বিশ্বকাপ – যেকোনো খেলাতেই সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার আসর। সারা বিশ্বে খেলাটার সাথে সম্পর্কযুক্ত সব খেলোয়াড়, বিশেষজ্ঞ কিংবা দর্শকরা এই আসরটার জন্য যেন উন্মুখ হয়ে থাকে। খেলোয়াড়রাও চায় এই টুর্নামেন্টে নিজেদের সেরাটা দিতে। যেহেতু টুর্নামেন্টটাতে হাইপ অনেক বেশি থাকে, তাই চাপটাও স্বাভাবিকভাবে অনেক বেশি হয়। এই চাপের কারণে অনেক সময়েই অসাধারণ খেলোয়াড়রাও নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারেন না।
১৯৭৫ সাল থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর শুরু হলেও সিরিজসেরার পুরষ্কারটা দেওয়া হচ্ছে ১৯৯২ সাল থেকে।
শোনা যাক বিশেষ সেই খেলোয়াড়দের কিছু গল্প।
১৯৯২ বিশ্বকাপের চমক: মার্টিন ক্রো
সেই বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ১টি শতরান আর ৪টি অর্ধশত রানের সাহায্যে তার সংগ্রহ ছিল টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ৪৫৬ রান। সেই টুর্নামেন্টে তার চাইতে বেশি ৫০+ ইনিংস আর কোনো ব্যাটসম্যান খেলতে পারেননি। গড় ছিল ১১৪, যা কি না টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড় পিটার কার্স্টেনের (৬৮.৩৩) চাইতে ঢের এগিয়ে। ন্যূনতম ২২৫ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মাঝে তার স্ট্রাইকরেটের (৯০.৮৩) চাইতে বেশি ছিল কেবল ইনজামাম-উল হকের (৯৩.৭৫), যদিও তার গড় মাত্র ২২.৫০। সব মিলিয়ে কেবলমাত্র অবিশ্বাস্য ব্যাটিং পারফরম্যান্সের কারণেই তিনি টুর্নামেন্টসেরা হবার জোরালো দাবিদার।
তবে সেই বিশ্বকাপে ব্যাটিং বাদেও মার্টিন ক্রো কিছু চমক দেখিয়েছিলেন। সাধারণ একটা দল নিউ জিল্যান্ডকে করে ফেলেছিলেন অজেয়। সেই সময়ে প্রতিটি দলের লক্ষ্য ছিল প্রথম দিকে উইকেট ধরে রেখে শেষ ১০-১৫ ওভারে রান তোলার চেষ্টা করা। কিন্তু মার্ক গ্রেটব্যাচকে পিঞ্চ হিটার হিসেবে ব্যবহার করে ক্রো ক্রিকেট খেলার ধরনটাকেই পাল্টে দিয়েছিলেন। ৭ ম্যাচে ৩টি হাফসেঞ্চুরির সাহায্যে ৪৪.৭১ গড় আর ৮৭.৯২ স্ট্রাইক রেটের সাহায্যে ৩১৩ রান করে ক্রো’র পরিকল্পনাটাকে বেশ ভালোভাবেই সফল করেছিলেন গ্রেটব্যাচ। শুধু এদিকেই নয়, দলের বোলিং সাইডেও মার্টিন ক্রো কাজ করেছিলেন। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি যাওয়ার পর থেকে নিউজিল্যান্ডে সেভাবে কোনো ফাস্ট বোলার উঠে আসছিল না। ক্রিস কেয়ার্নস আর ড্যানি মরিসনের সাথে গেভিন লারসন, ক্রিস হ্যারিসদের মতো মিডিয়াম পেসারদেরকে নিয়ে পরিকল্পনা করলেন। উইকেট নিতে না পারলেও হালকা সুইং কিংবা বাড়তি বাউন্সের সমন্বয়ে এমনভাবে বল করতেন এই বোলাররা, যাতে ব্যাটসম্যান বিগ শট নিতে না পারেন। এছাড়া বড় জুয়া খেলেছিলেন অফ স্পিনার দীপক প্যাটেলকে নিয়েও।
স্পিনারদের মূল কাজটা শুরু হয় বল কিছুটা পুরনো হয়ে যাবার পর। নতুন পিচ্ছিল বলে পেসাররা সুবিধে পেলেও স্পিনারদের বল গ্রিপ করতেই সমস্যা হয়। কিন্তু ক্রো ম্যাচের শুরুতেই বল তুলে দিলেন দীপক প্যাটেলের হাতে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্যাটেলও অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিলেন চমৎকারভাবে। ৯ ম্যাচে ৮টি উইকেট নিলেও তার মূল কাজ ছিল রান নিয়ন্ত্রণ করা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্যাটারসনের ১ ম্যাচে ১০ ওভার বল করে ২৫ রান দেওয়ার হিসেব বাদ দিলে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ইকোনোমিক্যাল বোলার ছিলেন প্যাটেলই (৩.১০)।
সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে হেরে গেলেও ব্যাটিংয়ে ঠিকই খেলেছিলেন ৮৩ বলে ৯১ রানের একটা দুর্দান্ত ইনিংস। ইনজুরির জন্য মাঠের বাইরে চলে না গেলে সেই ম্যাচটাতে হয়তো নিউ জিল্যান্ডই জিততো, এমন ভাবনা ভাবার মানুষের অভাব নেই। সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়ায় কোনো বিতর্কই নেই তাই।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ: সনাৎ জয়াসুরিয়া
৬ ইনিংসে করেছেন ৩৬.৮৩ গড়ে করেছেন মাত্র ২২১ রান, সেই বিশ্বকাপে তার চাইতে বেশি রান করেছেন আরো ১৬ জন। সর্বোচ্চ রান ৫২৩, করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। বল হাতে উইকেট পেয়েছিলেন ৩৩.০০ গড়ে ৭টি উইকেট। তার চাইতে বেশি উইকেট পেয়েছিলেন আরো ১৪ জন। সবচেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছিলেন অনিল কুম্বলে, ১৫টি।
পরিসংখ্যানের আলোকে খুবই সাদামাটা। তবে সূক্ষ্মভাবে দেখলে জয়াসুরিয়ার প্রভাবটা ছিল অন্যরকম। সেই টুর্নামেন্টে ন্যূনতম ৮০ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মাঝে তার স্ট্রাইকরেটই ছিল সর্বোচ্চ (১৩১.৫৪)। ভারতের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচে ৭৬ বলে ৭৯ রানের একটা ইনিংস খেলে শচীন টেন্ডুলকারের ১৩৭ রানের মহাকাব্যিক রানকেও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পরাজিতের দলে। মনোজ প্রভাকরের মতো খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারও সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল জয়াসুরিয়ার তোপে পড়ে। তবে আসল চমকটা দেখালেন কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৯৬ সালের প্রেক্ষাপটে ২৩৫ রান নিশ্চিত জেতার মতো স্কোর না হলেও লড়াই করার মতো অবশ্যই। কিন্তু জয়াসুরিয়ার তান্ডবে মাত্র ৪০ ওভারেই রানটা টপকে গেল শ্রীলংকা।। জয়াসুরিয়া করলেন ৪৩ বলে ৮২ রান। সেই সময়ের কম বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙতে জয়ার প্রয়োজন ছিল ১৮ বলে ১৮ রান।
বোলিংয়ে প্রথমে খুব ভালো কিছু করতে না পারলেও কাজের কাজটা করেন শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বিপদের দিনেই। ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়লেও অরবিন্দ ডি সিলভার কল্যানে ২৫১ রানের একটা লড়াকু স্কোর দাঁড় করায় শ্রীলঙ্কা। তবে শচীন টেন্ডুলকারের দৃঢ় ব্যাটিংয়ে একটা সময় স্কোরটাকে খুব স্বল্পই মনে হচ্ছিল। সাবলীল খেলতে থাকা ৬৫ রান করা শচীনকে আউট করে ভারতকে ধাক্কা দেবার কাজটা করেন জয়াসুরিয়াই। এরপর ক্রিজে জমে যাওয়া মাঞ্জরেকার এবং আগের ম্যাচেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ঝড়ো ইনিংস খেলে নায়ক বনে যাওয়া অজয় জাদেজাকে লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে বল পিচ করে অসাধারণভাবে বোল্ড করে ভারতকে ম্যাচ থেকে ছিটকে ফেলার কাজটা করেন জয়াসুরিয়াই। সেই ম্যাচে সিধু আর নয়ন মঙ্গিয়ার ক্যাচটাও ধরেন জয়াসুরিয়া।
ফাইনাল ম্যাচে ব্যাটিংয়ে সুবিধা করতে না পারলেও স্টুয়ার্ট ল’র উইকেট নেবার পাশাপাশি দুই ওপেনার মার্ক টেইলর এবং মার্ক ওয়াহর ক্যাচটা ধরেন। সব মিলিয়ে দলের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অবদান রাখার পাশাপাশি ক্রিকেটকে পাল্টে ফেলতে একটা অবদান রাখায় টুর্নামেন্টসেরার পুরষ্কারটা জয়ার হাতেই উঠে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ: ল্যান্স ক্লুজনার
