[১ম পর্ব]
পশ্চিমাদের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিতে থাকে। ২০০৬ সালে দেশটি ঘোষণা দেয়— তাদের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তি আছে। তৎকালীন ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ এই ঘোষণা দেন। স্বভাবতই, এই ঘোষণা বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন সংকটের জন্ম দেয়। আমেরিকা ও তার মিত্র ইসরাইল বিপাকে পড়ে যায়। এত দিনের এত প্রতিবন্ধকতাও ইরানকে দমাতে পারেনি। জাতিসংঘের সহায়তায় এবার দুই দেশ ইরানের উপর অবরোধ আরোপ করে। পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ রাখার চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০০৬ সালের জুনে গঠন করা হয় পাঁচ স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র ও জার্মানির সমন্বয়ে ছয় বিশ্ব শক্তির জোট (P5+1)। এই জোট ২০০৬ সাল থেকেই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ওই বছরেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই জোট এক প্রস্তাব উত্থাপন করে। এতে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ এবং তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
কিন্তু ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে পেছনে ফিরে আসেনি। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র ইরানি কর্মকর্তাদের সাথে গোপনে আলাপ-আলোচনা শুরু করে। সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ফোন করেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীকে। এই উদ্যোগের ফলে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে। যার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ ২০১৩ সালের নভেম্বরে (P5+1) এবং ইরানের মধ্যে একটি অন্তবর্তীকালীন সমঝোতা হয় যার মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিতকরণের শর্তে দেশটির উপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়া হয়। অবশেষে দুই বছরের সুদীর্ঘ আলোচনার পর, ১৪ জুলাই ২০১৫ সালে ইরান ও ছয় বিশ্ব পরাশক্তির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় বহুল আলোচিত ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তি (Joint Comprehensive Plan of Action)।
যা ছিল সমঝোতায়
১) ইরান শুধু নাতাঞ্জ ও ভূগর্ভস্থ ফর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।
২) ইরান আগামী ১৫ বছর পর্যন্ত ৩.৬৭% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ৩০০ কেজির বেশি রাখতে পারবে না।
৩) আরাকের পরমাণু চুল্লি ঢেলে সাজাতে হবে। এতে আর পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম তৈরি করা যাবে না।
৪) নতুন কোনো পারমাণবিক কেন্দ্র তৈরি করা যাবে না।
৫) ইরানকে ৬১০৪ সেন্ট্রিফিউজে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
৬) পারমাণবিক স্থাপনায় IAEA-কে পরিদর্শনের সুযোগ দিতে হবে।
বিনিময়ে ইরান যা পেত
১) চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার ৪-১২ মাসের মধ্যে ইরানের উপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
২) EU ইরানের উপর থেকে জ্বালানি এবং ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে।
৩) জাতিসংঘ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সব রেজুলেশন বাতিল করে নেবে।
৪) ইরানের বাজেয়াপ্ত ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পত্তি ফেরত দেয়া হবে।
চুক্তির বর্তমান অবস্থা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালের ৮ই মে ইরানের সাথে করা চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একগুয়েমির কারণে এরকম পরিস্থিতির তৈরি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর পূর্বের নিষেধাজ্ঞা চালু করে ‘সর্বাধিক চাপের অবস্থানে’ ফিরে আসে। ইরান আবার পূর্বের পারমাণবিক কর্মসূচিতে ফিরে গিয়ে সেন্ট্রিফিউজ সমৃদ্ধ করবে বলে ঘোষণা দেয়। পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জে উন্নত সেন্ট্রিফিউজ স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয় তেহরান।
অসংখ্য দেশ, আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা এই চুক্তি প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ, হতাশা, এবং সমালোচনা ব্যক্ত করেন। জার্মানি, ইংল্যান্ড, এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানরা এক যৌথ বিবৃতিতে ইউরোপের পক্ষ থেকে এই চুক্তি বজায় রাখার জন্য ইরানকে আহ্বান করেন। তবে আশার বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় বসার পরই তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হয়। পারমাণবিক বিস্তার রোধ ও অন্যান্য নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা থেকে মুক্তির প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আবার আগের চুক্তিতে ফিরে যেতে চাচ্ছেন। হয়তো এখানে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে ইসরায়েল, এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব। এদিকে ইরানে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ইব্রাহিম রাইসি। তার সময়ে আমেরিকার সাথে চুক্তির বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেই বিষয়ে মন্তব্য করার হয়তো এখনও সময় আসেনি।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বর্তমান ও ভবিষ্যত
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তির ছয় দেশের মধ্যে বাকি পাঁচ দেশ- চীন, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু সমঝোতায় ফিরতে চায় বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বরাবরের মতো ইরান তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বলেছে। তাই বলে ইরান তাদের কর্মসূচির ছক পাল্টাবে না বলেও ঘোষণা করেছে। এদিকে ইরানি সমরনায়ক কাশেম সোলাইমানি ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় নিহত হন। ঐ সময় ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
ভবিষ্যত ইরানের পারমাণবিক অবস্থান নির্ভর করবে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির গতিবিধির উপর। পরমাণু চুক্তির মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করার বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান নতুন চুক্তিতে পদার্পণ করতে পারে। যদিও এই চুক্তির ভবিষ্যত নিয়ে অনেক বিশ্লেষকই এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশায় রয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে ইসরায়েল বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। ভিয়েনা বৈঠকের পূর্বে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা হামলার মুখে পড়েছিল। সম্প্রতি ইরানের কারাজ শহরে পারমাণবিক কেন্দ্রে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ইরান।
শেষ কথা
পশ্চিমাদের সাথে সমঝোতা না হলে ইরান তাদের ইউরেনিয়াম আরো সমৃদ্ধ করবে, ক্রমেই পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে ধাবিত হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। যা-ই হোক, এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানের প্রথম পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইরান এখন পূর্বের তুলনায় যথেষ্ট পরিপক্ব। বিশ্বের বড় বড় সংস্থাকে ফাঁকি দেয়া, বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা দেয়া, ভঙ্গুর অর্থনীতিকে টেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া, এত ধ্বংসের পরেও তারা অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে গড়ে তুলেছে ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কেন্দ্র, সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে সেন্ট্রিফিউজ, শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার জন্য তৈরি করছে ভুয়া চুল্লি। নিম্ন জিডিপি নিয়েও তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল মিলিশিয়া বাহিনী পালনসহ নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তাই তারা এখন আরও একরোখা আচরণ করছে। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ হওয়ার এই ইচ্ছা সহজেই পূরণ কিংবা বাতিল হবে বলে মনে হয় না। বরং বিশ্ব রাজনীতিতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি দিন দিন আরো আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়ে যাবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।