ফুটবল বিশ্বকাপ এক অদ্ভুত মঞ্চ। এক মাস ধরে চলা বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল টুর্নামেন্টে অঘটন, রোমাঞ্চ, নতুন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল নিত্য দিনের ঘটনার মতো। প্রতি চার বছর পরপর ৩২ টি দল তাদের সেরা খেলোয়াড়গুলোকে বাছাই করে বিশ্বকাপের মঞ্চে আসে। কিন্তু তাদের সেই সেরা খেলোয়াড় যদি হতাশ করে তাহলে তার থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না। কারণ প্রতিটা দল তাদের তারকা খেলোয়াড়দের উপর নির্ভরশীল। এবারের বিশ্বকাপেও এমনটা হয়েছে, দলের সেরা খেলোয়াড় তাদের স্বভাবজাত খেলা খেলতে সক্ষম হয়নি। তাই বিশ্বকাপ শেষে তাদের নামের পাশে লেগেছে ফ্লপের তকমা। বিশ্বকাপে ফ্লপদের এ স্কোয়াড বাদেও অনেক তারকা ফুটবলার হতাশ করেছেন বিশ্বকাপে। টিমো ভের্নার, জেরোম বোয়াটেং, রবার্ট লেভানডভস্কি, অলিভিয়েঁ জিরুঁ, কৌলিদু কৌলিবালি, গঞ্জালো ইগুয়েইন, রাফায়েল গারেরো তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ডেভিড ডি হেয়া (স্পেন)
বিশ্বকাপে এসেছিলেন সময়ের সেরা গোলরক্ষক খেতাব নিয়ে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে গত মৌসুমটা অসাধারণ কেটেছিলো তার। একের পর এক দুর্দান্ত সব সেভ তাকে বানিয়ে দিয়েছিলো বর্তমান ফুটবলের সেরা গোলরক্ষক। অথচ বিশ্বকাপে স্পেনের সাথে তিনিও যে মাথা নিচু করে বিদায় নিলেন। মরিনহোর আন্ডারে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডিফেন্স খুব ভালো ছিলো তা কিন্তু নয়। জোনস, স্মেলিং এর করা ভুলগুলো তার কাছে এসে থেমে যেতো। কিন্ত বিশ্বকাপে পিকে ও রামোসের ভুল তো দূরে থাক, সহজ সেভগুলোও করতে পারেননি তিনি। পর্তুগালের বিপক্ষে হজম করেছেন তিন গোল। রোনালদোর দূরপাল্লার সহজ শট আটকাতে হিমশিম খেয়েছেন। মরক্কোর মত রক্ষণাত্মক দলও তাকে ফাঁকি দিয়ে দুইবার বল জালে জড়িয়েছে। আর রাশিয়ার বিপক্ষে আকিনফিভ যখন স্পেনের দুটো পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে নিজের দেশকে এক ধাপ এগিয়ে নিলেন, সেখানে বর্তমান সময়ের সেরা গোলকিপার ঠেকাতে পারেননি একটি পেনাল্টিও!