সেই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা টপ ফেভারিট হিসেবেই টুর্নামেন্ট শুরু করেছে। টুর্নামেন্টের বাকি দুই ফেভারিট ছিল পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা সহজেই জিতে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এর মাঝেও ক্লুজনার তার ফর্মের একটা ঝলক দেখান। ৪ বলের ইনিংসে পরপর ৩টি চার মেরে ম্যাচ শেষ করে ফিরেন।
গ্রুপের পরবর্তী ম্যাচ ছিল শ্রীলঙ্কার সাথে। সেই ম্যাচে মুরালির ঘূর্ণিতে ১২২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে আফ্রিকা। সেখান থেকে ক্লুজনার দলকে ম্যাচে ফেরান ৪৫ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলে। শেষ ব্যাটসম্যান ডোনাল্ডকে নিয়ে ৩৩ রানের একটি জুটি করেন, যার মাঝে ডোনাল্ডের অবদান ছিল মাত্র ৩ রান। লো স্কোরিং ম্যাচে বোলিংয়ে ৩ উইকেট নিয়ে আফ্রিকাকে জিতিয়ে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন ক্লুজনার।
পরের ম্যাচেও একই দৃশ্য। ইংল্যান্ডের সাথে ১৪৮ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে ২০০ রানের কমে অলআউট হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু ৪০ বলে অপরাজিত ৪৮ রান করে পথ হারানো দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার পথ দেখান ক্লুজনার। দল পায় ২২৫ রানের মাঝারি একটি পুঁজি। পরে বোলিংয়ে ১ উইকেট নিয়ে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন ক্লুজনার।
কেনিয়ার সাথে পরের ম্যাচেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ তিনি। এবার অবশ্য ব্যাটিং করতে হয়নি, বল হাতেই তুলে নেন ৫ উইকেট। জিম্বাবুয়ের সাথে পরের ম্যাচে বোলিংয়ে পান ১ উইকেট। ব্যাটিংয়ে ক্লুজনার ৫২ রান করে অপরাজিত থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ হারে।
তবে প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সেই বিশ্বকাপের অন্যতম টপ ফেভারিট পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় সুপার সিক্স পর্বে। সেই ম্যাচে ২২০ রান তাড়া করতে গিয়ে ৫৮ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বোলিং লাইনআপ ছিল দুর্দান্ত; দুই শতাধিক রান করে তারা হারবে, এটা ভাবাই যেত না। ওয়াসিম, সাকলাইন, শোয়েব আখতারের সাথে আজহার মাহমুদ আর আবদুর রাজ্জাক; বোলিং লাইনআপটা ছিল দারুণ। কিন্তু অমন বোলিংকেও ছিন্নভিন্ন করে ম্যাচ বের করে নেন সেই একজন, ল্যান্স ক্লুজনার। ৪১ বলে ৪৬ রান করে অপরাজিত থাকার পথে ওয়াসিম আর শোয়েবকে দু’টি বিশাল ছয় মারেন তিনি। সাথে বোলিংয়ে ১টি উইকেট পাওয়ায় ম্যান অফ দ্য ম্যাচ আবারও ক্লুজনার।
পরের ম্যাচ ছিল নিউ জিল্যান্ডের সাথে। সেটাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সেভাবে বিপদে পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সুপার সিক্সের ম্যাচেও ক্লুজনার ২১ বলে ৩৬ রান করেন। কিন্তু সেই ম্যাচে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকার।
তবে মূল ম্যাচটা হয় অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেমিফাইনালে। মাত্র ২১৪ রানের টার্গেটে নেমে ৬১ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্লুজনার যখন মাঠে নামেন, তখন ১৭৫ রানে ৬ উইকেট নেই। সবচেয়ে বড় কথা, শেন ওয়ার্ন তখন তার জীবনের অন্যতম সেরা ফর্মে বোলিং করছেন। উইকেট নেই, আস্কিং রানরেট বাড়ছে- এমন অবস্থায় তাকে ছেড়ে চলে গেলেন পোলক, তখন রান ১৮৩। এরপর মার্ক বাউচার যখন আউট হলেন, তখন ক্লুজনার বুঝে গেলেন, যা করার তাকে একাই করতে হবে। ৪৯তম ওভারের ৪র্থ বলে ম্যাকগ্রাকে উড়িয়ে মারলেন। ক্যাচ হয়ে যেত, কিন্তু টানটান মুহূর্তের স্নায়ুচাপে পড়ে পল রেইফেল মিস করে সেটিকে ছয় বানিয়ে দিলেন। গোটা ম্যাচের অনেক চড়াই-উৎড়াইয়ের পরে শেষ ওভারে দরকার হয় ৯ রান, হাতে তখন উইকেট ১টি।
