ফার্নান্দো সান্তোস নাকি জোয়াখিম লো? রোনালদো-ব্রুনো ফার্নান্দেজের পর্তুগাল নাকি ক্রুস-মুলারের জার্মানি? এবারের অন্যতম দুই শিরোপার দাবিদার মুখোমুখি হচ্ছে আজ রাত দশটায়। মিউনিখের অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই ম্যাচ দুই দুলের জন্যই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ম্যাচে পর্তুগাল জয় তুলে নিলেও তাদের লক্ষ্য থাকবে আজকের ম্যাচ জিতেই শেষ ১৬ নিশ্চিত করা। অন্যদিকে প্রথম ম্যাচ হারের পর স্বাগতিক জার্মানদের জন্য এটি অবশ্য ডু-অর-ডাই ম্যাচ। তাই আজ ফুটবলপ্রেমীরা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে এক দারুণ উত্তপ্ত ম্যাচ। চলুন ম্যাচের আগে দেখে আসা যাক দুই ইউরোপিয়ান জায়ান্টের ট্যাকটিকস, সম্ভাব্য ফর্মেশন ও অন্যান্য।
মুখোমুখি পরিসংখ্যান
পর্তুগাল ও জার্মানি এখন পর্যন্ত মুখোমুখি হয়েছে সর্বমোট ১৮ বার। তাতে জার্মানির জয় ১০টি, আর পর্তুগালের জয় ৩টিতে। বাকি ৫ ম্যাচ ড্র। তবে দুই দলের সর্বশেষ মুখোমুখি আরো ৭ বছর আগে; ব্রাজিল বিশ্বকাপে। সেবার মুলারের হ্যাটট্রিকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল পর্তুগিজ বাহিনী, পেপে দেখেছিলেন লাল কার্ড। এবার নিশ্চয়ই পর্তুগাল চাইবে না তার পুনরাবৃত্তি হোক। সেক্ষেত্রে পর্তুগালের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে ২০০০ সালের ইউরো। সেবার জার্মানিকে তারা হারিয়েছিল ৩-০ গোলে। সেই থেকে ‘ডাই মানশাফট’দের বিপক্ষে আর জয় নেই পর্তুগালের।
পর্তুগালের পারফরম্যান্স
বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের এইবারের ইউরো যাত্রা শুরু হয়েছিল হাঙ্গেরির বিপক্ষে। গতবারের গ্রুপপর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল, ঠিক সেখান থেকেই যাত্রা শুরু রোনালদো’র পর্তুগালের। সেবার ৩-৩ গোলে ম্যাচটি ড্র হলেও এইবার হাঙ্গেরির দর্শকদের সামনেই ৩-০ জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে পর্তুগিজ বাহিনী। তবে তার জন্য বেশ কাঠখড়ও পোড়াতে হয়েছে বৈকি ফার্নান্দো সান্তোসের শিষ্যদের। ৮৪ মিনিট পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল গোলের জন্য। রাফায়েল গুরেরোর পর রোনালদোর জোড়া গোলে বেশ ভালোভাবেই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে তারা। পুরো ম্যাচে সপ্রতিভ না থাকলেও রোনালদোসুলভ ভঙ্গিতেই কামব্যাক করে জয়ের মূল নায়ক ছিলেন রোনালদো।
এদিন দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার দানিলো আর কারভালহোকে নামিয়েছিলেন ফার্নান্দো সান্তোস। তবে বদলি নেমে দুর্দান্ত খেলেছেন রাফা সিলভা ও রেনাতো সানচেজ। মূলত ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন এই দুইজনই। জোড়া অ্যাসিস্টও করেছেন রাফা সিলভা। সেক্ষেত্রে রেনাতো সানচেজকে কারভালহোর জায়গায় দেখা যেতে পারে শুরু থেকেই।
জার্মানির পারফরম্যান্স