ইয়োশুয়া কিমিখ (জার্মানি)
যদি জার্মানি বিশ্বকাপে ভালো ফলাফল করতে পারতো তাহলো কিমিখ হতে পারতেন জার্মানির সাফল্যের পেছনের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়, এমনটাই আশা দেখাচ্ছিলেন বিশ্বকাপের আগে। রাইট-ব্যাক পজিশনে নামলেও রাইট-উইং দিয়ে তার অগাধ বিচরণ ছিলো। গোল করতেন, গোল করাতেন এমনকি নিচে নেমে এসে রক্ষণেও সহায়তা করতে পারতেন বলে এবার তার উপর পাহাড়সমান আশা ছিলো জার্মানদের। কিন্ত কিমিখ যে এই বিশ্বকাপে কোনোভাবেই জ্বলে উঠতে পারলেন না। মেক্সিকোর বিপক্ষে বেশিরভাগ সময় বল হারিয়েছেন। রক্ষণ ছেড়ে আক্রমণে গিয়ে আবার রক্ষণে ফেরত আসতে পারেননি। ফলে তার ফেলে রাখা শূন্যস্থান দিয়েই মেক্সিকো আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া বা সুইডেনের বিপক্ষেও মাঠে তিনি তার প্রভাব ফেলতে পারেননি। তাই বিশ্বকাপের মাঝপথেই সময়ের সেরা রাইট-ব্যাক ফিরে গেলেন একরাশ হতাশা উপহার দিয়ে।
নিকোলাস ওটামেন্ডি (আর্জেন্টিনা)
ভঙ্গুর আর্জেন্টিনার রক্ষণে ভরসা বলতে একজনই ছিলেন, তিনি নিকোলাস অটামেন্ডি। ম্যানচেস্টার সিটির সাথে দারুণ একটি মৌসুম পার করার পর অনেকেই ভেবেছিলেন আর্জেন্টিনা আর যা-ই করুক, ওটামেন্ডি অন্তত রক্ষণের হালটা ধরবেন। কিন্ত ওটামেন্ডিও ভাসলেন সময়ের স্রোতে। আইসল্যান্ডের সাথে একমাত্র গোল, ক্রোয়েশিয়ার সাথে ৩ গোল, ফ্রান্সের সাথে ৪ গোলের পেছনে আর্জেন্টিনার রক্ষণ যেমন দায়ী, ওটামেন্ডিও তেমনই দায়ী ছিলেন। এমবাপে, গ্রিজম্যানদের গতির সামনে খাবি খেয়েছেন, ট্যাকলগুলো ঠিকমত না হওয়ায় হয়েছে ফাউল, মেজাজ হারিয়েছেন বারবার। নিকোলাস ওটামেন্ডির কাছ থেকে এমন পারফর্মেন্স অবশ্যই কাম্য ছিলো না।
জেরার্ড পিকে (স্পেন)
পিকের ফর্মহীনতা বার্সেলোনার হয়ে শেষের দিকের ম্যাচগুলোতে বেশ বোঝা গিয়েছিলো, বিশ্বকাপে তা হলো স্পষ্ট। পর্তুগালের বিপক্ষে তিনি ছিলেন ছায়া হয়ে। মরক্কোর ম্যাচে ছেলেমানুষি সব ভুল করেছেন। ভাগ্য সহায় না হলে সেদিন দেখতে হতো লাল কার্ড। শেষ ষোলোতে রাশিয়ার পেনাল্টি পাবার পেছনেও তিনি দায়ী ছিলেন। ঐ সময়ে তার হাতে বল না লাগলে হয়ত রাশিয়া গোল না পেতেও পারতো। তাই স্পেনের বর্তমানে সেরা ডিফেন্ডারদের একজন বিশ্বকাপ শেষে সবথেকে প্রশ্নবিদ্ধ।
মার্সেলো ভিয়েরা (ব্রাজিল)
খুব অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন মার্সেলো কীভাবে এই ফ্লপ লিস্টে? তিন ম্যাচের পুরোটা সময় খেললেও মার্সেলো কি তার স্বভাবজাত খেলা খেলতে পেরেছেন? মিরান্ডা, সিলভার দৌলতে ব্রাজিল গোল খায়নি। মার্সেলোর শূন্যতা আর তার ভুলগুলো বোঝা যায়নি ক্যাসেমিরো থাকার কারণে। কিন্ত যখন ক্যাসেমিরো ছিলেন না এবং প্রতিপক্ষের গতির সাথে তাল সামলাতে না পেরে ব্রাজিল ডিফেন্স