পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের কতই না আগ্রহ। সমান আগ্রহ ছিল সেই যমুনা সেতু নিয়েও। একেকটি সেতু কেবল একেকটি জনপদকেই যুক্ত করে না, সহজ করে জীবনকে, বাঁচিয়ে দেয় মহামূল্যবান সময়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংযুক্তির ব্যাপার তো থাকছেই। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু যমুনা ব্রিজ। চার কিলোমিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যের এই সেতু আমাদের অনেক অর্জনের, অনেক পাওয়ার।
অন্যদিকে, বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুও নির্মিত হচ্ছে পালে তিরতির হাওয়া লাগার গতিতে। একটু একটু করে নাম লেখাচ্ছে নতুন অর্জনের খাতায়। সফলভাবে পদ্মা সেতু তৈরি হলে যমুনা সেতুর জন্য একটু খারাপ খবরই বটে। কারণ তার নাম চলে যাবে দ্বিতীয় অবস্থানে। সোয়া ছয় কিলোমিটারের পদ্মা সেতু হয়ে যাবে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। বিশ্বজুড়ে সেতু হলো নির্মাণের অন্যতম একটি শিল্পকলা। এসব স্থাপনা মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে। হাজার হাজার বছর ধরে এই ধরনের স্থাপনা এক ভূখণ্ড থেকে আরেক ভূখণ্ডের মানুষকে সংযুক্ত করে চলেছে। স্থাপত্যবিদ্যার আশীর্বাদ ও প্রযুক্তির কল্যাণে নিত্যনতুন স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে বটে, কিন্তু নির্মাণশৈলীর এক অপরূপ নিদর্শন হলো সেতু।
বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতুর গল্প তো গেলো। সেতু কীভাবে মানুষের সাথে মানুষের, সংস্কৃতির সাথে সংস্কৃতির ‘সেতুবন্ধন’ ঘটিয়ে দেয় তা নিয়েও দু’কলম তাত্ত্বিক কথাবার্তাও হলো। এখন জানা যাক, বিশ্বের বড় বড় সেতুগুলোর কথা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, পৃথিবীব্যাপী দীর্ঘতম সেতুর আলোচনা হলে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে চীন ও এশিয়া। কারণ দীর্ঘতম ১০ সেতুর মধ্যে চীনের নির্মিত সেতুই আছে গুণে গুণে ৭টি! আর এশিয়ার মধ্যে আছে সেরা ১০ এর মধ্যে ৯টি। মজার ব্যাপার হলো, একমাত্র যে সেতুটি এশিয়ার বাইরে সেটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পুরনো দীর্ঘতম সেতু। তৈরি হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। অর্থাৎ এই সেতুর তালিকা দিয়েই টের পাওয়া যায়, এশিয়া মহাদেশ প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি ও স্থাপত্যশৈলীতে কতটা এগিয়ে যাচ্ছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের দীর্ঘতম ১০ সেতু সম্পর্কে।
ডানইয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ, চীন (১ লাখ ৬৪ হাজার ৮০০ মিটার)
এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুর নাম চীনের ডানইয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ। ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮০০ মিটার, অর্থাৎ ১০২.৪ মাইল দীর্ঘ এই সেতু তৈরিতে সময় লেগেছে ৪ বছর। কাজ করেছেন অন্ততপক্ষে ১০ হাজার শ্রমিক। বিশাল এই সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ২০১০ সালে। মূল সেতুর কাজ শেষ হওয়ার এক বছর পর ২০১১ সালে এর রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। একই বছরে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু হিসেবে বিশ্বরেকর্ড করে ডানইয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড সেতু। জায়গা করে নেয় গিনেস বুক আব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তালিকায়।
চাংহুয়া-কোয়াশিউং রেলসেতু, তাইওয়ান (১ লাখ ৫৭ হাজার ৩১৭ মিটার)
পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু অবস্থিত তাইওয়ানে, নাম চাংহুয়া-কোয়াশিউং রেলসেতু। সড়কপথের পাশাপাশি তাইওয়ানের দ্রুতগতির রেলপথ এই সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দেশটির পশ্চিম উপকূলে পৌঁছানো যায়। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সর্বসাধারণের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়া হয়। ২০১২ সাল পর্যন্ত এই সেতু দিয়ে পারাপার হয়েছে প্রায় ২০ কোটি যাত্রী।
ক্যান্ডি গ্র্যান্ড ব্রিজ, চীন (১ লাখ ১৫ হাজার ৯০০ মিটার)
