মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের এক শহর জপলিন। এর বারো মাইল দক্ষিণ-পূর্বে একেবারেই সাদামাটা এক রাস্তা। পিচ ঢালা মসৃণ পথ নয়, বরং নুড়িপাথর বেছানো কিছুটা এবড়োথেবড়োই বলা চলে। একসময় হাইওয়ে-৬৬ এর অংশ ছিল চার মাইলের পথ, ডেভিল’স প্রোমেনেড। চলে গেছে ওকলাহোমা সীমান্তের দিকে।
এখন প্রায় পরিত্যক্ত রাস্তাটি। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর অবস্থাই অনেকটা অনুরূপ। তবে ব্যতিক্রম হর্নেট গ্রাম। আধুনিক লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত এই গ্রামে প্রায়শই লেগে থাকে মানুষের ভিড়। কেন? কারণ তারা সকলেই ছুটে আসে ডেভিল’স প্রোমেনেডে এক ভূতুড়ে আলো দেখতে, যার নাম হয়ে গেছে হর্নেট স্পুক লাইট (Hornet Spook Light)।
রুট-৬৬
রুট ৬৬ বা হাইওয়ে-৬৬ কে ‘মাদার হাইওয়ে‘ও বলা হয়। লেখক জন স্টেইনব্যাক ১৯৩০-এর দশকে এই নামের প্রচলন ঘটান। ১৯২৬ সালে এর উদ্বোধন হয়। পূর্বে শিকাগো থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমে লস অ্যাঞ্জেলস অবধি চলে গেছে এটা। ১৯৮৫ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে হাইওয়ের তালিকা থেকে কাটা পড়ে এর নাম, কারণ ততদিনে চালু হয়ে গেছে ইন্টারস্টেট হাইওয়ে।
হাইওয়ে-৬৬ এর আশেপাশে আছে প্রায় ২৫০টি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এর মধ্যে দালানকোঠা, সেতু, এমনকি ইন্টারসেকশনও পড়েছে। হর্নেটের ডেভিল’স প্রোমেনেড ঘিরেও আছে এমন কয়েকটি জায়গা।
ডেভিল’স প্রোমেনেড
মূলত মাটি আর পাথরের চার মাইল লম্বা এক রাস্তা, হাইওয়ে-৬৬ এর একপাশে পড়েছে। জায়গাটা মিসৌরির ওজার্ক পর্বতশ্রেণীতে, ওকলাহোমার সীমান্ত থেকে বেশ কাছে। পাশেই আবার বন, ভূতুড়ে কাজকর্মের উপযুক্ত জায়গাই বটে!
এই রাস্তায় নাকি দেখা যায় ভূতুড়ে এক আলোকচ্ছটা, যার গল্প জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে বলে আসছে স্থানীয়রা। অনেকটা গোলাকার এই আলো বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, তা-ও কেবল রাতে। আবার সব রাতে দেখাও যায় না তা। এজন্য গালভরা এক নামও জুটে গেছে এই রাস্তার- ডেভিল’স প্রোমেনেড (Devil’s Promenade)।
দ্য স্পুক লাইট
হর্নেটের ভূতুড়ে আলো, বা হর্নেট স্পুক লাইট (The Spook Light) অনেকটা বাস্কেটবাল আকৃতির জ্বলন্ত আলো। রাতের বেলা ডেভিল’স প্রোমেনেডের গা ছমছমে পরিবেশে সাধারণত সন্ধ্যার দিকে দেখা মেলে এই আলোর। জ্যান্ত প্রাণীর মতো মোচড় খায় রাস্তার উপর, ছুটোছুটি করে বেড়ায় এ-মাথা থেকে ও-মাথা। যারা দেখেছেন তাদের মতে, এর দিকে এগিয়ে গেলেই বেমালুম উবে যায় এই স্পুক লাইট!
