মেসি-রোনালদো দুজনেই যদি রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনার হয়ে খেলতেন, তাহলে সেই দলের সাফল্য কোন পর্যায়ে যেত একটু ভাবুন তো? এবার আসা যাক মূল বিষয়ে। বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বের সেরা দুই ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্স এবং বিরাট কোহলি। সম্প্রতি এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডি ভিলিয়ার্সকে ক্রিকেটের মেসি উপাধি দিয়েছেন বিরাট নিজেই। অন্যদিকে বিরাটকে ক্রিকেটের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বলেছেন ক্যারিবিয়ান তারকা ক্রিকেটার ডোয়াইন ব্রাভো। তবে যদি তাই-ই হয় তাহলে ক্রিকেটের মেসি এবং রোনালদো যখন একই দলে, তাহলে দলটির কেন এই হাল?
কমলা জার্সির দল নেদারল্যান্ডসের কথা একবার মনে করা যাক। তিন তিনবার বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে হেরেছে দলটি, কিংবা ক্রিকেটের দক্ষিণ আফ্রিকা। দল দুটির সাথে অনেক সাদৃশ্য পাবেন আইপিএলের অন্যতম এক ফ্রাঞ্চাইজি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ক্রিকেট লিগ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরকে যদি ক্রিকেটের দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা ফুটবলের নেদারল্যান্ডস বলা হয়, তাহলে কিন্তু একটুও ভুল হবে না। খেলার মাঠে তারা যেন সমানভাবে চোকিং করতে পছন্দ করে। একগুচ্ছ তারকা খেলোয়াড় দিয়ে দলটি ঠাসা, কিন্তু তিন তিনবার ফাইনাল খেলেও আইপিএলের শিরোপা ছোঁয়া হয়নি দলটির।
শিরোপা যেন তাদের কাছে মরীচিকা। দলটি সাজাতে টিম ম্যানেজমেন্ট কম টাকা ঢালেনি। কিন্তু ঐ যে, সাফল্য কিছুটা প্রজাপতির মতো। দেখতে মনে হবে তাকে ছোঁয়া সহজ, কিন্তু ধরতে গেলে বুঝবেন তাকে ধরাটা কত কঠিন।
ফিরে যাওয়া যাক ২০০৭ সালে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম আসরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে ৫ রানে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় ভারত। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এবং ললিত মোদির প্রচেষ্টায় ভারতের শীর্ষস্থানীয় ৮টি শহরের নামে পরের বছর ভারতের মাটিতে বসে আইপিএলের প্রথম আসর। ১১১.৬ মিলিয়ন ডলারে ব্যাঙ্গালোরের ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনে নেন ভারতের অন্যতম অ্যালকোহল ব্যবসায়ী বিজয় মালিয়া। নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল চ্যালেঞ্জের সাথে মিল রেখে দলটির নাম রাখেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। দলটির প্রথম আসরে ছিলেন অনিল কুম্বলে ও রাহুল দ্রাবিড়। আরো ছিলেন সেই বছর অনুর্ধ ১৯ বিশ্বকাপ জেতা ভারতীয় দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। অধিনায়ক করা হয় ঘরের ছেলে দ্রাবিড়কে। পয়েন্ট টেবিলের ৭ম স্থান নিয়ে টুর্নামেন্টের ১ম আসর শেষ করে ব্যাঙ্গালোর।
সে বছর মুম্বাই হামলার ফলে পরের বছরে দেশের মাটিতে আইপিএল অনুষ্ঠিত হওয়াটা হুমকির মুখে পড়ে। ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণে আইপিএলের ম্যাচগুলো সরিয়ে নেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। ফাইনালে তৎকালীন হায়দ্রাবাদ ফ্যাঞ্চাইজি ডেকান চার্জার্সের মুখোমুখি হয় ব্যাঙ্গালোর। গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলোতে ভাল করলেও ফাইনালে গিয়ে ৬ রানে হারে ব্যাঙ্গালোর।
