সীমান্তে মাদক চোরাচালান অসম্ভব জনপ্রিয় আর রমরমা এক অবৈধ ব্যবসা। অনেক করেও যার কোনো সমাপ্তি এখনো পর্যন্ত পাকাপাকিভাবে টানতে পারেনি কোনো দেশ। তবে নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে এই সমস্যাটিকে দূর করতে। যার ফলে চোরাচালানকারীরা হয়ে পড়েছে আরো সতর্ক। নানারকম মজার, অদ্ভুত আর নিত্যনতুন উপায় তৈরি করেছে তারা সীমান্তে মাদক চোরাচালানের। উপায়গুলো দেখলে চোখ কপালে উঠবে আপনারও।
১) মানবদেহ
‘লুসি’ চলচ্চিত্রটির কথা মনে আছে? লুসির পেটে জোর করে মাদকদ্রব্য ভরে দিয়েছিল চোরাচালানকারীরা। পেট কেটে মাদকদ্রব্য ঢুকিয়ে সেলাই করে দিয়েছিল তারা। ঠিক একইভাবে পর্দার বাইরে, বাস্তব জগতেও এমন করে অনেক মাদক চোরাচালান হয়। মাদক পাচারের জন্য মানুষের শরীর ব্যবহার করে চোরাচালানকারীরা। বেলুন বা কনডমের মাধ্যমে মানব শরীরে মাদক পাচারের নজির আছে অনেক। লুসি চলচ্চিত্রটির মতোই এখানেও মাদক পেট কেটে পেটের ভেতরে ভরেই পাচার করা হয়। তবে এ কাজের ঝুঁকিও অনেক। ২০১৪ সালে ডাবলিন থেকে লিসবনে যাচ্ছিল ২৪ বছর বয়সী এক ব্রাজিলিয়ান। পেটের ভেতরে ৮০টি কোকেনের টুকরো ছিল তার। পথিমধ্যে হঠাৎ দুই পাউন্ড কোকেন ভরা একটি টুকরো ভেঙ্গে যায় ছেলেটির পেটের মধ্যেই। বেশ খানিকক্ষণ অসুস্থতার পর মারা যায় সে।
তবে কেবল পেট নয়, এক্ষেত্রে অন্য অঙ্গকেও ব্যবহার করেন অনেকে। কিছুদিন আগেই বার্লিনে যাওয়ার সময় এক কলোম্বিয়ার নাগরিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই নারীকে পরীক্ষা করার এক পর্যায়ে তিনি প্রকাশ করেন যে, ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে প্রায় ২.২ পাউন্ড কোকেন শরীরে বহন করছিলেন তিনি।
২) স্নিকার্স
টেক্সাসের এল পাসোতে এই ঘটনাটি ঘটে। সিউদাদ জুয়ারেজ থেকে আগত এক নারী সেখানে ৫ সেপ্টেম্বর থেকেই অবস্থান করছিলেন। পায়ে হেঁটে পার হওয়ার জন্য ইয়েসলেটা সীমান্তের কাছে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সবকিছুই ঠিকঠাক হয়ে যেত যদি না সিবিপি এজেন্টের চোখ তার পায়ের দিকে যেত। তার পায়ের জুতো ছিল অসম্ভব ভারী আর চোখে পড়ার মতো। হাঁটার ধরনটাও কেমন যেন চোখে বাঁধছিল। আর তাই সন্দেহ হতেই এক্স রে করা হয় আর পাওয়া যায় কোকেনভর্তি এক জুতোর সোল। মোট ১.৩ পাউন্ড কোকেন পাওয়া যায় ঐ নারীর জুতোর সোলে।
৩) মূর্তি
এ বছরের শুরুর দিকের কথা। জানুয়ারিতে চিনচিনাতিতে এক সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষী অফিসার মেক্সিকো থেকে আসা একটি শামুকের মূর্তি খুঁজে পান। জর্জিয়াতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মূর্তিটি। সীমান্ত পার করছিল বেশ নিরীহ চেহারার শামুকটি। তাতে লেখা ছিল- মেক্সিকান পাথরের খোদাই করা মূর্তি। কী মনে হতে শামুকটিকে এক্স-রে করেন অফিসার। প্রায় ৫৩ পাউন্ডের মেথামফেটামিন পাওয়া যায় শামুকটির মধ্যে।
৪) গাড়ি
প্রতি বছর হাজার হাজার ট্রাক আর গাড়ি পার হয় যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর সীমান্ত দিয়ে। আর এই সুযোগটিই নিয়ে থাকে মাদক চোরাচালানকারীরা। সুবিধামতন গাড়ি আর ট্রাকের সাথে নানাভাবে মাদক পার করে তারা এ দেশ থেকে ও’ দেশে। সবগুলো হয়তো ধরা পড়ে না, তবে এই সীমান্তে গাড়ির মাধ্যমে করা চোরাচালানগুলোর যেটুকু ধরা পড়ে পুলিশের হাতে সেটার পরিমাণও কিন্তু কম নয়।
এ ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি ব্যবহার করা হয় ক্লাসিক ট্র্যাপ কার। কারখানা থেকে অনেক যত্ন আর সময় দিয়ে তৈরি করা হয় এই গাড়িগুলো। এমনভাবে তৈরি করা হয় এদের, যাতে গ্যাস ট্যাংক না কেটে মাদক দেখা বা বের করা না যায়। গাড়ির নানা অংশে লুকিয়ে রাখা হয় মাদক। গাড়ির টায়ার, গ্যাস ট্যাংক, ইঞ্জিনের নানা অংশে সাজিয়ে চোরাচালান করা হয় মাদক। তবে কেবল গাড়িতেই নয়, মাদক পাচার করা হয় পণ্যবাহী কার্গোতেও।
