২০২০ সালের অনিশ্চিত ও আতঙ্কের সময়ে ভিডিও গেম হয়ে উঠেছে অনেকের আশ্রয়স্থান। তাছাড়া, ধীরে ধীরে পপ কালচারের মূলধারাতে ভিডিও গেম অনেকটুকু জায়গা দখল করে নিচ্ছে। মহামারির কারণে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হলেও ভিডিও গেম ইন্ডাস্ট্রি এই বছরে সর্বমোট ১৭৪.৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। অবশ্য, অর্থের হিসেবে এই ইন্ডাস্ট্রি সিনেমা, টিভি, সংগীত সবধরনের বিনোদন মাধ্যমকে আরো আগেই ছাড়িয়ে গেছে। পপ কালচারে এখন সে প্রভাবটুকুই দেখা যাচ্ছে।
এই বছরের উল্লেখযোগ্য কিছু ভিডিও গেম নিয়ে এই লেখায় আলোচনা করা হবে। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ও দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সমালোচকদেরকে অনুসরণ করে এই গেমগুলো নির্বাচন করা হয়েছে।
স্পিরিটফেয়ারার
মৃতদেহ থেকে মুক্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করা একদল বিপর্যস্ত আত্মাকে শান্তি খুঁজে পেতে সাহায্য করতে হয় এই গেমে। এরকম বিমর্ষ আত্মাদের কথা বেদনাদায়ক শোনালেও, গেমটি আপনাকে একটি আত্মোপলব্ধির উষ্ণতা দেবে। যে উপলদ্ধিটি হচ্ছে, মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু একইসাথে তা প্রাকৃতিক, মানবীয়।
বিখ্যাত স্টুডিও জিবলির অ্যানিমে পেইন্টিংয়ে প্রভাবিত হয়ে এই গেমটির গ্রাফিক্স নির্মাণ করা হয়েছে। তাই গেমটি খেলার সময়ে চমৎকার দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে স্মৃতিকাতরতায় ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পুরো গেমে কল্পনা ও বাস্তবের অদ্ভুত একটি মিশেল তৈরি করা হয়েছে, যেটি মোহ তৈরি করে।
অ্যামং আস
আপনি বন্ধুদের সাথে একটি স্পেসশিপে রয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন গোপন খুনী রয়েছে। সে আবার স্পেসশিপের যন্ত্রপাতিতে গোপনে বিভিন্ন ক্ষতি করে যাচ্ছে। কে সে? ভুল অভিযোগে কাউকে যদি স্পেসশিপ থেকে বের করে দেওয়া হয়, তার বড় একটি মূল্য দিতে হবে। কারণ, এভাবে একজন একজন করে আপনার বন্ধুর সংখ্যা কমতে থাকবে। তাতে সেই গোপন খুনীর জন্যই সুবিধা।
কোয়ারেন্টাইনের মাঝে এই মাল্টিপ্লেয়ার গেমটি হঠাৎ করেই পুরো পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, যারা আগে কখনো গেম খেলেননি, তারাও এই গেমে তুখোর হয়ে উঠতে পারেন। গেমটির খেলতে একমাত্র যে দক্ষতাটি প্রয়োজন, তা হচ্ছে চাতুরি। ২০১৮ সালে মুক্তি পেলেও, এই বছরেই যে এর জনপ্রিয়তা এমন আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে, তা মোটেও বিস্ময়কর নয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, ডিজিটাল স্পেসে খেলার ছলে আড্ডা দেওয়ার একটি চমৎকার উপায় বাতলে দিয়েছে গেমটি।