উত্তেজনার খেলা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট, যেখানে ব্যাটসম্যানদের ধুমধারাক্কা চার-ছক্কার পাশাপাশি থাকে বোলারদের আগুন ঝরানো বোলিং, ফিল্ডারদের দুর্দান্ত সব ক্যাচ, আর তার সাথে চিয়ার লিডারদের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির উল্লাস নৃত্য। বিনোদনের যেন এক সম্পূর্ণ প্যাকেজ। আবার আপনার সমর্থিত দলটি যদি জিতে যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের হাজারো ভক্তের কাছে নিজেদের প্রিয় দলের হার দেখাটা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসুন দলটির ব্যর্থতা নিয়ে একটু কাটাছেড়া করা যাক।
১. অধিনায়কত্ব
২০০৮ সালে দলটির নেতৃত্ব ছিল রাহুল দ্রাবিড়ের ওপর। পরের বছর দলটিকে নেতৃত্ব দেন ইংরেজ খেলোয়ার কেভিন পিটারসেন। দলকে তোলেন ফাইনাল পর্যন্ত। ২০১৩ সাল থেকে দলকে নিয়মিত নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারত জাতীয় দলের বর্তমান অধিনায়ক বিরাট কোহলি।
প্রশ্ন হতে পারে, একজন খেলোয়ার হিসেবে বিরাট যতটা সফল এবং দায়িত্বশীল, একজন অধিনায়ক হিসেবে ঠিক ততটাই দায়িত্বশীল তো? তার অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে একবার ভাবুন দলটিতে তার অবদান, তার পরিশ্রম, ম্যাচ হারের পর তার করুণ চেহারা। এই তো কিছুদিন আগের কথা, অরেঞ্জ ক্যাপ নিতে গিয়ে বিরাটের দিব্যি স্বীকারোক্তি, “আপনি যদি ম্যাচ জেতাতে না পারেন তবে এই ক্যাপের মূল্য আপনার কাছে কিছুই না”।
কথাটার আড়ালেই লুকিয়ে আছে বিরাটের ভেতরের চাপা কষ্ট। নিজের ব্যক্তিগত অর্জনের চাইতে নিজের দলের একটা জয় যে বিরাটের কাছে আরো বেশি মূল্যবান। ২০০৮-১৫ পর্যন্ত যার নামের পাশে কোনো টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি ছিল না, সে-ই ২০১৬ সালে এসে করলো চার চারটি সেঞ্চুরি। টুর্নামেন্ট শেষে তার নামের পাশে ৯৭৩ রান। একা হাতে দলকে তুললেন ফাইনালে। অবশ্য দারুণ সমর্থন পেয়েছিলেন ডি ভিলিয়ার্সের কাছ থেকেও। কিন্তু ফলাফল আবারো তাদের বিপক্ষে।
কথায় বলে, “হিস্টোরি রিপিটস ইটসেলফ”। ২০০৯ সালের ফাইনাল ২০১৬-তে এসে আবার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। সেবার ছিল ডেকান চার্জার্স আর এবার সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ। একজন অধিনায়ক ও খেলোয়াড় হিসেবে নিজের দলকে সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিরাট। তাহলে সুযোগ কোথায় তার অধিকায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার? তাই বলে তাকে একজন খুব ভালো অধিনায়কও কিন্তু আমরা বলতে পারি না। সেই সাথে ধোনির অধিনায়কত্বের সাথে বিরাটের অধিনায়কত্বের তুলনা করতে যাওয়া সেটা নিছক বোকামি ছাড়া কিছুই না।
২. ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা
আসরের শুরু থেকে এই পর্যন্ত দলটিতে খেলেছেন ক্রিকেট বিশ্বের বহু তারকা ব্যাটসম্যান। খেলেছেন গেইল, দিলশান, ক্যালিসদের মতো তারকারা। তারকা ব্যাটসম্যান সমৃদ্ধ দলটিতে ব্যাটিং ব্যর্থতা একদমই মানা যায় না। তাই বলে সেরা ব্যাটসম্যানরা যে মাঝে মাঝে ব্যর্থ হবেন না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে কি ব্যাপারটা এমন যে তারা প্রয়োজনের সময়ে জ্বলে উঠতে পারেন না?
বর্তমানে দলটিতে আছেন বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা তিন ব্যাটসম্যান- বিরাট কোহলি, এবি ডি ভিলিয়ার্স ও ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। তবে কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে মাত্র ১৪৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৪১ রানেই থেমে যায় ব্যাঙ্গালোরের ইনিংস। ৫ রানের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে হায়দ্রাবাদ। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হতেই পারে দলের ব্যাটিং লাইন আপের ব্যর্থতা নিয়ে। প্রয়োজনের সময়েই যেন বোবা হয়ে থাকে তাদের ব্যাট।
৩. বোলারদের ব্যার্থতা
আচ্ছা বলুন তো, একটি দলের সফলতার পেছনে কার অবদান বেশি, দলটির ব্যাটসম্যানদের, নাকি বোলারদের?
