননি লিটন।
২০১৬-১৭ মৌসুমে বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। এবারেও ফেরার চেষ্টায় পুরোপুরি ব্যর্থ লিটন। ফলে ২০১৭ এর শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফরেও জাতীয় দলে ডাক পাননি তিনি। এরকম একটা সময়ে জাতীয় দলে ফেরার পথটা লিটনের জন্য একটু সহজ করে দেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম। ২০১৭ এর মার্চে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত টেস্ট সিরিজে মুশফিক পূর্ণাঙ্গ ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার সিদ্ধান্ত নিলে লিটনকে দলে নেওয়া হয় উইকেটকিপার হিসেবে। কিন্তু ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় একটি টেস্ট ম্যাচ খেলার পরেই আবারও দল থেকে ছিটকে পড়েন।
এরপর টানা ৬ মাস জাতীয় দলের বাইরে থাকার পর সেপ্টেম্বরে সাউথ আফ্রিকা সিরিজে জাতীয় দলে সুযোগ মেলে লিটনের। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে দলের বিপর্যয়ের সময়ে লিটনের ৭৭ বলের ৭০ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস কিছুটা হলেও ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজে আবারও ব্যর্থ লিটন; ৩ ম্যাচ ও ১ টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ৫০ রান করেন। ২০১৭-১৮ মৌসুমে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে খেলেন লিটন দাস। টুর্নামেন্টে তার দল চ্যাম্পিয়ন হলেও দলের হয়ে বিশেষ কোনো অবদান রাখতে পারেননি লিটন। ১২ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ২৭৮ রান।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে-আফগানিস্তান ত্রিদেশীয় সিরিজে তার ওপর আস্থা রাখতে পারেনি ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচক প্যানেল। জুনে ভারতে অনুষ্ঠিত আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে দলে ডাক পান লিটন এবং এই সিরিজেই প্রথমবার জাতীয় দলে ওপেনার হিসেবে খেলেন এবং সিরিজে ৩ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ৪৪ রান। একই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজে দল চরম বিপর্যের মুখে পড়ে; লিটনের ব্যাট থেকে আসে ৮২ রান। পরে ওয়ানডে দলে জায়গা না পেলেও ওই সফরেরই টি-টোয়েন্টি সিরিজে দেখা গিয়েছিল বেশ আত্মবিশ্বাসী লিটনকে। ৩ ম্যাচে তার ১৪৬.৫৫ স্ট্রাইক রেটে করা ৮৫ রান দলকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতাতে রেখেছিল বিরাট ভূমিকা। মূলত এই ম্যাচের পর থেকেই শুরু হয় লিটনের ঘুরে দাঁড়ানো।
২০১৮ এর সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসে এশিয়া কাপের দ্বাদশ আসর। আসরের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের সময় হাতে চোট পাওয়ায় টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়েন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নির্ভরযোগ্য ওপেনার তামিম ইকবাল। ফলে ব্যাটিংয়ের গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে লিটনের ওপর। তবুও গ্রুপ পর্বে আফগানিস্তানের ম্যাচ বাদে প্রায় সব ম্যাচেই অনুজ্জ্বল ছিল লিটনের ব্যাট। ২৯ তারিখের ফাইনালে হঠাৎ করেই সবাইকে চমকে দিয়ে লিটন তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। তার সেঞ্চুরির ওপর ভর করেই সেদিন ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপ জয়ের খুব কাছাকাছি গিয়েছিল বাংলাদেশ। এশিয়া কাপের ইতিহাসে এই প্রথমবার রানার আপ দল থেকে তিনি হয়েছিলেন ম্যান অফ দ্য ফাইনাল। একই বছরের অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে খেলেছিলেন ম্যাচজয়ী ৮৩ রানের ইনিংস। ২০১৮ এর নভেম্বরে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন লিটন দাস।
এখন পর্যন্ত লিটন দাসের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে দারুণ সময় হচ্ছে ২০১৯ সাল। এ বছরেই তিনি ব্যাট হাতে দলকে এনে দিয়েছেন বেশ কিছু সাফল্য। যদিও বছরের শুরুতে দলে জায়গা করে নেওয়াটাই ছিল তার জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। নিউজিল্যান্ড সফরে পুরোপুরি ব্যর্থ লিটন দাস আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ-আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে সুযোগ পান মাত্র এক ম্যাচে।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচেই খেলেছিলেন ৬৭ বলে ৭৬ রানের ম্যাচজয়ী এক ইনিংস। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি। বিশ্বকাপের একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে কোচ ও নির্বাচকদের নজরে আসেন আরো একবার। তবুও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম তিন ম্যাচে সেরা এগারোয় সুযোগ হয়নি লিটনের। ১৭ জুন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচের মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপে অভিষেক হয় লিটনের, এবং ওই ম্যাচেই খেলেছিলেন ৬৯ বলে ৯২ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। ৪ ছক্কা ও ৮ চারের ওই ইনিংসের ওপর ভর করেই ৩২২ রানের অসম্ভব প্রায় স্কোর তাড়া করে সেদিন জয় পায় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের বাকি চার ম্যাচে তিনি করেন ৯০ রান।
লিটন দাস বিপিএলের চলতি মৌসুমে খেলছেন রাজশাহী রয়্যালসের হয়ে। ১৫ ম্যাচে ৪৫৫ রান করে টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। পুরো টুর্নামেন্টে আফিফ হোসেনের সাথে তার ওপেনিং জুটির দৃঢ়তা দলকে এনে দিয়েছে প্রথমবারের মতো বিপিএলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।
এখন পর্যন্ত লিটন দাস ১৮টি আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ খেলে ২৪ গড়ে করেছেন ৭৪৪ রান। ওয়ানডেতে লিটনের রান ২৪.৭৭ গড়ে ৭৬৮। টি-টোয়েন্টিতে লিটনের ১৩৮.০৬ স্ট্রাইক রেটই বলে দিচ্ছে ব্যাট হাতে কতটা বিধ্বংসী হতে পারেন ডানহাতি এই ওপেনার। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ২৫ ম্যাচে ১৯.৮৮ গড়ে করেছেন ৪৬৭ রান; সর্বোচ্চ ৬১ রান এসেছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তিনি ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই দেবশ্রী বিশ্বাসের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে সাফল্য নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা লিটন দাসের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরুটা ছিল ব্যাপক চ্যালেঞ্জিং। ধারাবাহিকতার অভাবে বারবার জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়া লিটন সেই অবস্থা থেকে ফিরে এসে এখন দেশের ক্রিকেটের সেসব উজ্জ্বল নক্ষত্রেরই একজন, যাদের চোখে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে ২০২৩ বিশ্বকাপ জয়ের।