বিশ্বকাপ জিততে হলে যোগ্য দলই নয়, সাথে প্রয়োজন যোগ্য অধিনায়কও। বিশ্বকাপের মঞ্চে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরে দাঁড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। পুরো জাতির চাওয়া-পাওয়ার একটু এদিক-সেদিক হলেও যে কয়জনের দিকে আঙুল উঠবে, তার মধ্যে অধিনায়ক একজন। এই বিশাল প্রত্যাশার চাপ অনেকেই নিতে পারেন না। নিজে পারফর্ম করার পাশাপাশি তারকায় ভরা একটি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতাও সবার থাকে না। বিশ্বকাপের মঞ্চে সে তো আরো দুরূহ ব্যাপার।
তবে শুধু অধিনায়কত্বের জোরেও মাঝারি ধরনের দলকেও বিশ্বকাপ জিততে দেখেছে বিশ্ব। যার মধ্যে সবার প্রথমে নাম আসবে পাকিস্তানের ইমরান খানের। তবে প্রতাপশালী ক্লাইভ লয়েড কিংবা রিকি পন্টিংরাও কিছুমাত্র কম যান না। এদের বাইরে বিশ্বকাপ না জিতেও অধিনায়কত্ব দিয়ে দলের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন অনেকেই। যেমন: সৌরভ গাঙ্গুলী, কিংবা ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম। আজ আমরা দেখবো শতকরা জয়ের দিক দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেরা পাঁচ অধিনায়ক যারা।
সৌরভ গাঙ্গুলী (ভারত) – ৮১.৮১%
আগ্রাসী ও দুর্দান্ত অধিনায়কত্বের জন্যই শুধু গাঙ্গুলী বিখ্যাত ছিলেন না। ৯০’এর দশকে হতাশাজনক পারফরমেন্স থেকে বিংশ শতকের শেষদিকে খোলনলচে পালটে যাওয়া ভারতের মূল কারিগর ছিলেন তিনি। সেই বদলে যাওয়া ভারত যে এখন ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি, তার জন্য এক বিশাল অংশের কৃতিত্বের দাবিদার সৌরভ গাঙ্গুলী।
যদিও বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের সৌভাগ্য হয়নি এই ব্যাটসম্যানের, তবুও বিশ্বকাপের অন্যতম সফল অধিনায়ক তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হওয়া ২০০৩ বিশ্বকাপে গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠতে সক্ষম হয় ভারত। ১১ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে দুইটি ম্যাচ হারেন তিনি। দুইটি ম্যাচই ছিল সেই সময়ের মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
গ্রুপপর্বে পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করা ভারত ২০০৩ বিশ্বকাপে একে একে হারায় নেদারল্যান্ড, নামিবিয়া, কেনিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, রিকি পন্টিংয়ের অসাধারণ নৈপুন্যে ফাইনালে হেরে গিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয় গাঙ্গুলির। তারপরও ১১ ম্যাচে ৯ জয়ের ফলে ৮১.৮১% শতকরা সাফল্যে সেরা অধিনায়কের তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছেন গাঙ্গুলী।
মহেন্দ্র সিং ধোনি (ভারত) – ৮৫.২৯%
একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে সব ধরনের আইসিসি ট্রফি জেতা খেলোয়াড় হলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। গাঙ্গুলির হাত ধরে যে পরিবর্তন ভারতীয় শিবিরে এসেছিল, তা একেবারে শিখরে নিয়ে গেছেন সময়ের সেরা এই অধিনায়ক। ধোনির হাত ধরে ভারত অবশেষে দেখা পায় দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপার। ২০১৫ বিশ্বকাপেও ভারতীয় দলের ভার ছিল ধোনির কাঁধেই। এইবার সেমিফাইনালে গিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাদের। ২০০৩ সালের মতো অস্ট্রেলিয়ার কাছেই ধরাশায়ী হয় ধোনি-বাহিনী।
দুই বিশ্বকাপ মিলে ধোনি ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সর্বমোট ১৭ ম্যাচে, যার মধ্যে ড্র করেছেন একটি ম্যাচ, আর হেরেছেন মাত্র দুইটি ম্যাচে। হারগুলোর মধ্যে একটি ২০১১ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে, আর অন্যটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০১৫ সেমিফাইনালে। আর একমাত্র ড্র হওয়া ম্যাচটি ছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ১৭ ম্যাচে ১৪ জয়ে ধোনির সাফল্যের শতকরা হার ৮৫.২৯%
ক্লাইভ লয়েড (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) – ৮৮.২৩%
