শচীন-অঞ্জলি: ক্রিকেট ঈশ্বরের জীবনের শ্রেষ্ঠতম জুটি

ব্যাটসম্যান হিসেবে ভারতের ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকার বাইশ গজে অনবদ্য সব জুটি গড়েছেন রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী কিংবা ভিভিএস লক্ষ্মণের মতো কিংবদন্তীদের সাথে। কিশোর বয়সে বিনোদ কাম্বলির সাথে তার ঐতিহাসিক জুটি, কিংবা আইপিএলের সুবাদে রিকি পন্টিংয়ের সাথে ব্যাট হাতে ক্রিজে নামার কাহিনীও সকলেরই জানা। কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে লম্বা ও অপরাজিত জুটি, যেটি তিনি গড়েছেন স্ত্রী অঞ্জলির সাথে, সেটির ব্যাপারে জানেন খুব কম মানুষই।

চলুন পাঠক, এবার আপনাদের সামনে উন্মোচিত করি শচীন-অঞ্জলির সেই অবিশ্বাস্য প্রেমের আখ্যান।

প্রথম দেখা

প্রথম দেখায় কি কখনো প্রেম হয়? অনেকেই হয়তো এমন প্রেমে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, শচীন-অঞ্জলির প্রেমের সূচনা হয়েছিল একদম প্রথম দেখাতেই। সেটি ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসের কথা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম শুরু করেছেন ১৭ বছর বয়সী শচীন। এমনই একটা সময়ে তার জীবনে ঘটে যায় এক চরম নাটকীয় ঘটনা। তিনি দেখা পান অঞ্জলির।

ইংল্যান্ড সফর শেষে ভারতীয় দলের সাথে মাত্রই মুম্বাই বিমানবন্দরে অবতরণ করেছেন শচীন। অপেক্ষা করছেন নিজের ব্যাগপত্র ফিরে পাওয়ার। ঠিক তখনই তার চোখ পড়ে ভিউয়িং গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক দারুণ আকর্ষণীয় তরুণীর উপর। সেই তরুণীকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন তার বান্ধবী অপর্ণা সান্থানাম, যিনি এখন মুম্বাই শহরের নামকরা ডার্মাটোলজিস্ট। যা-ই হোক, সেই তরুণীর সাথে এক মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয় শচীনের। তারপরই তিনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যান।

জীবনের শ্রেষ্ঠতম জুটি শচীন গড়েছেন অঞ্জলীর সাথে; Image Source: YouTube

তবে দ্বিতীয়বার সেই তরুণীর দেখা পেতে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি শচীনকে। বিমানবন্দর থেকে যখন তিনি বের হচ্ছেন, তখনই আবার খুঁজে পান সেই তরুণী আর তার বান্ধবীকে। এবার ভালো করে তিনি লক্ষ্য করেন সেই তরুণীকে। তার পরনে কমলা রঙের টি-শার্ট এবং নীল জিন্স। কিন্তু খানিক পরই শচীন অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করেন, তরুণীটি তার দিকেই দৌড়ে আসছে। শুধু তা-ই না, মুখে চিৎকার করছেন, “ছেলেটা কত্ত কিউট!”

এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে রীতিমতো ভড়কে যান শচীন। আর কেনই বা যাবেন না! তিনি বেশ ভালো করেই জানেন বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন দুই ভাই অজিত আর নীতিন। অবশ্য সাথে থাকা ছোটবেলার বন্ধু সুনীল হারশে শচীনের কানে কানে বললেন, “দ্যাখ, কত সুন্দর একটা মেয়ে তোর নাম ধরে ডাকছে। নিশ্চয়ই আলাপ করতে চায়!” কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হয়েই শচীন তাকে বললেন, “অজিত আর নীতিনের সামনে কোনোভাবেই মেয়েটার সাথে কথা বলা সম্ভব নয়।”

ফোনালাপ

প্রথম দিনের সাক্ষাৎ খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল। এবং এরপর শচীন নিজে থেকে কোনো চেষ্টা করেননি অঞ্জলিকে খুঁজে বের করার। বরং অঞ্জলিই খুঁজে বের করেন তাকে। অঞ্জলির এক বন্ধু ছিলেন মুফি নামে (যিনি ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন এবং এখন একজন বিখ্যাত সার্জন)। মুফির কাছ থেকে তিনি শচীনের নম্বর জোগাড় করেছিলেন, এবং সেদিন বিমানবন্দর থেকে ফিরে বাবা-মাকে কৌতুক করে এ-ও বলেছিলেন, “বিয়ে করার মতো একটা ছেলেকে পেয়ে গিয়েছি!”

শচীন যে অঞ্জলির কল ধরতে পারেন, এজন্য ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল না, আর শচীনও খুব কম সময়ই বাসায় থাকতেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে অঞ্জলি যেদিন ল্যান্ডলাইনে কল দিলেন, সেদিন বাসাতেই ছিলেন তিনি। কল ধরার পর অঞ্জলি তাকে বলেন, তিনি বিমানবন্দরে দেখা হওয়া সেই মেয়েটি, এবং তিনি সামনাসামনি দেখা করতে চান।

বলাই বাহুল্য, শচীন নিজেও খুবই উদ্গ্রীব ছিলেন অঞ্জলির সাথে আবার দেখা করতে। কিন্তু কন্ঠস্বরে সেই আগ্রহ প্রকাশ হতে না দিয়ে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমার আপনাকে মনে আছে। আমরা ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ায় (সিসিআই) দেখা করতে পারি।” শুরুতে অঞ্জলির বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে শচীন তার কথা মনে রেখেছেন। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বলুন তো, সেদিন আমি কী পরেছিলাম!” শচীন যখন ঠিক ঠিক কমলা টি-শার্ট আর নীল জিন্সের কথা বললেন, তখন অঞ্জলির বিস্ময়ের অন্ত থাকল না।

বয়সে শচীনের চেয়ে ছয় বছরের বড় অঞ্জলি; Image Source: DNA India

দ্বিতীয় সাক্ষাৎ

ফোনের কথা অনুযায়ী, অঞ্জলি শচীনের সাথে দেখা করতে চলে এলেন সিসিআই’তে। কিন্তু ওখানে চারপাশে এত মানুষ ছিল যে, তারা খুব বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেদিন তারা করলেন, তা হলো পরস্পরের ফোন নম্বর আদান-প্রদান করে নিলেন। এরপর থেকে ফোনেই নিয়মিত তাদের কথা হতে থাকল, এবং একে অপরকে ভালো করে চিনতে ও জানতে শুরু করলেন।

চেনাজানা

ফোনে কথা বলতে বলতেই শচীন অনেক কিছু জেনে গেলেন অঞ্জলির সম্পর্কে। যেমন অঞ্জলি অর্ধেক গুজরাটি, অর্ধেক ইংরেজ। দক্ষিণ মুম্বাইতে বড় হয়েছেন, এবং খুবই সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারের মেয়ে। পড়াশোনা করেছেন সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে, এবং বর্তমানে জে জে হসপিটালে ডাক্তারি পড়ছেন।

তাছাড়া আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শচীন জানতে পারলেন। তা হলো, অঞ্জলিকে তিনি প্রথম বিমানবন্দরে দেখলেও, অঞ্জলি কিন্তু তাকে আগেও দেখেছেন। তা-ও আবার তার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিনে। সে বছর ১৪ আগস্ট ওল্ড ট্রাফোর্ডে যখন তিনি টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম শতকটি হাঁকিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডে বসে টিভিতে সেই ইনিংসের অংশবিশেষ দেখেছিলেন অঞ্জলি।

অবশ্য টিভিতে শচীনের শতক হাঁকানো ইনিংসটি দেখা ছিল খুবই কাকতালীয় একটি ঘটনা। অঞ্জলির বাবা আনন্দ মেহতা ছিলেন একজন জাতীয় পর্যায়ের সাবেক ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন এবং ক্রিকেটের পাঁড় ভক্ত। তার জোরাজুরিতেই শচীনকে টিভিতে দেখতে বাধ্য হয়েছিলেন অঞ্জলি। আর শচীনের সাথে বিমানবন্দরে দেখা হয়ে যাওয়াটা আরো বড় কাকতালীয় ঘটনা। সেদিন মা অ্যানাবেলকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসতে গিয়েছিলেন তিনি।

শচীনের বাড়িতে অঞ্জলির প্রথম আগমন

অঞ্জলির সাথে ল্যান্ডলাইনে খুব ঘন ঘন কথা বলতে শুরু করলেন শচীন। আর এই বিষয়টি নজর এড়াল না তার ভাবি মীনার। তিনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন, নিশ্চয়ই দুজনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। এ নিয়ে শচীনকে প্রায়ই নানা প্রশ্নও করেন তিনি। কিন্তু লাজুক শচীন পরিবারের কারো সাথে নিজের এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তাই ভাবির কথায় তিনি বিব্রত হন।

কিন্তু তারপরও, অঞ্জলির সাথে শচীনের যাকে বলে ‘প্রথম যথাযথ সাক্ষাৎ’, তা হলো তার নিজের বাড়িতেই। ষড়যন্ত্রটি ছিল এমন যে, সাংবাদিক পরিচয়ে শচীনের বাড়িতে হাজির হবেন অঞ্জলি। কিন্তু আগে যেহেতু কোনোদিন শচীনের সাক্ষাৎকার নিতে কোনো নারী সাংবাদিক আসেনি, আর সম্প্রতি একটি মেয়ের সাথে ফোনে খুব বেশি কথা বলছেন তিনি, তাই তার ভাবির দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না যে, এই বিশেষ সাংবাদিকটি আসলে কে!

যা-ই হোক, প্রথমবার যখন অঞ্জলি বাড়িতে এলেন, শচীন খুব করে চাইছিলেন তাকে বিশেষ কিছু খাওয়াতে। কিন্তু তিনি খুবই হতাশার সাথে আবিষ্কার করলেন যে, ইংল্যান্ড থেকে আনা চকলেটগুলো প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। মাত্র দুটি বেঁচে আছে। সেই দুটি চকলেটই শচীন খুব যত্নের সাথে ছোট ছোট টুকরো করে অঞ্জলির সামনে প্লেটে দিলেন। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার, সেদিন বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না অঞ্জলি। একটু যেন তাড়াহুড়া করেই চলে যেতে হলো তাকে।

কিন্তু তারপরও, সেই সাক্ষাৎকারটি সময়ের হিসেবে যতই ছোট হোক, তা শচীনের মনে একটি চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে গেল। তিনি অনুধাবন করলেন, এই মেয়েটির সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে, এই মেয়েটির সামনে তিনি নিজস্বতা বজায় রাখতে পারেন। সেদিন তাদের মধ্যে কথাবার্তা খুব কমই হয়েছিল। যা বলার, অঞ্জলিই বলেছিলেন। ইংরেজিতে সাবলীল না হওয়ায়, শচীন সেদিন খুব কম কথাই বলেছিলেন। অবশ্য অঞ্জলির ব্যবহার এতটাই আন্তরিক ছিল যে, নিজের দুর্বলতা নিয়ে তাকে খুব বেশি অস্বস্তিতে ভুগতে হয়নি।

অঞ্জলির সামনে নিজস্বতা বজায় রাখতে পারতেন শচীন; Image Source: 

ল্যান্ডফোনের দিনগুলোতে প্রেম

ফোনে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগলেন শচীন-অঞ্জলি, কিন্তু পরস্পরের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। প্রায়ই তারা ঠিক করেন সন্ধ্যা সাড়ে ৮টার দিকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে কাছে-পিঠে কোথাও ঘুরে আসবেন। এবং এ উদ্দেশে বান্দ্রা থেকে চল্লিশ মিনিট গাড়ি চালিয়ে ওয়ার্ডেন রোডে এসে উপস্থিত হন শচীন। এবং সেখানে পৌঁছে আরো ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করেন তিনি। এরপর ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসেন। রাস্তায় মানুষজন তাকে চিনে ফেলবে, এমন আশঙ্কায় গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশের ফোন বুথ থেকে অঞ্জলিকে কল দেয়াও হয় না। কেবলমাত্র গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে এসে, অঞ্জলিকে ফোন দিয়ে জানতে পারেন, তার বাবা-মা বাড়িতেই ছিলেন, সেজন্য বের হতে পারেননি তিনি।

অঞ্জলির সাথে শচীনের দ্বিতীয়বার দেখা হতে তাই অনেকদিন অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে একদিন ব্যাটে-বলে মিলল, অর্থাৎ তিনি অঞ্জলির বাড়ির সামনে গাড়ি চালিয়ে গেলেন, আর অঞ্জলিও বাড়ি থেকে বের হতে পারলেন। অঞ্জলির সেদিন ইচ্ছা ছিল মেরিন ড্রাইভে বসে ডাবের পানি খাবেন। শচীন খুব ভালো করেই জানেন, সেখানে মানুষ তাকে চিনে ফেলতে পারে। তবুও অঞ্জলিকে খুশি করতে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। এবং সেদিনই জীবনে প্রথম ও শেষবার তারা এয়ার ইন্ডিয়া ভবনের বিপরীত পাশের বেঞ্চিতে বসে প্রেম করলেন

জনপ্রিয়তা যখন প্রেমের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা

ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্টে শতক হাঁকানোর সুবাদে শচীন তখন বিখ্যাত মুখ। যেখানেই যান, লোকে তাকে চিনে ফেলে। কিন্তু অঞ্জলি এ ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না। কেননা ক্রিকেট সম্পর্কে তার একেবারেই ধারণা নেই। ফলে তিনি এ-ও জানেন না যে, একজন ক্রিকেটার ঠিক কতটা জনপ্রিয় হতে পারেন। শচীন নিজেও কখনো অঞ্জলিকে মুখ ফুটে এ বিষয়ে অবগত করতে পারেন না। কারণ তার মনে ভয়, এগুলো বললে অঞ্জলি যদি তাকে অহংকারী ভাবেন!

শচীন যথাসম্ভব চেষ্টা করেন তার জনপ্রিয়তা যেন তাদের স্বাভাবিক জীবনাচরণে বাঁধা হয়ে না আসে। কিন্তু তারপরও মানুষ ঠিকই তাকে চিনে ফেলে। তাই সাধারণ প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো তাদের যা খুশি তা-ই করা হয়ে ওঠে না। ১৯৯৩ সালে যেমন একবার ঠিক হয় যে, অঞ্জলি, তার বাবা, শচীনের কয়েকজন বন্ধু আর শচীন যাবেন দক্ষিণ মুম্বাইয়ের এক সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে। লোকে যেন তাকে চিনে না ফেলে, এজন্য শচীন সেদিন নকল দাঁড়ি-গোঁফ আর চশমা পরে ছদ্মবেশ নেয়ার চেষ্টা করলেন। ইন্টার্ভাল পর্যন্ত সব ঠিকই থাকল। কিন্ত এরপর তার চশমা পড়ে ভেঙে গেল, আর ভুল করে তার নকল গোঁফও অর্ধেক খুলে পড়ল। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। মানুষজন তাকে চিনে ফেলে হামলে পড়ল। শেষ পর্যন্ত দলবল নিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচলেন তিনি।

এটি তো কেবলই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এমন ঘটনা নিয়মিতই ঘটে। তাই তো মেরিন ড্রাইভে সেদিন সন্ধ্যায় প্রেমের পর, পুরো ছয় মাস দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ থাকল শচীন-অঞ্জলির। শচীন চলে গেলেন বিদেশ সফরে, আর অঞ্জলিও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ডাক্তারির ফাইনাল নিয়ে।

অঞ্জলির ডাক্তারি জীবন

পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিলেন অঞ্জলি। তাই ডাক্তারি ফাইনালেও প্রথম স্থান অধিকার করলেন তিনি। এরপর তার ইচ্ছা পেডিয়াট্রিকসে এমডি করার। শচীনও এ ব্যাপারে তাকে যথেষ্ট উৎসাহ জোগালেন। ফলে এগিয়ে চললেন অঞ্জলি। ইন্টার্ন হিসেবে তার পোস্টিং হলো মুম্বাইয়ের অদূরে পালগরের একটি হাসপাতালে। পালগর ছিল এমনই ছোট একটি শহর যে, শচীনের সাথে কথা বলার জন্য তাকে বিশ মিনিট ট্রেনে চড়ে যেতে হয় বয়সারে। তবে ভাগ্যক্রমে, অঞ্জলির বন্ধু মুফিরও পোস্টিং হয়েছে একই হাসপাতালে। অঞ্জলি যখন ট্রেনে করে বয়সার যান শচীনের সাথে কথা বলতে, তার সঙ্গী হিসেবে থাকেন মুফি।

ক্রিকেটের প্রতি অঞ্জলির আগ্রহ

এমডি করার সময়ই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে অঞ্জলির। ফোনে প্রায়ই তিনি শচীনের সাথে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেন। এমনকি ক্রিকেটের নিয়মকানুন শেখার জন্য একটি বইও কিনেছেন তিনি। প্রায়ই তিনি শচীনকে জিজ্ঞেস করেন, কাউ কর্নার কী? কিংবা উইকেটরক্ষক কি ডানহাতি না বাঁহাতি? অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রিকেট বিষয়ে শিখে যান তিনি, এবং তার এ জাতীয় প্রশ্নেরও অবসান ঘটে। তখন বরং শচীনই তাকে ক্রিকেট বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করেন, যাতে করে তার আগ্রহ অক্ষুণ্ন থাকে।

১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ টিভিতে দেখা অঞ্জলির প্রথম কোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শচীনকে অল্প রানে আউট হয়ে যেতে দেখে বড় ধরনের ধাক্কা পান তিনি। তখন মুফি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, কার্টলি অ্যামব্রোস এত ভালো বোলার যে তাকে কেউ খেলতেই পারে না। শচীন খুব ভালো ব্যাটসম্যান বলেই অন্তত ব্যাটে বলে সংযোগ ঘটাতে পেরেছেন!

শচীনের জন্য নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন অঞ্জলি; Image Source: PosToast

অঞ্জলির বাড়িতে শচীন

১৯৯২ সালের মার্চে বিশ্বকাপ শেষে দেশে ফেরেন শচীন। সেবারই প্রথম অঞ্জলির বাড়ির ভিতরে প্রবেশের সুযোগ হয় তার। এবং এক্ষেত্রেও বিশাল ভূমিকা থাকে মুফির। মুফি অঞ্জলির বাবা-মাকে জানান, সেটিই অঞ্জলির সাথে শচীনের প্রথম দেখা! কেবলমাত্র শচীন-অঞ্জলির বাগদান সম্পন্ন হওয়ার পরই অঞ্জলি তার বাবা-মাকে জানানোর সাহস পান যে তাদের সম্পর্কের সূচনা আরো অনেক আগে।