স্পুক লাইট হর্নেট থেকেই সবচেয়ে ভালো দেখা যায়, এজন্য এর নামের সাথে জড়িয়ে গেছে হর্নেট গ্রাম। তবে আদতে এর উপস্থিতি থাকে মিসৌরি সীমান্তের ঠিক ওপারে ওকলাহোমার কুইপা শহরের (Quapaw) সামনে। একে জপলিন স্পুক লাইট অথবা ট্রাই স্টেট স্পুক লাইটও বলে থাকেন কেউ কেউ।
কিংবদন্তী বলে, এই আলোকচ্ছটা সর্বপ্রথম দেখতে পায় ইন্ডিয়ানরা। ১৮৩৬ সালে শ্বেতাঙ্গ সেটলাররা জমি দখল করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলগুলো থেকে তাদের জোর করে ঠেলে দেয় পশ্চিমে। হাজার হাজার ইন্ডিয়ান নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে যে পথ ধরে অভিবাসন করে কালক্রমে তা পরিচিতি পায় ‘ট্রেইল অব টিয়ার্স‘ (Trail of Tears) নামে। এই পথেই নাকি প্রথম শুরু হয় স্পুক লাইটের আনাগোনা। ১৮৮১ সালে প্রকাশিত এক সংবাদে একে স্পুক লাইট নামকরণ করা হয়। তবে বিশদ বিবরণ প্রথম পাওয়া যায় ১৯৩৬ সালে কানসাস সিটি স্টার পত্রিকার একটি আর্টিকেলে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও লেখক ভ্যান্স র্যান্ডলফ ১৯৪৭ সালে এক লেখায় নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিন তিনবার এই আলো দেখেছেন বলে দাবি করেন তিনি। ডিমের সমান থেকে শুরু করে বড় বলের মতো আকার ধারণ করতে চোখের সামনেই দেখেছেন এই হলুদাভ এই লাইটকে। তার বর্ণনায় এমনও পাওয়া যায় যে, কোনো কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর চোখের সামনে এই আলো তিন-চার ভাগ হয়ে গেছে, এমনকি রঙ পরিবর্তন হয়ে লাল, নীল, এমনকি সবুজ হয়েছে বলেও জানায় তারা। কেউ কেউ তো বলেই বসেন এর থেকে চারদিকে আলোর বিকিরণ ছড়াতে দেখেছেন তারা, হালকা উত্তাপও অনুভব করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউএস আর্মি ইঞ্জিনিয়ার্স কর্পস হর্নেট স্পুক লাইটের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা বের করতে ব্যর্থ হয় তারা। এরপর চারদিকে ছড়িয়ে পরে ভূতুড়ে এই আলোর কাহিনী, দলে দলে মানুষ ভিড় জমায় হর্নেটে। গ্রামবাসীরা এই উপলক্ষে কামিয়ে নেয় বেশ ভালো অর্থ, এমনকি স্পুকলাইট মিউজিয়ামও গজিয়ে ওঠে রাতারাতি।
কিংবদন্তী
হর্নেট স্পুক লাইট নিয়ে প্রচলিত আছে বহু মিথ। সবচেয়ে পুরনো গল্প স্থানীয় ইন্ডিয়ান গোত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। তাদের এক রাজকন্যা নাকি গোত্রনেতা বাবার অমতে হর্নেটের এক লোকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। গোত্রের বাইরে বিয়ে দিতে বাবা রাজি হননি, ফলে প্রেমিক-প্রেমিকা পালানোর চেষ্টা করে। ইন্ডিয়ান যোদ্ধারা তাদের ধাওয়া করলে পাহাড়ের উপর থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে দুজন। তাদের অতৃপ্ত আত্মাই নাকি ভূতুড়ে আলো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এই গল্পের ভিন্ন এক সংস্করণে বলা হয়- রাজকন্যার স্বামী যুদ্ধে নিহত হলে তিনি আত্মহত্যা করেন, তার আত্মাই ঘুরে-ফিরে আসে বার বার।
আরেক গল্পে আছে এই অঞ্চলের এক খনিশ্রমিক একরাতে বাসায় ফিরে আবিষ্কার করে তার স্ত্রী-সন্তানকে অপহরণ করেছে স্থানীয় ইন্ডিয়ানরা। লন্ঠন জ্বালিয়ে তক্ষুণি পরিবারকে খুঁজতে বেরিয়ে পরে সে, প্রতিজ্ঞা করে তাদের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত দেবে না কিছুতেই। আজও নাকি সে লন্ঠন জ্বালিয়ে খুঁজে চলেছে, আর সেই আলোই তৈরি করছে স্পুক লাইট।
ভয়ঙ্কর এক কিংবদন্তীও আছে স্পুক লাইট ঘিরে। ওসাজে (Osage) ইন্ডিয়ানদের এক নেতাকে নৃশংসভাবে মাথা কেটে হত্যা করা হয়েছিল এখানে, এরপর থেকে সেই মাথার খোঁজে লন্ঠন নিয়ে নাকি ঘুরে বেড়ায় সে!