যখন নড়বড়ে তখনই ফুটে উঠেছে মার্সেলোর ভুল। বেলজিয়ামের ম্যাচে বারবার নিজের পজিশন ছেড়ে আক্রমণে গেছেন, কিন্ত ফিরে আসতে পারেননি। ফার্নান্দিনহোও পারেননি ক্যাসেমিরো হতে। ফলাফল ডি ব্রুইনা ও লুকাকুর ধারাবাহিক বাঁপাশ দিয়ে আক্রমণ। বেলজিয়ামের জয়সূচক গোলও হয়েছে মার্সেলোর দিক থেকে। মার্সেলোও টিকতে পারেননি বেলজিয়ামের দুর্নিবার গতির সাথে। অ্যালেক্স স্যান্দ্রোকে রেখে কোচ তিতে মার্সেলোর উপর ভরসা রেখেছিলেন। কিন্ত মার্সেলো? ব্রাজিল বিপর্যয়ের পর আবারও রাশিয়াতে তিনি বিতর্কিত।
স্যামি খেদিরা (জার্মানি)
সবাই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, বুফন বা টট্টি হয় না, সেটা যেন খেদিরা বিশ্বকাপে এসে প্রমাণ করলেন। বয়স অনেকের কাছে সমস্যা, সেটা খেদিরার জন্যও প্রযোজ্য। একটা সময়ে নিজের পজিশনে তিনি সেরা ছিলেন। কিন্ত সেই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রোলে এখন আর তিনি যান না। জার্মানি গ্রুপ পর্বে যে দুটো ম্যাচে হেরেছে, সে দুটো ম্যাচে ছিলেন খেদিরা। কান্তে বা ক্যাসেমিরোর মত মধ্যমাঠ পাহারা দেবার দায়িত্ব ছিলো তার। কিন্ত ৩১ বছর বয়সী খেদিরাকে মেক্সিকো ও দক্ষিণ কোরিয়া তাচ্ছিল্য করে ছুটে চললো। আর খেদিরা? না পারলেন আক্রমণ গড়ে দিতে, না পারলেন আক্রমণ থামাতে।
হাভিয়ের মাশ্চেরানো (আর্জেন্টিনা)
গত বিশ্বকাপে আরিয়েন রোবেনকে করা হাভিয়ে মাশ্চেরানোর সেই অতিমানবীয় ট্যাকল মনে আছে? নিশ্চিত গোল থেকে আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মাশ্চেরানো। দলের সবথেকে পুরনো সৈনিক ছিলেন তিনি, মাঠে তিনি যেন যুদ্ধ করতে নেমেছেন। সেই মাশ্চেরানো এবার আর্জেন্টিনার হয়ে কালো স্মৃতি হয়ে রইলেন। তার বয়সটা ৩৪ হয়ে গেছে, বার্সেলোনা ছেড়েছেন অনেক আগে। বয়সের সাথে তার গতি, পাসিং আর ট্যাকল করার দক্ষতাও যে হারিয়ে যেতে বসেছে তারই চিত্র ফুটে উঠলো বিশ্বকাপে। ফ্রান্সের গতি আর ক্রোয়েটদের দক্ষ পাস সামলাতে হিমশিম খেয়েছেন তিনি। মাঝমাঠের ইঞ্জিন রূপে খেলে সবসময় বল হারিয়েছেন। আক্রমণ ঠেকাতে ট্যাকল করেছেন ঠিকই, কিন্ত সেই ট্যাকলগুলো ফুটে উঠেছে ফাউল হয়ে। তার অসহায়ত্ব বেশি করে ফুটে উঠেছিলো এমবাপে, পগবা ও গ্রিজম্যানদের গতির কারণে। হয়তো তিনি এবার বিশ্বকাপে ফ্লপ, তবুও তিনি শেষ চেষ্টা করেছেন নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে।
মেসুত ওজিল (জার্মানি)
