“বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কী?”– এই প্রশ্নের উত্তরে যদি ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের নাম বলা হয়, তাহলে বোধহয় খুব একটা ভুল হবে না। বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে, কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে এসব মাধ্যম ব্যবহার করছেন, এসবের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন। হাতে একটি স্মার্টফোন আছে অথচ উপরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর একটিও ব্যবহার করেন না, এরকম ব্যক্তি খুঁজে পেলে সেটি হবে বিরল ঘটনা। আসলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কতটা জনপ্রিয় কিংবা কোনটি সবচেয়ে এগিয়ে আছে, এটা যাচাই করা এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের প্রধান কাজ “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কীভাবে আয় করে?“- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটালিজম’। সহজ ভাষায় বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা যাক। সাধারণত, উদীয়মান কোনো প্রতিষ্ঠানের যদি বিনিয়োগের দরকার হয়, তাহলে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা সেখানে বিনিয়োগ করে থাকেন। বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা প্রতিষ্ঠানের আংশিক মালিকানার অধিকারী হন এবং তাদের লক্ষ্য থাকে কীভাবে বিনিয়োগ থেকে মুনাফা অর্জন করা যায়। তবে তাদেরকে আগে থেকেই ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে হয়, কারণ কোনো উদীয়মান প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যেতে পারবে কিনা– সেটার নিশ্চয়তা কখনোই দেয়া যায় না। এমন অনেক সময় দেখা গিয়েছে যে, দীর্ঘমেয়াদে অনেক উদীয়মান প্রতিষ্ঠান বাজারে টিকতে পারেনি। এক্ষেত্রে সেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের বিরাট লোকসানের আশঙ্কা থাকে। সাধারণত কোনো ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ফার্ম কোথাও বিনিয়োগ করার আগে কোম্পানির বাজার, উৎপাদিত পণ্য বা সেবার গ্রহণযোগ্যতা এবং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিষদ কতটুকু শক্তিশালী– এই বিষয়গুলো খুব গভীরভাবে যাচাই করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে খুব সত্য একটি কথা হচ্ছে, ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা না থাকলে আজকের বিশ্বের অনেক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুরুতে মুখ থুবড়ে পড়ে যেত। ফেসবুকের কথাই ধরা যাক। ২০০৪ সালে যখন মার্ক জাকারবার্গ তার ফেসবুক প্রজেক্টকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন সেখানে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে এসেছিলেন পিটার থিয়েল নামের একজন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট। সেই সময় মাত্র পাঁচ লাখ ডলারের বিনিময়ে তিনি ও তার সহযোগী ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা ফেসবুকের বড় অংশের শেয়ার কিনে নেন। তবে তার সাথে চুক্তি হয়েছিল যে, আট বছরের বেশি সময় তিনি শেয়ার ধরে রাখতে পারবেন না। ২০১২ সালে যখন তিনি চুক্তি অনুযায়ী শেয়ারগুলো বিক্রি করেন, তখন তার আয় হয়েছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার! ইন্সটাগ্রাম ২০১২ সালের দিকে লাভ করতে পারছিল না। পরে ফেসবুকের ব্যবস্থাপনা পরিষদ এখানে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সেসময় ফেসবুক ধুঁকতে থাকা ইন্সটাগ্রাম কিনে নেয়। বর্তমানে অনেক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন, ইন্সটাগ্রাম বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ফেসবুকের থেকেও বেশি আয় করছে।
তবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের বিনিয়োগ অনেকসময় উদীয়মান কোম্পানিগুলোর প্রতিষ্ঠাতারা পছন্দ করেন না। কারণ, কোম্পানিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকানা পেয়ে গেলে কোম্পানির বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপের সুযোগ লাভ করেন, যেটি অনেকেরই পছন্দ নয়। এক্ষেত্রে তাদের আয়ের জন্য বিকল্প পন্থা খুঁজে বের করতে হয়। অনেক সময় তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ‘সাবস্ক্রিপশন সিস্টেম’ চালু করা হয়। এতে ব্যবহারকারীরা এমনিতে সাধারণভাবে বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারলেও কিছু বাড়তি সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সাবস্ক্রিপশন ফির বিনিময়ে ‘প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট’ খুলতে পারেন। বিভিন্ন ডেটিং সাইট এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সফলতার মুখ দেখেছে। সাধারণত ডেটিং সাইটগুলোতে এমনিতে পছন্দমতো সঙ্গী পাওয়া যায় না। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ সাবস্ক্রিপশন ফির বিনিময়ে প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট খুললে পছন্দমতো সঙ্গী পাওয়া যায়। প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয়, সেটি সেই ডেটিং সাইটের আয় হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। তবে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এই পদ্ধতি এড়িয়ে চলছে।
এবার আসা যাক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মূল আয়ের উৎস সম্পর্কে। এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি অর্থ আয় করে থাকে। ধরুন, আপনি একটি বিখ্যাত কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আপনার কোম্পানি নতুন একটি পণ্য বাজারে এনেছে, যেটি এখনও তেমন পরিচিতি বা জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। এখন আপনার প্রধান কাজ হচ্ছে সেই পণ্য সম্পর্কে মানুষকে জানানো, তাদের কিনতে উৎসাহিত করা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিপুল পরিমাণ ব্যবহারকারীর সামনে যদি আপনি বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, তাহলে দেশের বড় অংশের মানুষের কাছে পণ্যটির নাম পৌঁছে যাবে। বর্তমানে পৃথিবীর সব বড় কোম্পানিই ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জন্য বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যেকোনো কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ লুফে নেয়, যেহেতু এর মাধ্যমে তারা বড় অংকের অর্থ আয় করতে পারে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা ছাড়া কোনো কোম্পানি নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। নিজেদের কোটি কোটি ব্যবহারকারী থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে বিরাট অংকের অর্থ উপাজর্ন করতে পারছে।
তবে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ফেসবুকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার একটি গবেষণা প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জানা গিয়েছিল, ফেসবুক তার ব্যবহারকারীদের তথ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ফেসবুকের কাছে পাওয়া তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে তাদের বিজ্ঞাপনের সম্ভাব্য টার্গেট নির্ধারণ করে। এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। এই প্রতিবেদনের দাবিকে ভুল আখ্যায়িত করে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ বলেন, “একজন মানুষ কোন পেজে লাইক দেয়, কোন লিংকে ক্লিক করে, কী লিখে তথ্য খোঁজে– এসবের উপর ভিত্তি করে আমরা বিভিন্ন ক্যাটাগরি নির্ধারণ করি। এরপর সেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী আমরা যথাযথ বিজ্ঞাপন দেখানোর চেষ্টা করি।” তবে জাকারবার্গের এমন দাবিকে মিথ্যা বলে দাবি করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের সহকারী অধ্যাপক মাইকেল কোসিনস্কির মত, “আমি বিস্মিত হবো যদি কেউ এই দাবি (মার্ক জাকারবার্গের দাবি) বিশ্বাস করতে থাকে। আপনি যতবার কোনো বিজ্ঞাপনের লিংকে ক্লিক করেন, ফেসবুক প্রতিবার আপনার তথ্য সেই বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে।“
স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বিজ্ঞাপণী প্রচারণার জন্য কতটা আগ্রহী। যত দিন যাচ্ছে, তথ্য আদানপ্রদানের প্রযুক্তি হচ্ছে সহজলভ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও আরও বেশি মানুষের আগমন ঘটছে। তাই সামনের দিনগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর আয় যে আরও বাড়তে থাকবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।