ইফ ফাউন্ড…
নব্বইয়ের দশকে আয়ারল্যান্ডে বেড়ে ওঠার একটি আবেগপ্রবণ, স্মৃতিকাতর গল্প বলে ‘ইফ ফাউন্ড…’ গেমটি। গেমটিতে তরুণ ক্যাসিওর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার কঠিন সময়টুকু তুলে ধরা হয়েছে। পরিণত বয়সে পা দেওয়ার সময়ে একটি পুরো দুনিয়া তার কাছ থেকে ধীরে ধীরে কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, সেই গল্পটিই তার জার্নাল থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই জার্নালটির পৃষ্ঠাগুলো গেমের জগতে ইন্টার্যাকটিভ হয়ে ওঠে। কখনো স্টপমোশন অ্যানিমেশন দিয়ে, কখনো ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের রঙের ব্যবহার করে, ক্যাসিওর হৃদয়ের জানালা গেমারের সামনে উন্মুক্ত করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেদনার্ত অংশটি হচ্ছে, গেমারদেরকে জার্নালের এই পৃষ্ঠাগুলো মুছে দিতে বলা হয়। মায়ের সাথে পুরনো দিনগুলো থেকে শুরু করে রক মিউজিকে সমবেত হওয়া বন্ধুদের গল্প, সমুদ্রের পাশে বাতাসের গর্জন, ভাঙা ছাদ দিয়ে উঁকি দেওয়া নক্ষত্র, সবই ধীরে ধীরে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। পুরনো জায়গা, পুরনো সময়ের অনুভূতি ঘিরে এই গেমে যে নস্টালজিক আর্ট ব্যবহার করা হয়েছে, তা আমাদের কৈশোরের অনুভূতি জাগ্রত করে তুলবে।
ফল গাইজ
ম্যারিও পার্টির মজাদার কার্টুনের সাথে যদি ফোর্টনাইট গেমের ব্যাটল রয়েল যুক্ত করা হয়, তাহলে যে চমৎকার গেমটি তৈরি হবে সেটিই ফল গাইজ। মাল্টিপ্লেয়ার গেম হওয়া সত্ত্বেও, এর সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতাই আনন্দদায়ক। ফোর্টনাইটের মতো গেমে হেরে গেলে যে ধরনের হতাশা তৈরি হয়, তা এখানে অনুপস্থিত। এর পেছনে একটি কারণ হচ্ছে, জিততে হলে প্লেয়ারদেরকে এখানে প্রায়ই অন্যকে সাহায্য করতে হয়।
উপভোগ্য হতে হলে গেমকে কঠিন হতে হয়, এই ধারণাটি ফল গাইজে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। গেমের আর্টগুলো এতই মজাদার ও কার্টুনময় যে, গেমটি সহজেই বাচ্চাসুলভ আনন্দ দেয়।
মাইক্রোসফট ফ্লাইট সিমুলেটর
ভার্চুয়াল পাইলট সিমুলেশনের জন্যে ‘মাইক্রোসফট ফ্লাইট সিমুলেটর’ গত চল্লিশ বছর ধরে যথেষ্ট সুনাম কামিয়েছে। অনেক প্লেয়ারকে এই গেমটি সত্যিকারের পাইলট হওয়ার জন্যে, ত্রিশ হাজার ফুট উপরের আকাশের অনুভূতি নেওয়ার জন্যে প্রেরণা জুগিয়েছে। এই বছরের সিমুলেটরটি দেখতে এতটাই বাস্তবের মতো হয়েছে যে, মহামারির জন্যে যারা ঘর ছেড়ে বেরোতে পারেননি, তারা ঘরে বসেই পুরো পৃথিবী ভ্রমণের স্বাদ পেয়েছেন।