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
মিথ থাকুক মিথের জায়গায়। বিজ্ঞান কী বলে? বেশ কিছু ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, যার একটি উইল-ও-উইস্প (will-o-the-wisp) কেন্দ্রিক। কাঠ বা অন্যান্য জৈবিক বস্তু পচে সৃষ্ট আভাকে বলা হয় উইল-ও-উইস্প। বনভূমি অঞ্চলে বেশি দেখা যায় এই ঘটনা, এবং মাঝে মাঝে বেশ উজ্জ্বলও হয়। তবে হর্নেট স্পুক লাইটের তীব্রতার কাছে তা নস্যি। ফলে এই যুক্তি ধোপে টেকে না।
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, আশেপাশের জলাভূমি থেকে উৎপন্ন মার্শ গ্যাস স্পুক লাইটের কারণ হতে পারে। সমস্যা হলো- মার্শ গ্যাস এরকম আলো তৈরি করতে পারলেও এজন্য কোনো প্রভাবকের প্রয়োজন, নিজে নিজে এই গ্যাস জ্বলতে পারে না। আরো বড় কথা হলো মার্শ গ্যাস থেকেই যদি স্পুক লাইটের সৃষ্টি হতো, তাহলে বৃষ্টি-বাতাসে নিভে যাবার কথা সেটা, যা হয় না। পিটসবার্গ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অ্যান্ড্রু জর্জ আরো মনে করেন, হর্নেট স্পুক লাইটের আশেপাশে এমন কোনো পরিবেশ নেই যার কারণে মার্শ গ্যাস তৈরি হতে পারে।
ভূমিকম্প আর ফল্ট লাইনের সাথে স্পুক লাইটের সম্পর্ক আছে বলে মত আছে। এই অঞ্চলে ফল্ট লাইনের উপস্থিতি প্রমাণিত সত্য, এজন্য মাঝে মাঝে ভূমিকম্পও হয়। ১৮০০ সালে তো প্রবল এক ভূমিকম্পে বিশাল এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। গবেষকরা মনে করেন, ভূমিকম্পের ফলে ইলেক্ট্রিক্যাল ফিল্ডে যে কম্পন হয়েছিল, সেখান থেকে উদ্ভব ঘটে এই আলোকচ্ছটার। তখন এই এলাকায় লোকজন তেমন ছিল না, তাই স্পুক লাইট তেমনভাবে মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়নি। যখন ধীরে ধীরে মানুষ এখানে বসতি স্থাপন আরম্ভ করল, তখন থেকে চালু হলো এর কিংবদন্তী।
তবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত সম্ভবত প্রথম ব্যাখ্যাটি, যার পেছনে রয়েছেন এক সাংবাদিক, এবি ম্যাকডোনাল্ড। ১৯৩৬ সালে কানসাস সিটি স্টারের তরফ থেকে স্পুক লাইট নিয়ে অনুসন্ধান চালান তিনি। তিনি দাবি করেছেন- এই আলো আর কিছুই নয়, হাইওয়ে-৬৬ ধরে পূর্বদিকে চলে যাওয়া গাড়ির হেডলাইট, যা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে আসে বলে সৃষ্টি হয় এই বিভ্রান্তির। ১৯৪৫ সালে গবেষক ড. জর্জ ওয়ার্ড নামে ম্যাকডোনাল্ডের কথার সাথে একমত প্রকাশ করেন।
এর বছরখানেক পর ইউএস আর্মির মেজর থমাস শিয়ার্ড বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেন। হাইওয়ে-৬৬ এর যে অংশ থেকে এই আলোর উৎপত্তি দাবি করা হয়েছিল, সেখানে গাড়ি রেখে হেডলাইট ফ্ল্যাশ করেন তিনি। তার সহকারীরা হর্নেটে বসে স্পুক লাইট উদয় হতে দেখে। লেখক রবার্ট গ্যানন ১৯৬৫ সালে এই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করেন। ডেভিল’স প্রোমেনেডে বসে থাকা তার সহকারী নিশ্চিত করে হেডলাইট জ্বালানো মাত্রই আলোকচ্ছটা দৃশ্যমান হয়, বন্ধ করলে চলে যায়।
তবে স্থানীয়রা কিন্তু এই প্রতিফলন তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। কাটতির জন্য মিডিয়াও একে প্রচার করে অব্যাখ্যাত রহস্য হিসেবে। এমনকি মিসৌরির ট্যুরিজম বোর্ড ১৯৬৯ সালের নিজেদের এক লিফলেটে স্পুক লাইটের কোনো সন্তোষজনক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই বলে উল্লেখ করে, উদ্দেশ্য ছিলো নিজেদের রাজ্যে পর্যটক টেনে আনা।
যদি চান, চলে যেতে পারেন ডেভিল’স প্রোমেনেডে। ভাগ্য ভালো থাকলে অন্ধকার কোনো রাতে পেয়ে যেতে পারেন স্পুক লাইটের দেখা! তবে দুর্বলচিত্তের হয়ে থাকলে হয়তো না যাওয়াই ভালো হবে!