স্ট্রাইকে ক্লুজনার থাকায় সেই পরিস্থিতি সামলানোর সম্ভাবনা তখনও বেশ ভালোভাবেই ছিল। ফ্লেমিংয়ের প্রথম বলেই একটা চার মারলেন তিনি, আর দরকার ৫ বলে ৫। দ্বিতীয় বলে আরেকটা চার মারলেন। মাঠে থাকা সব অস্ট্রেলিয়ানরা মুখে হাত দিয়ে নিশ্চুপ। আর মাত্র একটি রান, তাহলেই বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ডোনাল্ড নিজের ভুলে রানআউট হয়ে গেলেন। ক্লুজনার ১৬ বলে ৩১ রানে অপরাজিত থাকার পরও ম্যাচ টাই হলো। টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী, আগের মুখোমুখি লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া জয়ী থাকার কারণে টাই হওয়ার পরও দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ পড়ে যায়। কিন্তু ট্রাজিক হিরো হিসেবে সমগ্র বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করে নেন ক্লুজনার।
২০০৩ বিশ্বকাপ: মাস্টার ব্লাস্টার শচীন
সেই টুর্নামেন্টে ভারত হেরেছিল মাত্র ২টি ম্যাচে, ২টাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। একটা গ্রুপপর্বে, আরেকটা ফাইনালে। ভারত রানার্সআপ হলেও পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই শচীন তার ঝলক দেখিয়েছিলেন। ১১ ইনিংসে করেছেন ৬৭৩ রান, সেই বিশ্বকাপে অন্য কোনো ব্যাটসম্যান ৫০০ রানের কোটাই পার করতে পারেননি। এমনকি বিশ্বকাপের এক আসরে এটাই সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ড।
গ্রুপপর্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭৫ বলে ৯৮ রানের ইনিংসটা দুই অঙ্কের ইনিংসের মাঝে সর্বকালের সেরার খুব সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও জায়গা পেয়ে যাবে। সুপার সিক্সে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯৭ রান এবং সেমিফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে ৮৩ রানের ইনিংসটাও ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফাইনালটাও হয়তো শচীনের হতো। কিন্তু প্রথমে ব্যাট করে ৩৫৯ রানের স্কোর গড়ে ম্যাচটা কার্যত প্রথম ইনিংসের পরেই শেষ করে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
ফাইনালে ব্যর্থ হলেও টুর্নামেন্টসেরার স্বীকৃতি যায় শচীনের ঘরে।
২০০৭ বিশ্বকাপ: গ্লেন ম্যাকগ্রা
সেই টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ খেলেছিল ১১টি, তার মাঝে ৯টি ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে অলআউট করেছিল। যে দুইটি ম্যাচে অলআউট করতে পারেনি, সেই দুটো ম্যাচ হয়েছিল কার্টেল ওভারের। আর অস্ট্রেলিয়ার এই বিধ্বংসী বোলিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। কোনো ইনিংসেই ৩টির বেশি উইকেট পাননি, কিন্তু কোনো ম্যাচে উইকেটবিহীনও থাকতে হয়নি। সবচেয়ে কঠিন লড়াইয়ের সম্ভাবনা ছিল সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ম্যাকগ্রার তোপে পড়ে মাত্র ১৪৯ রানেই অল আউট হয়ে ম্যাচটাকেই ম্যাড়ম্যাড়ে বানিয়ে ফেলে দক্ষিন আফ্রিকা।
টুর্নামেন্টে ম্যাকগ্রা পান ২৬টি উইকেট, যা বিশ্বকাপের এক আসরে সবচেয়ে বেশি উইকেট পাওয়ার রেকর্ড।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম কোনো স্পেশালিষ্ট বোলার পেলেন সিরিজসেরার পুরষ্কার। এছাড়া টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ডও ম্যাকগ্রার।
