কাউকে যদি গত দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা উল্লেখ করতে বলা হয়, নিঃসন্দেহে সেখানে ২০১৯-২০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া ভয়াবহ দাবানলের কথা উচ্চারিত হবে। প্রকৃতির এতটা ভয়াবহ রূপ মানুষ গত দশকে খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছে। কয়েক কোটি প্রাণীর মৃত্যু, কয়েক হাজার মানুষের বাস্তুচুত্যি আর সমৃদ্ধ এক জীববৈচিত্র্যের করুণ পরিণতি বিশ্ববিবেকে খানিকটা হলেও কড়া নেড়ে এক কঠিন বার্তা দিয়ে গিয়েছে। চোখে চোখ রেখে বুঝিয়ে দিয়েছে যে প্রকৃতির ওপর যে ধ্বংসযজ্ঞ আমরা প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছি, তার প্রতিফল ক্রমে ক্রমে আমাদের ভোগ করতে হবে। ভয়াবহ এই দাবানলকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ‘ব্লাক সামার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর কারণে পুরো অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ১০৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়।
২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় চলে এই ভয়াবহ দাবানল। যতটুকু পর্যন্ত প্রকৃতিতে এই রোষানল ছড়িয়েছে, তার ক্ষতচিহ্ন সে প্রকৃতিতে লেপ্টে দিয়েছে। গাছপালা, বন্যপ্রাণী, মানুষের আবাসস্থল- সবকিছুই গোগ্রাসে গিলেছে। যতটুকু পেরেছে সোনালী অগ্নিকুন্ড সবকিছু হজম করে শুধুই রেখে গিয়েছে একরাশ ছাই আর ধোঁয়া। অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টারি লাইব্রেরির প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র অনুযায়ী ভয়ানক এই দাবানল সৃষ্টির মূল কারণ ছিল তুলনামূলক শুষ্ক আবহাওয়া আর স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি মাত্রায় বজ্রপাত। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার তাপদাহ, দাবানলের অনুকূল পরিমাণ বায়ুতে উপস্থিত জলীয় বাষ্প এবং স্থানীয় কিছু গাছপালা (যেমন: ইউক্যালিপটাস গাছ) দাবানলের মাত্রা তীব্রতর হতে সহায়তা করেছিল।
২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় গরমের তীব্রতা মারাত্মক বেড়ে গিয়েছিল। তাপমাত্রার এই বৃদ্ধির কারণেই অস্ট্রেলিয়ার ফায়ার ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তীব্র দাবানলের সম্ভাবনা আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।এমনই একজন কুইন্সল্যান্ড ফায়ার এন্ড ইমার্জেন্সি সার্ভিসের অ্যাক্টিং ডিরেক্টর মাইক ওয়াসিং, যিনি ২০১৯সালের জুন মাসে দাবানল শুরুর স্বাভাবিক মৌসুমের পূর্বেই দাবানল শুরুর পূর্বাভাস দেন।
অস্ট্রেলিয়ায় স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি উষ্ণ বছর ২০১৯। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় তুলনায় সেই বছর অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ১.৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা ছিল। এর আগে এক বছরের গড় তাপমাত্রায় সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৩ সালে। ২০১৩ সালে পুরো বছরের গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১.৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। নিউ সাউথ ওয়েলসের গড় তাপমাত্রা ২০১৯ সালে ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১.৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি, যা পুরো অস্ট্রেলিয়াতে সর্বোচ্চ।
২০১৯ সালকে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে শুষ্ক মৌসুম বললেও ভুল হবে না। এ বছর পুরো অস্ট্রেলিয়া জুড়ে গড় বৃষ্টিপাত ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৪০% কম।
আবহাওয়াগত কিছু কারণেও অস্ট্রেলিয়ার দাবানল অনেক বড় রূপ লাভ করে। এর মধ্যে ভারত মহাসাগরের ক্রমাগত সী সারফেসের তাপমাত্রার পরিবর্তনশীলতা, যাকে INDIAN NINO-ও বলা হয়ে থাকে, যার ফলে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম অংশ তুলনামূলকভাবে একবার গরম হয় তো আরেকবার ঠান্ডা। INDIAN NINO-কে দুটি ফেজে ভাগ করা হয়; পজিটিভ আর নেগেটিভ। পজিটিভ ফেজে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম ভাগ তুলনামূলক গরম থাকে এবং নেগেটিভ ফেজে এই মহাসাগরের পশ্চিমাংশ তুলনামূলক ঠান্ডা থাকে।
