২৬ আগস্ট, ২০১০। লর্ডসের আকাশ অন্য দশদিনের মতোই ঝকঝকে ছিল। একটু পর শুরু হবে ইংল্যান্ড-পাকিস্তান চার ম্যাচ টেস্ট সিরিজের শেষটি। এ পর্যন্ত ইংল্যান্ড ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে। সিরিজ বাঁচাতে পাকিস্তানের ‘মাস্ট উইন’ গেইম। ক্যাপ্টেন সালমান বাট টস জিতে ফিল্ডিং নিলেন। তাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাল – কিছুক্ষণ পরই একটা মিথ্যে অভিনয় শুরু করতে হবে যে!
প্রথম ইনিংসের তৃতীয় ওভারের প্রথম বল। মোহাম্মদ আমিরের ওভারস্টেপ করা বলটিকে ‘নো’ কল করলেন আম্পায়ার বিলি বাউডেন। একই কাণ্ড দশম ওভারের শেষ বলে, তবে এবার বোলার ভিন্ন, মোহাম্মদ আসিফ।
হ্যাঁ, সেই আসিফ, যার নাম শুনতেই স্মৃতির মানসপটে ভেসে ওঠে একজন ফিক্সারের মুখ, যিনি ‘জেন্টলম্যানস গেইম’কে কলুষিত করেছিলেন। ‘ক্রিকেটের মক্কা’-খ্যাত লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড সাক্ষী হয়েছিল ক্রিকেট ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়টির সাথে।
প্রিয় পাঠক, আমরা আজ কথা বলব ফিক্সিংয়ের অপরাধে ৭ বছর (পরে যদিও আংশিকভাবে শিথিল করা হয়েছে) নির্বাসনে থাকা পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ আসিফকে নিয়ে। ওয়াসিম-ওয়াকার পরবর্তী যুগে যাকে ‘ফাইনেস্ট পেসার’ ধরা হয়েছিল। কিন্তু অন দ্য ফিল্ড – অফ দ্য ফিল্ডে একের পর এক বিতর্ক যাকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে।
ক্যারিয়ারের শুরু যেভাবে
মোহাম্মদ আসিফের জন্ম ১৯৮২ সালের ২০ ডিসেম্বর, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে। একটি ক্রিকেটপাগল জাতি হিসেবে তার রক্তেই মিশে ছিল ক্রিকেট। প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন খান রিসার্চ ল্যাব, ন্যাশনাল ব্যাংক কোয়েটার হয়ে। সেখানে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় দলের টিকেট পেয়ে যান। বাকিটা পথ ছিল সাফল্য এবং বিতর্কে মোড়ানো। নিন্দুকের নিন্দা পারফর্ম করে আটকে দিয়েছেন ঠিক, কিন্তু এটিই শেষ অব্দি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা এবং পাকিস্তানি – একজন জাত পেস বোলারের অন্যতম পরিচায়ক হলেও সিম পজিশন এবং স্পিড যেন সায় দিচ্ছিল না। ১৩০-এর আশেপাশে বোলিং করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সার্ভাইভ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে ছিল অনাস্থা।
যা-ই হোক, আসিফের শুরুটা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে, সাল ২০০৫। তৎকালীন ‘সুপার পাওয়ার’ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৮ ওভার বল করে ৭২ রান দিয়ে থেকেছেন উইকেটশূন্য। এমন সাদামাটা পারফরম্যান্স দেশের বাইরে তার কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। অভিষেক ম্যাচের পর দ্বিতীয় ম্যাচটি খেলতে খেলতে লেগে যায় পুরো একটি বছর। ততদিনে আসিফ আরো পরিণত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন
মার্চ, ২০০৬। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তানের আরেকটি দ্বৈরথ। ফয়সালাবাদে ২য় টেস্টে দলে জায়গা পেয়ে সুবিধা করতে পারেননি আসিফ। ৩৪ ওভার বল করে ১০৩ রান দিয়ে পেয়েছেন একটি উইকেট।
তৃতীয় টেস্ট, করাচি ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। সিরিজ-নির্ধারনী শেষ ম্যাচ। ভারতের ব্যাটং লাইনআপে শেবাগ-দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ-শচীন-সৌরভদের কম্বিনেশন একটা নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে দলটিকে। প্রথম ইনিংসে ৭৮ রানে ৪ উইকেট পাওয়ার পর ২য় ইনিংসে ৪৮ রানে ৩ উইকেট নেন আসিফ। পাকিস্তান ম্যাচ জিতে নেয় ৩৪১ রানে, সেই সাথে সিরিজও। শেবাগ-লক্ষণ-শচীনদের ক্লিন বোল্ড করে দিয়ে স্পটলাইট নিজের দিকে টেনে আনেন ‘দ্য ম্যাজিশিয়ান অব দ্য বল’।
সে বছরটা আসিফের স্বপ্নের মতো কাটতে থাকে। এর পরের সিরিজেই শ্রীলংকায় ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করেন। এর পরের বছরের শুরুতে সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৩ ম্যাচ টেস্ট সিরিজে ১৯ উইকেট নিয়ে সিমিং কন্ডিশনে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন। এছাড়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম উইকেট মেইডেনের কৃতিত্বও তার।
