আফ্রিকা মহাদেশ পৃথিবীর ‘সভ্য’ মানুষদের কাছে অপরিচিত ছিল বহু বছর ধরে। ইতিহাসের হাজার বছরের পরিক্রমায় আফ্রিকা মহাদেশের আবিষ্কার মনে হয় যেন সেদিনের ঘটনা। জীববৈচিত্র্যের বিশাল সমাহার নিয়ে মহাদেশটি পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা নিয়ে আছে সগৌরবেই। আর একটা বিষয় হচ্ছে, আবিষ্কার না হলেই তো আর কোনো কিছু অস্তিত্বহীন হয়ে যায় না!
ইউরোপীয়দের উন্নতির পেছনে যে হাজার হাজার আফ্রিকানকে দাস হিসেবে ব্যবহার করার নির্মমতা মাটিচাপা পড়ে রয়েছে, সে গল্প কি এত সহজে ঢেকে রাখা যাবে? শান্ত, সহজ-সরল আফ্রিকানদের প্রতি এমন অবিচারের কলঙ্ক ইউরোপীয় সভ্যতা চাইলেই তো আর মুছে ফেলতে পারবে না, পারা সম্ভব নয়।
আফ্রিকার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। নিজেদের মতো করেই তারা জীবনকে যাপিত করছে, অনেক বছর ধরেই। অনেকটা বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদীর মতো, একটানা। ইউরোপীয় জ্ঞানের আলোয় ‘আলোকিত’ শ্বেতাঙ্গদের চোখে তারা অসভ্য, বর্বর হতে পারে, কিন্তু তাদের ঐতিহ্য-প্রথা-বিশ্বাস-সংস্কৃতি তাদের সমাজকে ঠিকই চালিয়ে নিচ্ছে। পৃথিবীতে প্রকৃতির সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা মানুষদের তালিকা করলে আফ্রিকার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীদের নাম আসবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
পূর্ব আফ্রিকার একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নাম মাসাই। এককালে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ার বিশাল ভূমিতে তারা রাজত্ব করত। গ্রেট রিফ্ট উপত্যকার বিশাল জায়গায় তারা তাদের উপস্থিতি জানান দিত সমহিমায়। সময়ের সাথে সাথে হয়তো তাদের আধিপত্যের বৃত্তের ব্যাসার্ধ কমে এসেছে, কিন্তু একেবারেই ফিকে হয়ে যায়নি।
মাসাই জনগোষ্ঠীর আদিপুরুষেরা নাইলো-সাহারান অঞ্চল থেকে দক্ষিণ দিকে সমতল ভূমির আশায় পা বাড়িয়েছিল। সেটি আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগের কথা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজকের দিনের উত্তর কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ার বিশাল সবুজ ভূমিতে তারা নিজেদের স্বপ্নের জায়গা খুঁজে পেয়েছিল। তাদের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার কারণ, তাদের পশুর পাল চড়ানোর জন্য ভালো জায়গা খুঁজে নেয়া।
মাসাই সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের পশুর পাল। তাদের জীবন আবর্তিত হয় পশুর পাল ঘিরেই। সে সমাজে সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হলো পশুর পাল ও সন্তান। যার সন্তান ও পশুর পাল যত বড়, তার সম্মান ও মর্যাদাও তত বেশি। সন্তান ও পশুর পালের সাথে তাদের সামাজিক অবস্থান সমানুপাতিক। গরুর পালকে মাসাই সমাজে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে গণ্য করা হয়। গরুকে সৃষ্টিকর্তা ও মানুষের মাঝে মেলবন্ধনকারী জীব হিসেবে মাসাইরা সমাদর করে থাকে।
মাসাই জনগোষ্ঠীর ভাষার নাম ‘মা’ (maa)। আসলে মাসাই শব্দের অর্থ মা (maa) ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠী। অর্থাৎ তাদের নামকরণ তাদের ভাষার মাধ্যমেই হয়েছে।
তাদের খাবারের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক। তাদের খাদ্যের প্রধান যোগান আসে তাদের পালিত পশুগুলোর কাছ থেকে। দুধ, মাংস, রক্ত- তাদের খাদ্যের তালিকায় এগুলোর অবস্থান উপরের দিকে। রক্তপান তাদের সমাজে একটি ঐতিহ্যবাহী কাজ। দুধের সাথে রক্ত মিশিয়ে পান করে তারা, আবার শুধু টাটকা রক্তও পান করে। মধু গাঁজিয়ে একধরনের মদ বানানো হয়, যেটির পান করার অনুমতি রয়েছে শুধু সমাজের প্রভাবশালী ‘এলডার’দের।
একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তারা দিনে প্রায় ৬০০-২,০০০ গ্রাম কোলেস্টেরল গ্রহণ করে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে দিনে একজন মানুষের গ্রহণ করা উচিত সর্বোচ্চ ৩০০ গ্রাম। কিন্তু তারপরও তাদের কোলেস্টেরলের আধিক্যজনিত কোনো রোগের চিহ্ন নেই।
মাসাইরা যে ঘরে থাকে, তাকে বলা হয় ‘ইনকাজিজিক’। অনেকটা ভবঘুরে ঘরানার হওয়া, তারা টেকসই কোনো ঘর বানায় না। ঘর বানানোর দায়িত্ব মেয়েদের। বৃদ্ধা ও গর্ভবতী নারীদের এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়। তবে বৃদ্ধারা ঘর বানানোর সময় তরুণীদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
‘ইনকাজিজিক’ তৈরির মূল উপাদান সংগ্রহ করা হয় প্রকৃতি থেকেই। প্রথম গোলাকার ঘরের প্রাথমিক কাঠামো দাঁড় করানো হয় গাছের শুকনো ডালপালা দিয়ে। এরপর গোবর, মাটি ও পানির মিশ্রণে তৈরি আঠালো চিটচিটে কাদাসদৃশ জিনিস দিয়ে দেয়ালগুলো লেপে দেয়া হয়। ছাদেও লেপে দেয়ার পর খড় দিয়ে পুরো ছাদ ঢেকে দেয়া হয়। দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের মাটির ঘরগুলোর মতো। তাদের পুরো গ্রামের চারপাশে গোলাকৃতির বেড়া নির্মাণ করা হয়, যাতে বন্য হিংস্র জানোয়ারের কাছ থেকে তাদের পশুগুলো রক্ষা পায়।
মাসাই যোদ্ধারা অত্যন্ত সাহসী ও শক্তিশালী। বাছাই করা তরুণ ও যুবাদের কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সমাজে তাদের অবস্থানও উঁচুতে। নানা রকম নকশাকৃত গহনা পরিধান করে তারা, যেগুলো তাদের গৌরবগাঁথাকে উপস্থাপন করে। মাসাই যোদ্ধারা হিংস্র সিংহের হাত থেকে মাসাই গ্রামগুলোকে রক্ষা করে।
তাদের ইতিহাসেও খারাপ সময় এসেছে। ১৮৮৩ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত সময়কে মাসাইদের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় ভাবা হয়। মহামারী, দুর্ভিক্ষ ও খরায় সিংহভাগ পশু মারা যায় এ সময়ে। মাসাইদের ভাষায় এ সময়কালকে ‘এমুতাই’ বলা হয়।
কেনিয়ায় ১৯০৪ ও ১৯১১ সালের চুক্তির কারণে মাসাইদের বিরাট অঞ্চল ছেড়ে দিতে হয়েছে ব্রিটিশদের কাছে। প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি এই দুই চুক্তির ফলে হাতছাড়া হয়ে যায়। তাঞ্জানিয়াতেও বিরাট অঞ্চল সরকার মাসাইদের কাছ থেকে নিয়ে নেয় ন্যাশনাল পার্ক তৈরি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জায়গা হিসেবে তৈরি করার কথা বলে।
মাসাই সমাজ অত্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক। সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে বয়স্ক পুরুষেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সমাজের নেতাও পুরুষদের মাঝ থেকেই হয়ে থাকেন।
মাসাইরা একেশ্বরবাদী। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের ঈশ্বর সবকিছুতেই বিরাজমান থাকেন। মাসাই সমাজে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন পাবার জন্য বেশি করে সন্তান ও পশু থাকতে হয়।
মাসাইরা প্রকৃতির কোলে থাকতেই ভালোবাসে। কেনিয়ার সরকার তাদের আদিম পেশা ত্যাগ করে আধুনিকতার সাথে খাপ খাওয়াতে উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু তারা তাদের আদি পেশাতেই সন্তুষ্ট। আফ্রিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সাফারি পার্কের নাম ‘মাসাই মারা’, যেটি তাদের জাতিসত্ত্বার নামেই নামকরণ করা হয়েছে। প্রকৃতির কোলে থেকেও তারা প্রকৃতিকে ধ্বংসের কোনো চেষ্টা করেনি, প্রকৃতিও তাদের দু’হাত ভরে প্রতিদান দেয় অনবরত। আফ্রিকার সবচেয়ে চমৎকার বনভূমিগুলো মাসাই এলাকাগুলোতেই অবস্থিত। আধুনিক প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষময়তার এ যুগে এসেও তারা তাদের প্রথানুযায়ী নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলেছে।