ক’দিন ধরেই ঢাকায় খুব বৃষ্টি, মন খারাপ করা আবহাওয়া। শীত যাই যাই করে যাওয়ার শেষবেলায় যেন মোমবাতির জ্বলে ওঠার মতো করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইয়ে দিয়ে যাচ্ছে। যান্ত্রিক নগরীতে মেঘ জমলেই যেন মনে হয়, নাগরিক জীবনের সব দুঃখগুলো যেন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে বায়ুমণ্ডলে জমা হচ্ছে। কিন্তু, ফুরিয়ে যাওয়ার বেলায় এই ফেব্রুয়ারির পুরোটা জুড়েই যেন মন খারাপের মর্মর পাতার শুকনো হাহাকার বইয়ে দিয়ে গেল সবার মনে। ভাষার জন্য আন্দোলনে আত্মত্যাগের মাসে, বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দেওয়া বইমেলায় নিদারুণ চাপা কষ্ট দেখে অনেকে বলে উঠেছিলেন, ‘আহারে!’
আর সবাই যখন ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম ভোরে প্রভাত ফেরির জন্য তৈরি হচ্ছে, তার আগে পুরনো ঢাকার চকবাজারে কেমিক্যাল গোডাউনের বিস্ফোরণে নগর দেখলো নারকীয় আগুনের লেলিহান শিখা। রাতের অন্ধকারে বিস্ফোরণের মিছিলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হলো কতশত স্বপ্ন, কতশত সোনালী ভবিষ্যৎ। পুড়ে কয়লা হলো কত মায়ের সন্তানের দেহ। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে ছিল কেবল লাশের পোড়া গন্ধ। ঢাকার সেই দুঃখ গভীর রাতের বৃষ্টি ধুয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সবকিছু কি ধুয়ে ফেলা যায়?
স্বজন হারানোর, অভিভাবক হারানোর সেই দুঃখকে আরও বাড়িয়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারির রাত। বাংলাদেশের ক্রিকেট হারিয়েছে তার সন্তানকে। যে সন্তান তিল তিল করে ভিত গড়েছিলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের। যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি সৈয়দ আলতাফ হোসেন। তিনি আর নেই। কত নামে অঙ্কিত তিনি! আম্পায়ার, ক্রিকেটার…। তবে সবচেয়ে বড় দু’টি পরিচয় হলো, তিনি পাকিস্তান আমলে প্রথম ক্রিকেটার, যিনি পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাংলাদেশের হয়েও অল পাকিস্তান জাতীয় টেস্ট স্কোয়াডে জায়গা পেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, আলতাফ হোসেন বাংলাদেশের ক্রিকেট কোচিংয়ের পথিকৃৎ।
১.
সৈয়দ আলতাফ অবিভক্ত ভারতবর্ষের হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ১৯৩৮ সালে। এরপর দেশভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাঝে পড়ে যান। সেই দাঙ্গায় হারান বাবা আর ভাইদের। পরবর্তীতে একরকম জীবন বাঁচাতেই এপার বাংলায় আসেন, পাকিস্তানের অংশ হয়ে যান।
ক্রিকেট ব্যাপারটা আলতাফ হোসেনের কাছে ছিল আজন্ম আত্মার সম্পর্কের মতো। ফাস্ট বোলার ছিলেন, ব্যাটিংটাও ভালো ছিল। নিজেকে নিয়ে বলতেন,
‘আমি প্রথম বোলার, তারপর ব্যাটসম্যান। শেষে অলরাউন্ডার।’
আলতাফ হোসেনের পেশাদার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৫৪ সালে। ক্লাব ক্রিকেটে রাজত্ব করেছেন, ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ভরসার নাম। খেলেছেন ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, পশ্চিম পাকিস্তান ক্রিকেটে ক্রিকেটার বের করার আঁতুড়ঘর জিমখানা ক্লাব, শান্তিনগর ক্লাবে। তবে সবচেয়ে বেশি খেলেছেন পিডব্লিউডি ক্লাবের হয়ে। আলতাফ হোসেনের সেরা ফর্ম কেটেছে এই ক্লাবে খেলার সময়।
অল পাকিস্তান জাতীয় দলের স্কোয়াডে সুযোগ পান ১৯৬৫ সালে। সেবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলো পাকিস্তান। শোষণের ধারাবাহিকতায় আলতাফ হোসেন স্কোয়াডে সুযোগ পেলেও সেই সিরিজের সময় কেটেছে ড্রেসিংরুমেই।
মৃত্যুবরণের বছর তিনেক আগে এক সাক্ষাৎকারে আলতাফ হোসেন সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেছিলেন,
‘১৯৬৫ সাল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ। আমাকে ওরা স্কোয়াডে নিলো ঠিকই, কিন্তু খেলায়নি। দলের সঙ্গে ঘুরিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিল। আমাকে না খেলিয়ে ওদের নিজেদের মানুষ খেলালো। টিম করে হাতে দিয়ে দেয়। বলে, তুমি বসে থাকো। আমি তো আর কিছু বলতে পারি না। কারণ আমার হাতে কিছু নেই, সব কিছু ওদের হাতে। আমাকে খেলতে দেয়নি বলে খুব কষ্ট পেয়েছি। আবার এটিও সত্য, পাকিস্তান জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া কঠিন ব্যাপার ছিল। আর আমরা যারা পূর্ব পাকিস্তানে ছিলাম, তাদের জন্য আরো কঠিন। আমাকে এখানকার প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টেস্ট স্কোয়াডে ডাকায় তাই খুশি হয়েছিলাম খুব। কিন্তু ওরা যে আমাকে খেলালো না, সেই দুঃখ এখনো রয়েছে।’
ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ার টেনেছিলেন ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। তবে ক্রিকেটার থাকাকালীন সময়েই শুরু করেছিলেন আম্পায়ারিং, সেই ১৯৭০ সালে। তখন ছিল পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। সেই বোর্ডের অধীনে আম্পায়ার হিসেবে আলতাফ হোসেনের সর্বোচ্চ অর্জন ছিল প্রথম শ্রেণির ম্যাচে আম্পায়ারিং করা।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলতাফ হোসেন নিয়োগ পেলেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ হিসেবে। মজার ব্যাপার হলো, যেহেতু ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট খেলেছেন, তাই কোচ হিসেবে কাজ করার সময়েও ক্রিকেট খেলেছিলেন তিনি! তবে আলতাফ হোসেনের কোচিং ক্যারিয়ার তার পুরনো সব সাফল্যকে মলিন করে দিয়েছে। সত্যি বলতে, তার অধীনেই নির্মাণ হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
বন্ধুর পরামর্শে ভারতের পাতিয়ালা ন্যাশনাল ইনস্টিউট অব স্পোর্টস থেকে কোচিং কোর্স করলেন। তারপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাকে। সরাসরি জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব এসে পড়লো তার কাঁধে। বলে রাখা ভালো, তিনিই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পাতিয়ালা থেকে কোচিং কোর্স করে আসেন। শুধু ভারত নয়, ইংল্যান্ড থেকেও কোচিং করেছেন তিনি। সেটা ছিল ১৯৭৯ সালে, লর্ডসে। সেবারই ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েছিলো বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। কোচ থাকাকালীন সময়ে একাধিকবার জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে জাতীয় দলের সাথে তার সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৯০ সালে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের কোচ ও ডেপুটি ম্যানেজার ছিলেন, কাজ করেছেন বয়সভিত্তিক দলগুলোর সাথেও।
২.
২০০৬ সালে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ছিলেন। সৈয়দ আলতাফ হোসেনের অধীনে বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোচিং ব্যাপারটার গুরুত্ব দারুণভাবে উঠে আসে। দেশীয় কোচ তৈরিতেও ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। ঢাকার ক্রিকেটে তিনিই প্রথম ফিল্ডিংয়ে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন।
আজকে সালমা খাতুন-রুমানা আহমেদদের যে সাফল্য আমরা দেখতে পাই, তার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন এই আলতাফ হোসেনই। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের শুরুর অংশ ছিলেন তিনি, ছিলেন নারী জাতীয় দলের প্রথম কোচ। ১৯৮৩ সালে কলকাতায় আবাহনী দল নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই তাকেই ১৯৯৭ সালে জাতীয় মহিলা দল গড়ার কাজ দেওয়া হয়।
দেশের ক্রিকেটে এতোগুলো কৃতিত্ব রাখার উপহার হিসেবে ১৯৯৯ সালে তিনি লাভ করেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এই অর্জন একজন ক্রিকেট কোচ হিসেবে তিনিই প্রথম।
বয়সের ভারের সাথে সাথে রোগটাও জেঁকে ধরেছিল আলতাফ হোসেনকে। ২০০৯ সালে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হন। ২৪ ঘন্টা কোমায় ছিলেন। বেঁচে ফিরলেও শ্রবণশক্তি অনেকটাই হারিয়ে বসেন। তারপর… দু’দিন আগে পৌঁছে গেলেন না ফেরার দেশে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট কখনোই আলতাফ হোসেনকে ভুলবে না। তাকে মনে রাখবে প্রতিটি সাফল্যে, প্রতিটি প্রহরে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন তাকে স্মরণ করতে গিয়ে বললেন,
‘আমরা আমাদের ক্রিকেটের স্থপতিকে হারিয়েছি। যিনি কি না ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দাঁড় করিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি তার নিঃস্বার্থ অবদানের জন্য তিনি সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি এ দেশের ক্রিকেটের আজীবন উত্তরাধিকারী। গেল ৫০ বছর ধরে তিনি তার সততা, নিষ্ঠা দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কাজ করেছেন। তার অবদান আমরা কোনোদিনও ভুলবো না।’
আলতাফ হোসেনের অবদান না ভোলাই থাক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানুক একজন সত্যিকারের ক্রিকেটপ্রেমীর গল্প। ওপারে ভালো থাকুন, সৈয়দ আলতাফ হোসেন।