এই গেমটিকে মাইক্রোসফটের অসাধারণ ক্লাউড প্রযুক্তির একটি প্রদর্শনী বলা যায়। যে প্রযুক্তির ফলে আমাদের সমগ্র পৃথিবীর একটি ডিজিটাল প্রতিচ্ছবি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো শহরে, যেকোনো বন অথবা সমুদ্রের চমৎকার দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় কখন পার হয়ে যাবে, তার খেয়ালই থাকবে না।
স্পাইডারম্যান: মাইলস মোর্যালিস
স্পাইডারম্যানের কথা ভাবলেই সবার মাথায় শ্বেতাঙ্গ, অসামাজিক পিটার পারকারের চেহারা ভেসে উঠে। কিন্তু নিউ ইয়র্ক শহরে নতুন একজন স্পাইডারম্যানের আগমন ঘটেছে এবং এবারে সে কোনো পার্শচরিত্র নয়, বরং প্রধান চরিত্রের জায়গাটি কেড়ে নিয়েছে। ‘স্পাইডারম্যান: মাইলস মোর্যালিস’ গেমে পোর্তোরিকান এক কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরের ভূমিকায় প্লেয়ারকে খেলতে হয়। মাইলস মোর্যালিস নামের এই কিশোর সবে ব্রুকলিন থেকে হারলেমে এসেছে। তার মেন্টর ছুটিতে গেলে শহরটি রক্ষার দায়িত্ব তার কাঁধেই এসে পড়ে।
শীতকালীন আবহাওয়ার নিউ ইয়র্কে এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিংয়ে জাল ছোঁড়াছুড়ি, অপরাধীদের সাথে মারামারির পাশাপাশি এই গেমটি মাইলসের বন্ধুত্ব ভাঙার গল্প, তার মায়ের সাথের সম্পর্কের গল্প বলে যায়।
অ্যানিমেল ক্রসিং: নিউ হরাইজনস
এই গেমটি বিখ্যাত জাপানি স্টুডিও নিনটেন্ডোর লাইফ সিমুলেটর ফ্র্যাঞ্চাইজির সর্বশেষ সংযোজন। গেমটি আপনাকে একটি নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দেবে, যেখানে আপনার পুরো সময় কাটাতে হবে। ছোট একটি ঘরে আপনাকে থাকতে দেওয়া হবে। আপনি সেই দ্বীপে ভ্রমণ করবেন, মাছ ধরবেন, গাছ লাগাবেন, চাষ করবেন। অর্থাৎ, আপনার জীবনটুকু সেখানে কাটাতে হবে। কোনো প্রতিযোগিতা নেই, কোনো লক্ষ্য নেই, আপনাকে শুধু নিজের মতো করে সময় কাটাতে হবে।
যখন কিছুই করতে ইচ্ছা করবেনা, তখন রয়েছে নিউ হরাইজনসের অন্যান্য প্লেয়ারদের বিশাল কম্যুনিটি। সেখানে পার্টি করা যায়, টক শো করা যায়, এমনকি একটি স্টক মার্কেটও রয়েছে। নিনটেন্ডোর বাচ্চাসুলভ কার্টুনে বানানো সম্পূর্ণ গেমটিই একটি মজাদার অভিজ্ঞতা দেয়।
অরি অ্যান্ড দ্য উইল অব দ্য উইস্পস
এই গেমটি ২০১৫ সালের জনপ্রিয় ‘অরি অ্যান্ড দ্য ব্লাইন্ড ফরেস্ট’-এর সিক্যুয়েল। চমৎকার গ্রাফিক্সের এই গেমটি নরডিক রুপকথা থেকে প্রভাবিত। বনের মধ্যে একটি শিশু পেঁচা ও একটি আত্মা ভয়ংকর সব প্রাণীর সাথে লড়াই করে এগিয়ে যেতে থাকে। গেমটির আর্ট নির্দেশনা নান্দনিকতায় ভরপুর, তার সাথে যুক্ত হয়েছে এর পরিবেশের সাউন্ড। এই দুইয়ে মিলে গেমটি মনের মধ্যে ভারি একটি রেশ রেখে যায়, যা থেকে বের হতে ইচ্ছা করে না।
বনের মধ্যে অরির ছুটে চলা, প্রতিটি ঝাঁপ, দৌড় এত নিখুঁত ও কমনীয় যে বারবার সেই অভিজ্ঞতা নিতে মনে চাইবে। নব্বইয়ের দশকের বিখ্যাত প্ল্যাটফর্ম গেমগুলোর ভালোই প্রভাব রয়েছে এখানে। সাথে যুক্ত হয়েছে এই যুগের সুনিপুণ গ্রাফিক্স।
