অ্যাশেজ ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে ঐতিহ্যের, অস্তিত্বের এবং মর্যাদার লড়াই। পুরুষদের পাশাপাশি প্রমীলাদের মধ্যেও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে উইমেনস অ্যাশেজ সিরিজ। শুরুর দিকে প্রমীলাদের সিরিজকে অ্যাশেজে নামে আখ্যায়িত করা হতো না। তারা ক্রিকেটকে ভালোবেসে নিজেদের মধ্যে খেলতো। ১৯৯৮ সাল থেকে ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া প্রমীলা মধ্যকার সিরিজকেও অফিসিয়ালি অ্যাশেজ সিরিজ হিসাবে গণ্য করা হয়।
উইমেনস অ্যাশেজ সিরিজ প্রথম মাঠে গড়ায় ১৯৩৪ সালে। ঐতিহাসিক প্রথম অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ডের প্রমীলারা। তারা তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ২-০ ব্যবধানে জয়লাভ করে অ্যাশেজ ঘরে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আরও একবার অ্যাশেজ সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিন ম্যাচের সিরিজ ১-১ এ ড্র করে ট্রফি নিজেদের কাছে রেখে দেয় ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই অ্যাশেজ জয়লাভ করে অস্ট্রেলিয়া। ১৯৪৯ সালে নিজেদের মাঠে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজে ১-০ ব্যবধানে জিতে অ্যাশেজ নিজেদের দখলে নিয়ে আসে তারা।
উইমেনস অ্যাশেজের প্রথম ১৮টি সিরিজে অ্যাশেজ জয়ী দল নির্ধারিত হতো টেস্ট ম্যাচের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট অধিক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর ২০১৩ সাল থেকে উইমেনস অ্যাশেজে শিরোপার লড়াই অনুষ্ঠিত হচ্ছে পয়েন্ট সিস্টেমে। একটি টেস্ট, তিনটি করে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি খেলে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। টেস্টে জয়লাভ করলে চার পয়েন্ট, ড্র হলে দুই পয়েন্ট ভাগাভাগি করে। আর সীমিত ওভারের ক্রিকেটে প্রত্যেক জয়ে দুই পয়েন্ট করে যোগ হয়।
পয়েন্ট সিস্টেমে অ্যাশেজ বিজয়ী নির্ধারণ করার পর থেকে ইংল্যান্ড প্রথম দুই সিরিজে জয়লাভ করে। এরপর ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া চার পয়েন্টে এগিয়ে থেকে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করে। ২০১৫ তে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দুই দলই তিনটি করে ম্যাচ জিতেছিল। ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল একমাত্র চারদিনের টেস্ট ম্যাচ। ২০১৭ সালের অ্যাশেজে দুই দলের পয়েন্টই সমান আট ছিলো। সর্বশেষ সিরিজে জয়লাভ করার ফলে তাই অস্ট্রেলিয়ার কাছেই বর্তমানে অ্যাশেজের শিরোপা রয়েছে।
এখন পর্যন্ত মোট ২২টি উইমেনস অ্যাশেজ সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া আটবার এবং ইংল্যান্ড ছয়বার অ্যাশেজ ঘরে তোলে। দুই দল মোট ৪৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে, এতেও এগিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া। তারা ১২টি জয়ের বিপরীতে নয়টি টেস্টে পরাজিত হয়েছে, ড্রয়ের সংখ্যা ২৮টি। সূচি অনুযায়ী, এইবারের উইমেনস আসর বসবে ইংল্যান্ডের মাটিতে। শেষ দুইবারের চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়া স্বাগতিক ইংল্যান্ড চাইবে নিজেদের মাটিতে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করতে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করার পর ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ইংল্যান্ডকে বাদ করে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এরপর ২০১৭ সালে অ্যাশেজ ধরে রাখার পর নভেম্বরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করেছিল অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ডের সাফল্য বলতে ২০১৭ সালের বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের জয়।