জার্মানি দলে ওজিলের অবস্থা অনেকটা খেদিরার মতোই। আর্সেনালের হয়ে গত মৌসুম তেমন ভালো কাটেনি ওজিলের। তবুও জার্মান কোচ ভরসা রেখেছিলেন তার প্রতি। কিন্ত মাঠে তার প্রতিদান ওজিল দিতে পারেননি। মেক্সিকোর বিপক্ষে তার পারফর্মেন্স এতোটাই হতাশাজনক ছিলো যে পরবর্তী সুইডেন ম্যাচে কোচ তাকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে সুযোগ পেলেও একই অবস্থা। গোল বা অ্যাসিস্ট তো দূরের কথা, আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হয়েও ন্যূনতম পাস এবং গোল সুযোগ তৈরি করতে পারেননি তিনি। তার উপর আগে থেকেই তিনি রক্ষণে একদম আনাড়ি। সুতরাং জার্মানিকে কোনোদিক থেকো সহায়তা না করতে পারায় রাশিয়া বিশ্বকাপে ওজিল ফ্লপ খেলোয়াড়দের লিস্টে অনেক উপরেই থাকবে।
টোমাস ম্যুলার (জার্মানি)
টোমাস ম্যুলার, যার নাম শুনলেই মনে পড়ে গত দুই বিশ্বকাপের কথা। গত দুই বিশ্বকাপে করেছিলেন মোট ১০ গোল। প্রতিবার বিশ্বকাপে জ্বলে ওঠা ম্যুলারকে নিয়ে এবারও জার্মানদের আশার শেষ ছিলো না। কিন্ত সবার আশার প্রদীপ যেন চিরতরে নিভিয়ে দিলেন ম্যুলার। বিশ্বকাপে কোনো গোল পাননি তিনি। অ্যাসিস্ট তো দূরের কথা, তার গোলমুখে শটের দৃশ্যও মনে হয় কেউ মনে করতে পারবেন না। জার্মান কোচ ওজিল, খেদিরা ভের্নারকে বেঞ্চে বসিয়ে ড্রাক্সলার, ব্রান্ডটদের সুযোগ করে দিলেও মুলার বিশ্বকাপের ভালোই সুযোগ পেয়েছেন। কিন্ত বিশ্বকাপে তার পরিসংখ্যান তুলে ধরলে ম্যুলার নিজেও হয়তো লজ্জা পাবেন।
গ্যাব্রিয়েল জেসুস (ব্রাজিল)
গত মৌসুমের বেশ বড় একটি সময়ের জন্য ইনজুরিতে ছিলেন জেসুস। তাও লিগ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে তার গোলসংখ্যা ১৯টি। ‘বর্তমানে ফুটবলের অন্যতম সেরা ইয়াংস্টার হয়ত বিশ্বকাপেও ভালো কিছু সময় উপহার দেবে’- এই আশা শুধু ব্রাজিল ফ্যান নয়, তিতেও করেছিলেন। তাতেই কিনা ফিরমিনোর মত গোলস্কোরার বেঞ্চে বসিয়ে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত জেসুসকে সুযোগ দিয়ে গেলেন তিতে। কিন্ত ৫ ম্যাচ সুযোগ পেয়ে জেসুস অ্যাসিস্ট করেছেন ১টি আর গোলের সংখ্যা ০। বরাবরই কৌতিনহো, নেইমারদের বানানো গোল সুযোগ নষ্ট করেছেন। তাই রাশিয়া বিশ্বকাপে ফ্লপ স্ট্রাইকারদের তালিকায় তিনিই হয়তো প্রথমে থাকবেন।
রহিম স্টার্লিং (ইংল্যান্ড)
রহিম স্টার্লিংয়ের অবস্থা ক্লাব সতীর্থ জেসুসের মত। লিগ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে ২৪ গোল করা স্টার্লিংয়ের ইংল্যান্ড দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় হয়ে বিশ্বকাপে এসেছিলেন। কিন্ত গ্যারেথ সাউথগেটের ছোঁয়ায় পুরো দল বদলে গেলেও স্টার্লিং ম্যানচেস্টার সিটির ফর্ম রাশিয়াতে টেনে আনতে পারলেন না। ইংল্যান্ডের ৬ ম্যাচে সবগুলোতেই নেমেছিলেন তিনি। তবে সুবিধা কিছু করতে পারেননি। বিশ্বকাপে তার এভারেজ রেটিং ৬.৬২। এবং ঠিক ধরেছেন! কোনো গোল করতে পারেননি তিনি। প্রতিটা ম্যাচে যেসব ছেলেমানুষি ভুল করেছেন, ম্যানচেস্টার সিটিতে পেপ গার্দিওলাও হয়তো এখন তাকে নামাতে ভয় পাবেন।
ফিচার ইমেজ: Getty Images