২০১৯ সালের অধিকাংশ সময় INDIAN NINO পজিটিভ ফেজে ছিল। ফলে অস্ট্রেলিয়ার বায়ুমন্ডল থেকে বিপুল পরিমাণ জলীয়বাষ্প ভারত মহাসাগরের পশ্চিম অংশে স্থানান্তরিত হয়। যার প্রতিফল স্বরূপ ঐ বছর পুরোটা সময় জুড়ে খুবই কম বৃষ্টিপাত হয় অস্ট্রেলিয়া জুড়ে, যা দাবানলকে উসকে দেয়।
বিশ্বজুড়ে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে দিন দিন আমাদের বায়ুমন্ডল আরো তাপসহনীয় হয়ে উঠছে। এর ফলে আমাদের ভূপৃষ্ঠের তাপ বিকিরণের মাধ্যমে পূর্বের মতো মহাশূন্যে ফিরে যেতে পারছে না, বরং আমাদের বায়ুমন্ডলের গ্যাসগুলোর তাপসহনীয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই তাপ আমাদের বায়ুমন্ডলেই থেকে যাচ্ছে। ফলে যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দাবানলের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
অস্ট্রেলিয়ার এই দাবানলের ভয়াবহতা কতটুকু ছিলো তা আমরা একটি ছোট্ট পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বুঝতে পারব। ইউএনইপি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, দাবানলে প্রায় ১৮ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রায় ৫, ৯০০ ভবন এবং ২,৮০০ বাড়ি পুড়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টারি লাইব্রেরির ১২ মার্চ ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র অনুযায়ী প্রায় ৩৩ জন মানুষ এই দাবানলে মৃত্যুবরণ করেন যাদের মধ্যে ন’জন ফায়ার সার্ভিসে দায়িত্বরত কর্মকর্তা।
দাবানলের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হয়তো অস্ট্রেলিয়ার বন্য প্রাণীদেরই দেখতে হয়েছিল। ১ বিলিয়নের বেশি বন্যপ্রাণী এই তীব্র দাবানলে মারা যায়। দাবানল পরবর্তী সময়ে লাখ লাখ বন্যপ্রাণী আহত অবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। খাবার, বাসস্থান এবং পানির সংকটে বন্যপ্রাণীদের অনেকাংশই ধুকতে ধুকতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পুরো অস্ট্রেলিয়ার জীববৈচিত্র্য দাবানল এবং দাবানল পরবর্তীকালে এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়।
দাবানলের এই ভয়াবহতা যদি ভবিষ্যতেও বিদ্যমান থাকে, তবে প্রায় ১০ লক্ষের মতো জীবপ্রজাতি বিলুপ্তির সম্মুখীন হতে পারে। দাবানলের কারণে অস্ট্রেলিয়ার বন্যপ্রাণীদের প্রায় ১১৩টি প্রজাতি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এই সবগুলো প্রজাতিরই এখন সাহায্য প্রয়োজন। দাবানলের কারণে পুরো অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত প্রাণীকূল তাদের বাসস্থানের প্রায় ৩০ ভাগ হারিয়ে ফেলে।
অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বড় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ক্যাঙারু আইল্যান্ড। ধারণা করা হয়, ২০১৯-২০ সালের এই দাবানলে ক্যাঙারু আইল্যান্ডের প্রায় ২ লক্ষ ১৫ হাজার হেক্টর জমি পুড়ে যায়। এই দ্বীপের বন্যপ্রাণীরাও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রায় ৫০হাজারের মতো কোয়ালা আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করে।
অস্ট্রেলিয়ায় হয়ে যাওয়া দাবানল সেদেশের জনস্বাস্থ্যের উপর এক বিশাল প্রভাব ফেলেছে। দাবানল-পূর্ববর্তী সময়ের তীব্র গরম আর শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে মানুষ এমনিতেই বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। দাবানল-পরবর্তী সময়ে ছাই এবং ধোয়া বাতাসের সাথে মিশে মানুষের গ্রহণ-অনুপোযোগী করে তোলে। ধোয়া এবং ছাইয়ের সূক্ষ্ম কণা নিঃশ্বাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করায় মানুষ সহজেই বিভিন্ন শ্বাসকষ্টজনিত রোগে (যেমন- ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা ইত্যাদি) আক্রান্ত হচ্ছিল। তাছাড়া ছাইয়ে উপস্থিত অতি সূক্ষ্ম কণা চোখের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসাধন করে থাকে বিধায় অনেক মানুষ চোখের সমস্যায় ভুগছিল। দাবানলের কারণে বাতাসে তীব্র ধোয়া আর ছাইকণার উপস্থিতির জন্য ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ছিল পৃথিবীর অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় সবচেয়ে খারাপ।