বেশ কয়েক বছর ইনজুরি সমস্যাতে ভোগা অস্ট্রেলিয়ার তারকা ব্যাটসম্যান এবং অধিনায়ক মেগ ল্যানিং ফিট হয়ে আবারও ক্রিকেটে ফিরেছেন, যা অ্যাশেজের আগে অস্ট্রেলিয়ার জন্য ভালো খবর। ল্যানিং ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া দলে বেশ কয়েকজন দুর্দান্ত ক্রিকেটার আছেন। এলিস পেরি ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত ফর্ম বজায় রেখেছেন। অ্যাশ গার্ডনার, এলিসা হিলি, নিকোল বল্টন, বিথ মুনি সবাই নিজেদের দিনে একাই ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা রাখেন। অপরদিকে, ইংল্যান্ডেরও রয়েছে বেশ কয়েকজন ম্যাচ উইনার। অধিনায়ক হেদার নাইট, উইকেটরক্ষক সারাহ টেইলর, ন্যাট সিভার, ট্যামি বিউমন্ট, ড্যানি ওয়েট, ক্যাথরিন ব্রুন্ট সবাই অসাধারণ ক্রিকেটার এবং ছন্দেও আছেন।
তিন ফরম্যাট মিলিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ২৩তম অ্যাশেজ সিরিজ জয়ের ক্ষেত্রে যেসব প্রস্তুতি থাকা জরুরী, তার সবই নিয়ে রেখেছে দুই দল। অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক ফর্ম এবং ইংল্যান্ডের ঘরের আঙিনা, দুই দলই আলাদাভাবে অনুপ্রেরণা খুঁজে নিচ্ছে সিরিজ শুরুর আগে। সেই সাথে দুই দলই বেশ সাজানো একাদশ নিয়েই মাঠে নামবে। শক্তিমত্তার দিক দিয়ে কেউই কারে থেকে পিছিয়ে নেই।
উইমেনস অ্যাশেজে দুই দলের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মতো বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার খেলে গেছেন। তাদের মধ্য থেকে সেরা পাঁচ রান সংগ্রাহক এবং সেরা পাঁচ উইকেট শিকারি বোলারদের সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যান
অ্যাশেজে এখন পর্যন্ত চারজন ক্রিকেটার সহস্রাধিক রান করেছেন, যাদের মধ্যে মাত্র একজন এইবারের আসরে খেলছেন। তাছাড়া অন্য তিনজন ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন।
-
শার্লট এডওয়ার্ডস (ইংল্যান্ড)
প্রমীলা ক্রিকেটের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান শার্লট এডওয়ার্ডস ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অ্যাশেজ খেলেছিলেন। তিনি ২০০৫, ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৪ সালের অ্যাশেজজয়ী ইংল্যান্ড দলের সদস্য ছিলেন। ব্যাট হাতে অ্যাশেজে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহের রেকর্ড তার দখলে। তিনি ৩১ ম্যাচের ৪৪ ইনিংস ব্যাট করে একটি শতক এবং ১২টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪০.৩৬ ব্যাটিং গড়ে ১,৫৩৪ রান সংগ্রহ করেছেন। তিনি ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যান অ্যাশেজে ১,২০০ রানও করতে পারেননি।
-
এলিস পেরি (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়া ২০১৭ সালের অ্যাশেজের একমাত্র টেস্ট ম্যাচটি ড্র করে, যার ফলে অ্যাশেজ নিজেদের কাছে রেখে দিতে সক্ষম হয় তারা। টেস্ট ম্যাচটি ড্র করার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন এলিস পেরি। তার অপরাজিত ২১৩ রানের অনবদ্য ইনিংসের সুবাদে ড্র করে অস্ট্রেলিয়া। পেরি অ্যাশেজে ৩১ ম্যাচ খেলে ৩৩ ইনিংস ব্যাট করে একটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৮.৪৭ ব্যাটিং গড়ে ১,১১৫ রান সংগ্রহ করেছেন।
-
অ্যালেক্স ব্ল্যাকওয়েল (অস্ট্রেলিয়া)
অ্যালেক্স ব্ল্যাকওয়েল ২০০৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অ্যাশেজ খেলেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ফলে তার আসন্ন অ্যাশেজ খেলা হচ্ছে না। এর আগে তিনি ৩২ ম্যাচের ৪২ ইনিংসে ব্যাট করে নয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩০.২৯ ব্যাটিং গড়ে ১,০৩০ রান সংগ্রহ করেছেন। এখন পর্যন্ত অ্যাশেজে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটি তার দখলে।
-
জ্যানেট ব্রিটিন (ইংল্যান্ড)