দ্য লাস্ট অব আস পার্ট টু
‘প্রতিশোধের পথে যাত্রা শুরু করার আগে দুটি কবর খুঁড়ে রাখো’ কনফুসিয়াসের এই প্রবাদতুল্য উক্তিটি দ্য লাস্ট অব আস টু গেমটি তার ত্রিশ ঘন্টার গল্পে অনুসরণ করে, প্রবল ও ভয়ঙ্কররুপে এবং মানবীয় অনুভূতির সবচেয়ে গভীর অঞ্চলগুলোকে সকাতরে নাড়িয়ে দেয়। প্লেয়ারকে এখানে এলি নামে উনিশ বছর বয়সী এক কিশোরীর ভূমিকায় খেলতে হয়। পুরো দুনিয়া অদ্ভুত এক মহামারিতে ছেয়ে গেছে, আক্রান্তরা যেখানে জম্বি হয়ে যায়। এর মাঝে যারা বেঁচে আছে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তারা ছোট ছোট এলাকা তৈরি করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসবই অবশ্য প্রথম গেম ‘দ্য লাস্ট অব আস’-এ দেখানো হয়েছে।
এলির পালক বাবা জোয়েলের সাথে তার সম্পর্ক ও নানা ঘটনা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে পুরো গেমটি প্রতিশোধের এক ভয়ানক পথ অনুসরণ করে। ন্যারেটিভ দিয়ে এই গেমটি যা অর্জন করেছে, তা এর আগে অকল্পনীয় ছিল। প্লেয়ারকে যে সহিংস সিদ্ধান্তগুলো নিতে বাধ্য করে, তা হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো। গেমটি উপলদ্ধি করাতে বাধ্য করে যে, প্রতিশোধ একটা একমুখী রাস্তা, যেখানে নির্মমতা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা নেই, নির্দয় ভিন্ন অন্য কোনো চরিত্র নেই। দ্য গার্ডিয়ানের রিভিউ একে এভাবে বিশেষায়িত করেছে:
No video game has ever gone to these lengths to humanize the enemy, or to interrogate the violence that it asks the player to perform.
গেমটি দ্য গেম অ্যাওয়ার্ডসে এই বছরের সেরা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। অন্যদিকে, দ্য লাস্ট অব আসের গল্প থেকে এইচবিওতে টিভি সিরিজ নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
হেডিস
জ্যাগ্রিয়াস হচ্ছে হেডিসের পুত্র, যে তার বাবার কুৎসিত পাতালপুরী থেকে পালাতে চায়। উল্লেখ্য, হেডিস গ্রিক মৃত্যুদেবতা, যিনি পাতালপুরী শাসন করেন। গেমটিতে প্লেয়ারের নিয়ন্ত্রণে জ্যাগ্রিয়াসকে দেওয়া হয়, তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে হবে। পথিমধ্যে গ্রিক পুরাণের অনেক প্রাণীর সামনাসামনি পড়তে হয়, যাদের সাথে লড়াই করে এগিয়ে যেতে হয়। কিছু দেবতার সাথেও এখানে দেখা হয়ে যাবে, তাদেরকে পেরোতে হলে আশ্রয় নিতে হবে চাতুরির।
শুনতে ভরপুর অ্যাকশনের গেম মনে হলেও, হেডিসের সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হচ্ছে, গল্পকথনে এর অপ্রচলিত রীতি। চমৎকার আর্ট ও নিমজ্জিত করে ফেলার মতো পরিবেশ যে কাউকেই গেমটি আবার খেলার জন্য আহবান জানাবে।