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সোনালি সময়ের কান্ডারি ছিলেন এই বিখ্যাত ক্রিকেটার। আক্রমণাত্মক দল হিসেবে তখন সবার সমীহ আদায় করে নিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দেয়া দোর্দণ্ড প্রতাপে সেই সময় ক্রিকেটে রাজত্ব করতো লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তারই নেতৃত্বে প্রথম দুই বিশ্বকাপই ঘরে তুলে উইন্ডিজিরা। দুর্ভাগ্যক্রমে তৃতীয় বিশ্বকাপের ফাইনালে ধরাশায়ী হয় ভারতের কাছে। তা না হলে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের মাইলফলক গড়তে পারতেন ক্লাইভ লয়েড। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বকাপে একটি ম্যাচও না হেরে শিরোপা জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে লয়েডের নেতৃত্বে দুইটি ম্যাচ হারের স্বাদ নিতে হয় উইন্ডিজদের। কাকতালীয়ভাবে দুইটিই আন্ডারডগ ভারতের বিপক্ষে। গ্রুপপর্বে ভারতের কাছে আটকে যাওয়ার পর ফাইনালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কপিল দেবের কল্যাণে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নেয় ভারত।
তবে সেই দুই ম্যাচ হারলেও লয়েডের কৃতিত্ব এতটুকুও খাটো হবে না। দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লয়েড ১৭ ম্যাচে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে হেরেছেন মাত্র দুইটি ম্যাচে। আর তাতে শতকরা ৮৮.২৩% জয়ে এই তালিকায় তিন নাম্বার স্থান দখল করেছেন তিনি।
ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম (নিউ জিল্যান্ড) – ৮৮.৮৯%
ভারতের যেমন গাঙ্গুলী, তেমনই কিউই বাহিনীদের ছিলেন একজন ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম। নিউ জিল্যান্ডের ভেতর জেতার স্পৃহা তৈরি করে দিয়েছিলেন এই আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। বলতে গেলে নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেট খেলার চোখকেই বদলে দিয়েছেন তিনি। ২০১৫ বিশ্বকাপে ম্যাককুলামের নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম ফাইনালে উঠতে সক্ষম হয় ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’রা। ম্যাককুলামের নেতৃত্বে সেবার ডার্ক হর্স হয়ে ওঠা নিউ জিল্যান্ড ফাইনালে হেরে যায় প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ার কাছে। তবে বিশ্বকাপ শেষেও সমাদৃত হয়েছে ম্যাককুলামের দৃঢ়চেতা মনোভাব আর অধিনায়কত্ব।
২০১৫ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের সবগুলো ম্যাচ জিতেই নকআউট পর্বে পা রাখে নিউ জিল্যান্ড। এমনকি অস্ট্রেলিয়াকেও তারা হারায় ১ উইকেটে। ঘরের মাঠের সবক’টি ম্যাচ জিতে ফাইনালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় তারা। সেই ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। পুরো বিশ্বকাপে ম্যাককুলামের নেতৃত্বে নয়টি ম্যাচের মধ্যে আটটিতেই জয় লাভ করে নিউ জিল্যান্ড। আর তাতে করে অধিনায়ক হিসেবে ম্যাককুলামের শতকরা জয় দাঁড়ায় ৮৮.৮৯%, যে সাফল্যের কারণে শতকরা হিসেবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সফল অধিনায়ক বনে যান ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম।
রিকি পন্টিং (অস্ট্রেলিয়া) – ৯২.৮৫%
বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক কে? ক্রিকেট সম্পর্কে যার ন্যূনতম জ্ঞানও রয়েছে, সে-ই নির্দ্বিধায় বলে দেবে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের নাম। শুধু বিশ্বকাপই নয়, ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সফল অধিনায়কও তিনি। সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচজয়ী অধিনায়কের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ ম্যাচজয়ী অধিনায়কের রেকর্ডও পন্টিংয়ের ঝুলিতে।
২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপে পন্টিংয়ের অধীনে থাকা অস্ট্রেলিয়া একটি ম্যাচও না হেরে জিতে নেয় টানা দুইটি শিরোপা। তাতে করে অস্ট্রেলিয়া অর্জন করে হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার মাইলফলকও। ২০১১ সালেও রিকি পন্টিংকে অধিনায়ক করেই অস্ট্রেলিয়া দল পাঠায়। কিন্তু সেই সময় অস্ট্রেলিয়া দলটিই যাচ্ছিল পালাবদলের মধ্য দিয়ে। হেইডেন, গিলক্রিস্ট, ম্যাকগ্রার মতো তুরুপের তাসরা তখন অবসরে। আনকোরা এক দল নিয়ে সেই বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পন্টিংবাহিনী সর্বপ্রথম হোঁচট খায় পাকিস্তানের কাছে। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে তাদের বিশ্বকাপে টানা ৩৪ ম্যাচ জয়ের ধারার ইতি টানে। পাকিস্তানের বিপক্ষে হারের পরের ম্যাচে কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে হেরে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে যায় অস্ট্রেলিয়া।
তবে তারপরও বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে ২৯ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ২৬টিতেই জয়ের মুখ দেখেছেন পন্টিং, তার সাফল্যের শতকরা হার ৯২.৮৫%। শুধু ম্যাচ জয়ের দিক দিয়েই নয়, শতকরা হারেও এক নাম্বার স্থানটি দখল করে আছেন রিকি পন্টিং।