জ্যানেট ব্রিটিন ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অ্যাশেজে ইংল্যান্ড প্রমীলা দলের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন। অ্যাশেজে সবচেয়ে বেশি তিনটি শতক হাঁকানোর রেকর্ডটিও তার দখলে। তিনি ১১ ম্যাচের ২০ ইনিংসে ব্যাট করে তিনটি শতক এবং পাঁচটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৬.৮৮ ব্যাটিং গড়ে ১,০২৪ রান সংগ্রহ করেছেন।
-
মার্টলি ম্যাক্লাগান (ইংল্যান্ড)
মার্টলি ম্যাক্লাগান ১৯৩৪ সালের প্রথম অ্যাশেজ সিরিজ খেলেছিলেন। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও তিনি দুটি অ্যাশেজ সিরিজ খেলেন। ইংল্যান্ড প্রমীলা ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ব্যাট হাতে তখন অন্যান্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন। ক্রিকেটকে ভালোবেসে খেলাটা উপভোগ করার পাশাপাশি রানও করেছিলেন। তিনি ১২ ম্যাচের ২২ ইনিংসে ব্যাট করে দু’টি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৩.৭৬ ব্যাটিং গড়ে ৯১৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। সে সময় রান সংগ্রহের তালিকায় তিনি সবার উপরে ছিলেন। পরে তা টপকে যান জ্যানেট ব্রিটিন।
সেরা পাঁচ বোলার
অ্যাশেজে সহস্রাধিক রান করা ব্যাটসম্যানদের সংখ্যা যেমন চারজন, পঞ্চাশের অধিক উইকেট নেওয়া বোলারের সংখ্যাও চারজন। এর মধ্যে একজন এইবারের আসরেও খেলবেন।
-
বেটি উইলসন (অস্ট্রেলিয়া)
বেটি উইলসন ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনটি অ্যাশেজ সিরিজ খেলেছেন। এই ডানহাতি অফস্পিনার এখনও অ্যাশেজে সর্বকালের সেরা উইকেট সংগ্রাহক হিসাবে সবার উপরে অবস্থান করছেন। তিনি নয় ম্যাচ খেলে তিনবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট এবং একবার ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করেছেন। মাত্র ১২.৬৯ বোলিং গড়ে তার উইকেট সংখ্যা ৫৩টি।
-
ক্যাথরিন ফ্লিৎজপ্যাট্রিক (অস্ট্রেলিয়া)
ফ্লিৎজপ্যাট্রিক ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অ্যাশেজ খেলেছিলেন। তার খেলা প্রথম তিনটি অ্যাশেজের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া এক ম্যাচেও পরাজয়ের স্বাদ পায়নি। ব্যক্তিগত সাফল্যের দিক থেকেও তিনি বেশ উজ্জ্বল ছিলেন। অ্যাশেজে নয় ম্যাচ খেলে ১৮.২৬ বোলিং গড়ে ৫২ উইকেট শিকার করেছিলেন, ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন দুইবার।
-
মার্টলি ম্যাক্লানাগান (ইংল্যান্ড)
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতেও দুর্দান্ত ছিলেন ম্যাক্লানাগান। অফস্পিন বোলিং করে নয় ম্যাচে ১৬.৯০ বোলিং গড়ে ৫১ উইকেট শিকার করেছেন তিনি, ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন দুইবার। তার সেরা বোলিং ফিগার হলো ১৭ ওভারে দশ রানের বিনিময়ে সাত উইকেট। উইমেনস অ্যাশেজে এক ইনিংসে এর চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করতে পারেননি আর কোনো বোলার।
-
ক্যাথরিন ব্রান্ট (ইংল্যান্ড)
প্রমীলা ক্রিকেটে যে কয়েকজন গতিময় বোলার আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ইংল্যান্ডের ক্যাথরিন ব্রান্ট। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অ্যাশেজের এইবারের আসরে উইমেনস অ্যাশেজের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারি বোলারদের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসবেন ব্রান্ট। তিনি ইতঃমধ্যে ২৬ ম্যাচে ২৪.৫০ বোলিং গড়ে ৫১ উইকেট শিকার করেছেন, ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন দুইবার।
-
এলিস পেরি (অস্ট্রেলিয়া)
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতেও অসাধারণ পারফর্ম করে আসছেন এলিস পেরি। আর মাত্র এক উইকেট শিকার করলেই তিনি উইমেনস অ্যাশেজের প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে সহস্রাধিক রান করার পাশাপাশি ৫০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়বেন। তিনি এখন পর্যন্ত ৩১ ম্যাচে ২৫.৭৭ বোলিং গড়ে ৪৯ উইকেট শিকার করেছেন।