আজকের লেখার শুরুতেই চলুন ২০১৪ সাল থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রায় ৫৫ কোটি মানুষ তখন খোলা জায়গায় মলত্যাগে অভ্যস্ত ছিলো। কোথায় ছিলো না তাদের মলের ছাপ? খোলা মাঠ, গাছের নিচে, রাস্তার পাশে, নদীর তীরে, রেললাইনের ধারে- সব জায়গাতেই তারা মলত্যাগ করতো। দেশটির শহরে বসবাসকারী সাড়ে ১৫ কোটিরও অধিক মানুষ উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত ছিলো।
এই অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রভাব ফেলেছিলো দেশটির স্বাস্থ্যখাতসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থাতেও। যত্রতত্র মলত্যাগের ফলে দূষিত হতো পানি। সেই পানি পান করে শিশুরা আক্রান্ত হতো নানাবিধ রোগে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, ইতোমধ্যে দেশটির প্রায় সাড়ে ৪ কোটির মতো শিশুর (পাঁচ বছরের কম বয়সী) দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হচ্ছিলো কেবলমাত্র সেই দূষিত পানি পানের ফলে। এমনকি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুমৃত্যুর বার্ষিক হারটাও নগণ্য নয়, প্রায় ৩,০০,০০০। এটা তো গেলো কেবল স্বাস্থ্যখাতের চিত্র, অর্থনীতির দিকেও একবার তাকানো দরকার। বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, বছরে প্রায় ১৬৬ বিলিয়ন ডলার (যা তাদের জিডিপির ৬.৪ শতাংশ) ভারত হারাচ্ছে কেবলমাত্র অপর্যাপ্ত স্যানিটেশনের ফলে উদ্ভূত শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে। অসুস্থ শ্রমিকদের কথাই ধরা যাক। শারীরিক অসুস্থতার দরুন তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না, তাদের আয়ুষ্কাল হয় অল্প, হয় না পর্যাপ্ত সঞ্চয়, সম্ভব হয় না সন্তানদেরও পর্যাপ্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে দেয়ার। অর্থাৎ বাটারফ্লাই ইফেক্টের মতোই এই অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রভাবিত করে পুরো সিস্টেমকেই।
আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এই যে এত বিশাল সংখ্যক মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, আর্থিকভাবে এত ক্ষতি হচ্ছে, এত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে- এই বিষয়গুলো কি ভারত সরকারের নজরে পড়ছিলো না? তারা কি এই অবস্থার উন্নয়নে কাজ করছিলো না? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আপনি এমন সব বিষয়ের মুখোমুখি হবেন, যা জেনে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকবে না।
গত তিন দশক ধরেই দেশটির সরকার দূরবর্তী গ্রামগুলোতে টয়লেট নির্মাণের জন্য অর্থ সাহায্য দিয়ে আসছে। ১৯৮৬-৯৯, এই ১৩ বছরে দেশটিতে নতুন প্রায় ৯৪ লক্ষ টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে বছরে প্রায় ৭৪ লক্ষ মানুষ নতুন করে টয়লেট ব্যবহারের আওতায় আসতে পারছে।
এই তথ্য দেখে আশাবাদী হতেই পারেন ভারতীয় নাগরিকেরা। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। বিপুল সংখ্যক এই টয়লেট নির্মাণ কিন্তু বিপুল হারে সেগুলো ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেয়নি কোনোকালেই। আজ যে ২০১৪ থেকে যাত্রা শুরু করেছি, সেই একই বছরে রিসার্চ ইন্সটিটিউট ফর কমপ্যাশনেট ইকোনমিক্সের গবেষণা থেকে জানা যায়, শতকরা যে ৪০ ভাগ বাড়িতে অন্তত ১টি করে হলেও ব্যবহারোপযোগী টয়লেট রয়েছে, সেখানেও পরিবারের অন্তত একজন মানুষ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো!