সম্পর্কের পরবর্তী ধাপ

এ বিষয়টি শচীন কিংবা অঞ্জলি কারো জন্যই আর স্বস্তিদায়ক থাকল না যে তাদের মধ্যকার সম্পর্কটি এখনো দুই পরিবারের অজানা। তাই তারা ভাবতে শুরু করেন, কীভাবে নিজ নিজ পরিবারকে তাদের সম্পর্কের কথা জানানো যায়। তাই শচীন প্রথমে তার বন্ধু সুনীল হারশেকে অনুরোধ করেন যেন তিনি অজিত আর অঞ্জলির সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। সে অনুযায়ী দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ওয়েলিংটন ক্লাবে প্রথম সাক্ষাৎ হয় অজিত আর অঞ্জলির। বাড়িতে বসে গভীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করতে থাকেন শচীন।

এমন না যে শচীন অজিতের অনুমোদনের আশা করছিলেন। বরং তার চাওয়া ছিল অন্তত এটুকু দেখা যে, তিনি অঞ্জলিকে যতটা পছন্দ করেন, তার পরিবার ও বন্ধুরাও অঞ্জলিকে ঠিক ততটাই পছন্দ করেছে। এবং শচীনের সে আশা পূর্ণ হলো। অঞ্জলির সাথে আলাপের পর অজিতেরও মনে হতে শুরু করল, শচীনের সাথে অঞ্জলিকেই সবচেয়ে ভালো মানাবে।

বাগদানের সিদ্ধান্ত

১৯৯৪ সালে শচীন যখন নিউজিল্যান্ড সফরে গেলেন, ততদিনে ক্রিকেট বিষয়ে অঞ্জলির জ্ঞানের পরিধি ভালোই বিস্তৃত হয়ে উঠেছে। এই সিরিজের মাধ্যমেই একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলা শুরু করেছেন শচীন, যা নিয়ে তিনি খুবই খুশি। এবং তার ভালো লাগার পরিমাণ আরো বেড়ে গেল এ কারণে যে, খেলোয়াড়ি জীবনের অনুভূতিগুলো তিনি খুব সহজেই অঞ্জলির সাথে ভাগ করে নিতে পারছেন।

নিউজিল্যান্ড সফর শেষে যখন শচীন দেশে ফিরলেন, ততদিনে অঞ্জলির সাথে তার প্রেমের বয়স চার বছর পেরিয়ে গেছে। নিউজিল্যান্ডে থাকাকালীনই ফোনালাপের একপর্যায়ে অঞ্জলি বাগদানের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন, এবং শচীনও এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি অঞ্জলিকে এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছিলেন, অঞ্জলি দুজনের বাবা-মায়ের সাথেই কথা বলতে পারবেন কি না! কারণ তিনি নিজে এতটাই লাজুক যে, নিজের বাবা-মায়ের সাথেও এ বিষয়ে কথা বলা তার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার।

শচীনের অনুরোধ অঞ্জলি রাখলেন। নিজের বাবা-মায়ের সাথে তো কথা বললেন বটেই, এমনকি শচীনের বাবা-মায়ের কাছে গিয়েও তিনিই বললেন, “আপনাদের ছেলে আমার সাথে বাগদান করতে চায়!” দুই পরিবার থেকে কোনো আপত্তি আসল না, বরং সকলেই খুব খুশি হলেন শচীন-অঞ্জলির সম্পর্ক নিয়ে। ফলে ২৪ এপ্রিল, ১৯৯৪ তারিখে, শচীনের ২১তম জন্মদিনে, অঞ্জলিদের ওয়ার্ডেন রোডের বাড়িতে বন্ধুবান্ধন এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের উপস্থিতিতে তাদের বাগদান সম্পন্ন হলো।

১৯৯৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শচীন-অঞ্জলি; Image Source: India TV

বিয়ে

বাগদানের কথা যেমন অঞ্জলিকেই জানাতে হয়েছিল দুই পরিবারকে, ঠিক একই পরিস্থিতি তৈরি হলো বিয়ের সময়ও। নিজে মুখ ফুটে বিয়ের কথা বলতে শচীন এতই লজ্জা পাচ্ছিলেন যে, এবারও সব দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন অঞ্জলি। এবং ১৯৯৫ সালের ২৫ মে, চিরাচরিত মহারাষ্ট্রিয়ান রীতি মেনে, শচীনের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলেন তিনি।

