আমরা যখন ঢাকায় চলে আসি, আমার বাবা খুব বৃদ্ধ হওয়ার কারণে এখানে কাজ করতে পারতেন না, তাই আমার ভাই আমাদের দেখভাল করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর আমাকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে হয়েছিল। (যদি আমরা বাড়িতে থাকতাম) আমি আমার স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারতাম। চাষ করার জন্য আমাদের জমি থাকত, যাতে আমাদের জীবন আরও ভালভাবে কাটত। আমাদের নিজেদের জমি ছিল, তাই আমাদের মানুষের পেছনে ছুটতে হতো না। সেখানে জীবনটা ভালো ছিল।
কথাগুলো বিলকিসের (৪১)। ১৯৭০ সালের প্রলয়কারী ঘূর্ণিঝড়ে বিলকিসের পরিবারসহ আরও অসংখ্য পরিবারকে ভোলা থেকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। বরণ করে নিতে হয় জলবায়ু-শরণার্থীর পরিচয়।
জলবায়ু-শরণার্থী কারা?
একজন ‘শরণার্থী’ বা ‘উদ্বাস্তু’ বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা হয় যিনি একটি আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করেছেন। এর কারণ হতে পারে- তিনি সম্ভবত জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা কিংবা একটি নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ বা রাজনৈতিক মতামতের কারণে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ের মুখে রয়েছেন। কিছু প্রেক্ষাপটে, সংজ্ঞাটি “জনসাধারণের শৃঙ্খলাকে গুরুতরভাবে বিঘ্নিত করে এমন ঘটনা” থেকে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ক্রমেই বৈশ্বিক এক গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা প্রভাব ফেলছে মানুষের জীবনযাত্রায়। পরিবেশের বিধ্বংসী পরিবর্তন দেশে দেশে মানুষকে প্রভাবিত করছে। মানুষ বাধ্য হয়ে ভিটেমাটি ছাড়ছে, বদলাচ্ছে চেনা পরিবেশ। ঠাঁই খুঁজছে নিরাপদ আশ্রয়ে। প্রাথমিক অবস্থায় অবশ্য দেশের সীমানা পেরোনোর কথা ভাবছে না ভুক্তভোগীরা। গ্রামের মানুষ চলে আসছে শহরে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় শরণার্থীর সংজ্ঞায়। কারণ, ১৯৫১ সালে শরণার্থী বিষয়ক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- শরণার্থী হিসেবে পার করতে হবে দেশের সীমানা। আবার যারাই জায়গা বদল করছেন, তারা যে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ভিটেমাটি ছাড়ছেন- এটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ধরুন, জলবায়ু পরিবর্তন খরা এবং কৃষিকাজের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এর অর্থ হতে পারে যে লোকেরা তাদের কৃষি থেকে আয় কমে যাওয়ার সাথে সাথে স্থান বদলে ফেলছেন, এবং অন্য কাজ খুঁজে বের করছেন। তারা কি জলবায়ু-শরণার্থী হিসেবে পরিচিত হবেন?