৫) মরিচ এবং গাজর
হাসি পেল শুনে? তবে সত্যিই মরিচ আর গাজরও রেহাই পায়নি মাদক চোরাচালানকারীদের হাত থেকে। মরিচের ভেতরে মাদক পাচার করার এমন অনেক নজির আছে। সান ডিয়াগোর আদালত অনুসারে, সম্প্রতি সীমান্তে ১,৪০০ বাক্স মরিচের বাক্স থেকে প্রায় কয়েকশ কিলোগ্রাম কোকেন পাওয়া গিয়েছে। এমনকি ২০১৬ সালে এক গাজরের চালানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে মারিজুয়ানা। মারিজুয়ানার উপরে টেপ লাগিয়ে সেটাকে গাজরের রঙ ও আকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এ তো গেল ২০১৬ সালের জানুয়ারীর কথা। একই বছরের অক্টোবরেও সীমান্তে প্রায় ১৫৯টি গাজর ভর্তি প্যাকেট পাওয়া যায়। আর গাজর ভর্তি মাদক ছিল।
৬) কাঁচা কলা
কলোম্বিয়ায় প্রচুর পরিমাণ কলা জন্মায়। আর তাই দেশটির মাদক চোরাচালানেও কলার বেশ ভালো ভূমিকা আছে। শুধু কলা নয়, কলোম্বিয়ায় কোকেনের উৎপাদনও প্রচুর। চোরাচালানকারীরা এ দুটো ব্যাপারকে মিলিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা শুরু করেছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসেই সেভিলা শহরের দক্ষিণ দিকে স্প্যানিশ পুলিশ এক বিশাল ২,০০০ পাউন্ড বোঝাই কোকেনের চালান খুঁজে পান। অবশ্য কলাগুলো আসল ছিল না। নভেম্বর মাসেও উপকূলবর্তী মালাগা আর ভ্যালেনশিয়া শহরে ৩৭.৫ পাউন্ড কোকেন খুঁজে পায় পুলিশ।
৭) ডোনাট ও কেক
মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন? আর কেক? সেটা খেতে ভালো লাগে তো আপনার? দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মাদক পাচারের জন্য এই কেক আর ডোনাটকেও ব্যবহার করছে চোরাচালানকারীরা। ২০১৪ এর শেষার্ধ এবং ২০১৫ এর প্রথমভাগে মেক্সিকোর সীমান্তরক্ষীরা এমনকিছু ডোনাট খুঁজে পান যেগুলোর উপরে সাদা আস্তরণ ছিল; তবে সেগুলো চিনির নয়, কোকেনের। ২০১৩ সালে কলোম্বিয়ার সান আন্দ্রেস দ্বীপে প্রায় ১২টি ডোনাটের মধ্যে ১ কিলোগ্রাম কোকেন পাওয়া যায়। এছাড়া কেকের মধ্যেও এমফিটেমাইন খুঁজে পাওয়া যায় এর আগে।
৮) বরফ জমা হাঙ্গর এবং সামুদ্রিক খাবার
বর্তমানে সামুদ্রিক খাবার আমাদের সবার কাছেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এই সামুদ্রিক খাবারের জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্রকে করে গড়ে উঠেছে মাদক পাচারের ব্যাপারগুলোও। ২০০৯ সালে মেক্সিকান সামুদ্রিক নিরাপত্তারক্ষীরা ইয়াকটানের প্রোগ্রেসোর কাছে এক বরফ জমাট হাঙ্গর মাছ বোঝাই জাহাজে খুঁজে পান কোকেনের বেশ কিছু প্যাকেট। এর আগে এমনভাবে মাদক চোরাচালানের ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি বলেই ব্যাপারটি সবার চোখে বাঁধে। তবে মাদক পাচারের ক্ষেত্রে হাঙ্গর ব্যবহার করা সামুদ্রিক খাবারকে চোরাচালানের একমাত্র রাস্তা বলা যায় না। মাছ বোঝাই জাহাজ মানুষের চোখে খুব একটা পড়বে না এটা ভেবে আরো নানা ধরনের মাছের মধ্যে মাদক চালান করেছে অনেক মাদক চোরাচালানকারীই।
৯) সুড়ঙ্গ
মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তকে অনেকটা পনিরের টুকরোর সাথে তুলনা করা যায়। কারণ এই সীমান্তের নীচে অনেক সুড়ঙ্গ আছে যেগুলো দিয়ে হরহামেশাই মাদক চোরাচালান করা হয়। ৮০’র দশকে এ পেশায় বেশ বিখ্যাত গাজম্যান, (মেক্সিকোর বিখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী) একজন স্থাপত্যশিল্পী নিয়োগ করেন কেবল আগু প্রেইতার অ্যাটর্নির বাড়ির ২০০ মিটার দূর থেকে অ্যারিজোনার ডগলাস পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করতে। সেখান থেকেই সমস্ত মাদক চোরাচালান করার নির্দেশ দেন তিনি। এরপর একের পর এক সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা শুরু করেন তিনি। প্রচুর খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তগুলোর নীচে এমন অনেকগুলো সুড়ঙ্গ ছড়িয়ে দেন এই সিনালোয়া বস।
ফিচার ইমেজ: YouTube