উত্তরটা হবে এমন যে, তাদের উভয়ের অবদান মোটেও সমান হতে পারে না। ধরে নিলাম, তাদের উভয়ের অবদানই সমান। কিন্তু দুই শতাধিক রান করেও কোনো দল যখন হেরে যায়, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতেই পারে দলটির বোলারদের নিয়ে। এক্ষেত্রে দলের ব্যর্থতায় দায় কিন্তু বোলারদের উপর বর্তায়। চেন্নাই সুপার কিংসের সাথে ৫ই মে অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে ২০৫ রান করেও ৬ উইকেটে হারতে হয়েছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরকে।
এমনও বহু ম্যাচের সাক্ষী হয়ে আছে আইপিএল, যেখানে শুধুমাত্র বোলারদের ব্যর্থতার কারণে হেরেছে ব্যাঙ্গালোর। নিজেদের দলের বোলাররাই যেন তাদের প্রধান শত্রু। সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ দলের কথা যদি চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন দলটির সফলতায় অবদান ব্যাটসম্যানদের চাইতে বোলারদের কিন্তু একটু হলেও বেশি। বোলারদের দায়িত্বশীল বোলিং বহু ম্যাচের ফলাফল এনে দিয়েছে হায়দ্রাবাদের পক্ষে। গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা টি টোয়েন্টি, যেখানে একজন বোলারের করা ভালো একটি ওভারই পারে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে।
৪. টিম ম্যানেজমেন্ট
একটি দল নির্বাচন কিংবা দল গঠনে টিম ম্যানেজমেন্টের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আইপিএলের নিলামে যখন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা বোলার মোস্তাফিজুর রহমান বিক্রি হন ১. ৪ কোটি রুপিতে, অন্যদিকে পবন নেগি ৮.৫ কোটি রুপিতে কিংবা টাইমাল মিলসের মত খেলোয়ার ১২ কোটি রুপিতে, সেক্ষেত্রে আরসিবির টিম ম্যানেজমেন্টের দূরদর্শিতার নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা স্বাভাবিক।
দল গঠমে টিম ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতা দলটির ব্যর্থতার আরেকটি কারণ। চলমান আইপিএলের কথা একটু ধরা যাক। গত আসরে দলটির অন্যতম সেরা তিন ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইল, শেন ওয়াটসন কিংবা নিজেদের ঘরের ছেলে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান লোকেশ রাহুল এদের কাউকেই দলে ধরে রাখেনি আরসিবি টিম ম্যানেজমেন্ট। ফলাফল, এই আসরে গেইল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব এবং শেন ওয়াটসন চেন্নাই সুপার কিংসের; দুজনেই করেছেন সেঞ্চুরি। ধারাবাহিকভাবে ভাল পারফর্মেন্স করে যাচ্ছেন লোকেশ রাহুলও।
এসব দেখে আরসিবি টিম ম্যানেজমেন্টের আফসোস হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? যদি ব্যাঙ্গালোরের কোচিং স্টাফদের কথা চিন্তা করা যায়, সেখানে প্রধান কোচের ভূমিকায় দলটির সাবেক খেলোয়াড় ড্যানিয়েল ভেট্টোরি । তাহলে মূল সমস্যা কি তাদের দুর্ভাগ্য, নাকি অন্যকিছুতে?
দলটিকে আপনি ট্রল করতে পারেন কিংবা অপছন্দও করতে পারেন, তাই বলে দলটিকে আপনি ঘৃণা করতে পারেন না। তাদের হোম এবং অ্যাওয়ে জার্সির পাশাপাশি সবুজ জার্সি পরে তাদের খেলতে দেখা যায়। স্বভাবত প্রশ্ন হতেই পারে, সবুজ জার্সি পরে খেলার কারণ নিয়ে। বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং সবুজ বনায়ন সৃষ্টির লক্ষ্যেই তাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা
আইপিএল ও আরসিবি
১. গত ১০ আসরের মধ্যে তিন তিনবার ফাইনাল খেলে তিনবারই হেরেছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার ব্যাঙ্গালোর।
২. ২০১৩ সালে পুনে ওয়ারিয়র্স ইন্ডিয়ার বিপক্ষে করা ব্যাঙ্গালোরের ২৬৩ রানের ইনিংসটি আইপিএলের ইতিহাসে দলীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
৩. আইপিএলের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৭৫ রানের ইনিংসটি গেইল খেলেছেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার ব্যাঙ্গালোরের হয়ে ২০১৩ সালে, যে ম্যাচে মাত্র ৩০ বলেই সেঞ্চুরি করেছিলেন গেইল।
৪. আইপিএলের দলীয় সর্বনিম্ন ৪৯ রানের রেকর্ডটিও তাদেরই করা।
৫. ২০১৬ সালে আইপিএলের সর্বোচ্চ ২২৯ রানের জুটি গড়েছিলেন দলটির বিরাট কোহলি এবং এবি ডি ভিলিয়ার্স।
ফিচার ইমেজ: hindustantimes