এমনও তো হতে পারে যে- যদি তাদের কাছাকাছি অন্য কাজের সুযোগ থাকে, তবে তারা ভিটেমাটি থেকে সরবেন না। তাহলে কি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের সরানো হয়েছে? নাকি এটা সত্যি যে তাদের স্থানীয় অর্থনীতিতে বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে? অবশ্যই আমরা বলতে পারি যে- জলবায়ু পরিবর্তন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু ‘জলবায়ু-শরণার্থী’ কথাটি খুব নিখুঁত কিছু প্রস্তাব করে। জলবায়ু-শরণার্থীর সংজ্ঞা নিয়ে তাই আছে মতভেদ। শব্দটি জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশন দ্বারাও অনুমোদিত নয়। সংস্থাটি বলছে, এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের “দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি” হিসেবে উল্লেখ করা আরও সঠিক।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার প্রতি বছর শরণার্থীদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে আসছে। তবে এই পরিসংখ্যানে আলাদা করে জলবায়ু শরণার্থীদের কথা বলা হয় না। দুর্যোগ বিষয়ক তাদের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০০৮-২০ সালে প্রায় ৩১৮.৭ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন নানা দুর্যোগের কারণে। এই সময়ে সাড়ে নয় হাজারের বেশি দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে বিশ্বের ২০০টি দেশে। দুর্যোগের ক্যাটাগরিতে তারা রেখেছেন ভূমিকম্প, খরা, অগ্ন্যুৎপাত, বন্যা, তাপমাত্রার উর্ধ্বগতি, দাবানলের মতো ঘটনাগুলোকে।
এই পরিসংখ্যান দেখে অবশ্য জলবায়ু-শরণার্থীদের সঠিক সংখ্যা বোঝা যাবে না। কারণ, এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসী হওয়া ভুক্তভোগীদের তথ্য থেকে। দেশের অভ্যন্তরে যে ভুক্তভোগীরা ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য শহরে স্থায়ী হয়েছেন, তাদের তথ্য আমলে নেওয়া হয়নি। সংজ্ঞার গোলমাল তাই গড়িয়েছে পরিসংখ্যানেও। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন সর্বশেষ শরণার্থী বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করে গত বছরের নভেম্বরে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৮ কোটি ৪২ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছেন বিভিন্ন দেশে। কারণ হিসেবে জুলুম, নিরাপত্তাহীনতা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষা বলছে, ২০২০ সালের শেষদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ।
জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে শরণার্থীদের উপর প্রভাব ফেলে?
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অসংখ্য, এবং উভয়ই বাস্তুচ্যুত হওয়া এবং জীবনযাত্রার অবস্থাকে আরও খারাপ করতে পারে, বা যারা ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে তাদের জন্য ফিরে আসা কঠিন করে তুলতে পারে। সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ (যেমন- খাওয়ার পানি) বিশ্বের অনেক অংশে আরও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে, যা শরণার্থীর জীবন বরণে বাধ্য করছে অসহায় মানুষদের। কোথাও ক্রমেই তাপমাত্রা সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, এবং মাঠের পর মাঠ শুকিয়ে যাচ্ছে। কোথাও আবার শীত জেঁকে বসছে হাড় কাঁপিয়ে। এমন পরিস্থিতি শস্য এবং গবাদিপশুর জন্য যেমন হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, একইভাবে মানুষের জীবন ও জীবিকাতেও রাখছে বিরূপ প্রভাব।
পরিস্থিতি থাকছে না সহ্যসীমায়। মানুষ যে খাপ খাইয়ে বাঁচার চেষ্টা করবে, সেই উপায়ও থাকছে না। ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, মাসের পর মাস ধরে থাকা খরা, মরুকরণ, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো ঘটনা প্রতি বছর গড়ে দুই কোটির বেশি মানুষকে নিজ ভিটা ছেড়ে দেশের অন্যত্র গিয়ে বসবাসে বাধ্য করছে। কিছু লোক জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হয়, এবং কিছু পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সুরক্ষারও প্রয়োজন হতে পারে।
একজন বিলকিস যেন লাখো শরণার্থীর প্রতিচ্ছবি
এই লেখার শুরুতে বিলকিসের কথা জানিয়েছিলাম আপনাদের। তার কথায় ফেরা যাক। বিলকিসের পরিবারের আবাস এখন রাজধানী ঢাকার একটি বস্তিতে। এই বস্তিকে সবাই ভোলা বস্তি নামেই চেনে। কারণ, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভোলা থেকে আসা অসংখ্য পরিবারের আবাসস্থল এখন এটি। বস্তিতে বিলকিস থাকেন কাঠের একটি বাসার তিন তলায়। জায়গাটা এতটাই নোংরা যে খাবার, বর্জ্য কিংবা সুয়ারেজ লাইনের দুর্গন্ধকে আলাদা করার উপায় নেই। তবু বিলকিস খুশি। কারণ এখানে যদি বন্যা হয় তাহলে তার পরিবার তিন তলায় থাকায় বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ার শঙ্কা নেই। তবে আগুন লাগলে যে পরিস্থিতি অন্যরকম হবে সেটা বিলকিসও জানেন।