বিয়ের সময় শচীনের মা তার পুত্রবধূকে মঙ্গলসূত্র, সিঁদুর, সবুজ চুড়ি, পায়ের মল এবং পায়ের আঙ্গুলের আংটি দিলেন। অঞ্জলি শচীনের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কি তোমার মায়ের দেয়া সব গহনাই পরব, নাকি বিশেষ কোনো একটা পরব?” জবাবে শচীন বললেন, “আর কিছু পরো বা না পরো, মঙ্গলসূত্রটা অবশ্যই পরো।” সেই মঙ্গলসূত্র কোনোদিন খোলেননি অঞ্জলি।

অঞ্জলির আত্মবিসর্জন

বিয়ের আগে থেকেই শচীন ও অঞ্জলি উভয়ই জানতেন, বিয়ের পর দুজনের ক্যারিয়ারই একসাথে ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। যেকোনো একজনকে তার ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিতে হবে এবং ঘর-সংসার সামলাতে হবে, যেন অন্যজন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। নিজের ইচ্ছায় অঞ্জলিই তার ক্যারিয়ারের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি জানতেন, ডাক্তার হিসেবে তার ক্যারিয়ারে বড় হওয়ার যতটুকু সম্ভাবনা আছে, ক্রিকেটার হিসেবে শচীনের সম্ভাবনা বহুগুণে বেশি। তাই তো শচীনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজের এতদিনের পরিশ্রমের ক্যারিয়ারকে বিদায় বলতে দুবার ভাবলেন না তিনি।

পুত্র অর্জুন ও কন্যা সারার সাথে শচীন-অঞ্জলি; Image Source: Hindustan Times

শেষ কথা

অঞ্জলির সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের প্রায় দুই যুগ কাটিয়েছে ফেলেছেন শচীন। তাদের ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছে দুই সন্তান সারা ও অর্জুন। ২০১৩ সালের নভেম্বরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিজের ২০০তম টেস্ট ম্যাচের মাধ্যমে ২৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন শচীন। বিদায়বেলায় তিনি যে ঐতিহাসিক বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন, তার একটি বিশেষ অংশ বরাদ্দ ছিল স্ত্রী অঞ্জলির জন্য। তিনি সেদিন গোটা বিশ্বকে সাক্ষী রেখে বলেছিলেন,

“আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯০ সালে, যখন প্রথম দেখা হয়েছিল আমার স্ত্রী অঞ্জলির সাথে। এরপরের বছরগুলো ছিল খুবই বিশেষ। তা এখনো অব্যহত রয়েছে, এবং আজীবন থাকবে। আমি জানি, একজন ডাক্তার হিসেবে অঞ্জলির সামনে খুবই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমরা যখন পরিবার শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম, অঞ্জলি নিজে থেকেই পিছিয়ে এসেছিল, বলেছিল, ‘তুমি তোমার ক্রিকেট নিয়ে এগিয়ে যাও, সংসারের দায়িত্ব সব আমি নেব।’ তার এই আত্মত্যাগ ছাড়া, আমি স্বাধীনভাবে, চাপমুক্ত থেকে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যেতে পারতাম না। তাকে ধন্যবাদ আমার সকল ব্যস্ততা, সকল হতাশা, সকল ছাইপাঁশ কথাবার্তা সহ্য করে যাওয়ার জন্য। ধন্যবাদ আমাকে সহ্য করার জন্য, সবসময়, সকল সাফল্য ও ব্যর্থতায় আমার পাশে থাকার জন্য। তুমিই সেই ব্যক্তি, যার সাথে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম জুটি গড়ে তুলেছি।”

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about Sachin Tendulkar's best partnership with his wife Anjali Tendulkar. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © DNA India

Related Articles

Exit mobile version