বিশ্বব্যাপী দীর্ঘতম সেতু স্থাপনার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে চীন। সেরা দশের মধ্যে তাদের নির্মিত সেতু রয়েছে একাধিক। পৃথিবীর তৃতীয় দীর্ঘতম সেতুর নাম ক্যান্ডি গ্র্যান্ড সেতু, তৈরি করেছে চীন। এটিও সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু ডানইয়াং-কুনশান গ্র্যান্ডের মতো দীর্ঘ রেললাইন বিশিষ্ট, যা বেইজিং ও সাংহাইকে সংযুক্ত করেছে। সব মিলিয়ে ১১৫.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু। বিশেষভাবে তৈরি ক্যান্ডি গ্র্যান্ড সেতু বড় ধরনের ভূমিকম্পেও অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম।
তাইয়ানজিন গ্র্যান্ড সেতু, চীন (১ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ মিটার)
চীনে অবস্থিত তাইয়ানজিন গ্র্যান্ড সেতু দৈর্ঘ্যে ৭০.৬ মাইল। দেশটির রেলপথের অংশ হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাইয়ানজিন গ্র্যান্ড সেতু নাম লিখিয়েছে।
উইনান উইহি গ্র্যান্ড সেতু, চীন (৭৯ হাজার ৭৩২ মিটার)
সেতুটি দ্রুতগতির রেলপথ ঝেংঝউ-জি’আন এর অংশ এবং পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘতম সেতু। ২০০৮ সালে যখন এই সেতুর কাজ শেষ হয়, তখন এটি বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হিসেবে নাম লিখিয়েছিল। শীর্ষস্থান হারালেও উইনান-উইহি গ্র্যান্ড সেতু এখনও শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে।
হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাও ব্রিজ, চীন (৫৪ হাজার ৭১৭ মিটার)
চলতি বছরের দুই মাস আগে, অর্থাৎ অক্টোবরে সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাও ব্রিজ। বহুল আলোচিত এই সেতুটি বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম সেতু। আলোচিত হওয়ার মূল কারণ এটি হংকং-চীনের মধ্যে সংযুক্ত করেছে ঝুহাই এবং ম্যাকাওকে এর মাধ্যমে। সেতুটি লিংডিং-জিউঝউ চ্যানেলের মাধ্যমে দুই দেশের সংযোগ ঘটিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ৫৪ হাজার ৭১৭ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটি বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুর পাশাপাশি সমুদ্র টানেলও। ২০০৯ সাল থেকে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বলে রাখা ভালো, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসেতুও এই হংকং হাই ম্যাকাও সেতু। বলে রাখা ভালো, এই সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অথচ সেতুর প্রাথমিক সাম্ভাব্য নির্মাণ খরচ ছিল ৯.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ব্যাং না এক্সপ্রেসওয়ে, থাইল্যান্ড (৫৪ হাজার মিটার)
থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ও বিশ্বব্যাপী সপ্তম দীর্ঘতম সেতু হলো দ্য ব্যাং না এক্সপ্রেসওয়ে। সব মিলিয়ে এর দৈর্ঘ্য ৫৪ কিলোমিটার। ২০১০ সালের দিকেও এটি ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু। একটি সেতু হলেও মূলত থাইল্যান্ডের এলিভেটেড সেকশনের অংশ হিসেবে এই সেতু যুক্ত হয়েছে দেশটির জাতীয় হাইওয়ের সঙ্গে। সেতুটি কোনো বিশাল নদীর উপরে স্থাপিত নয়। বরং সেতুর একদম ছোট্ট একটা অংশের নিচ দিয়ে ছোট একটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। অর্থাৎ, পুরো ৫৪ কিলোমিটার পথে মাত্র একটি ছোট নদী পার হওয়ার মাধ্যমে সেতুটি নিজের ‘সেতু নাম রক্ষা’ করেছে।
বেইজিং গ্র্যান্ড সেতু, চীন (৪৮ হাজার ১৫৩ মিটার)
চীনের বেশিরভাগ দীর্ঘ সেতুগুলো মূলত রেলপথ। তারই ধারাবাহিকতায় নাম লিখিয়েছে বেইজিং গ্র্যান্ড সেতু। ৪৮ হাজার ১৫২ মিটার দীর্ঘ এই সেতু ২০১১ সালে হাই-স্পিড বুলেট ট্রেনের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
লেক পন্টচারট্রেইন কজওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র (৩৮ হাজার ৪৪২ মিটার)
পৃথিবীর দীর্ঘতম ১০টি সেতুর নাম লিখতে গেলে এখন পর্যন্ত তালিকার ৯টিই এশিয়ার। একটিমাত্র সেতু এশিয়ার বাইরে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। নাম লেক পন্টচারট্রেইন। ১৯৫৬ সালে সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। দেশটির দীর্ঘতম এই সেতু নিউ অরলিন্স লুইজিয়ানার শহরতলি দিয়ে শুরু করে পন্টচারট্রেইন হ্রদ হয়ে দক্ষিণে চলে গেছে। দুই পাশে দুটি সেতুর মাধ্যমে চার লেনবিশিষ্ট সেতুটি গাড়ি নিয়ে পার হতে হলে আপনাকে খরচ করতে হবে ৫ মার্কিন ডলার।
লাইন-১, উহান মেট্রো সেতু, চীন (৩৭ হাজার ৭৮৮ মিটার)
চীনের উহান শহরের পুরো লাইন ১ মেট্রো সিস্টেম একাই নিয়ন্ত্রণ করছে এই মেট্রো সেতুটি। সবমিলিয়ে সাড়ে ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর কাজ শেষ হয় ২০০৪ সালে।