বিতর্ক কথন
বিতর্ক এবং একজন আসিফ – একই বৃন্তে দু’টি ফুল যেন। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ অবধি ছিলেন বিতর্কিত। এর সূত্রপাত ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে ‘০৬ সালের টেস্টের মধ্যে দিয়ে। উইকেট পেয়ে আবেগের বাঁধ হারানো উদযাপনের জন্য ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড কর্তৃক তিরস্কৃত হন, ফাইন দিয়ে এ যাত্রায় বেঁচে যান।
মোহাম্মদ আসিফের প্রবল সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার যে কারণে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তা হচ্ছে – ড্রাগ। যদিও নানা সময়ে মেডিসিন বা ভিটামিন বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, শেষমেশ ‘০৬ এর ১৬ই অক্টোবর নিষিদ্ধ ড্রাগ ন্যান্ড্রোলন নেওয়ার কারণে তার আরেক সতীর্থ শোয়েব আখতারসহ তাকে ২ বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয় (যদিও তা পরে কমিয়ে আনা হয়)। ২০০৮ এর জুনে দুবাই এয়ারপোর্টে আবার গ্রেফতার হন একই অভিযোগে। ড্রাগের নেওয়ার অপরাধে আরো অনেকবার সাময়িক নিষেধাজ্ঞা বা শাস্তির সম্মুখীন হন।
এরপরের বিতর্কটা আরো গুরুতর। ‘০৭ এর ক্যারিবিয়ান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে গুঞ্জন ওঠে, সতীর্থ শোয়েব আখতারের সাথে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে শোয়েব তাকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করেন। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের তদন্তে শোয়েব অভিযুক্ত হন এবং পাঁচ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন। পরে শোয়েবের সেবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা হয়নি। এ ঘটনার পর থেকে তাদের মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
এরপর আসে লর্ডস টেস্ট, সাল ২০১০। মোহাম্মদ আসিফের ক্যারিয়ার শেষ হয় সবচেয়ে বড় বিতর্ক দিয়ে। জুয়াডি মাজহার মাজিদের প্রি-প্ল্যানড ট্র্যাপে পা দিয়ে একটি সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার শেষ করে দেন আসিফ। তৎকালীন অধিনায়ক সালমান বাট ও মোহাম্মদ আমিরের সাথে তাকেও নির্বাসনে পাঠায় ট্রাইব্যুনাল। ২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আইসিসির অ্যান্টি-করাপশান ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।
খসে পড়া এক ধ্রুবতারা
বিশ্বক্রিকেটে মোহাম্মদ আসিফের আবির্ভাব সাদামাটা হলেও শেষের আগ পর্যন্ত ছিল রঙিন। লর্ডসের টেস্ট চলাকালীন টেস্ট বোলিং র্যাঙ্কিংয়ে ডেল স্টেইনের পরই তিনি ছিলেন। লেজি লিথাল অ্যাকশন, উইকেটের দু’দিকে সুইং করানোর সক্ষমতা তাকে অনন্য করে তুলেছিল। বিশ্বের বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করতে ওস্তাদ মানুষটি হেরে গেছেন এথিকসের কাছে। এ যেন মিটিমিটি করে জ্বলা নক্ষত্রের নীরব প্রস্থান।
ক্যারিয়ার স্ট্যাটিসটিক্স দেখলে আসিফকে আহামরি ভাবার কিছু নেই। ৩৮ ওয়ানডেতে ৪৬ উইকেট, কিংবা ১১ টি-টোয়েন্টিতে ১৩ উইকেট তার লিথ্যাল বোলিংকে বর্ণনা করতে পারে না। তবে ২৩ টেস্টে প্রায় ২৪ গড়ে, ১০৫ উইকেট কিছুটা হলেও প্রশান্তি দেয়।
বিশ্বকাপ এবং ভাগ্য
২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে তার আরেক সতীর্থ শোয়েব আখতারসহ বাদ পড়ে যান আসিফ। পিসিবির বরাতে পাওয়া যায়, তারা সন্দেহ করছেন, আসিফ আনফিট। ‘১১ বিশ্বকাপটা খেলা হয়নি স্পট ফিক্সিংয়ে অভিযুক্ত হয়ে নিষিদ্ধ থাকায়। দুটো বিশ্বকাপেই পাকিস্তানের এক্স-ফ্যাক্টর হতে পারতেন তিনি।
দ্য ম্যাজিশিয়ান অফ দ্য বল
মডার্ন ক্রিকেটের অন্যতম পথিকৃৎ হাশিম আমলার মতে,
“আমার ফেস করা সবচেয়ে কঠিন বোলার মোহাম্মদ আসিফ। আমি মনে করি, অনেকে এ ব্যাপারে আমার সাথে একমত হবেন যে, হি ওয়াজ দ্য ম্যাজিশিয়ান অফ দ্য বল।”
নিঃসন্দেহে আসিফ একজন ম্যাজিশিয়ান ছিলেন। এক দুর্ভাগা জাদুকর। সেদিনের লর্ডসের ঝকঝকে আকাশ তার জন্য গভীর অন্ধকার হয়ে এসেছিল, এনেছিল বিশ্ব ক্রিকেটের জন্যও। শৈল্পিক বোলিংয়ের মুন্সিয়ানা যিনি দেখিয়েছিলেন হ্যামেলিনের সেই বাঁশিওয়ালার মতো, সেই ক্রিকেট ইতিহাস তাকে আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন ক্রিকেটের ইডিপাস।
ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