হার দিয়ে শুরু হয়েছে জার্মানির ইউরো-যাত্রা। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের কাছে তারা হেরেছে হামেলসের একমাত্র আত্মঘাতী গোলে। তবে স্কোরলাইন অবশ্য বলবে না, জার্মানি ঠিক কতটুকু অসহায় ছিল পুরো ম্যাচ জুড়ে। বল বেশি ধরে রাখা ছাড়াও চান্স ক্রিয়েশনেও এগিয়ে ছিল জার্মান-বাহিনী। কিন্তু ফাইনাল থার্ডের ব্যর্থতায় ফ্রান্সের রক্ষণদূর্গে তেমন কোনো আতঙ্কই সৃষ্টি করতে পারেনি তারা।
অন্যদিকে জার্মানির রক্ষণভাগকে পুরো সময় ধরে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছেন এমবাপে-বেনজেমারা। সেজন্য দলে বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। হাভের্টজ আর নাব্রির জায়গায় আসতে পারেন টিমো ভার্নার ও লেরয় সানে। ম্যাথিয়াস জিন্টারের জায়গায় রক্ষণে এমরি চানের খেলার সম্ভাবনাও প্রবল। আর মাঝমাঠে পরিবর্তন হলে গুণ্ডোয়ানের জায়গায় আসতে পারেন গোরেৎজকা, ইনজুরি কাটিয়ে সদ্যই দলে ফিরেছেন তিনি।
পর্তুগালের ফর্মেশন ও ট্যাকটিকস
গত ম্যাচের মতোই একই ফর্মেশনে নামলেও ট্যাকটিকসে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারেন ফার্নান্দো সান্তোস। দুই হোল্ডিং মিডফিল্ডার খেলানোর কারণে হাঙ্গেরির বিপক্ষে পর্তুগাল ফাইনাল থার্ডে ক্লিয়ার কাট চান্স পেয়েছে মোটে দুইটি। সেজন্য উইলিয়াম কারভালহোর জায়গায় রেনাতো সানচেজের ম্যাচে শুরু থেকেই খেলার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে বিগত ম্যাচগুলো ঘাঁটলে দেখা যায়, বড় দলগুলোর বিপক্ষে ‘রক্ষণ আগে সামলাও’ নীতিতে দেখা গিয়েছে পর্তুগিজদের। সেক্ষেত্রে দুই হোল্ডিং মিডফিল্ডার নিয়ে খেললেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেটির আগাম ইঙ্গিত অবশ্য প্রেস কনফারেন্সে দিয়েছেন সান্তোস।
“শেষ ম্যাচে জার্মানি ম্যাচের শেষের দিকে অনেক লং বল খেলে দ্রুত আক্রমণে উঠছিল। সে জিনিসটাই আমাদের বেশ ভালোভাবে করতে হবে।”
সান্তোস বলছিলেন সংবাদ সম্মেলনে। তবে কাজটা আসলে করতে হবে ব্রুনো ফার্নান্দেজকেই। সামনে রোনালদোকে লক্ষ্য রেখে যদি ব্রুনো ফার্নান্দেজ নিজের কাজটা ঠিকঠাকভাবে করতে পারেন, তাহলে পর্তুগালের জয়ের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে অনেক।
এমবাপের গতি বেশ ভুগিয়েছিল জার্মানদের। প্রতি-আক্রমণে খেলা পর্তুগাল গতি কাজে লাগিয়ে একই ফায়দা তুলে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে সান্তোসের তুরুপের তাস হতে পারেন জোয়াও ফেলিক্স। পাশাপাশি দুই ফুলব্যাক সেমেদো ও গুরেরো বেশ ছন্দে রয়েছেন। গুরেরো তো এই ইউরোতে পর্তুগালের প্রথম গোলটিও করলেন। অন্যদিকে ক্যান্সেলোর অভাব এতটুকুও বুঝতে দেননি সেমেদো। আজ এই দুই ফুলব্যাকের কাজ থাকবে থ্রি-ব্যাকলাইন ডিফেন্সে খেলা জার্মানির দুই ফ্লাংক ব্যতিব্যস্ত রাখা।
পাশাপাশি পর্তুগালের রক্ষণেরও বড় পরীক্ষা দিতে হবে এই ম্যাচে। বিশেষ করে গুরেরো বনাম সানের রাইট ফ্লাংকে লড়াইটা বেশ উপভোগ্যই হওয়ার কথা।
সম্ভাব্য একাদশ
রুই প্যাট্রিসিও, রাফায়েল গুরেরো, রুবেন দিয়াজ, পেপে, নেলসন সেমেদো, দানিলো পেরেইরা, রেনাতো সানচেজ, দিয়েগো জোটা, ব্রুনো ফার্নান্দেজ, বার্নার্ডো সিলভা, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
জার্মানির ফর্মেশন ও ট্যাকটিকস
অন এবং অফ দ্য বল ভালো খেললেও জার্মানরা মার খেয়েছে মূলত দুই জায়গায়। প্রথমত ফাইনাল থার্ডে তাদের খেলা মোটেই জার্মান-সুলভ ছিল না। প্রথাগত স্ট্রাইকার ছাড়া খেলতে নামার খেসারত দিতে হয়েছিল তাদের ম্যাচ হেরে। সর্বমোট ১০টি শট নিলেও গোলবারে ছিল মাত্র ১টি শট। সেক্ষেত্রে আজ হাভের্টজের জায়গায় ভার্নারকে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দ্বিতীয়ত এমবাপের গতির সাথে তাল না মিলাতে পেরে বারবার প্রতি-আক্রমণে ধরাশায়ী হচ্ছিল জার্মানি। অথচ নিজেরা প্রতি-আক্রমণে যাওয়ার সময় সেই গতিময় ফুটবল খেলতে পারেনি জোয়াখিম লো’র শিষ্যরা। সেই ক্ষেত্রে রাইট ফ্লাঙ্কে সানেকে দেখা যেতে পারে এই ম্যাচে। অন্যদিকে গুন্দোয়ানের জায়গায় গোরেৎজকা ফিরছেন, ফলে রক্ষণভাগ নিয়ে কিছুটা হলেও চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন জোয়াখিম লো।
মাঝমাঠে বরাবরের মতোই দুর্দান্ত ছিলেন ক্রুস আর কিমিখ। তবে ফাইনাল থার্ডে মুলারের সাথে লিংকআপ টা ঠিক জুতসই হচ্ছিল না। লো’র মাথা ব্যাথার কারণ হতে পারে এটিই। তবে সেই লিংকআপ ক্লিক করলেই বড় পরীক্ষা দিতে হতে পারে রুবেন দিয়াজ ও পেপেকে।
অন্যদিকে থ্রি লাইন ডিফেন্স থেকে জোয়াখিম লো চারজনের ডিফেন্সে যাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিন্তু প্রতি- আক্রমণে খেলা পর্তুগাল এই জায়গাতে ভোগাতে পারে জার্মানিকে। তবে সে ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব নিতে হবে প্রথম ম্যাচেই ‘খলনায়ক’ বনে যাওয়া হামেলসকে। কারণ, রোনালদোকে আটকানোর দায়িত্ব থাকবে তারই কাঁধে।
সম্ভাব্য একাদশ
ম্যানুয়েল নয়্যার, ম্যাট হামেলস, অ্যান্তোনিও রুডিগার, এমরি চান, জশুয়া কিমিখ, লিওন গোরেৎজকা, টনি ক্রুস, রবিন গোসেনস, টমাস মুলার, লেরয় সানে, টিমো ভার্নার।
ম্যাচ ট্রিভিয়া
-
নিজেদের শেষ ২৭ ম্যাচের ২৫ টিতেই গোল পেয়েছে জার্মানি। যে দুই ম্যাচে পায়নি, তার মধ্যে একটি হলো কয়েকদিন আগে হওয়া ফ্রান্সের বিপক্ষে খেলা সেই ম্যাচ।
-
নিজেদের সর্বশেষ সাত ম্যাচে হার নেই পর্তুগালের।
-
প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে শেষ চার দেখায় প্রতিটিতেই জার্মানির সাথে হেরেছে পর্তুগাল। এই চার ম্যাচে জার্মানি গোল করেছে ১১টি, বিপরীতে হজম করেছে মাত্র ৩টি।
-
জার্মানদের বিপক্ষে ক্যারিয়ারে কোনো গোল নেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর।
এই মহারণের আগে পর্তুগাল কিছুটা নির্ভার থাকলেও জার্মানির জয় ব্যতীত অন্য কিছুই মাথায় নেই। সেক্ষেত্রে চাপ কিছুটা হলেও থাকবে জার্মান শিবিরে। তবে চাপের মুখে জার্মানদের চেয়ে কে-ই বা আর ভালো খেলতে পারে! সর্বশেষ নজির তো রাশিয়া বিশ্বকাপেই সুইডেনের সাথে ম্যাচটি। তাই দুই শিরোপাপ্রত্যাশী দুই দলের এক জমজমাট লড়াইয়ের অপেক্ষায় ফুটবলপ্রেমীরা।