২০১১ বিশ্বকাপ: লড়াকু যুবরাজ
ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ হওয়ায় সবার প্রত্যাশা ছিল, শিরোপাটা ভারতের ঘরেই যাবে। তবে গ্রুপপর্বে শুরুটা তেমন দাপুটে হয়নি। বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয় পেলেও ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বড় স্কোর গড়েও জয় না পাওয়াটা তাদেরকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে ফেলে। তবে এর মাঝেও যুবরাজ সিংহ ব্যাট-বল দুই দিকেই তার ফর্ম বজায় রাখেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়ার পাশাপাশি অপরাজিত ৫০ রানের ইনিংস খেলে পরিণত হন বিশ্বকাপের ইতিহাসে একই ম্যাচে ৫ উইকেট এবং ৫০ রান করা একমাত্র খেলোয়াড়।
তবে একজন গ্রেট খেলোয়াড়ের শুধুমাত্র ভালো খেললেই চলে না, ভালো খেলতে হয় দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের দিনে। দলের বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারাটা একটা বিশেষ কৃতিত্ব। সেই কাজটা করলেন কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। অস্ট্রেলিয়ার ২৬০ রান তাড়া করতে গিয়ে মাত্র ১৪৩ রানেই ভারতের ৩ উইকেট পড়ার পর ক্রিজে নেমেছিলেন যুবরাজ। নামার কিছুক্ষণ পরই আউট হয়ে গেলেন গম্ভীর আর ধোনিও। ব্রেট লি তখন উইকেটে আগুন ঝড়াচ্ছেন। এই অবস্থায় অপরাজিত ৫৭ রানের একটা ইনিংস খেলে সুরেশ রায়নাকে নিয়ে ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন যুবরাজ।
সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে ফ্লপ ছিলেন। কিন্তু সেই ব্যর্থতা পুষিয়ে দেন বোলিংয়ে। আউট করেন সেট হয়ে যাওয়া আসাদ শফিক এবং পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ইউনিস খানকে। ফাইনাল ম্যাচেও আউট করেন সাঙ্গাকারা এবং সামারাবীরাকে।
৮ ইনিংসে ১টি শতক আর ৪টি অর্ধশতকের কল্যাণে ৯০.৫০ গড়ে ৩৬২ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নেন ১৫টি উইকেট। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ৪টি ম্যাচে।
২০১৫ বিশ্বকাপ: মিচেল স্টার্ক
এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট পাওয়ার রেকর্ড গ্লেন ম্যাকগ্রার। তবে ম্যাকগ্রার মতো ১১টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে রেকর্ডটা ভেঙে ফেলা স্টার্কের জন্য হয়তো কঠিন হতো না। সেক্ষেত্রে বাকি ৩ ম্যাচে তাকে শিকার করতে হতো মাত্র ৫টি উইকেট। টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচেই উইকেট পাওয়া স্টার্ক যেমন ফর্মে ছিলেন, তাতে রেকর্ড ভাঙতে না পারাটাই হতো বিস্ময়ের। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে ন্যূনতম ২২ উইকেট পেয়েছেন, এমন খেলোয়াড়ের মাঝে তার গড় (১০.১৮) এবং স্ট্রাইকরেটই (১৭.৪১) সবচেয়ে ভালো।
গ্রুপপর্বে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৫১ রানের সংগ্রহ নিয়েও তাদের ৯ উইকেট ফেলে দেবার পেছনে মূল কৃতিত্ব ছিল স্টার্কের ৬ উইকেট প্রাপ্তি। এই রকম দুর্ধর্ষ পারফর্মের পরও ম্যাচ হারাটা হয়তো তার পছন্দ হয়নি। ফাইনালে প্রতিপক্ষ পেলেন আবারও নিউ জিল্যান্ডকে। এবার আর ভুল করেননি। প্রথম ওভারেই আউট করে দিয়েছিলেন ফর্মে থাকা বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান ম্যাককুলামকে। এরপর আর ফিরতে পারেনি নিউ জিল্যান্ড।
টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট নিয়ে ম্যান অফ দ্য সিরিজ হলেন স্টার্কই।