বিলকিসের গল্প জলবায়ুর সংকটের কারণে মানুষ যে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তার একটি উদাহরণ মাত্র। নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে তার পরিবার ভোলা বস্তিতে চলে আসে। ঘূর্ণিঝড়ের ভাঙনে তিনটি ঘর ও দুই ছেলে হারানোর পর আর কোনো পথ খুঁজে পায়নি পরিবারটি। কিন্তু ঢাকায় এসেও আতঙ্ক আর চ্যালেঞ্জের সাথে লড়াই করে দিন কাটছে এই পরিবারের। অবৈধ বসতি স্থাপনের কারণে বার বার উচ্ছেদের শিকার হতে হয়েছে তাদের। সংসার চালাতে ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশা বেছে নিতে হয়েছে তাকে। এমন করেই অনিশ্চিত এক জীবনে নিজেদের অসহায়ত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা বিলকিসের মতো লাখো জলবায়ু-শরণার্থীর।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অভ্যন্তরে জলবায়ু-শরণার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি ছাড়াবে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হবে বাংলাদেশের।
জলবায়ু-শরণার্থীদের গন্তব্য শুধু রাজধানীই নয়। গ্রাম থেকে শহর, যেখানে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ মেলে, সেখানেই আবাস গড়ার চেষ্টা করেন ভুক্তভোগীরা। যেমন, বাগেরহাটের মংলা উপজেলাতেই আছেন দেড় লক্ষাধিক জলবায়ু শরণার্থী। মংলা এখন জলবায়ু সহনশীলতার মডেল টাউন হিসেবে গড়ে উঠেছে। নদীবন্দর, ইপিজেড, এবং জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামোর কারণে ভুক্তভোগীদের কাছে আস্থার নাম হয়ে উঠছে মংলা। এমন একটি সফল মডেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী আরও শহর অভিবাসী-বান্ধব স্থানে পরিণত হতে পারে। এতে বিলকিসের মতো শহরকেন্দ্রিক পরিবারগুলোকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে না।
সংকট কি বাড়ছে?
২০১৯ সালের ১৪ মার্চ; আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে আঘাত হানলো ঘূর্ণিঝড় ইদাই। বিগত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর এই ঘূর্ণিঝড়ে একদিনেই বাস্তুচ্যুত হলো প্রায় দেড় লাখ মানুষ। সরকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের অস্থায়ী আবাসে নিয়ে যায়। ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়ের সপ্তাহ ছয়েকের মধ্যে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে দেশটিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এর ভয়াবহ রূপ দেখতে শুরু করেছে। বিশ্ব একটি ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে এই ‘ভয়াবহ’ ঝড়গুলো সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠবে। এতে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশগুলো। বৃহৎ আকারে জলবায়ু-শরণার্থীর সৃষ্টি হবে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। কিন্তু সেই তুলনায় সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুতি চোখে পড়ার মতো নয়।
শরণার্থীরা নতুন জায়গায়আবাস গড়তে গিয়ে জেনে কিংবা মনের অজান্তেই ক্ষতি করে বসছে সংশ্লিষ্ট স্থানের পরিবেশের। গাছ কাটা পড়ছে, পাহাড় কেটে সমতল করে দেওয়া হচ্ছে, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান বাড়াচ্ছে দূষণ। এক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে নতুন করে হাজারও সমস্যাকে ডেকে আনা হচ্ছে। জলবায়ু পড়ছে নাজুক পরিস্থিতিতে। জাতিসংঘ সহ বৃহৎ দাতা সংস্থাগুলো বরাবরই বলে আসছে, সমস্যার সমাধানে তারা যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা এবং ভবিষ্যতের ভাবনায় সেই আন্তরিকতায় ঘাটতিকে সামনে আনে। নইলে বছরের পর বছর চলে যাওয়ার পরও জলবায়ু-শরণার্থী বিষয়ক একটি সংজ্ঞা দাঁড় করানো গেল না কেন? কেন কোনো সঠিক পরিসংখ্যান বা তদারকি নেই জলবায়ু শরণার্থীদের? আন্তর্জাতিক আইনের বর্তমান ব্যবস্থা জলবায়ু-শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য অনুকূল নয়, কারণ জলবায়ু-শরণার্থীদের সমর্থন করার জন্য দেশগুলোকে বাধ্য করে এমন কোনো আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক চুক্তি নেই। আগামীতে তাই দেখার বিষয়- সংকট মোকাবিলায় সংশ্লিষ্টরা ঠিক কী ব্যবস্থা নেন, এবং তা কীভাবে কার্যকর করেন।