গ্রামের মানুষগুলোর অবস্থা তো আরো খারাপ। একটি ভালো পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থার গুরুত্বই তো তারা বুঝতে চাইতো না। খুব জরুরি না হলে তারা টয়লেট ব্যবহারই করতে চাইতো না। তাদের ধারণা ছিলো, সেখানে মলত্যাগের ফলে যে গর্তে গিয়ে মল জমা হচ্ছে তা খুব দ্রুতই ভর্তি হয়ে যাবে, যেখানে বাস্তবতা হলো, ৫ সদস্যের একটি পরিবারের জন্য যে আকারের গর্ত খনন করা হয়, তাতে অনায়াসে ১০ বছর সেটাতে টয়লেটের কাজ সারা যাবে।
কেউ কেউ তো আরো এককাঠি সরেস। তারা এটাকে তাদের পৌরুষত্ব প্রকাশের একটি মাধ্যমে মনে করতো। কারো কারো মতে, এভাবে খোলা ময়দানে মলত্যাগের ফলে তা হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তায় করে! কোনো কোনো বাড়িতে টয়লেটের জন্য কনক্রিটের একটি কাঠামো বানিয়ে রাখা হচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু সেটা আর মলমূত্র ত্যাগের কাজে লাগানো হচ্ছিলো না। বরঞ্চ আসল কাজ ছাড়া আর বাকি সব কাজেই লাগানো হচ্ছে সেই টয়লেটকে। কী সেটা? জ্বালানী কাঠ, মুরগি, ঘাস, গরুর শুকনো গোবর, খাদ্যশস্য, ছাগল রাখার জায়গা, এমনকি মন্দির হিসেবেও ব্যবহারের কথাও শোনা গিয়েছে।
উপরের দুই অনুচ্ছেদে তো তুলে ধরা হলো বোকামির চিত্র। এখন চলুন দেখা যাক দূর্নীতির দুটো নমুনাও। অনেক পরিবারই আছে, যারা টয়লেট নির্মাণের জন্য আর্থিক সাহায্য নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই অর্থ দিয়ে আর সেই টয়লেটটি গড়ে উঠছে না। সেটা ব্যয় হচ্ছে পরিবারেরই অন্য কোনো কাজে। অনেক সময় গ্রাম্য নেতা, এলাকাটি পরিদর্শনের কাজে নিয়োজিত জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার এবং স্থানীয় ঠিকাদারের মাঝে গোপন আঁতাত থাকে, যার ফলে টয়লেটের ডিজাইন থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রী পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই চলে অর্থ হাতানোর ধান্দা।
এতটুকু পড়ে যে কারোরই মনে হবে, আমি ভারতবাসীর নিন্দা করতে এই লেখাটি লিখতে বসেছি, হয়তো টয়লেটের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে তাদেরকে ছোট করাই আমার উদ্দেশ্য। আপনি যদি এমনটা ভেবে থাকেন, তাহলে বলতেই হয়, আপনি একেবারেই ভুল জগতে আছেন। কারণ এতক্ষণ ধরে আপনাকে মুদ্রার একপিঠ দেখানো হয়েছে, যা ২০১৪ সালের কথা বলে। এখন চলুন আমরা ধীরে ধীরে ২০১৮ সালের দিকে রওয়ানা দেই, যা আপনাকে মুদ্রার অপর পিঠই কেবল দেখাবে না, সেই সাথে সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের হার আপনাকে অতিমাত্রায় বিস্মিত করে ছাড়বে।
১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি কালক্রমে তার যুগান্তকারী কর্মকাণ্ডের দরুন সমগ্র বিশ্বজুড়েই এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিতে পরিণত হন, পরিণত হন ভারতের জাতির পিতায়। তাঁর মতো একজন ব্যক্তির অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ২ অক্টোবর, অর্থাৎ গান্ধীজীর জন্মদিনে ভারতজুড়ে পালন করা হয় গান্ধী জয়ন্তী। দিনটি ২০০৭ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে অহিংস দিবস হিসেবেও প্রতিপালিত হয়ে আসছে।
২০১৪ সালের গান্ধী জয়ন্তীর দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজকের আলোচ্য স্বচ্ছ ভারত অভিযানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ২০১৯ সালের ২ অক্টোবরের মাঝে ভারতে খোলা জায়গায় মলত্যাগের রীতি পুরোপুরি বন্ধ করা। কেন ২০১৯ সাল? কারণ আগামী বছরই মহাত্মা গান্ধীর জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হবে। জাতির পিতার প্রতি সম্মানার্থে এমন চমৎকার একটি লক্ষ্য অর্জন করার এটাই তো শ্রেষ্ঠ সময়, কারণ গান্ধীজী রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেয়েও সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থাকে পবিত্র এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন।
স্বচ্ছ ভারত অভিযানের (ইংরেজিতে যা ‘ক্লিন ইন্ডিয়া মিশন’ নামে পরিচিত) আওতায় সারা ভারত জুড়ে ৯ কোটি টয়লেট নির্মাণ করা হবে। তবে স্বচ্ছতা, অর্থাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তো কেবলমাত্র টয়লেট থেকেই হবে না, পাশাপাশি পরিষ্কার রাখতে হবে আশেপাশের পরিবেশও। এজন্য দেশটির শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণও এই অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে ৩২,৮৭,৪৬৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাস করা প্রায় ১৩৫ কোটি মানুষের জন্য সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা তো যেনতেন কথা নয়। তাই এই অভিযানের খরচও পড়বে প্রচুর, প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!
গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা মনে আছে তো? ভারতের প্রায় ৪,০৪১টি শহর, নগর ও গ্রামাঞ্চল জুড়ে চলা বিশাল এ কর্মযজ্ঞকে নরেন্দ্র মোদী আখ্যায়িত করেছেন ‘সত্যাগ্রহ থেকে স্বচ্ছগ্রহ’ আন্দোলন হিসেবে। এখানে যারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন, তাদেরকে বলা হচ্ছে ‘স্বচ্ছগ্রাহী’, অর্থাৎ ‘পরিচ্ছন্নতার প্রতিনিধি’। তারা মূলত গ্রামাঞ্চলগুলোতে এই অভিযান সফল করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল যেসব পরিবার তাদের ঘরে টয়লেট নির্মাণ করতে চাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে ১২,০০০ রুপির অনুদান।
বিষয়টি এমন না যে এর আগে ভারতে এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সেটা চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। ২০০০ সালে গ্রামাঞ্চলে স্যানিটেশন নিশ্চিতের লক্ষ্যে শুরু হওয়া টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেইন (টিএসসি) ২০১২ সালে নাম পরিবর্তন করে হয় ‘নির্মল ভারত অভিযান’। মধ্যপ্রদেশের ৮০টি গ্রাম নিয়ে চলা ছোটখাট সেই অভিযান খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার কিছুটা কমাতে সক্ষম হলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এটাকে আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। তাই ২০১৪ সালে নানাবিধ পরিবর্তন এনে এখান থেকেই তৈরি করা হয় ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’।
শচীন টেন্ডুলকার, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, শাহরুখ খান, মনীষা কৈরালা, বিরাট কোহলি, এমএস ধোনী, সঞ্জয় দত্তসহ ভারতের অনেক নামকরা তারকাই অংশ নিয়েছেন স্বচ্ছ ভারত অভিযানের প্রচারণামূলক ক্যাম্পেইনে। দ্য আগলি ইন্ডিয়ান, ওয়াস্ট ওয়ারিয়র্স ও SWaCH Pune (Solid Waste Collection and Handling) এর মতো এনজিওগুলো কাজ করে যাচ্ছে এই কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য।
অভিযানের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও বিশাল কর্মযজ্ঞের কথা তো এতক্ষণ ধরে জানলেন। এর ফলাফল কী হলো সেটা জানবেন না? স্বচ্ছ ভারত অভিযানের আওতায় ২০১৪ সাল থেকে এখন অবধি দেশটিতে সাড়ে ৮ কোটির অধিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে খোলা জায়গায় মলত্যাগ করা মানুষের সংখ্যা ৫৫ কোটি থেকে আজ নেমে এসেছে ১০ লাখেরও নিচে!
ভাবা যায়, কতটা আত্মনিবেদিত ও বদ্ধপরিকর হলে একটি জাতি মাত্র চার-পাঁচ বছরের মাঝে এই বিশাল সাফল্য অর্জন করতে পারে! এ যেন অনেকটাই রাতকে দিন কিংবা দিনকে রাত করে ফেলার মতো ব্যাপার। কিন্তু সেটাই তারা করে দেখাচ্ছে, এবং সেটাই তারা সম্পূর্ণ করে দেখাবে।
আমাদের দেশেও তো এমন নানাবিধ সমস্যা আছে। দেশটাকে ভালোবেসে, দেশটাকে নিজের মা মনে করে আমরাও কি পারি না সীমিত সম্পদের ব্যবহার করে দেশের জন্য সর্বোত্তম সমাধান নিয়ে আসতে? আমাদের প্রতিবেশীরা যদি এমন সফলতা অর্জন করতে পারে, তাহলে আমরাই বা পারবো না কেন? আমাদেরও অবশ্যই পারতে হবে। কারণ এই দেশটা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি, এসেছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং শত-সহস্র জানা-অজানা আত্মত্যাগের বিনিময়ে…
বি.দ্র: পুরো লেখাটি পড়ে বাংলাদেশী যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, “আচ্ছা, বাংলাদেশের স্যানিটেশন ব্যবস্থা তাহলে কেমন?” আপনাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলতে হয়, আমরা এখানে বেশ ভালো অবস্থাতেই রয়েছি। ১৯৯০ সালে যেখানে আমাদের দেশের শতকরা ৩৪ ভাগ মানুষ খোলা জায়গায় মলত্যাগে অভ্যস্ত ছিলো, ২০১৫ সালে সেটা নেমে এসেছে শতকরা মাত্র ১ ভাগে! অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্যি। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, এ দেশের ৬১ ভাগ মানুষ উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতাভুক্ত, প্রতি বছর যেটা ১.১ শতাংশ করে বাড়ছে।