অস্ট্রেলিয়ায় হয়ে যাওয়া দাবানল সেখানকার মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। চোখের সামনে চারপাশের সব কিছু জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে, নিজের চোখের সামনে নিজের বাড়ি পুড়ে যাচ্ছে, বন্য পশুপাখিগুলো গণহারে মারা যাচ্ছে- সব কিছুই মানুষকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছিল। তাছাড়া যে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি হয়ে গিয়েছে দাবানলের কারণে, তার ক্ষতিপূরণ পাবে কিনা এমন অনিশ্চয়তাও মানুষের মানসিক পরিস্থিতি খারাপ করে তুলেছিল।
অস্ট্রেলিয়ার কৃষিখাতও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল দাবানলের কারণে। তীব্র শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়ার কৃষকেরা এমনিতেই পানির সংকটে ভুগছিলেন। দাবানলের কারণে তারা ব্যাপক পরিমাণ আবাদি জমি হারিয়েছেন। এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলস, এই দুই রাজ্য হলো অস্ট্রেলিয়ার প্রধান দুগ্ধ উৎপাদনকারী রাজ্য। এই রাজ্যগুলো দাবানলের রোষানলে সরাসরি পড়ে, যার ফলে ২০১৯-২০ সালে এই দুই রাজ্যের দুধ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাছাড়া মাংস, পশম এবং মধু উৎপাদনের ক্ষেত্রেও দাবানলের প্রভাব স্পষ্ট।
ভয়াবহ এই দাবানল মোকাবেলার জন্য অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সব মহল থেকেই দারুন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ান কমেডিয়ান চেলেস্ট বারবার মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই প্রায় ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ফান্ড রেইজ করেন দাবানলের ক্ষতি মোকাবেলায়। এছাড়াও আমেরিকান গায়িকা পিঙ্ক, হলিউড মুভি অভিনেতা ক্রিস হেমসওর্থ, অস্কারজয়ী অভিনেত্রী নিকোল কিডম্যানসহ অনেক তারকাই বড় অংকের অর্থ দাবানল মোকাবেলায় দান করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ, অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী, হেলিকপ্টারসহ নানা ধরনের সরঞ্জাম পাঠানো হয় দাবানল মোকাবেলার জন্য। ৪ফেব্রুয়ারি ২০২০সালে অস্ট্রেলিয়ার পার্ল্টামেন্টে প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের দেয়া ভাষ্য অনুযায়ী প্রায় ৭০টি দেশ সাহায্য পাঠাতে চেয়ে অস্ট্রেলিয়াকে অনুরোধ করে। গ্রাউন্ড লেভেলে দাবানল মোকাবেলায় সাহায্য প্রদানের জন্য স্কট মরিসন এক টুইটে আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও নিউজিল্যান্ডকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত হাজারো নাগরিকরা স্বেচ্ছায় অগ্নিমোকাবেলায় নিজেদের নিয়োজিত করেন।
একসময় আমরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে রচনায় পড়তাম, যদি আমরা যথাযথ পদক্ষেপ না নেই, তবে খুব শীঘ্রই আমরা ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হবো। সেসময় ভবিষ্যৎ কালে যে লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম, সেই বাক্যগুলোর কাল পরিবর্তন হয়ে বর্তমান হয়ে গিয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল আমরা ধীরে ধীরে পেতে শুরু করেছি। দুই মেরুতে বরফ ভয়াবহ পরিমাণে গলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
খরা, বন্যা, ঘুর্ণিঝড়সহ নানা বিপর্যয়ে আজ সারাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল আক্রান্ত। এখনই সচেতন না হলে এর পরিণতি খুব একটা সুখকর হবে না। তখন কী হবে একবার ভেবে দেখেছেন? যে প্রকৃতিতে আমরা আছি, তাকে উপেক্ষা করে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটাই না কেন, যতই নিজেদের ক্ষমতা জাহিরের চেষ্টা চালাই না কেন, দিনশেষে প্রকৃতির রোষানলে সকলেই সমান। ভালো থাকুক পৃথিবী, আমাদের পরিচ্ছন্ন চিন্তায় প্রকৃতি হেসে উঠুক আবার। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা যেন দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেন প্রতিটি জীবকে।